গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

আবু রাশেদ পলাশ


মা


কঠিন স মানুষের কাছে তার জীবনে দুঃসময় যেন জানা ছিল তার । ভালবাসা প্রত্যাশী এ জীবনে এক মুঠো সুখের জন্য সংগ্রাম করেছে সে । যে সংসার নিজের হাতে তৈরি করেছে এতকাল আজকাল সেখানেও কেন যেন অস্তিত্বহীন ঠেকে নিজেকে । ভাবনা হয় নিজের ঘরে কতটুকু নিরাপদ সে ! এক এক করে দিন গেলে সম্পর্ক ফিকে হয় আরও । তারপর একদিন নিজ শয্যায় মেয়ে মানুষের গোঙানোর আওয়াজ শুনা যায় হয়তো ।
মোহনপুর গ্রামে শফিমোল্লার বড় বাড়ী । ধনু নদীর তীর ধরে যে কাঁচা সড়কটা উত্তরে প্রবাহিত তার ঠিক শেষ মাথায় বড় বাড়ীটা । স্থানীয়দের ভাষায় খুনকার বাড়ী । এ পাড়ায় পোক্ত গৃহস্থ শফিমোল্লা । বাড়ীতে পাকা দালান আছে তার । গোয়ালে হালের বলদ আর চাষবাসের জন্য বিস্তর সম্পত্তি । কখনও কখনও মানুষের মূল্যায়ন অর্থেও হয় । সে ক্ষেত্রে সংসারে সচ্ছলতার ঘাটতি নেই শফিমোল্লার । পাড়ায় দাপুটে মানুষ সে । সবাই সমীহ করে তাকে । পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও চার ছেলে আর একমাত্র কন্যা আছে তার ।
শফিমোল্লার সন্তানদের মধ্যে ছেলেরা বড় । পরপর চারটি ছেলে সন্তানের পর আলেয়া বেগমের মেয়ে সন্তান প্রসব পুলকিত করে এ বাড়ীর সবাইকে । খুশীতে হালের বলদ জবাই করে পাড়ায় ভোগ দেয় শফিমোল্লা । তবে মনে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়না তার । মেয়ের গাঁয়ের রঙ যে পাড়ার অন্য দশটা মেয়েদের থেকেও ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ এটা ভেবেই কেন যেন ভেতরে আফসোস হয় পরমুহূর্তে  সত্য হয়তো আজন্মকাল অপ্রকাশিতই থাকে তবে ভেতরে চাপাকষ্ট পোষে রাখে সে । খুনকার বাড়ীতে সন্তানের আগমন পাড়ায় উৎসাহ সৃষ্টি করে ঘরে ঘরে । গাঁয়ের বউ-ঝিরা মেয়ে দেখে কানাকানি করে-
-হুনছনি চাচি, খুনকার সাবের বউ বেটি বিয়াইছে কাইল ?
-হাঁচানি, সুরত কেমুন কওতো ?
-এককেরে কাইয়্যার ডংগো চাচি । দেকক্যা আহ পিত্তি জ্বলে ।
উত্তর পাড়ার হরবলা বিবি সম্পর্কে দাদি হয় তিতলির । শফিমোল্লার দূরসম্পর্কের আত্মীয়া । নবজাতকের মুখ দেখতে এসে রীতিমত হৈচৈ করে সে । খুশি মনে প্রথম আঘাতটা হয়তো সেই দেয় বাড়ীর সবাইকে 
-আয়গো খোদা ভাইপোর ঘরে বেটিনি ? অমুন সুরত জম্মে দেহিনায়গো ।
কিছুদিন এভাবেই মোহনপুর গ্রামের ঘরে ঘরে শফিমোল্লার মেয়েকে নিয়ে কানাকানি করে বউরা । তারপর একদিন হয়তো পার্শ্ববর্তী গ্রামে খবর পৌঁছায় । আত্মীয়তার ছল করে অথবা অল্পপরিচিত কারও মাধ্যমে আরও সুদূর কোন গাঁয়েও হয়তো সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত খবর পৌঁছে একদিন । সে গাঁয়ে শফিমোল্লাকে চোখে দেখেনি কেউ  কিন্তু নাম শুনেছে তার । বিকেলে পার্শ্ববর্তী চায়ের দোকানে বসে হয়তো একদিন গল্পে মজে তাকে নিয়েই ।
-হুনছনি কাহা, খায়ের ঘরেনি কাউয়া বিয়াইছে বউ ?
-হাঁচানি, কেডা কইলো কওতো ?
-গণ্ডামারা গেদুমুন্সী মিছা কওনের মানুষনি ?
তারপর দিনে দিনে বয়স বাড়ে তিতলির । এক এক করে জীবনের নিগুঢ় সত্যগুলোকে একদিন বোঝতে শিখে সে । আলেয়া বেগম বাজার থেকে কিনে আনা সস্তাদরের প্রসাধনী মেখে মেয়ের রঙ ডাকার চেষ্টা করে লোকসমাজে । প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলেনা তিতলির । পাশের বাড়ীর ছকু,মকু আর হনুফা খেলাধুলার ছল করে জল কাদায় গড়াগড়ি খায় । ওদের দেখে উৎসাহী হলে চোখ রাঙায় আলেয়া বেগম ।
-ঠ্যাং ভাঙুম ডরাইস কলাম । বাপের গোস্যা অইবো ।
অতিউৎসাহী ভাইদের মধ্যেও বোনের প্রতি ভালবাসা অকৃএিম । প্রত্যহ সন্ধ্যায় বাজার থেকে ফেরার পথে বাহারি খেলনা কিনে আনে সবাই । কিন্তু এসবে আগ্রহবোধ করেনা তিতলি । অন্তরাত্মা যখন বাইরের টানে ব্যাকুল হয়, ভেতরে স্বর্গসদৃশ জীবন ব্যবস্থাকেও তখন নরক মনে হয় সবার কাছে । একাকী আবদ্ধ জীবনে হয়তো নিজেকে খাঁচায় বন্ধী পাখি মনে হয় তিতলির । ভেতরে বিনাভাষী আর্তনাদ হয় তবুও সহসা অনুমতি মিলেনা আলেয়া বেগমের । মাঝে মাঝে রশিদের মেয়ে হনুফা এসে খেলা করে ওর সাথে । ও এলে পুতুল বিয়ের আসর জমায় দুজন । তিতলি বলে-
-ল, পুতুলের বিয়া দেই আইজ । পুলা কই আমার ? হনুফা বলে-
-নিয্যস, আমি আইজ বেটি লমু কলাম ।
পাড়ায় হনুফার সাথে গলায় গলায় ভাব হয় তিতলির । সুযোগ পেলে দুজনে বসে খোশ গল্প করে ওরা । তারপর আরেকটু বড় হলে হয়তো মায়ের নিষেধের কারণ বোঝতে পারে তিতলি । দিনে দিনে বাইরের জগতে অতৃপ্তি আসে তার । সবার মধ্যে নিজেকে কেমন বেমানান ঠেকে যেন । তবুও দিনের পর দিন যে ব্যাপারগুলোকে এড়িয়ে চলতে চায় সে, কেন যেন বারংবার সে সত্যিগুলোই সামনে এসে দাঁড়ায় ওর । গায়ের রঙ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিব্রত হয় আরও বেশী । তারপর প্রায়ই ঘরে এসে বিছানায় অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । পশ্চিমপাড়ার আহালুর বউ জুলেখা দিন মজুরীর খোরাক নিতে এসে তিতলিকে নিয়ে কথা উঠালে প্রতিবাদ করে আলেয়া ।
-মিছা কওকে বউ, বেটি মোর কালানি ? সুরত শ্যামলা মালুম অয় ।
মোহনপুর প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ভাল কোন বন্ধু পায়না তিতলি । সহপাঠীদের মধ্যে কেউই খুব আগ্রহ করে মিশতে আসেনা ওর সাথে । অথচ পড়াশোনায় কত ভাল সে ! একই ক্লাশের হাসু মাঝেমাঝে ওর সাথে দুএকটি কথা বলে এই যা । তবুও দিন শেষে হাসুকেই একমাত্র বন্ধু মনে হয় তিতলির । টিফিন পিরিয়ডে ছেলেমেয়েরা স্কুলের মাঠে বউছির আসর জমায় । তিতলি নিশ্চুপ বসে থাকলে হাসু খেলায় নিতে চায় ওকে । সে বলে-
-লও খেলি এক লগে ?
হাসুর কথায় আগ্রহবোধ করেনা অন্যরা । একই ক্লাশের জরি বলে-
-শিগগির আয় হাসু । হেরে নিমুনা কেউ 
হঠাৎ কি বোঝে সহপাঠীদের কথায় রাজী হয়না হাসু । তিতলির সাথে বসে খোশগল্পে মাতে সে । যৌক্তিক আর অযৌক্তিক বাক্যের মিশেলে নানা আজগুবি গল্প । রূপকথার ন্যায় । তারপর মাঝেমাঝেই একাকী থাকলে হাসু এসে ভাব জমায় তিতলির সাথে । ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয় ওদের মধ্যে ।
তিতলি আর হাসু একই ক্লাশে দশ বছর সহপাঠী । কত সুখ দুঃখের স্মৃতি ওদের ! এরপর কি ভেবে স্কুলে শেষ বর্ষে এসে দুজনের বন্ধুত্ব প্রেমময় সম্পর্কে গড়ালো  যাদের দেহের চামড়া কাল তারাও দর্শননন্দিত তিতলিকে দেখে হয়তো তাই মনে হয় হাসুর । না হলে দুরন্ত যৌবনের প্রথম বেলায় কোন পুরুষের চোখে নিজেকে দেখার কারণ খুঁজে পায়না মেয়ে । তিতলি কালকেশী, কালরঙা আর ওর কাল হরিণ চোখ । তাতে কি, গুণেরতো অভাব নেই ওর । আমরা যারা চামড়ার চক্ষু দিয়ে মেয়েদের সৌন্দর্য খুঁজি ,তিতলিদের আসল সৌন্দর্য বোঝার সামর্থ্য নেই তাদের । ওরা যে চন্দ্রমুখী । জানো,ওরা যে আকাশে প্রজ্বলিত হয় সেখানেই জোছনা ছড়ায় নিগুঢ় আমাবস্যাতেও ।
তিতলি আর হাসুর সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কোন কারণে  ভালবাসা দেহ মন মিলে হয় ।হাসুকে কোনদিন নিজের করে পায়নি তিতলি । উঠতি যৌবনে মেয়েদের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মাংস বৃদ্ধি পায় আর ছেলেদের চাহনির গাঢ়ত্ব । সামনে বিপরীত লিঙ্গের কেউ দৃষ্টিগোচর হলে ক্ষুধার্ত চোখদুটো রীতিমত চিবিয়ে খেতে চায় ওদের । নবকৈশোরে লোকচক্ষুর অন্তরালে কতবার তিতলির দেহে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে হাসু ! কদিন না যেতেই সত্যিটা বোঝতে পারে তিতলি । হাসুরা কাল মেয়েদের সাথে দেহের আদান প্রদানে যত আগ্রহী, মন বিনিময়ে ততটায় অনাগ্রহ ওদের ।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিতলির মনে হয় এবার হয়তো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে সবার । কিন্তু ওকে কলেজে পড়াতে রাজী হয়না বাড়ীর কেউ । বুড়ো হরবলা বিবি ভাইপোর বাড়ীতে বেড়াতে এসে প্রথম অনাগ্রহ প্রকাশ করে ।
-মাইয়্যা বশ করবিনি শফি ? পুলা দেকক্যা বিয়া দে শিগগির ।
আলেয়া বেগমও আপত্তি করে তিতলির ইচ্ছায় । সে বলে-
-অতো পইড়্যা কি অইবো কন দেহি ? শিগগির পুলার খোঁজ নেন ।

অবশেষে মেয়ের বিয়েতে আগ্রহী হয় শফিমোল্লা । ভাইয়েরাও পাড়ায় পাড়ায় ছেলের খোঁজ করে । হোসেনপুর গ্রামের আরজু ঘটক । ছোট দারকিনা মাছের মত দেখতে । তিতলির বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় আনাগোনা করে সে । সুযোগ বোঝে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় শফিমোল্লার কাছ থেকে । এক এক করে অর্ধশত পাত্রের সম্বন্ধ আনে সে । কিন্তু সম্পর্ক হয়না কোথাও । ছেলেপক্ষ আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসে ফেরত যায় শেষমেশ । যা হোক এরই মধ্যে আবার বিয়ের সম্বন্ধ আসে তিতলির জন্য । পাত্র দাসপাড়া গ্রামের দাগন ভুঁইয়ার ছেলে সোলেমান । দেখতে ভাল, গঞ্জে ব্যবসা আছে নিজের । শফিমোল্লা বলে-
-হগগল খোঁজ ভালানি আরজু ? আরজু বলে-
-হ, মিয়া ভাই পুলা সরেস । বিয়া মুনে কয় পাক্কা ।  
বিকেলে নূরআলীর চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় গেঁয়োরা । শফিমোল্লার মেয়েকে নিয়ে কানাঘুষা করে সবাই ।
-খুনকার সাবনি পুলা দেহে মনা ? বেটির বিয়া দিব হুনি ।
-লক্কনে বুঝন ভার । নাউয়ের বশ করে মালুম অয় ।                  
যাহোক, খুনকার বাড়ীতে পাত্র আসার উছিলায় একটা হৈ হৈ রব বিরাজ করে সবার মধ্যে । ভাইয়ের বউয়েরা আসর জমায় তিতলিকে নিয়ে  তারপর তামাশায় মাতে কতক্ষণ । এসবে আগ্রহবোধ করেনা তিতলি । আমাদের দেশে মেয়ে দেখা কোরবানির হাটে গরু কেনার শামিল । দাঁত হতে দেহের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরখ করে নেয় ছেলেপক্ষ । বারবার ওদের সামনে এভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে ভাল লাগেনা মেয়ের  তবুও কাল চামড়া ডাকতে দামী প্রসাধনী ব্যবহার করে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে হয় তাকে । ওকে দেখে কানাঘুষা করে সবাই । ছেলের সাথে আসা ঠাট্টার সম্পর্কের একজন বলে 
-মাইয়্যা দেহি চাঁদরূপ, সরেস কপাল দেউরার ।

কথাটা হয়তো আহত করে উপস্থিত সবাইকে । যাহোক, এবারের সম্বন্ধটা হাতছাড়া হয়না তিতলির । ওকে দেখে যাওয়ার কদিন পর দাগন ভূঁইয়া খবর পাঠায় এ বাড়ী আত্মীয় করতে আগ্রহী সে তবে শর্ত আছে সামান্য । বিয়ের সব খরচ বহন করতে হবে শফিমোল্লাকে, সাথে মোটা অংকের নগদ টাকা । কথা শুনে আপত্তি করেনা শফিমোল্লা । কালো মেয়ের জীবনে যেখানে ছেলে পাওয়ায় দুষ্কর । সেখানে সোলেমান মন্দ কি ? সুখী হবে মেয়ে । তারপর একদিন শাস্ত্র মেনে বিয়ে হয়ে যায় তিতলির ।
নতুন সংসারে এসে দ্রুত পাকাপোক্ত গৃহিণী হয় তিতলি । শ্বশুরবাড়ীর মানুষগুলোকে নিজের বলে মেনে নিতে সময় লাগেনা তার । যদিও মাঝেমাঝে কফিরন্নেসার তীক্ষ্ণ বাক্য বানে আক্রান্ত হয় সে, তথাপি সংসার খারাপ লাগেনা ওর । বুড়ো কফিরন্নেসা, মোটা পটকা মাছের মত মানুষটা সারাদিন তিতলির পেছনে পরে থাকে সে । মাঝেমাঝে ধমকায়-
-কেমুন বেটি কওতো, ঘরের কামনি করুম মুই ?
তারপর হয়তো বাপ-মা নিয়ে শ্রাব্য অশ্রাব্য কতগুলো কথা শুনিয়ে দেয় তিতলিকে । মাঝেমাঝে দাগন ভূঁইয়া স্ত্রীর এমন ব্যবহারে বাঁধ সাধে । পরমুহূর্তে স্ত্রীকে আড়ালে ডেকে কানাঘুষা করে অনেকক্ষণ । দাগন ভূঁইয়ার অসচ্ছল সংসারে আজ যে ভাতের অভাব সামান্য তা কেবল তিতলির কারণেই । বিয়ের সময় সোলেমান কে মোটা অংকের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে শফিমণ্ডল ।
তিতলির বিয়ের কদিন পর ভুঁইয়া বাড়ীতে বেড়াতে আসে আহাদ আলী । নিজের চোখে বোনের গোছান সংসার দেখে পুলকিত হয় সে । আহাদ এলে ওকে পাশে বসিয়ে খোশগল্প করে দাগন ভূঁইয়া  বাড়ীর অন্যদের কুশল জানতে চায় সে । কফিরন্নেসা তাগিদ দেয়-
-খাড়ায় থাইকোনা বউ । মিয়ারে অজুর পানি দেও শিগগির ।
রাতে তিতলির ঘরে বসে খোশ গল্প করে ভাই বোন । হগগল ভালানি বইন ?” জিজ্ঞেস করলে তিতলির সহজ স্বীকারোক্তি-
-হগগল ভালা মিয়া ভাই । পরদিন ফেরার পথে সোলেমানের হাতে মোটা অংকের টাকা গুঁজে দেয় আহাদ । তারপর বলে-
-এইগুলান থও ভাই । নাগলে আবার কইও 
আহাদ আলী চলে গেলে শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া টাকাগুলো দাগন ভূঁইয়ার হাতে তুলে দেয় সোলেমান । বিনিময়ে তিতলির দিকে শ্বশুরবাড়ীর সবার মনোযোগ বাড়ে আরও ।
তারপর দিনে দিনে সোলেমানের ব্যস্ততা বাড়ে । শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে গঞ্জের ব্যবসাটা বড় করে সে । রাতে বাড়ী ফিরলে ওকে অজুর পানি এগিয়ে দেয় তিতলি । খেতে বসে খোশ গল্প করে দুজন
-খাইছনি বউ ? শইল কাতর দেহি মুনে কয় ?
-বেবাগ ভালা  খাইয়া লও শিগগির ।
রাতে একই বিছানায় শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন । সে গল্পে না বলা কত কথা ভাষা পায় !  তারপর এক এক করে দিন যায় । দাগন ভূঁইয়ার সংসারে সচ্ছলতা আসে একদিন । বাড়ীতে পাকা দালান উঠে । অন্যছেলেরাও বিয়ে করে সংসারী হয় তার । বছর দুই পর সোলেমানের ঘরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ শুনা যায় ।

তিতলির সংসারটা হয়তো সারাজীবন এমনই হতে পারতো কিন্তু হয়নি । হাতে টাকা এলে মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয়, সাথে বেশভূষাও । দাসপাড়ায় সোলেমান এখন মোটা টাকার মালিক । পাড়ায় সবাই সমীহ করে তাকে । বয়স বাড়লে সৌন্দর্যে ভাঁটা পরে মেয়েদের । নাজানি, এ কারণেই দিনে দিনে সংসারের প্রতি মনোযোগ কমে সোলেমানের ।  
আজকাল সোলেমানকে বাড়ীতে দেখা যায়না খুব বেশী । রাতে বাড়ী ফিরলে চোখাচোখি হয় তিতলির সাথে  সোলেমান বলে-
-খাওনাই মালুম অয়, খাইয়্যা নেও শিগগির ।
তারপর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেনা সোলেমান । শোবার ঘরে চলে যায় সে । রাতে বিছানায় স্বামীর জন্য উতলা হয় তিতলি । রক্তমাংসের যে শরীর সঙ্গীহীন আর্তনাদ করে তার জন্য শরীরী ভালবাসা দরকার । সোলেমান কিছু না বললে তিতলি বলে-
-শরীলনি ভালা আইজ কতা নাই যে ?
-হগগল ভালা, জ্বালাইওনা  কই ।
তারপর একই বিছানায় শুয়ে ঘুমের বাহানা করে তিতলি । সহসা চোখে ঘুম আসেনা ওর ।
আচ্ছা, হেনার কথা মনে আছে ? কলমাকান্দার বিশু মাতব্বরের মেয়ে হেনা কৈশোরে সোলেমানের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছিল সে । আজ কত বছর দুজনে দেখা নাই ! সম্প্রতি স্বামী তালাক দিয়েছে ওকে  কারণ, দশ বছরের সংসার জীবনেও স্বামীকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি সে । যাহোক স্বামী তালাক দিলে বাপের বাড়ী ঠাঁই হয় হেনার । তারপর চৈত্র মাসের এক বিকেলে দাগন ভূঁইয়ার বাড়ীতে দেখা যায় ওকে । ও এলে পুলকিত হয় সবাই । একদিন ওকে সোলেমানের বউ করতে চেয়েছিল দাগন ভূঁইয়া  বিশু মাতব্বর রাজী হয়নি সেদিন । ফিরে যাওয়ার সময় হেনা বলে-
-সোলেমান ভাইরে আমরার বাড়ীত যায়তে কইয়ো চাচি, দুগা কতা আছে হাঁচা ।
রাতে বাড়ী ফিরে কফিরন্নেসার কাছে হেনার আগমনের কথা শুনে সোলেমান । পরদিন ওকেও বিশু মাতব্বরের বাড়ীতে দেখা যায় । কে জানে, জীবনের শেষ বেলায় এসে পুরনো সম্পর্ক মাথাচাড়া দেয় কিনা ? মাঝেমাঝে হেনাও লোকচক্ষুর অন্তরালে গঞ্জে দেখা করে সোলেমানের সাথে । বসে খোশগল্প করে দুজন । সোলেমানের মিশ্র ব্যবহারে ভাল মন্দ বোঝা ভার । তিতলির কাছেও সত্য প্রকাশিত হয়না সহসা । জেলেপাড়ার হাসেম পোদ্দারের ছেলে জগা সোলেমানের গঞ্জের দোকানে কাজ করে । একদিন ওর মুখেই সত্যি আবিষ্কৃত হয় । জগা বলে-
-একখান কতা কমু গোস্যানি অয় ভাবি ? তিতলি বলে-
-কও হুনি গোস্যা কিয়ের ?
-ভাইরে কেমুন দেহি, সামাল দিয়েন কই ।

এরপর একদিন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে স্বামী স্ত্রী কলহ করে দুজন । পরদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে বাপের বাড়ী এসে উঠে তিতলি । এক এক করে দিন যায় বউয়ের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা সোলেমান । বাপের বাড়ী সত্য প্রকাশিত হয়না তিতলির । ভেতরে ভেতরে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । একদিন ভাইয়েরা শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার তাগিদ দিলে ধলপ্রহরে আবার নিজের সংসারে ফেরত যায় সে  ভূঁইয়া বাড়ীতে তখন শুনশান নীরবতা । নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে দেখে দরজা ভেতর থেকে আটকানো  মনোযোগী হলে ভেতরে মেয়েমানুষের গোঙানোর আওয়াজ শুনা যায়  তারপর সতর্ক দৃষ্টি দিলে সত্য আবিষ্কৃত হয় । ভেতরে সোলেমান আর হেনা । যুগ যুগ ধরে চলে আসা আদিম খেলায় মত্ত দুজনই ।