সতাই ও সম্পর্ক
কার্তিক মাসের শেষ দিকে শীত পড়ে
সিংধায় । রাতে হালকা কুয়াশা । সকালে কাঁচারাস্তার
দূর্বাগুলোতে শিশির জমলে সূর্যের আলোয় চিকচিক করে । অগ্রহায়ণ আসতেই হঠাৎ ঠাণ্ডাটা যেন ঝেঁকে বসে গাঁয়ের সর্বত্র । এমন শীত গত দুই দশক
চোখে দেখেনি কেউ । গেরস্ত বাড়ীর
উঠানগুলোতে বেলা করেও আগুনের ডিবি জ্বালায় মেয়েরা । হাতে পায়ে সেঁক দেয় । সবে কূল ছাড়া ছেলেগুলো অতি উৎসাহে গোল আলু পুড়িয়ে খায় আগুনে ।
পাশের গাঁয়ের জহুর সিংধায় জোনাব
আলীর বাড়ীতে বছর চুক্তি গতর খাটে । প্রত্যহ যখন সে ঘর ছাড়ে এশরাত আলীর বাড়ীতে সকালের মোরগটা ডাকেনা
তখনও । ঘুমকাতর ছেলেগুলোও
ভোরের ঘুমে বিভোর হয় । মাঝে মাঝে জায়েদা হয়তো ফজরের নামাজ পড়তে উদগ্রীব হয় । সুযোগ হলে চোখাচখি হয়
মা ছেলের । জহুর বলে-
-আয়গো মা । বৈকালেনি আওন যায় ? কাহা জমি হাল দিব কয় ।
তারপর মা’র উত্তরের জন্য
অপেক্ষা করেনা সে । বাড়ী থেকে বেরিয়ে সিংধার পথ ধরে সে ।শীতের কুয়াশায় গাঁয়ের পথে অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হয় । পথ সংক্ষেপ করতে
ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটে জহুর । হয়তো ধলপ্রহরের পূর্বেই জোনাব আলীর বাড়ী এসে হাজীরা দেয় সে । গোয়াল ঘরে গরুগুলোও ওর
অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে । ফজরের নামাজ শেষ করে জোনাব আলী যখন বাইরে আসে ততক্ষণে হাতের
কাজগুলো শেষ প্রায় । চোখাচোখি হলে জোনাব বলে-
-জহুরনি আইলি ?
-হ, কাহা ।
-বইয়ে থাহিসনে, শীগগির নাঙ্গল ল উত্তরে
হাল দিমু ।
জহুরকে কথা বলতে শুনা যায়না । যৎসামান্য পর দেখা যায়
হালের বলদ দুটো সাথে নিয়ে উত্তরের দিকে ধাবমান সে ।
এ গাঁয়ে তদ্রূপ উড়নচণ্ডী রাখালসদৃশ
ছেলেরা মাঠে বড় করে আগুনের ডিবি জ্বালিয়ে দেহ গরম করে । একই পাড়ার হারু জহুরের
বন্ধু মানুষ । দৃষ্টিগোচর হলে হাঁক
দেয় সে-
-জহুর, আহ ভাই শইলে সেঁক দেই জারনি করে মেলা । জহুর বলে-
-নিয্যস । অমন জার বাপের জম্মে দেহিনাই মালুম অয় । লও বিড়ি খাও । পরক্ষণে
লুঙ্গীর ভাঁজে রাখা বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি হারুকে দিলে আগুণ ধরায় সে ।
উত্তরপাড়ায় জহুরদের বাড়ীটা খানসামা
নদীর পশ্চিমে । দমদমা বাজার হতে যে সড়কটা খানসামার পারে এসে ঠেকেছে, সে সড়ক পেরিয়ে
মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই জহুরদের বাড়ী । নির্দিষ্ট সড়ক নেই । বাড়ী যেতে মাঝি পাড়ার
শেষ মাথায় এসে বিনুবংশীর ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হয় খানিক ।
জহুরের বাপ এশরাত আলী পরবাসী । ওর
বয়স যেবার আট কি নয় হল সেবার বাপকে হারিয়েছে সে । বাপ মরলে খুব কেঁদেছিল জহুর ।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল সে । দৃষ্টিগোচর হলে পাশের বাড়ীর বুচির মা এসে সান্ত্বনা
দিত তাকে ।
-দিলরে সবুর দে ভাই । বাপনি আর
বাঁচে চিরকাল ?
জহুরদের বাড়ীতে মা ছাড়াও ছোট তিন
ভাই আছে তার । সৎ মা । ফলে এ বাড়ীতে
মা’র স্নেহ প্রাপ্তিতে অন্য
ভাইদের সাথে পার্থক্য আছে তার । নিজের ছেলেদের জায়েদা বেগম যতটা দরদ করে জহুরের ক্ষেত্রে
অভাব হয়তো ততটাই । অথচ একদিন জহুরের জন্যই
জায়েদা বেগমকে ঘরে তুলেছিল এশরাত আলী । কিন্তু এ সংসারে এসে জায়েদা বেগম যতটা স্নেহ দিয়েছে জহুরকে তাতে
করে মা নামের মানুষটিকে খুব বেশী মমতাময়ী মনে হয়নি জহুরের । নিজের মাকে কোনদিন চোখে
দেখেনি সে । এ পৃথিবীতে স্বার্থহীন
বলতে কেবল বাপকেই বোঝে জহুর। বাপের জন্য ওর দুঃখটা হয়তো এখানেই । যাহোক, এতকিছুর পরও জায়েদা
বেগমকে ভালবাসে জহুর । তার চোখের কোন এক জায়গাই নিজের অবস্থান খুঁজে সে । বারংবার ব্যর্থ হয়
কিন্তু আশাহত হয়না কখনই । তথাপি ছোট ভাইদের ক্ষেত্রেও স্নেহপরায়ণতার অভাব হয়না তার । এশরাত আলীর মৃত্যুর পর
সংসার বাঁচাতে দিনরাত খেটে মরে সে । জোনাব আলীর দেওয়া মজুরীতে সংসার চলেনা ওদের । তাই বলে কয়ে দু’বিঘা জমি বর্গা
চাষ করে সে । তাতে ঘরে ভাতের জোগান হয় । মজুরীতে বাজার । টেনেটুনে সংসার চলে জহুরদের ।দিন যায় এক এক করে ।
হাতে কাজ না থাকলে খানসামা নদীর
কিনারে প্রকাণ্ড বটগাছটার গুঁড়ায় এসে বসে জহুর ।বাড়ীতে বসে থাকতে পারেনা সে । ধমকায় জায়েদা-
-বইয়ে আছস যে, কামলা দিলে দুগা টাহা
আইতো নিয্যস ।
সহসা মা’র সাথে কথা
বাড়ানোর সাহস করেনা জহুর । উঠে এসে বটগাছটার গুঁড়ায় বসে সে।
মাঝি পাড়ার গুনাই মাঝির মেয়ে
জরজিনা । দোহারা গড়ন । সম্প্রতি ওর সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছে জহুর । কাঁচা
সম্পর্ক । এইতো গেল কার্তিকের পূজায় ঘোষবাড়ী পূজা দেখতে যেয়ে চোখাচোখি হল দুজনের ।
এখন ওরা আত্মার সম্পর্কে আত্মীয় । মন খারাপ হলে মাঝে মাঝে জরজিনা এসে খোশগল্পে
মাতে জহুরের সাথে । সে বলে-
-মুনখান সত্যই খারাপ মালুম অয় জহুর
ভাই ? জহুর বলে-
-ছাড়ান দে লেউডা কতা । বয় কতা কই ।
তারপর পাশাপাশি বসে খোশগল্প করে
ওরা । সে গল্পে লুকানো কত কথা ভাষা পায় ! কথা বলে বলে আগামীর স্বপ্ন দেখে দুজন ।
একটা নির্ঝঞ্ঝাট সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ।
সেবার পৌষের শেষের দিকে ব্যস্ততা
বাড়ে জহুরের । হেতু জোনাব আলীর ছেলে আহাদ । হঠাৎ কি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পড়ে
বিছানা নেয় তিন বছরের ছেলেটা । অসুখ ছাড়েনা সহসা । বাড়ীতে জোনাব আলীর বউ হবিরণ
কেঁদে আকুল হয় ।
-আয়গো খোদা, পোলার জান ছদগা
দেও ।
দিন শেষে অবস্থা বেগতিক হলে জহুরকে
নিয়ে রাঁধানগর উপেন কবিরাজের কাছে যায় জোনাব আলী । পরদিন ছেলেকে দেখে আঁতকে উঠে
উপেন ।
-সব্বনাশ । শত্তুর আছেনি মিয়া সা’ব কনতো ?
পুলারে বিষবান দিছে মালুম অয় ।
কবিরাজের কথাকেই সত্যি বলে মনে করে
পাড়ার সবাই । কেবল জহুর সত্যি মানতে নারাজ । এতটুকু মানুষের শত্রু হয় নাকি ? জোনাব আলীকেও
জীবনে যেচে কারো সাথে কলহ করতে দেখেনি সে । সপ্তাহ খানিক পর সবাই যখন আশাহত হয়,
তখন শিশুটাকে বাঁচাতে মরিয়া হয় জহুর । দিন রাত শহরে ডাক্তারের
কাছে ছোটাছুটি করে সে । তখন সহসা বাড়ী ফেরার ফুরসৎ হয়না ওর । নিজের বাড়ীতেই থাকার
ব্যবস্থা করে দেয় জোনাব । এর মধ্যে একদিন দুপুরে খেতে বসে জহুর বলে-
-একখান কতা আহে মুনে, কমুনি চাচি ?
হবিরণ বলে-
-ক বাপ । আমারেনি শরমাস ?
-দরগাতলার হুযুর কিছু মানত করবার
কয়, করবানি ?
-মানত,কাহার লগে কতা ক
তাইলে ।
জোনাবের সাথে কথা বলতে হয়না জহুরকে
। ছেলের রোগমুক্তির বাসনায় জোড়া খাসী মানত করে হবিরণ । জোনাব আলীও বউয়ের ইচ্ছাই
বাঁধা সৃষ্টি করেনা । এরপর সম্ভবত জহুরের দৌরােত্মাই ছেলের রোগমুক্তি ঘটে জোনাবের
।
এর দিন দশেক পর একদিন জহুর বাড়ী
ফিরে দেখে কুটুম এসেছে ওদের । জায়েদার ভাইয়ের ছেলে মনু । জমি নিয়ে কলহ করায় মামলায়
পড়ে এ বাড়ী এসে গা ঢাকা দিয়েছে সে । মনু এলে নিজের বিছানাটা ছেড়ে দেয় জহুর । তারপর
বারান্দায় চট বিছিয়ে রাতযাপন করে সে । মাঘ মাস যায় যায় করে কিন্তু শীতের প্রকোপ
কমেনা সহসা । ঠাণ্ডায় রাতভর শরীরটা
ঠক ঠক কাঁপে ওর ।
ছেলে সুস্থ হলে একদিন জহুরকে নিয়ে
দমদমা বাজারে যায় জোনাব । ভাল দেখে জোড়া খাসী কিনে আনে সে । পরদিন আখের মুনশি খাসী
জবাই দিলে মাংস পায় গাঁয়ের অনেকেই । একভাগ জহুরও পেলে মনে মনে পুলকিত হয় সে । ওদের
বাড়ীতে ঈদ ছাড়া মাংস খেতে পায়না কেউ । কোরবানির ঈদে জোনাব আলী খুশী হয়ে কেজি দুই
মাংস দেয় প্রতিবার । তাতে বাড়ীতে দুবেলা ভুঁড়িভোজ হয় সবার । ছদগায় পাওয়া মাংস হয়তো
সামান্যই কিন্তু একবেলাযে অনায়াসে খাওয়া যাবে কেবল এটা ভেবেই খুশী হয় জহুর । সেদিন
ওদের বাড়ীতে উৎসব হয় । বাজার থেকে কিনে আনা মশলায় মাংস পাঁকালে গন্ধে বাড়ী মও মও
করে ।তাতে পেটে খিদে বাড়ে
জহুরের । কিন্তু সহসা খাবার অনুমতি মেলেনা ওর । অন্যদের খাওয়া শেষ হওয়া অবধি
অপেক্ষা করতে হয় তাকে । তারপর যখন অনুমতি মিলে ততক্ষণে হয়তো আশাহত হয় সে । জহুর
বলে-
-একখান লেডা দিবানি মা, খামু ? জায়েদা বলে-
-লেডা, কহন শেষ !
-শেষনি, আমারে দিলানা
যে ?
-কেমুন কইরা কতা কয় হারামিরপু, আমি খাইছি
মালুম অয় ?
-তাইলে দুগা ভাত দেও, লগে ডাইল ।
-নাই । দিলরে সবুর দে, সাঞ্ঝেবেলা
খাইস ।
এরপর আর কথা বাড়ায়না জহুর । কষ্টে
চোখে জল আসে ওর । মাংসের লোভে হয়তো সবাই এক দুচামচ ভাত বেশী খেয়েছে আজ, সাথে জহুরের
ভাগের মাংসটাও । কিন্তু তবুও সত্য মানতে ইচ্ছে করেনা তার । পরক্ষণে আধপেট খিদে
নিয়েই বাইরে বেরিয়ে আসে সে । জরজিনার সাথে দেখা হলে এক দুই কথায় কলহ করে । কারণ
খুঁজতে ব্যর্থ হয় জরজিনা ।
এভাবেই এক এক করে দিন যায় । একদিন
বয়সে পরিপক্ব হয় জহুর । ওর প্রচেষ্টাতেই ছোট ভাইগুলো যৎসামান্য শিক্ষিত হয় । তারপর
দমদমা বাজারে বিভিন্ন আরতে মাসিক বেতনে চাকরী পায় কেউ কেউ । ফলে জায়েদা বেগমের
সংসারেও সচ্ছলতা আসে দিনে দিনে ।পাশাপাশি সংসারে গুরুত্ব কমে জহুরের । এক সময় প্রত্যহ সন্ধ্যায়
জহুরের জন্য অপেক্ষা করতো জায়েদা বেগম । বাজার থেকে কিনে আনা সবজী পেলে চুলাতে
হাড়ি উঠত ওদের । এখন দিনের পর দিন মা’র দেখা পায়না জহুর । ছেলেদের অর্থে আয়েশি
জীবনযাপন করে সে । তিলকপুর গ্রামের হারুঘটকের সহায়তায় বড় ছেলে হরমুজের বিয়ের
পাত্রী খুঁজে বেড়ায় জায়েদা । মাস দুই পর ভাল পাত্রীর সন্ধানও পায় সে । ঘটক বলে-
-মাইয়্যা সাদেক আলীর বেটিগো ভাবি, ভালা গেরছ ।
লগে নগদ টাহা দিব কয় । জায়েদা বলে-
-হাঁচানি, শীগগির কতা কও
ভাই ।
হরমুজকে নিয়ে মাতামাতি করে সবাই ।
জহুরের কথা মনে করেনা কেউ । সহসা জায়েদাও । এদিকে মাঝি পাড়ার গুনাই মাঝি মেয়ের
জন্য পাত্র খুঁজে মনে মনে । একসময় ভাল একটা ছেলে পেয়েও যায় সে । সব ঠিক । কেবল
রাজী নয় জরজিনা । কারণ অনুসন্ধানে ব্যর্থ হলে মেয়েকে ধরে মারে সে । এরপর একদিন
আবার জহুর আর জরজিনাকে বটগাছটার গুঁড়ায় দেখা যায় । বসে কথা বলে ওরা । জরজিনা বলে-
-হুনছ হগগল মালুম অয় ? জহুর বলে-
-হ ।
-কিছু কওনা যে ?
-কি কমু ? হতাই মা আমাকনি
বিয়া দিব ?
-আমাক ক্ষেমা দিও তাইলে, বাজান সত্য
বুঝনের নয় ।
এরপর আর কথা বাড়ায়না জরজিনা । সোজা
বাড়ীর পথ ধরে সে । জহুরও থামানোর চেষ্টা করেনা ওকে । ওর সামর্থ্য যে যৎসামান্য
সেটা অজানা নয় কারও । অমতে বিয়ে করলে হয়তো বাড়ীতেই জায়গা হবেনা তার । তার থেকে
অন্য কোথাও বিয়ে করুক জরজিনা । হয়তো তাতেই বেশী সুখী হবে সে । সেদিন রাতে জহুরের
সাথে কথা বলতে এসে হরমুজের বিয়ের খবর দেয় জায়েদা । জহুর বলে-
-মাইয়্যা ভালানি ? তাইলে বিয়া
দিওন যায় ।
সেবারই জ্যৈষ্ঠের গোড়ায় একদিন
ধূমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় হরমুজের । কনে বাঁশখালি গ্রামের সাদেক আলীর মেয়ে হনুফা ।
মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ । বিয়েতে শ্বশুরের কাছ থেকে মোটা টাকা পেয়েছে হরমুজ । সে
টাকাই দমদমা বাজারে একটা মনোহারি দোকান দেওয়ার ইচ্ছে তার । জায়েদা বেগমেরও আপত্তি
নেই তাতে ।
এর কদিন পর অকস্মাৎ একদিন জরজিনারও
বিয়ে হয়ে যায় । সেদিন কনে দেখতে এসে জরজিনাকে দেখে পছন্দ হলে ফিরে যায়নি ছেলেপক্ষ
। পরমুহূর্তে ছেলেকে এনে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেছে মুরব্বীরা । সকালে হারু এসে
জহুরকে খবরটা জানায়-
-হুনছনি জহুর, জরজিনার বিয়া
অইছে কাইল ?
-হাঁচানি ?
-নি্য্যস । ভালা পুলা, গঞ্জে ব্যবসা
আছে কয় ।
হরমুজের বিয়ের পর বাড়ীতে ঘর বাড়ে
এক এক করে । জায়েদা বেগমের অন্যান্য ছেলেরাও বিয়ে করে সংসারী হয় দিনে দিনে । ঘরে
নবজাতকের কান্নার আওয়াজ শুনা যায় । এশরাত আলীর বাড়ীটা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে গমগম করে
একসময় । কে জানে, হয়তো জনসংখ্যা বাড়ার অজুহাতেই জহুরের প্রতি সবার বিতৃষ্ণাটা প্রকট হয়
আরও । ও বাড়ী না থাকলে ওকে নিয়ে কানাঘুষা করে ভাইয়ের বউয়েরা । জায়েদা বেগম প্রবোধ
দেওয়ার চেষ্টা করে দুএকবার । কিন্তু ব্যর্থ হয় সে । তারপর একদিন হরমুজের মাধ্যমেই
সত্য প্রকাশ হয় । হরমুজ বলে-
-একখান কতা কমু, গোস্যানি অয় মা
? জায়েদা বলে-
-গোস্যা ক্যান, হাঁচা ক বাপ ?
-ভাইরে বাড়ী ছাড়বার কও । থাওনের
জিরাত কই ?
জায়েদা বেগম নিষেধ করতে পারেনা
ছেলেদের । বরং ওদের ইচ্ছাতেই সম্মতি জানাতে হয় তাকে । সেদিন রাতে বাড়ী ফিরলে
কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় জহুরকে । জায়েদা বলে-
-বাড়ীখান দিয়া দে ভাইগো, একলা মানুষ
তরনি থাহার অভাব ?
জহুর কিন্তু কথা বাড়ায়না । সংসারে
ওর অপ্রয়োজনীয়তা বিস্মিত করে ওকেই । তারপর রাগে দুঃখে নিজের অজান্তেই চোখে জল আসে
ওর ।
অবশেষে একদিন সকাল বেলা জায়েদা
বেগম এসে দেখে বিছানায় নেই জহুর । রাতের অন্ধকারে কখন যেন বাড়ী ছেড়েছে সে । সাথে
কিছু নেয়নি কেবল পরনের লুঙ্গিটা ছাড়া । বাড়ী ছেড়ে আসার পর জবেদ আলীর বাড়ীতেই জায়গা
হয় জহুরের । হবিরণের হস্তক্ষেপে কালীতলায় সামান্য জমি ছেড়ে দেয় জবেদ । সেখানে ছনের
একটা দুচালা ঘর তুলে জহুর ।
ঘরে ভালমন্দ রান্না হলে জহুরকে
ডেকে খাওয়ায় হবিরণ । এ মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তার । হবিরণ বলে-
-অহন একখান বিয়া কর জহুর, একলানি থাহুন
যায় ? জহুর বলে-
-বিয়ানি, খাওয়ামু কি চাচি
?
-ক্যান, কাহারে ভরসা
নাই ?
-নিয্যস, মাইয়া দেহ
তাইলে ।
এরপর একদিন সত্যি জহুরকে বিয়ে করায়
হবিরণ । ওর হস্তক্ষেপেই কালীতলার ছোট্ট ঘরটাতে এক জোড়া কপোত কপোতীর সাজানো সংসার
হয় । কণের বাপ বিয়েতে নতুন রিকশা দিয়েছে জহুরকে । জহুর এখন রিকশা চালায় শহরে । ওর
বউ মরিয়ম পথ চেয়ে অপেক্ষা করে সারাদিন । সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরলে অজুর পানি এগিয়ে দেয় ।
খেতে বসলে তালপাখায় বাতাস করে । রাতে একই বিছানায় শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন ।
এদিকে এশরাত আলীর বাড়ীতে নানা
ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে কলহ বাড়ে বউদের মধ্যে । জায়েদার সাথে কলহও প্রকট হয় দিনকে
দিন । মুখে মুখে চলা বিষবাক্যগুলো একদিন হয়তো হাতাহাতিতে রূপ নেয় । অশান্তি চরমে
উঠলে একদিন নিজ ছেলেরাই সংসার ত্যাগের সিদ্ধান্ত জানায় জায়েদাকে । হরমুজ বলে-
-সৎ পুলার বাড়ী যাও অহন । দায় একলা
আমগোরনি ?
জায়েদা বেগম কিন্তু ঘোর আপত্তি
জানায় তাতে । এতকাল ধরে গড়া সংসার
ছাড়তে ইচ্ছে করেনা সহসা । কিন্তু তবুও শেষমেশ ছেলেদের সিদ্ধান্তই মানতে হয় তাকে ।
যে সংসারে সবাই তার বিপক্ষে সেখানে একাকি টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু ? তাই সংসার
ছাড়তে হবে তাকে । কিন্তু সহসা জহুরের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায়না জায়েদা । সুখের
দিনে সৎ বলে জহুরের প্রতি তার অন্যায় যৎসামান্য নয় । সত্যি কিন্তু লুকায়িত থাকেনা
বেশীদিন । একদিন উত্তরপাড়ার হারুর মাধ্যমেই সব জানতে পারে জহুর । হারু বলে-
-মাও তোমার ভালা নাইগো জহুর, পুলারা রাখবনা
কয় ।
এরপর একদিন আবার জহুরকে নিজ বাড়ীতে
দেখা যায় । জহুর এসে মা’র সামনে দাঁড়ালে অশ্রু বিসর্জন দেয় জায়েদা । তারপর বলে-
-আমাক ক্ষেমা দিস বাপ ।
তারপর জহুরের হাত ধরেই কালীতলা এসে
উঠে জায়েদা বেগম । আজকাল নিজেকে খুব সুখী মনে হয় জহুরের । সারাদিন পরিশ্রম করে
ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরলে মায়ের চোখে সমুদ্র দেখে সে । একটা নির্ঝঞ্ঝাট সমুদ্র ।
সমুদ্রকে কেবলই নিজের মনে হয় তার ।
জহুরের দিনগুলো এমন হতে পারত সবসময়
কিন্তু হয়নি । মাসদুই পর একদিন খবর আসে শহরে রিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে
জহুর । লালখানের হাসেম আলী খবর পৌঁছালে আহাজারি করে সবাই ।
-আয়গো খোদা একি সব্বনাশ অইল আইজ !
জবেদ আলীর হস্তক্ষেপে শহরে চিকিৎসা
হয় জহুরের । একদিন পুরোপুরি সুস্থও হয় সে কিন্তু পা দুটো হারাতে হয় তাকে । ফলে
জহুরের সংসারে দুর্দিন আসে আবার । পেট কি আর অভাব বোঝে । হয়তো পেট বাঁচাতেই একদিন
জায়েদা বেগম দমদমা বাজারের এক মাথায় চট বিছিয়ে ছেলেকে বসিয়ে দেয় । জহুর ভিক্ষা করে
। ভিক্ষার টাকা কতইবা আর । ঘরে অভাব কমেনা ওদের । জান, সম্পর্ক আত্মায়
হয় । কি এক মুহে পড়ে জহুরকে আর ছাড়তে পারেনা জায়েদা । নিজের ছেলেরা নিতে এলে ফিরে
যেতে অসম্মতি জানায় সে ।
এরপর একদিন হারু দমদমা বাজারে
নিজের বিয়ের সওদা করতে গেলে বন্ধুকে দেখে ভিক্ষা করতে । তখনও সত্যি প্রকাশ হয়নি ওর
কাছে । সামনে পা বাড়ালে দেখে বাজারের অন্য মাথায় জায়েদা দাঁড়িয়ে । গায়ের শাড়িটাকে
বুকে পীঠে গুঁজে আঁচলটা সামনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে । কারো সাথে কথা বলেনা । ওর চোখ হতে টপ টপ জল ঝরে কেবল ।