গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

চন্দনকৃষ্ণ পাল

বাক্স বদল

ঝামেলা, মহা ঝামেলা
মহাঝামেলায় পড়ে গেছে মানিক। অনার্স ফাইনাল চলছে। দুটো পরীক্ষা ইতিমধ্যে শেষ। তিন টার আগেই এই ঝামেলা। এখন পরীক্ষা বাদ দিয়ে গ্রামের বাড়ী চলে যাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আর বিষয়টা এমন যে কাউকে বলাও যাচ্ছে না। সবাই দিব্যি পড়াশুনা করছে আবার মন খুলে আড্ডাও দিচ্ছে। আর মানিক না পড়তে মন সংযোগ করতে পারছে না আড্ডায়। গত তিন চার বছরের হল জীবনে এ রকম সমস্যায় পড়েনি মানিক। প্রথম এবং দ্বিতীয় দিন যখন হলো না তখন ভেবেছিলো কনষ্টিপেশন। ইসবগুলের ভুষি দুবেলা দু গ্লাস গেলার পর আজ তৃতীয় দিনও যখন সকাল থেকে এ পর্যন্ত কোন বেগই হলো না তখন টেনশন না করে আর কি উপায়। মনে মনে চিন্তা করলো কার সাথে এ বিষয়ে সুষ্ঠ একটা আলোচনা করা যায়। আমজাদ এর কথা প্রথমে মনে হলো। ঠান্ডা এবং বুদ্ধিমান ধরণের ছেলে। নিজের এলাকার দুবছরের জুনিয়র। শ্রদ্ধা ভক্তি করে। এই বিপদে ওর সাহায্য পাওয়া যাবে এটা বিশ্বাস করে মানিক। আমজাদের নম্বরে কল দেয় ও। কল ঢুকে। ন্যান্সির ভিতর বলেবেজে ওঠে। রুচিশীল ছেলে। মানিকের প্রিয় গানটাই কলার টিউন হিসেবে রেখেছে। আমজাদ ফোন রিসিভ করে।
-
    মানিক ভাই স্লামালেকুম।
-
    ওয়ালাইকুম সালাম।
-
    কি ব্যাপার মানিক ভাই, হঠাৎ........
-
    সমস্যা খুব জটিল আমজাদ। তুমি একটু আসো।
-
    আচ্ছা মানিক ভাই আসছি।

টেষ্ট ছাড়া গতি নাই
মানিক এর কল পেয়ে পাশের হলে থাকা আমজাদ দ্রুত মানিক এর রুমে পৌঁছে যায়।
-
    এসেছো। (আমজাদ মানিক এর চেহারা পড়তে চেষ্টা করে। চেহারায় টেনশন ভর করছে)
-
    কি সমস্যা মানিক ভাই?
মানিক বিস্তারিত আমজাদকে জানায়। গম্ভীর মুখে আমজাদ পুরো ঘটনা শুনে। পরীক্ষা বলে কথা। না হলে বলতো
  সোজা বাসে ওঠেন। খালাম্মার হাতে পড়লে সব ফকফকা হয়ে যাবে। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর আমজাদের মুখে কথা ফুটে-
-
     টেষ্ট ছাড়াতো গতি নাই মানিক ভাই।
-
     টেষ্ট! ডাক্তারের কাছে না গিয়েই টেষ্ট করায়ে ফেলবো?
-
    মানিক ভাই ডাক্তারের কাছে গেলে অন্ততঃ গোটা পাঁচেক টেষ্ট দিবেই। সে মোতাবেক আগে অন্ততঃ ষ্টুলটা টেষ্ট করিয়ে নেন।
-
    ষ্টুল কোথায় পাবো যে টেষ্ট করাবো। ষ্টুলই নেই আজ তিন দিন।
-
    মানিক ভাই কষ্ট করেন। চেষ্টা করলে কিছু হবে। টেষ্টের জন্য খুব বেশীতো দরকার নাই।
-
    হুম, দেখি চেষ্টা করে।
-
    হ্যাঁ চেষ্টা করেন। সমস্যা হলে ফোন দিবেন।

প্রস্তুতি পর্বঃ ষ্টুল টেষ্ট
মানিক নিজের ভাগ্যকেই দোষ দেয়। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে হলে থাকছে। কারো এ ধরণের সমস্যা নেই। সমস্যা হলো কিনা ওর। কি আর করা। দুটো খালি ম্যাচ বাক্স যোগাড় করে মানিক। বাথরুমে ঢুকে। অনেক চেষ্টার পর উপরওয়ালা দয়া করেন। যে পরিমাণ পাওয়া যায় তাই দুটো ম্যাচ বাক্সে কায়দা করে তুলে নেয়। শৌচকার্য করে বাক্স দুটো বা হাতে ধরে রুমে এসে দেয়ালের খাজে রেখে দেয়।
  পোষাক পরে হালকা নাস্তার উদ্দেশ্যে বাইরে চলে আসে। নাস্তা সেরেই ঢাকা মেডিক্যালে একটা আর ভার্সিটির ডিসপেন্সারীতেএকটা পৌছে দেবে। আজ কাল ঐ সব টেষ্ট রিপোর্টের তো মা বাপ নাই। তিন জায়গায় তিন রকম রিপোর্ট দেয়। এ চিন্তা থেকেই মানিক দু জায়গায় টেষ্ট এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুতই নাস্তা সারে মানিক। মনেতো শান্তি নাই। খুবই হালকার ওপর নাস্তা সেরে রুমে ফিরে আসে। দেয়ালের খাজে রাখা ম্যাচ বক্স দুটি উঁকি দিয়ে নামিয়ে নেয়। প্যাকিং টেপ দিয়ে সুন্দর করে প্যাক করে একটি পলিথিনে বাক্স দুটি ঢুকিয়ে বা হাতে ঝুলিয়ে মেডিকেলের দিকে যাত্রা শুরু করে মানিক।

নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে
মানিক নাস্তা খেতে বেরিয়ে
যাবার পর পরই বাবু আসে রুমে। শাহনেওয়াজ ফারক বাবু। নাম রাজাবাদশার মতো হলে কি হবে ফেন্সিডিলের ভক্ত। দিন দুপুরে টাল হয়ে থাকে। আজও ঘুম থেকে উঠেই বোতল টেনে এসেছে। হাতে গাঁজা ভরা সিগারেট। মানিক এর রুমমেট ফয়সল এর সাথে ভালো খাতির। রুমে বাবু ঢুকে টলতে টলতে। দেয়ালের খাজে ম্যাচ রাখে ফয়সল। মাঝে মাঝে মোম ধরাতে হয়। বাবু সিগারেট খেতে চাইলে ওখান থেকে ম্যাচ পেড়ে দেয় ফয়সল। সারারাত জেগে পড়াশুনা করে সকাল দশ এগারোটা পর্যন্ত ঘুমায় ও । বাবু ওকে ডিষ্টার্ব না করে দেয়ালের খাজ থেকে ম্যাচ পেড়ে টলতো টলতেই ছাদের দিকে রওয়ানা দেয়। ছাদে বসে গাজার ষ্টিকটা সাবাড় করবে। ছাদে পৌছে বাবু। গাছের ছায়া পড়েছে। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে বাবু। গাজার ষ্টিকটা মুখে দিয়ে ম্যাচ বক্সে নাড়া দেয়। শব্দ হয় না। বক্সটা খুলে কাঠির জন্য আঙ্গুল ঢুকায় ভিতরে। কাঠির পরিবর্তে আঠালো ভারী তরল উঠে আসে আঙ্গুলে। সাথে দুর্গন্ধ। বাবু অবাক হয়ে যায়। এটা কি! শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের দুই আঙ্গুলের দিকে তাকায় বাবু। মনুষ্য বিষ্ঠা!! ঘেন্নায় নেশা কেটে যায় বাবুর।

ডিসপেনসারীতে নূতন ঝামেলা
ডিসপেনসারীতে ভয়াবহ ভিড়। প্রত্যেকটা কাউন্টারে বিশাল লাইন। আধঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর মানিকের পালা। পলিথিনে জড়ানো ম্যাচ বাক্স দুটো কাউন্টারে বসা লোক টার সামনে রাখে মানিক।
-
    প্রেসক্রিপশন কোথায়?
-
    প্রেসক্রিপশন কেন মামা।
-
    আপনার টেষ্ট এর জন্য রেফারেন্স লাগবে তো।
-
    তাহলে
-
    আগে সমস্যার কথা ডাক্তারকে জানান। ডাক্তার টেষ্ট দেবার হলে দেবেন। তবেই না টেষ্ট এর প্রশ্ন।
-
    আচ্ছা
মেজাজটা খিচড়ে যায় মানিকের। আমজাদের পন্ডিতির জন্য এটা হলো। ডায়গনোষ্টিক ল্যাব থেকে ডাক্তারদের চেম্বারে চলে আসে মানিক। টিকিট কেটে মেডিসিনের ডাক্তারের রুমে ঢুকে ডাক্তারের সামনে বসে পড়ে।
-
    সমস্যা?
বিস্তারিত বলে যায় মানিক। ডাক্তার প্যাড টেনে খস খস করে ঔষধের নাম লিখেন।
-
    স্যার টেষ্ট?
ডাক্তার একটু অবাক চোখে তাকান।
-
    টেষ্ট দেবো?
-
    স্যার ষ্টুলতো নিয়ে এসেছিলাম।
-
    আপনারতো .............., পেলেন কোথায়?
-
    ঠিক আছে।
ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের নীচে ষ্টুল টেষ্ট এর কথা লিখে দেন। মানিক খুশী মনে এবার ল্যাবে ঢুকে। কাউন্টারের মামা এবার ষ্টুলের একটি বাক্স নাম্বার দিয়ে রেখে দেন।
-
    কাল সকালে রিপোর্ট নিয়ে যাবেন।
অপর বাক্স নিয়ে মানিক ঢাকা মেডিক্যালের দিকে রওয়ানা দেয়।


রিপোর্ট বিড়ম্বনা
রাতে শুয়ে শুয়ে পরদিনের কাজের ছকটা কেটে ফেলে মানিক। ঠিক নটায় আমজাদ সহ মেডিক্যাল থেকে রিপোর্ট নেবে। এরপর ডিসপ্রেনসারী থেকে। দুটো রিপোর্ট পেলে ডাক্তার বুঝতে পারেন প্রকৃত সমস্যা কি? নিজের বিবেচনার ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় মানিকের। বড়দা যতোই ওকে গর্দভ বলে ডাকুক, সে যে গর্দভ না, এই ক্রাইসিস টা না এলে এটা বুঝতেই পারতো না মানিক। পেটের যন্ত্রনা চেপে মনে একটা তৃপ্তির ভাব নিয়ে ঘুমিয়ে যায় মানিক।
সকাল হতেই আমজাদকে একটা শর্ট মেসেজ পাঠায় মানিক। মেসেজটা এ রকম ঠিক সাড়ে আটটায় রুমে এসো।যথা সময়ে আমজাদ পৌছে যায় রুমে। দুজনে দ্রুত বের হয়। ঢাকা মেডিকেলর রিপোর্টটা সহজেই সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু প্যাঁচ বাধে ইউনিভার্সিটির ডেসপেনসারীতে। রিপোর্টের স্তুপ দুবার ঘেটেও মানিকের রিপোর্টের কোন হদিস পাওয়া যায় না। মানিক হতাশ দৃষ্টিতে আমজাদের দিকে তাকায়। এদের ঘাটাঘাটি ডেক্সে বসা লোকটার দৃষ্টি এড়ায়না।
-
    মামা কোন সমস্যা।
-
    একটা ষ্টুল রিপোর্ট থাকার কথা।
-
    ষ্টুল কি ম্যাচ বক্সে ছিলো?
-
    হ্যাঁ।
-
    আচ্ছা আপনিই তাহলে সেই ব্যক্তি।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত লোকটা মানিককে দেখে নেয়। মানিকের গলা শুকিয়ে কাঠ। হাতের তালু ঘামা শুরু হয়েছে। মুখে ভয়াবহ দুশ্চিন্তার ছাপ।
-
    আসুন ভিতরে আসুন।
আরে ঘাবড়ে যায় মানিক। আমজাদ এর হাত চেপে ভিতরে ঢুকে মানিক। লোকটা ওদের ল্যাব এর ভিতরে নিয়ে যায়। ভারী চশমা পরা একটা লোক কাঁচের টিউব নিয়ে নাড়া চাড়া করছে। ওর কাছে নিয়ে যায় লোকটা।
-
    স্যার, ইনি সেই ব্যক্তি। ম্যাচ বক্সের মালিক।
-
    উনাকে বাক্সটা দাও আর খুলতে বলো। ভারি চশমা ওদের দিকে না তাকিয়েই বাক্যটা বাতাসে ছেড়ে দেন। তার সাগরেদ মানিকের বাক্সটা একটা র‌্যাক থেকে তুলে মানিকের হাতে দেয়।
-
    খুলুন।
মানিক দেখে তার বক্সটাই যত
œ করে সেভাবেই ট্যাপে আটকানো। ওর হাত কাঁপে। লোকটা লক্ষ্য করে।
-
    কাইপেন না ভাইজান। ধীরে সুস্থিরে খুলেন। আস্তে আস্তে ট্যাপ এর প্যাঁচ খুলতে থাকে মানিক। আমজাদ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে। প্যাঁচ খোলা শেষ হলে বাক্স খুলে মানিক এবং অবাক হয়।
ঝকঝকে নূতন একটা ম্যাচ বক্স। কাঠিতে ঠাসা।
-
    আমার ষ্টুল।
-
    ম্যাজিক ভাইজান, ম্যাজিক। আপনার মূল্যবান ষ্টুল ম্যাচের কাঠিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা দুঃখিত। 
ভারী চশমা সহ দুজন এক সাথে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে।
বিষন্ন মুখে আমজাদের হাত ধরে বাইরে আসে মানিক। আমজাদ ভাবে, যে ম্যাচ মনে করে ষ্টুল এর বাক্স খুলেছে তার অবস্থা যে কি যদি জানা যেতো।