আমার নিশ্চিত মনে আছে, সেটা আশ্বিনের
পূর্ণিমা ছিলো । সেইবছর আমি কোজাগরী উপন্যাসটা পড়েছিলাম এবং নদীর পাড়ে ঘুপসি বাঁধা
কাশবন নুয়ে ছিলো । কে কে মনে রেখেছে জানি না, আমি পুরোপুরি মাতাল হব ভেবেও সামলে নিয়েছিলাম।
নদীর যে পাশটা আমাদের উঠানের কাছে, সেদিকেই আমরা অসুখি মনের কয়েকজন খেজুর পাতার পাটি
বিছিয়ে, শরীর ছড়িয়ে বসেছিলাম । আমাদের নদীপাড়ের বাড়িটা, যেখান থেকে স্টিমারের যাওয়া
আসা দেখা যেতো; এখনও দেখা যায়। একটা কাঠের দোতলা, অগুণতি গাছেদের ঠাঁসাঠাসি, সীমানাঘেরা
ঝাউবন এবং কীর্তনখোলা । বন্ধুরা খোলামেলা ঈর্ষা দেখাতো, আর আমাদের ঈর্ষাবিহীন আড্ডা
জমে উঠতো । সেই আশ্বিনে, আমার দিব্যি মনে আছে, বাবা-মা ছোট’কা কাকিমা কে প্লেনে তুলে দিতে
ঢাকা গিয়েছিলেন । ইনুচের মা ঘর সামলাতো, আমি বন্ধুদের ।
কাঠঘর ইতিহাস হয়েছে, এখানে এখন সিরামিকের
দোতলা । অনেক গাছ নেই, নদী তেমনি আছে, আদিম বালিয়ারী.. ঝাউয়ের বিস্তার... কিন্তু ঠিক
আগের মত নয়! দুইপাশ চাপিয়ে আনা হয়েছে, সরকারী প্লটের সীমানাদেয়াল তোলা । কেউ কেউ কিনে
আলিশান বিল্ডিং তুলে ফেলেছে । বেশ, এই শহর ধনী হয়েছে অনেক! আমি ভাবি এবং ভোরের আলো ফোটার আগে এই
ব্যালকনিতে বসে গাছপালাদের আড়মোড়া ভাঙ্গা দেখি। চড়াইদের নাচানাচি, ময়লাভূক কাকদলের
ঝগড়া, একশালিখ.. দু’টো... তিনটে.. অনেক । রোদ্দুর চড়লো, এবার নয়ারাজার বৌ দোকান খুলবে,
চায়ের দোকান । বড় বড় মাটির উনান, একটায় ঘন হচ্ছে গাইয়ের দুধ, আরেকটায় চায়ের কেটলিতে
জল ফুটছে । চাবি ঠেসে গ্যাস পাম্প করা হয়েছে পিতলের চুলায়, আগুন জ্বলে উঠলো । লোহার
তাওয়ায় পরোটা ভাজা হচ্ছে । ক্রমশ কাঠের বেঞ্চিগুলোতে মজুর, রিকসাওয়ালা, পাড়ার বেকার
যুবক, মালকিনের চাকরাণী, মহিদ হাওলাদার.. দেখেই তেতো লাগে। বারোটি বাড়ি আছে তার, অগুণতি টাকা এবং একটি পুটি মাছের
মত আত্মা ।
দ্বিপ্রহর বলে যে শব্দটা আছে, সেটা
আমার অপেক্ষায় থাকতো । সুনশান খেয়াঘাট, কালাম মাঝির নৌকা আমার অপেক্ষায়, :আইছেন আফা? জলদি ওডেন, নাও ছাড়ি । কোন
নদীতে গোছল হরবেন আইজ? রশি লইয়া আইছি । কথাগুলির মাহাত্ম বোঝা গেলো না তো! আমি প্রতিদিন কোন না কোন
নদীর মাঝখানে স্নান করি, ঠিক মাঝখানে । এত স্রোত, ভেসে যাই যদি! কালাম মাঝি মোটা একটা রশি
নিয়ে আসে, সেটা কোমরে বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দেই । রশির আরেক প্রান্ত নৌকার সাথে বাঁধা,
ভেসে কতদুর যাবো? প্রকাশঅযোগ্য অনুভব । আমি, তলস্রোতা নদী, আকাশ আর একটি নিঃসঙ্গ অর্ধেক ছই তোলা নৌকা । স্নান সেরে
ছইয়ের নীচে, চটের পর্দা ফেলে দিয়ে হ্যাভারস্যাকে রাখা শুকনো পোষাকগুলি পরে ফেলি । এবার
দুপুরের খাবার সময় । সামনে যে বাজার পড়বে সেখানকার কোনো সস্তা হোটেলে বসে টকটকে লাল
তরকারি দিয়ে ভাত খাই, কালাম মাঝিও খায় । দিব্যি দিয়ে বলি, আমার পাগলামিতে মজা পায় লোকটা
। বিকেল শেষ হয়ে যায় ফিরতে । মাঝির হাতে টাকা দিয়ে বাড়ির পথ ধরি । কাল আবারও.... কালাম
মাঝি জানে কখন আমি আসবো ।
উনিশ বছর! খেয়াঘাটে যাওয়ার আগে নিজেকে বলেছিলাম,
মাত্র উনিশ বছর! কেউ খেয়াঘাট বলায় চিনলই না!! শেষতক রেগে গিয়ে বললাম, নিয়ে যাও তোমাদের
চেনা চুলোয়, সম্ভবত আমি বুড়োই হয়ে গেছি । হয় আমার পার্কিনসন ডিজিজ হয়েছে, নয়তো আমি
গতজন্মের ভূত । অটো এগিয়ে চললো, এই পথ আমি চিনি না! সে বাঁক ঘুরলো, এই মোড়ের ধারে হোগলার
বন ছিলো, কোথায়! বাড়ি আর বাড়ি, পরিকল্পিত গুচ্ছগ্রাম । উঁচু সড়কে এলো, একি, দুইপাশে
দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত ছিলো! হঠাৎ কোন মেঘ উড়ে এলে ভয়ংকর সুন্দর একাকিত্ব তছনছ হয়ে যেতো । এখানে
এখন ডকইয়ার্ড, একটু দুরেই কাঠচেরাই মেশিনঘর, তারপর টিনের দোকানের সারি । নেই খেয়াঘাটের
বিশ্রামঘর, অনেক আগেই নদীর ভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে । :আমনে কিয়ের খেওয়াঘাড কইতেয়াছেন! এইডা তো ফেরিঘাড । অটোর
ড্রাইভারের দিকে তাকাই, তাইতো! ঝকঝকে পল্টুন, ফেরি ভিড়লো । কালাম মাঝি.... আমি এই বয়সে উনিশ বছর আগের
মত দৌঁড়াতে চেষ্টা করি । এই ঘাটে কোনো নৌকা নেই! কেউ আমাকে কালাম মাঝির সন্ধান দিতে
পারে না, অলৌকিক শূন্যতা কুয়াশার
মত ঘিরে ফেলে আমাকে ।
নেই আমার ধঞ্চেক্ষেত, তিনরঙা হিজল গাছ,
কোনো নৌকার ছায়া! আছে ইটের ভাটা, বালি বোঝাই কার্গোশিপ । হঠাৎ একটা কিশোর ছেলে বলে ওঠে, :বেডি বোধয় এম্মে থাহে না,
মাতায় ডিস্টাব আছে । অকটেন পোড়া বাতাসের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, এখন আমাকে উল্টোদিকে হাঁটতে
হবে, অটোতে উঠে বসতে হবে, অচেনা ঘরটায় ফিরতে হবে । এখানে কেউ আর আমাকে চেনে না ।