অনুগ্রহ করে শুনবেন, একশ’ ঊনত্রিশ আপ বর্দ্ধমান লোকাল ভায়া মেন, তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে, পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিটে ছাড়বে।
অ্যাটেনশন
প্লীজ, ওয়ান টোয়েন্টি নাইন আপ বর্দ্ধমান
লোকাল ভায়া মেন, উইল লিভ প্ল্যাটফর্ম নাম্বার থ্রী, অ্যাট সেভেন্টিন ফিফটি আওয়ার্স।
কৃপয়া
ধ্যান দে,
একশ’ ঊনত্রিশ আপ বর্দ্ধমান লোকাল
ভায়া মেন,
তিন নম্বর
প্ল্যাটফর্ম সে, পাঁচ বাজকর পঁচাশ মিনিট পর ছুটে গি।
অফিস
ফেরত যাত্রীরা হাওড়া স্টেশন সাবওয়ে দিয়ে, কেউ প্রায় ছেড়ে যাওয়া গাড়ি ধরবার জন্য ছুটছে, কেউ আবার শ্লথ গতিতে এদিক
ওদিক লক্ষ্য করতে করতে, সবজি বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের খোঁজ করছে।
ক্রেতা
চিন্তা করছে,
বিক্রেতা তাকে
খারাপ মালটা গছাবার চেষ্টা করছে কী না। বিক্রেতা চিন্তা করছে ক্রেতার চোখ এড়িয়ে কী
ভাবে ওজনে কম দেওয়া যায়, বা খারাপ সবজিটা ক্রেতাকে বোকা বানিয়ে গছানো যায়।
নকুড়বাবুর
চোখে মুখে কিন্তু কোন চিন্তা, কোন উদ্বেগের ছাপ নেই। পকেট হাতড়ে একটা বিড়ি বার করে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে, মুখে গুঁজে, ধীরেসুস্থে বিড়িটা ধরিয়ে, একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। এইসব
জায়গায় এখনও ধুমপান করায় সেরকম বাধা না থাকায়, নকুড়বাবু মনের সুখে বিড়িতে টান দিতে
দিতে, সাবওয়ের মুল সিঁড়ি দিয়ে
ওপরে উঠে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।
এখানেও
হকারদের ভিড়। বাচ্ছাদের খেলনা, কাপড় মেলার ক্লীপ, নাইলন দড়ি, ডাইনিং টেবিল কভার, কী না পাওয়া যায়? প্রত্যেকের কাছেই ছোটখাটো জটলা।
নকুড়বাবু
সবার ওপর দিয়ে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও, কোন কিছুই যেন তাঁর দেখার বিন্দুমাত্র
আগ্রহ নেই। চারিদিকে আর একবার লক্ষ্য করে, একজনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হ’ল। তাঁর মুখে একটা মৃদু
হাসির রেখা ফুটে উঠেও, মিলিয়ে গেল।
পকেট
হাতড়ে আর একটা বিড়ি বার করে, তাতে বেশ কয়েকবার সুখটান দিয়ে বিড়িটা ফেলে দিয়ে, পকেট থেকে একটা ছেঁড়া মানিব্যাগ
বার করে, গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে
এগিয়ে গেলেন।
রোজই
একজন অন্ধব্যক্তি লটারির টিকিট বিক্রী করে। হঠাৎ বড়লোক হওয়ার লোভ ও অন্ধব্যক্তির প্রতি
করুণা বা সাহায্য করার বাসনায়, অনেকেই তার কাছ থেকে বিভিন্ন রাজ্য লটারির টিকিট কেনেন।
নকুড়বাবু
লটারির টিকিট বিক্রেতার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক রাজ্যের, অনেক টিকিট ঘেঁটে, শেষে তিনি একটা টিকিট পছন্দ
করলেন। সামনের সপ্তাহে খেলা, প্রথম পুরস্কার দু’লক্ষ টাকা। টিকিটের মূল্য এক টাকা।
আরও
একবার পছন্দ করা টিকিটটা নেড়েচেড়ে দেখে, তিনি তার চারপাশে আর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে, ছেঁড়া মানিব্যাগ থেকে একটা
ঠিক একটাকা মাপের সাদা কাগজের টুকরো অন্ধ লোকটার হাতে গুঁজে দিয়ে, স্থান ত্যাগ করার আগেই, একজন চিৎকার শুরু করে দিলেন—“অন্ধ লোককে ঠকাতে লজ্জা
করে না? বিনা পয়সায় বড়লোক হবার সাধ”?
এদেশে
হুজুগে লোক ও সমাজ সেবা করার লোকের অভাব নেই। চারিদিক থেকে পিলপিল করে মজা দেখতে
অনেক লোকের আগমন হ’ল।
তারপর
নানা প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, অনেক দিন ধরে প্ল্যান করে, নকুড়বাবু আজই প্রথম এক টাকার মাপের
সাদা কাগজ কেটে নিয়ে এসে, লটারির টিকিটটা নিতে গেছিলেন। কিন্তু ঐ ব্যক্তি ব্যাপারটা লক্ষ্য করায়, যত বিপত্তি।
ব্যাস।
বিনা পয়সায়,
বিনা পরিশ্রমে
এরকম সমাজ সেবার সুযোগ তো আর রোজ রোজ মেলে না। একটা আধটা চড় চাপড় দিয়ে শুরু করে তাঁকে
নীতিজ্ঞান শেখানো শুরু হ’ল। শেষে মৌখিক নীতিজ্ঞান বন্ধ হয়ে শুধুই কিল, চড়, লাথি দিয়ে তাঁকে নির্লোভ
ও সমাজের একজন সৎ ও আদর্শ পুরুষে পরিণত করা সম্পূর্ণ হলে দেখা গেল, তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, হাতে, পায়ে, অনেক স্থানে ক্ষত।
অবস্থা
আয়ত্তে আনতে পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করলেও, নকুড়বাবুর তখন কথা বলার ক্ষমতা নেই।
মুখ চোখ ফুলে ঢোল। গোলযোগের মধ্যেই একজন সহৃদয় ব্যক্তি লটারির টিকিটটা পাঁচ টাকায় কিনে
নিয়ে, উপস্থিত সকলের বাহবা কুড়ালেন।
অন্ধ টিকিট বিক্রেতা নীরব।
ধরাধরি
করে নকুড়বাবুকে স্থানিয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হ’ল। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা
জানালেন তাঁর আঘাত গুরুতর। তবে বুকে ও পেটে সে রকম কোন আঘাত না লাগায়, বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই।
দিন
সাতেক চিকিৎসার পর নকুড়বাবু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। আজই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছুটি
দিয়ে দেওয়া হবে।
নকুড়বাবু
হাসপাতালের বিছানায় বসে সকালের দৈনিকটা পড়ছেন। কিছুক্ষণ পরে বাড়ির লোক এসে তাঁকে বাড়ি
নিয়ে যাবে। কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, হঠাৎ একটা খবরে নকুড়বাবুর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।
গতকাল
গোকুলবাবু নামে এক ব্যক্তি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারির প্রথম পুরস্কার বাবদ দু’লক্ষ টাকা পেয়েছেন। সঙ্গে
গত সপ্তাহের হাওড়া স্টেশনের ঘটনা সবিস্তারে পরিবেশন করা হয়েছে।
নকুড়বাবুর
সেদিন সারা শরীরে আঘাত লাগলেও, বুকে সেরকম কোন আঘাত পাননি। কিন্তু হঠাৎ তার বুকটা কী রকম মোচড় দিয়ে
যন্ত্রণা শুরু হ’ল। যন্ত্রণা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়ায়, ডাক্তার ছুটে এলেন।
কিছুক্ষণ
পরীক্ষা করে নকুড়বাবুর দেহ সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হ’ল। জানা গেল নকুড়বাবু হৃদরোগে আক্রান্ত
হয়ে মারা গেছেন।
সুবীর
কুমার রায়