গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

নির্মলেন্দু কুন্ডু

বিধান

—"না,না,তুমি যা বলছো,তা কিছুতেই সম্ভব নয় ৷"
—"কেন সম্ভব নয় অর্চিতা ! আমার প্রতি তোমার কী কোন ফিলিংস নেই ?"
—"আছে,তবে সেটা নিখাদ বন্ধুত্বের ৷"
শুধুই কী বন্ধুত্বের ?তাহলে আমি আঘাত পেলে তোমার অত কষ্ট হয় কেন ? জ্বর হলে কেন বুবাইকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসে সময় কাটাও ? কেন মন্দিরে আমার নামে পুজো দাও ? কেন আমার লেখা কবিতার বই তোমার বালিশের নিচে পাওয়া যায় ?"
—"উফ্ ,থামো সুপর্ণ,থামো....আমি আর শুনতে পারছি না ৷"
—"সত্যি কথা বলেই কী এত তীক্ষ্ণ লাগছে,অর্চিতা?বুকে হাত দিয়ে বলো তো,তোমার মনে আমার কোন জায়গা নেই ৷"
—"আমি....আমি জানি না....এ সম্ভব নয়...লোক কী বলবে ? সমাজ....সমাজ এসব মেনে নেয় না এখনো!"
—"লোক....সমাজ...! তুমি এরপরেও এসবের পরোয়া করো ? অভিজ্ঞানের হঠাৎ চলে যাওয়ায় তোমার তো কোন হাত ছিল না ৷ তবে কেন ওরা তোমায় বাড়িছাড়া করলো ? কেন তোমাকে তোমার বাড়িতেই শত লজ্জা নিয়ে থাকতে হয় ? কেন কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে পাড়ার কেউ তোমাকে ডাকে না ?"
—"এসব তো সমাজেরই বিধান..."
—"কীসের বিধান ? সমাজ গড়ে মানুষ ৷ যে বিধান মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, সে বিধানটাই তো অসামাজিক ৷"
—"তুমি বুঝছো না...এটা পাগলামি হচ্ছে"
—"পাগলামি ! তবে তাই....তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম পাড়ায়, সেদিন থেকেই পাগলামির শুরু৷আমাকেও তো তোমার ভালো লাগত৷তারপর ভাগ্যের ফেরে হলে অভিজ্ঞানের ঘরণী৷কিন্তু এখন,ওর চলে যাওয়ার পর,তুমি তো একা ৷ গোটা জীবন তুমি কাটাবে কী নিয়ে ? অভিজ্ঞানের প্রতি আমার কোন ঘৃণা বা রাগ নেই, কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা আছে....নিখাদ, নিষ্কলঙ্ক ৷ কোন কিছু পাওয়ার আশায় আমি তোমার দিকে হাত বাড়াইনি ৷ আমি শুধু চেয়েছি তোমায়,আমার মিষ্টি অর্চিকে...."
—"সুপর্ণ!!এ কোন্ বাঁধনে জড়াচ্ছো আমায়?জানি না,এর পরিণাম কী হবে?"
—"সব ঠিক হয়ে যাবে,দেখো৷"

কথাটা জানাজানি হতে অবশ্য দেরি হল না৷সমাজপতিরা হামলে পড়লেন দুজনের ওপর৷গাঁয়ের চন্ডীমন্ডপে বসলো বিচারসভা৷বলা হতে লাগলো নানা রসালো কিসসা৷দুজনের অভিভাবককেই হতে হল চরম হেনস্থা৷দুই পরিবারকে একঘরে করে এক লাখ টাকা করে জরিমানা ধার্য করা হল৷পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি৷তাই ইচ্ছা থাকলেও ছেলে-মেয়েটার আর কোন ক্ষতি ওরা করতে পারলো না৷

এরপর ব্যাপারটা থিতিয়ে গেল আস্তে আস্তে৷অর্চিতা হয়ে পড়লো ঘরবন্দি৷যাওয়ার মধ্যে শুধু মন্দিরটুকু৷সেখানেও জুটল প্রাত্যহিক লাঞ্ছনা৷সুপর্ণকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কলকাতায়,কাজে৷হঠাৎ একদিন শোরগোল উঠলঅর্চিতাকে পাওয়া যাচ্ছে না৷খোঁজ-খোঁজ রবের মধ্যেই কেউ একজন কলকাতায় অফিসে ফোন করে জানতে পারলো সুপর্ণ দু'দিন থেকে নিখোঁজ৷হিংস্র শ্বাপদের মতো সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো গাঁয়ের আনাচে-কানাচে৷এবার চরম শাস্তি৷কিন্তু নাঃ,কোথাও পাওয়া গেল না দুজনকে৷

একদিন পর দেখা গেল,পাশের ভুবনডাঙা স্টেশনের কাছে রেললাইনের পাশে দুটো লাশ,হাত ধরাধরি করে,যেন এক্ষুনি হেঁটে যাবে ওদের গন্তব্যে,দিকশূন্যপুরে.....