গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

মনোজিৎ কুমার দাস


একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক একটা টিকটিকির গল্প                                                                                           
                                                                                                                     
কলকাতা বন্দরে ইংরেজ বণিকেরা যে তরী ভিড়েয়েছিল তা একদিন ভারতবাসীদের জন্যে গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়।ইংরেজ বণিকেরা একদিন ভারতবর্ষের রাজদন্ড অধিকার করায় ভারতবাসীরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হল। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্যে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ভারতবাসীদের মনে স্বাধীনতা লাভের উদগ্র বাসনা বহাল থাকে। কেটে যায় বছরে পর বছর। থেমে থাকে না স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম।
বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিতেরা ব্রিটিশের শৃঙ্খল ভাঙার জন্যে প্রথম জীবন উত্সর্গ করলেন  ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতারা। তারা ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতা মশাল জ্বালালেন। কোন পন্থায় ভারতের স্বাধীনতা আসবে,সহিংস পন্থায়, নাকি অহিংস আন্দালনের পথ ধরে এ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এক সময় একটাই দাবী উঠে, ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে হবেই।গঠিত হল অনুশীলন ও যুগান্তর সমিতির মতো বিপ্লবী সংগঠন,বিপ্লবী কর্মকান্ডের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোই তাদের একমাত্র প্রতিজ্ঞা । বিপ্লবী সংগঠনের বিপ্লবী কর্মকান্ডের ফলে ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসন তটস্থ।  
বাদল,বিনয়, দিনেশের কলকাতার রাইটার বিল্ডিং আক্রমন, ইংরেজ কর্মকর্তাদের উপর বিপ্লবী সংগঠনের আক্রমনকে প্রতিহত করার জন্যে বিপ্লবী ও তাদের সমর্থকদের উপর পুলিশের গোয়েন্দাগিরি তখন তুঙ্গে। ব্রিটিশ পুলিশের টিকটিকিরা লেগে আছে,স্বদেশীদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্যে।
সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী জমিদারীর এস্টেটের অধস্তন পুরুষ লাহিড়ী বাবু একজন জমিদার হলেও  উকালতি পেশার পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক কাজে সক্রিয়।  স্বদেশী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। তার  পূর্বপুরুষ জমিদাররা ইংরেজদেরকে তোষণ করে এদেশের গরীবদের ওপর শাসন ও শোষণ করতে দ্বিধা করেনি। লাহিড়ীবাবু তারই  প্রায়শ্চিত্ত করতে চান।
লাহিড়ীবাবুকে  প্রায় প্রায়ই কলকাতা যেতে হয় স্বদেশী আন্দোলনের দিকনির্দেশনা লাভের জন্যে।  ট্রেনেই সিরাজগঞ্জ থেকে কলকাতায় যাওয়ার একমাত্র বাহন। সিরাজগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে হেঁটে গিয়ে ট্রাম ধরেন, নতুবা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়েন লাহিড়ীবাবু, মানুষে টানা রিকশায় তিনি চড়েন না।পরনে খদ্দরের ধুতি,গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।  
ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ত্রিশঙ্কু।  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধে গান্ধিজী ও ভারতীয় কংগ্রেস ইংরেজদের সমর্থন দিয়েছিল এ আশায় মিত্রশক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করলে ইংরেজরা ভারতকে স্বাধীনতা দেবে।                                                                                              অন্যদিকে, নেতাজী সুভাষ বোস জার্মানী ও জাপানের পক্ষ যোগদানের পর আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে আসামের ইম্ফল পর্যন্ত এগিয়ে এসেও শেষ রক্ষা করতে পারেন না।  হিটলারের মৃত্যু ও পরাজয়ের কারণে নেতাজীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তিনি নিখোঁজ না নিহত অমিমাংসিত রয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ায় নামে ইংরেজরা টালবাহানা শুরু করলে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে।ইংরেজরা স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের প্রতি নজরদারী বাড়িয়ে দিলেও নেতারা মোটেই ভীত নন।
 চৈত্র মাসের মাঝামাঝি একদিন,লাহিড়ী বাবু সিরাজগঞ্জ স্টেশন থেকে ভোরের ট্রেন চড়লেন কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশে। তিনি ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গিয়ে ট্রাম ধরে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের কাছে নামলেন। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের পাশেই একটা বাড়িতে তাদের গোপন  মিটিং।
মিটিং শেষ হতে না হতে সিরাজগঞ্জ ফেরার ট্রনের সময় হয়ে এল। তিনি ভাবলেন,  এ ট্রেন ধরলে সন্ধ্যা আটটার দিকে সিরাজগঞ্জ পৌঁছানো যাবে। তিনি সব সময়ই ট্রেনের থার্ড ক্লাসের কামরায় যাতায়াত করেন। এদিনও তার ব্যত্যয় হল না।
শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ছাড়ার সময় কামরায় যাত্রীতে ভর্তি।  দর্শনা স্টেশনে ট্রেন পৌছানোর পর তিনি দেখলেন যাত্রী সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশী কমে গেছে। পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পেরোলেই ঈশ্বরদী জংশন।  লাহিড়ীবাবু লক্ষ করলেন ঈশ্বরদী জংশনে অনেক যাত্রী নেমে গেল,  আবার অনেক কামরায়  উঠল। লাহিড়ীবাবু জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। চৈত্রের বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে,কিন্তু সূর্য তখনো প্রচন্ড তাপ ছড়াচ্ছ, প্রচন্ড গুমোট, একটুও বাতাস নেই।
ট্রেনের কামরায় একজন  লোক কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউজের ওখান থেকেই লাহিড়ীবাবুর অলক্ষ্যে তার ওপর নজরদারী করছে ।ট্রেন সিরাজগঞ্জের দিকে এগিয়ে চলেছে। লোকটা কিন্তু লাহিড়ীবাবুর পিছু ছাড়েনি।
লোকটা ভাবল, পুলিশের টিকটিকি হওয়ার মতো খারাপ কাজ আর একটিও নেই। থানায় রিপোর্ট না পেশ না করা পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। লাহিড়ীবাবু ডাকসাইটে স্বদেশী! তার অকরণীয় কিছু নেই। তাই ইংরেজ পুলিশের বড়কর্তারা তার গতিবিধির ওপর নজরদারী কড়াকড়ি করেছে।
প্রচন্ড গরমে ট্রেনের কামরায় গুটি মেরে বসে তিক্তবিরক্ত হয়ে আবারও ভাবল, সেও  ব্রিটিশ পুলিশের ডাকসাইটে গোয়েন্দা!
হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি ছুটছে, আর এক স্টেশন পেরোলেই সিরাজগঞ্জ । পুলিশের টিকটিকিটি ক্লান্তিতে চোখে ঝিমুনী ভাব এসে যাওয়ায় সে যেন লাহিড়ীবাবুর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।
ট্রেনটি স্টেশনে থামার ধাক্কায় চোখ থেকে ঝিমুনী ভাব কেটে যেতেই দরজার দিকে লোকটা নজর পড়তেই সে দেখে  লাহিড়ীবাবুকে ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছেন! তা দেখে সে হকচকিয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে তার পেছনটা ধরার জন্যে সেও  ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।
ততক্ষণে লাহিড়ীবাবু প্লাটফরম ছাড়িয়ে হাঁটা রাস্তা ধরেছেন। টিকটিকিটা বুঝে উঠতে পারছে না,কেন লাহিড়ীবাবু আগের স্টেশনে নেমে পড়লেন, তবে কি তিনি তাকে চিনে ফেলেছেন?
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, লাহিড়ীবাবু হনহন করে তার চেনা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছেন।  টিকটিকিটার পক্ষে লাড়িহীবাবুকে অনুসরণ করে চলতে হিমশিম।বাবু হাঁটা পথ ছেড়ে খোলা মাঠে নেমে সিরাজগঞ্জের সোজা পথ ধরলেন।ব্রিটিশের টিকটিকিটিকে চাকরী বাঁচাতে হলে লাহিড়ীবাবুর পিছু নিতেই হবে ভাগ্যিস,পূর্ণিমার রাত!তাই সে লাহিড়ী বাবুকে অনুসরণ করতে পারছে।  
রাত সাড়ে নয়টার দিকে লাহিড়ীবাবু সিরাজগঞ্জের লাহিড়ীপাড়ায় এসে পৌছালেন। পুলিশের টিকটিকিটার মনে জানার ইচ্ছে হল,কেন লাহিড়ীবাবু আগের স্টেশনে নেমে পড়লেন? বিষয়টা জানার জন্যে সে লাহিড়ীবাবুর পিছন পিছন তার বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

লাহিড়ীবাবু পেছন ফিরে লোকটা দেখে ভাবলেন-- এ আবার কেতিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি?                                                                                                                                -একটু জলতেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে লাহিড়ীবাবু টেবিল রাখা ঘটি থেকে গ্লাসে জল ভরে লোকটা হাতে দিলে সে তা এক চুমুকে সাবাড়ের পর নিজেই আরে এক গ্লাস জল ভরে তা পান করে  পাশে রাখা  টুলটাতে বসে পড়ল।                                                                                 
লাহিড়ীবাবু বিস্মিতকন্ঠে বললেন-অপনার পরিচয়!  লোকটি নিজের পরিচয় না দিয়ে বলল-- কেন আপনি আগের স্টেশনে নেমে মেঠো পথে হেঁটে বাড়ি এলেন? আমার এ প্রশ্নটার জবাব দিন আগে,আমাকে জব্দ করার জন্যে নাকি। -ওহ, এই কথা , সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত টিকিটের পয়সা আমার কাছে না থাকায় ওই স্টেশন পর্যন্ত আমি টিকেট কাটতে বাধ্য হই।লাহিড়ী বাবু জবাব শুনে লোকটা বলল-এটা একটা জবাব হল। আপনারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধ লড়াই করছেন, সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছেন। আর কয়টা পয়সা কমের জন্যে আগের স্টেশনে নেমে পড়লেন!! আমাকে নাজেহাল করে আপনার কী ---- লোকটা কথা শেষ করতে না দিয়ে লাহিড়ীবাবু বিস্মিত কন্ঠে বললেন
-আপনি কী বলছেন! আপনার সঙ্গে চেনা নেই, শোনা নেই আপনাকে আমি নাজেহাল করতে যাব কেন?                                                         
 -আপনি এলাকার গন্যমান্য মানুষ, আপনার কাছে কি চেকার টিকেট চাওয়ার সাহস করে
-আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত  টিকিট না কেটেও আমাকে সিরাজগজ্ঞ স্টেশনে নামা উচিত ছিল?                                                                                      
-হ্যাঁ।                 
-এমনটা আপনি কীভাবে ভাবতে পারলেন?                                                                        -আপনারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ব্রিটিশের রেলের কয়েকটা পয়সা ক্ষতি হবে ভেবে আপনার এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল!                                                  
-এটা নৈতিকতার প্রশ্ন ।স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কাজ হয় না।                    আমরা সেই বিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের কাজে ব্রতী। আমরা যদি নীতির থেকে বিচ্যুত হই তবে কি আমরা সফল হতে পারব? তা আপনি কেন আমাকে এখন এ সব প্রশ্ন করছেন,তাতো আমি বুঝছিনা।
লাহিড়ীবাবুর কথা শুনে ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা অরিন্দমের মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হল। সে ভাবল, আমি একজন বাঙালি হয়ে সারাটা জীবন ব্রিটিশের গোলামী করে আসছি! তার মনের মধ্যে অনুতাপের আগুন যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। দেশমাতৃকাকে ভালবাসার জন্যে সামান্যতম নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হতে রাজি নন দেশমাতৃকার সাচ্চা দেশপ্রেমিক লহিড়ীবাবু, আর আমি এই দেশেই সন্তান হয়ে সাচ্চা দেশপ্রেমিকের পেছনে টিকিটিকিগিরি করছি, এর থেকে লজ্জার আর কী থাকতে পারে!
অরিন্দম হঠাৎ করে লহিড়ীবাবুর পা জড়িয়ে ধরে বলল- বাবু,আমাকে ক্ষমা করে দেন, আমি আর জীবনে ব্রিটিশের গোলামী করব না। আমি পুলিশের চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশমাতৃকার কাজ করে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব।                                                           
লাহিড়ী কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অরিন্দম গড়গড় করে সব ঘটনা বলে গেল। লাহিড়ীবাবু তো অরিন্দমের কথা শুনে তাজ্জব। তিনি তাকে পায়ে উপর থেকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।