গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আবুরাশেদ পলাশ

সান্ধ্যকালে সূর্যময়ী

শ্রাবণের মাঝামাঝি থেমে যাওয়া বর্ষাটা দিন দুই বিশ্রামের পর পূর্বাবস্থায় ফেরত যায় । আজকাল বৃষ্টি শুরু হলে থামেনা সহসা । মধ্যাহ্নে সূর্যের দিকে দৃষ্টি গেলে বুড়ো মনে হয় ওকে । দিনমান পাংশুটে মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে ওটা । গাঁয়ের পথে আলো-আঁধারি খেলা হয় এ সময় । মাঝে মাঝে গুড়ুক গুড়ুক মেঘ ডাকে, বিদ্যুৎ চমকায়না । কর্মহীন গাঁয়ের বউয়েরা মেঝেতে বসে কাঁথা সেলায় । কিশোরীরা দল বেঁধে পুতুল বিয়ের খেলা করে সখীদের সাথে । উলঙ্গ,অর্ধউলঙ্গ উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো হৈ হৈ রব তুলে কাদা জলে গড়াগড়ি খায় । দৃষ্টিগোচর হলে ধমকায় বাবারা-
-হারুনি, শিগগির উইঠ্যা আয় হারামির পুত । ব্যারাম অইল্যা পাগারে চুবান দিমু নিয্যস ।

আষাঢ়ে বর্ষা হয় । তার জলে বন্যা হয় করাতকান্দি । শ্রাবণে জলের ধারা থৈ থৈ করে গাঁয়ের  সর্বত্র । আউশের খেত ভাসে সাদা জলে । চলতি বন্যায় আবাদি জমি গেছে চাষিদের । শুকনো মওসুমে অনাহারে থাকতে হবে অনেককে । উত্তরপাড়ার বিনোদ বর্ষায় আবাদি জমি হারালে চিন্তিত হয় । বিকেলে বানের জলে ডুবে যাওয়া চারাগুলো টেনে তুলে সে । আলীনা পাড়ার আহালু বড়শীতে মাছ ধরতে এলে চোখাচোখি হয় দুজনের । তারপর হাঁক দেয় আহালু-
-বিনদেনি, চারাগুলান তুলো যে ?
-গরুরে খাওয়ামু মিয়া ভাই ।
-উঠ্যা আহ বিড়ি খাই । দখিনা বাতাসে শইলে সার পাইন্যাগো ।

আচমকা বর্ষার ধারা থেমে গেলে দখিনা বাতাস বয় গাঁয়ের সর্বত্র । হিমবাতাস আলিঙ্গন করলে বস্ত্রহীন শরীরে কাঁপন ধরে সহসা । বড় ব্যাঙের ম্যাগো ম্যাগো শব্দগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হয় । রাতে ঘরের পাশে ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রাম আওয়াজ শুনা যায় । জানালা খুলে বাইরে তাকালে জোনাকির মিটিমিটি আলো জ্বলে এ সময়  । এ আলো গাঁয়ের পথে পথিকের পথচলা প্রাঞ্জল করেনা কখনও । তবে ওর দিকে দৃষ্টি গেলে দিনভর উপোস বেহুলা,জমিলার মত মেয়েরা ক্ষণিকের জন্য পেটের খিদে ভুলে সত্যি । 
উত্তরপাড়ার হামিদ মাস্টার মারা গেছে পাঁচ বছর হতে চলল । কাছে কুলে কেউ নেই তার । একমাত্র ছেলেটা নিখোঁজ আজও ।ইটে তৈরি প্রকাণ্ড বাড়িটার চারপাশে জঙ্গল গজিয়েছে অনেক আগেই । লোকে বলে বড়বাড়ি । রাতে শেয়ালের আওয়াজ শুনা যায় বড়বাড়ির চারপাশে । হামিদ মাস্টারের দ্বিতীয় বউ হাসিনা বেগম স্বামীর মৃত্যুর পর বাপের বাড়ি থাকে । বছর দুই আগেও এ পাড়ার জামাল কাজির সাথে যোগাযোগ ছিল তার । জামাল কাজির বড় ছেলে সমু পরমা বলে ডাকতো তাকে । এখন এ পাড়ায় গত সে ।জামাল কাজি হামিদ মাস্টারের বাল্যবন্ধু । মৃত্যুর আগে সে বলেছিল-

-কাছে কুলে কেউ নাই যখন জমিগুলান বউরেই লিখ্যা দেও হামিদ ।
জামাল কাজির কথায় রাজি হয়নি হামিদ মাস্টার । সে বলেছিল-
-না, পুলা যদি ফেরত আসে জমিগুলান ওরে দিও জামাল ।

হামিদ মাস্টারের কথায় সেদিন আপত্তি করেনি হাসিনা বানুও । অসম বয়সের যে মানুষের সাথে সংসার বেঁধেছে সে, আর যায় হোক এখনতো সে সত্ত্বার কেউ । তার কাছে ভালবাসা ছাড়া আর কিবা চাওয়ার আছে ? এরপর একদিন বড়ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় হাসিনা বানু । হামিদ মাস্টার মারা গেছে একটু আগে ।

সমু এখন করাতকান্দি প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার । জামাল কাজির কিনে দেওয়া সাইকেলটা এখনও আছে ওর । মোটা ফ্রেমের চশমাটা পড়ে বাইরে বের হলে সমীহ করে সবাই । বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে হামিদ মাস্টারের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় সমুকে । ওদিকে দৃষ্টি গেলে পুরনো মানুষ গুলোর কথা মনে হয় তার । দুবছর হতে চলল হামিদ মাস্টারের এক বিধবা বোন এসে বসতি গড়েছে এখানে । সাথে জোয়ান ছেলে তার, নাম ভুলা । হাহারামজাদা, হাতে একটা ধারালো চাকু নিয়ে সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে সে । নিরীহ মানুষগুলোর কাছে নিজেকে ডাকু বলে পরিচয় দেয় । লোকে বলে ভুলা ডাকু । ভুলা ডাকু দুর্ধর্ষ, এ পাড়ার কেউ লাগতে যায়না ওর সাথে । করাতকান্দির বখে যাওয়া ছেলেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করেছে সে । রাতে ওদের সাথে মেথর পাড়ার ভাতপচা মদ খেয়ে পড়ে থাকে রাস্তায় । সংসারের ধার ধারেনা । বড়বাড়ির চারপাশে মউসুমি ফলের বাগান । এগুলো বেচেই সারাবছর সুখে দিনাতিপাত করে মা-ছেলে ।

এর মধ্যে একদিন জ্বরে পড়ে সমু । সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার কাদায় পড়ে যায় সে । বৃষ্টির পানিতে ভিজলে গায়ে জ্বর আসে ওর । সে জ্বর কমেনা সহসা । দিন দুই প্রায় অচেতন থাকার পর একদিন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে সকালে । কিন্তু শরীরে শক্তি পায়না সে । হাতের চশমাটা চোখে দিলে উঠানে দৃষ্টি পড়ে ওর । ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে এখনও । সমু হাঁক দেয়-
-মা, আজ কি বার কওতো ?
রাহেলা বানু বলে-বিষ্যুদবার ।
-বিষ্যুদবার! সহসা চমকে উঠে সমু । গত দুইদিন প্রায় অচেতন ছিল মনে নেই তার । উত্তরপাড়ার হারেছ আলীর ছেলে মনা সমুদের বাড়িতে চুক্তি খাটে । সমুর ডাক শুনলে এক সময় এসে ভেতরে দাঁড়ায় সে । হাতে একটা কাগজ দিয়ে সমু বলে-
-কাগজখান তর ঝুমু আপারে দিস মনা ।

উত্তর পাড়ায় হোসেন তালুকদারের বাড়িটা মসজিদের কূলঘেঁষে । পাড়ায় সচ্ছল গেরস্ত সে । ঘরে বউ ছাড়াও একমাত্র মেয়ে আছে তার । নাম ঝুমু । সমুর সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছে সে । ওদের সম্পর্কের বয়স হয়েছে বেশ । এখন সম্পর্কে স্থিত হওয়ার স্বপ্ন দুজনের । সময় পেলে গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটে ওরা । নিতাই মাঝির ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যে বড় সড়কটা শহরমুখী চলে গেছে তার পাশে বসে গল্প করে দুজন ।

এর কিছুদিন পর একদিন করাতকান্দি গ্রামে অপরিচিত মুখের আগমন ঘটে হঠাৎ । এক বিকেলে হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে ভেজা কাকের মত নিজ বাড়িতে ফিরে আসে তারেক । তারেকের কথা মনে আছে ? হামিদ মাস্টারের ছেলে-বাবার সাথে অভিমান করে একদিন নিরুদ্দেশ হয়েছিল সে । সেই তারেক ফিরে এসেছে পনের বছর পরে । ও নিরুদ্দেশ হওয়ার পর বছরে একটা দুটো চিঠি লিখত বাবার কাছে । কিন্তু গ্রামে আসেনি কোনদিন । হামিদ মাস্টার মারা যাওয়ার আগে ছেলেকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল খুব । কত খুঁজেছে ওকে, সন্ধান দিতে পারেনি কেউ । তারেক ফিরে এলে গাঁয়ের মেয়েরা বলাবলি করে-
-হুনছনি বু, হামিদ মাস্টরের পুলানি ফেরত আইচ্যা কাইল ।
-হাঁচানি,বাপের ভিটায় বাতি জ্বলব মালুম অয় ।

তারেকের ফেরার সংবাদে কিছুদিন জটলা করে গাঁয়ের ছেলেবুড়োরা । কুশলাদি জিজ্ঞেস করে ওর । এতদিন কোথায় ছিল, কি করত এসব কথা জানতে চায় সবাই । এদিকে তারেকের ফেরার খবর মনার মাধ্যমে জানতে পারে জামাল কাজি । তারপর লোক মারফত খবর পাঠায় সে-তারেক যেন একবার দেখা করে ওর সাথে । বয়সের ভারে ন্যুব্জ কাজি হাঁটতে পারেনা এখন । লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ালে শরীরটা ঠকঠক কাঁপে তার । অবশেষে খবর পেয়ে তারেক স্বয়ং একদিন দেখা করতে যায় কাজি বাড়ি । তারেক এলে আহাজারি করে জামাল কাজি-

-আইলাগো বাজান ? এতদিন পরে যে, বাপ আর নাইগো তোমার ।
সহসা জবাব দেয়না তারেক । এ কথার উত্তর কি হতে পারে জানা নেই তার ।ও চুপ করে থাকলে জামাল কাজি আবার বলে-“ মরুন কালে তোমারে দেখুনের সাধ অইচিল তোমার বাপের,কত খুঁজলাম পাইলামনা তোমারে ”।
-আপনের শরীর কেমুন কাকা?
-ভালা, আইছ যহন যাইওনা আর । মিসতিরি খবর দেও,ঘরখান মেরামত কর তাইল্যা ।
-একলা মানুষ ......... ?
-বউরে নিয়া আহ বাজান । বাপের ভিটা ফেলায় রাখুন ভালানা ।
ঐদিনইফেরার পথে সমুর সাথে দেখা হয় তারেকের । তারপর চোখাচোখি হয় দুজনের । সমু দৃষ্টি সরিয়ে নিলে তারেক হাঁক দেয়-
-আমারে ভুইল্যা গেচিস গুল্লু ?
গুল্লু বললে পুরনো কথাগুলো মনে হয় সমুর । ছোটবেলায় গুলগুলি খাওয়ার নেশা ছিল ওর । তারেকের পকেটের টাকা কতবার ওর পেছনে খরচ হয়েছে তা কি ভুলা যায় ?রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের সাথে গল্প করে সমু । এক এক করে সবার কথা মনে হয়তখন ।

করাতকান্দি গ্রামে হামিদ মাস্টারের বাড়িটা শহরমুখী সড়কের কূলঘেঁষে । মস্তবাড়ি । একপাশে তার মৌসুমি ফলের বাগান,অন্যপাশে প্রকাণ্ড বাঁশঝাড় । গ্রীষ্মের উন্মত্ত সূর্যও এখানে মৃত প্রায় । বাড়িতে দিনের এলো পড়েনা সহসা । হামিদ মাস্টারের গোছান সংসার । স্ত্রী খোদেজা বেগম ছেলেকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন দেখে । হামিদ মাস্টার খেতে বসলে হাতপাখায় বাতাস করে সে । এরপর একদিন রোগে পড়ে খদেজা বেগম, পচনরোগ । দেশি-বিদেশী কত কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হয় রোগ ছাড়েনা তার । শরীরের মাংস পচে পোকা ধরে স্বস্থানে । তারপর আর বেশীদিন বাঁচেনি খোদেজা বেগম । শেষ মুহূর্তে প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য হামিদ মাস্টার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিল । স্ত্রীশোকে ভেতরে ভেতরে অশ্রু বিসর্জন দিত সে । মরার আগে খোদেজা বেগম বলেছিল- 
-আপনেরে একখান কতা কমু, রাখবেননি ?
-নিয্যস,কও হুনি ।
-আমি মরে গেলে একখান নিকা কইরেন আপন্যা,একলানি থাকুন যায় ?
প্রিয়তমা স্ত্রীকে সেদিন মিথ্যে আশ্বাস দেয় হামিদ মাস্টার । ভালবাসা দেহে হয়,মনেও । সব নারীতেই দেহক্ষুধা নিবারণ হয় হয়ত কিন্তু মনক্ষুধা ? খোদেজা বেগমের সত্ত্বায় যে রস আস্বাদন করেছে হামিদ মাস্টার, পরনারীতে সাধ্য কই ?
খোদেজা বেগম মারা যাওয়ার পর হামিদ মাস্টারের সংসারটা বদলে যায় দ্রুতই । মেয়েমানুষহীন সংসার হয়না । স্নেহপাগল তারেকের দিকে দৃষ্টি গেলে ভেতরটা আঁকুপাঁকু করে তার । কাজিবাড়িতে তখন আনাগোনা বাড়ে হামিদ মাস্টারের । বন্ধু জামাল কাজির সাথে বসে খোশ গল্প করে সে । কাজি বলে-
-এবার একখান নিকা কর হামিদ ।
-নিকানি ? পুলার গোস্যা অইবো মুনে কয় ।
-গস্যানি, মিছা কতা ।মাইয়া মানুষহীন সংসার অয়না ভাই ।

এরপর সত্যি একদিন বিয়ে করে ঘরে দ্বিতীয় স্ত্রী আনে হামিদ মাস্টার ।কেন যেন, পিতার এহেন কর্মে খুশী হয়না তারেক । কে জানে,নিজের মায়ের জায়গা হয়তো পরনারীতে দিতে নাখোশ সে । হাসিনা বেগম মানুষ ভাল, দেখতেও বেশ ।অসম বয়সের স্বামী, অনাকাঙ্ক্ষিত পুত্র-তাদের নিজের বলে মেনে নিতেদেরী হয়না তার । গাঁয়ের মেয়েরা বলাবলি করে-
-হুনছনি বুজান, মাস্টারের বউ দেহি বেটির বয়স ।
-ছি! ছি! তবা তবা, সুরতে কালি মাখল মালুম অয় ।
স্কুলে গেলে গাঁয়ের ছেলেরা ক্ষ্যাপায় তারেককে । ওদের ক্লাসের মতি কালো পাঠার মত চেহারা, সারাদিন তারেকের পেছনে পড়ে থাকে সে । একদিন ওর সাথে কলহ হয় তারেকের । মতি বলে-
-জুয়ান মায়ের সোহাগ কেমুন কত হুনি ?

এরপর মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে নিরুদ্দেশ হয় তারেক । সেবার হামিদ মাস্টার কত খুঁজেছে ওকে, পায়নি কোথাও । মাস দুই পর একটা চিঠি এসেছিল ডাকহরকরার মাধ্যমে । তারেকের চিঠি । তাতে লেখা-“নিরুদ্দেশ হলাম বাজান, খুঁজোনা আমারে ”। এরপর শহরে কত কষ্ট করেছে তারেক । বাবার কাছে সহযোগিতা নেয়নি কোনদিন । সেই তারেক ফিরে এল এত বছর পর । কেন এল সে ? নিজের প্রাপ্য বোঝে নিতে নাকি অন্যকোন কারণ আছে তার ? ব্যাপারটা ভাবায় সমুকে ।
আজকাল প্রায়ই তারেককে বাবা-মার কবরের পাশে দেখা যায় । সাথে আনা সাদা রঙের চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বসে থাকে সে । শরীর ভাল নেই । চোখগুলো দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে ওর । পুরনো অসুখটা বেড়ে গেছে হঠাৎ । নাকে-মুখে ঘা হতে শুরু করেছে এখন । প্রস্রাব হয়না সহসা, প্রস্রাবের রাস্তায় রক্ত আসে মাঝেমাঝে । খোদেজা বেগম মারা যাওয়ার আগে এমন হয়েছিল তার ।  এখানে একাকী জীবনে অরুকেও মনে পড়ে খুব । অরুর কথা মনে আছে ? তারেকের বউ । একই কলেজে পড়েছে ওরা । তারপর বিয়ে করেছে নিজেদের পছন্দে । আলীপুর শহরে একটা টিনের দুচালা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো দুজন । অভাব ছিল,ভালবাসার কমতি ছিলনা কোনদিন । সেই অরুকে ছেড়ে এসেছে তারেক । আসার আগে কলহ করে এসেছে সে । কে জানে এখন কেমন আছে অরু ? আজকাল ওকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব । যেদিন অরুকে ফেলে তারেক চলে আসছিল সেদিন কতনা কেঁদেছে মেয়েটা ! ওর দিকে তাকিয়ে দয়া হয়নি পাষণ্ডটার । অরু বলেছিল-
-আমাকে সাথে নাও সোনা, তুমি ছাড়া বাঁচবনা আমি ।
ওর কথা শুনে ধমকেছিল তারেক । বলেছিল-
-ছেড়ে দাও এবার । সংসারে বিতৃষ্ণা এখন ।

সেদিন বাসা থেকে বেরিয়ে তারেকও কেঁদেছিল গোপনে । উপায় ছিলনা তার । ভঙ্গুর জীবনে অরুকে 
কোনদিন স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারেনি সে । জীবন আকাশে ডুবন্ত সূর্যের বেলায় রৌদ্রজ্জ্বল পৃথিবী দেওয়ার  সামর্থ্য কই ? তার চেয়ে কষ্ট পাক অরু,তবু যদি সুখী হয় কোনদিন । সঙ্গীবিহীন জীবন চলেনা, সান্ধ্যকালে এসে আজ অন্তত এতটুকু বোঝতে পেরেছে তারেক । সেদিন হাসিনা বেগমের বউ হয়ে আসা এক অর্থে ঠিক ছিল হয়তো । সে না এলে একাকী জীবনে হামিদ মাস্টার কতদিন বাঁচত বলতো ?
এরই মধ্যে একদিন ঝুমুর সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয় সমুর । হোসেন তালুকদার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে অনেকদিন ধরে । ঝুমুকে সংসারী দেখে হজে যাওয়ার ইচ্ছে তার । সম্প্রতি পাত্র একটা পেয়েছে সে । ছেলে ভাল, দেখতেও বেশ । তবে রাজি নয় ঝুমু । কারণ জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর দেয়না সে । ফলশ্রুতিতে মেয়েকে মারে হোসেন তালুকদার । এরপর একদিন নদীপাড়ে নৌকার গলুইয়ে বসে কথা বলতে দেখা যায় দুজনকে । ঝুমু বলে-
-কিছু কওনা যে সমু ভাই ?
সমু কথা বলেনা সহসা । জামাল কাজির কথা মনে হয় তার । অসুস্থ সে । এ সম্পর্ক সেও মেনে নিবেনা এখন । সমু চুপ করে থাকলে ঝুমু আবার বলে-
-মুখখান দেখাইওনা আর । পুরুষ মানুষ এমুননি ?
তারপর মন খারাপ হলে তারেকের কাছে আসে সমু । তারেকের শরীর খারাপ বিচলিত করে তাকে । সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনা তারেক । সে বলে-
-ঝুমুরে এবার ঘরেনে সমু, মেয়েটা ভাল দেখি ।
তারেক হঠাৎ ফিরে আসায় গাঁয়ের সবাই খুশী হলেও মনে মনে হয়তো খুশী হতে পারেনা হরবলা বিবি । এতদিন যে সম্পত্তি একা ভোগ করে আসছিল সে, তা হঠাৎ হারানোর আশংকা হয় তার । পাড়ার মেয়েদের সাথে কথা বললে ভাইপোর নামে কুৎসা রটনা করে সে ।
-পুলানি,কেমুন পুলা কওতো, বাপ মরলে আহেনা যে ? এমুন পুলার মুখে ঝাঁটা ।
তারেক বোঝতে পারে সবই । ভুলাও কেমন চোখ বড় বড় করে তাকায় আজকাল । তারেককে দেখিয়ে চাকু ধার দেয় সে । বখে যাওয়া ছেলেগুলোর সাথে কি সব পরামর্শ করে যেন ।
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে অবাক হয় সমু । বাড়িতে ঝুমুকে দেখে রীতিমত চমকে উঠে সে । অন্দরে দৃষ্টি দিলে দেখে দশ বারো জন মানুষ কি সব বলাবলি করছে । রাহেলা বেগম বলে-
-ঝুমুরে আমার খুব পছন্দ, তর পছন্দ কস নাই যে ?
পরক্ষণে সবকিছু বোঝতে পাড়ে সমু । সেদিন তারেকের কাছে গেছিল ঝুমু । কি যেন বলে এসেছে তাকে । তারপর তারেক স্বয়ং এ সবের ব্যবস্থা করেছে এখন । দৃষ্টিগোচর হলে তারেক বলে-
-আজ যার হাত ধরেছিস, ছাড়িসনা গুল্লু । সঙ্গীহীন মানুষ বাঁচেনারে ।

এরপর দিনে দিনে তারেকের অসুস্থতা বাড়ে আরও । তাড়াইল বাজারের বিরু ডাক্তার এসে স্যালাইন দিয়ে যায় ওকে । তারপর একদিন সকালে একটা বুনো গন্ধে ঘুম ভাঙে তারেকের । ঘরে কোথাও ইঁদুর মরেছে হয়তো । দিনের আলো তখনও ফোটেনি । বড় ঘরের দরজা খোলে দেখে অরু দাঁড়িয়ে । চোখাচোখি হলে রীতিমত চমকে উঠে তারেক । এ বাড়ির খবর জানার কথানা ওর । তবুও অরু চলে এসেছে কেমন করে যেন । এটাযে সম্পর্কের টান, ভেতরে যে সঙ্গীহীন রিক্ততা । এ ভাবনা কারও মনে আসেনা তখন । তারপর মান-অভিমানের একপালা গান হয় দুজনের মধ্যে ।
কয়েক বছর আগের কথা । সেবার খুব অসুস্থ হয়েছিল অরু । তারেকের মত । ডাক্তার বলেছিল কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা । সরকারী অফিসের ছাপোষা কেরানি, কতবা বেতন হতে পারে তারেকের। দুবেলা ডালভাত জোগান দেওয়ার সামর্থ্য ছিল হয়ত । স্ত্রীর চিকিৎসা নয় । ভালবাসা পাগল মানুষটা মরিয়া হয়েছিল সেদিন । নিরুপায় হয়ে নিজের একটা কিডনি দিয়েছিল অরুকে । সত্যিটা আজও জানা হয়নি অরুর । অবশেষে একদিন সমুর কাছে সত্য উন্মোচিত হয়, ততদিনে ছাড়পত্র এসে গেছে তারেকের । সমু বলে-
-জমিগুলান বেচো তারেক ভাই, চিকিৎসা কর নিজের ।
রাজি হয়না তারেক । সে বলে-
-দুর্দিনে যে বাপের কাজে আসি নাই, আজ নিজের জন্য তার সম্পদ ব্যবহার করি কি করে বলত? এত অকৃতজ্ঞও মানুষ হয় ?

তারেকের বউ অরু সন্তান সম্ভবা । আজকাল নিজের সন্তানের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে তার । পরক্ষণে সন্দেহ হয় ছাড়পত্রের মেয়াদ কতদিন ? তারপর রাতে পুরনো অতীতগুলো মনে করে সুখ-দুঃখের একপালা গান রচনা করে দুজন । পরমুহূর্তে তারেক বলে-
-কথা দাও সোনা । 
অরু বলে, কি ? 
-আমি মরে গেলে আবার বিয়ে করো তুমি । সঙ্গীহীন বাঁচা দায় ।
সহসা তারেকের কথার জবাব দেয়না অরু । চোখাচোখি হলে অশ্রু বিসর্জন দেয় দুজনই ।