গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৫

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

ডেথ সার্টিফিকেট

আমার এক বিচিত্র লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় । নাম ধীরেন মল্লিক । ধীরেন বাবু আমাদের গ্রামের সরকারী ডাক্তার খানায় কেরানি র কাজ করতেন । মাস মাহিনা জাই পান না কেন কিছু উপরি না পেলে ভদ্রলোক অস্থির হতেন। এ হেন লোক সরকারী  চাকরি কি করে করেন আমার কৌতূহল হত। আমার সঙ্গে ওই ডাক্তার খানার  ডাক্তার বাবুর আলাপ  প্রায় দু বছর হবে! উনি আমাদের গ্রামে পোস্টিং পাওয়ার সময় আমি দেখা করি ওনার সঙ্গে , তারপর থেকে কথায়  কথায় আলাপ হয়ে যায়। আলাপ থেকে হৃদ্যতা । আমি যেদিন গ্রামে আসতাম ওনার কাছে না গিয়ে পারতাম না।  একদিন ডাক্তার বাবুকে জিজ্ঞাসা না  করে থাকতে পারলামনা ।
ডাক্তার বাবুকে , আমি ,  পরিতোষ বাবু বলেই ডাকতাম । ওনার নাম ডাক্তার পরিতোষ সমাদ্দার। উনি আসলে হার্ট স্পেশালিষ্ট  । সরকারী নিয়ম মাফিক দু বছর গ্রামে না থাকলে স্পেশালিষ্ট  স্কেল পাবেন না তাই উনি দু বছর আমাদের গ্রামের ডাক্তার খানাতে ডাক্তার । খুব অমায়িক  লোক এবং নিরহংকার মানুষ । আমার সঙ্গে একটু বেশি মেশেন কারন আমার সঙ্গে ওনার রসায়ন টা ভালো মেশে।
 পরিতোষ বাবুকে ওনার বাডিতে কথার ছলে জিজ্ঞাসা করি , “আচ্ছা ওই ধীরেন বাবু কেন এরকম করেন বলুন তো”! গ্রাম সুদ্ধ লোক আমাকে বলে ওনার কথা । আমি এড়িয়ে যাই । তাও ওরা বলে । বারে বারে শুনে একদিন ভাবলাম আপনাকে কথাটা বলা উচিৎ । আপনি আবার কিছু মনে করবেন না যেন !
আরে না না । আপনি বলুন না ।
না মানে , ওনার ওই টাকা পয়সার ব্যাপারে গ্রামের লোকেরা একটু অ খুশি ।
টাকা পয়সা ? খুলে বলুন ।
না আমি খুলে বোলতে পারবোনা । ওটা অসুন্দর দেখায় ।
তবে কথাটা তুললেন কেন?
সেটাই তো ভাবছি , কেন বললাম ! তবে ও কথা থাক । আপনি পরে যেনে যাবেন । আমার বলার প্রয়োজন হবে না।
আমি আমার ব্লাড প্রেশার চেক করাই ডাক্তার বাবুর কাছে । কাল রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে একটু চিন্তিত । আজ ডাক্তার বাবু ওষুধ লিখে দিয়েছেন । ওটা রেগুলার খেতে বলেছেন । তা ছাড়া রেগুলার ব্যায়াম এবং প্রাণায়াম করতে বললেন। ডায়েট কন্ট্রোল এর  বিশেষ প্রয়োজন।
কথা হচ্ছিল হঠাৎ ধীরেন বাবু এসে হাজির ।
আমি উঠে পড়ি । ডাক্তার বাবুর উদ্দেশে বলি , “চলি ডাক্তার বাবু।
আচ্ছা আসুন।
ধীরেন বাবু যে ফাইলটা আনেন সেটা আমার আন্দাজ করতে কষ্ট হলনা  । ওই বিষয়তেই কথা বলতাম কিন্তু
ওটা ওনাদের অফিসিয়াল ব্যাপার তাই মাথা না ঘামানোটাই উচিৎ মনে করলাম । আবার ডাক্তার বাবু অহেতুক বদনাম হতে পারেন তাই সেটা জানানো উচিৎ বলে মনে করলাম যার জন্য ডাক্তার বাবুর কাছে যাওয়া ।
ব্যাপারটা হল , না থাক ! ওটা এখন না বলাই শ্রেয় ।
আমি বাইরে পা রেখেছি দেখি ধীরেন বাবু আমার দিকে হন হন করে আসছেন।
ও দাদা শুনুন না !
আমি কর্ণপাত না করে এগোই ।
ও দাদা আপনাকেই বলছি , শুনুন না!
কি মুস্কিল । কি বলুন তো ?
আপনি ডাক্তার বাবুকে একটু বলুন না !
কেন বলুন-তো ?
আহা আপনার বন্ধু না !
না উনি কোন দুঃখে আমার বন্ধু হবেন ?
এটা জনতার স্বার্থে আপনাকে অনুরোধ করছি।
দেখুন আমি রাজনীতি করিনা। আপনি যেমন ছা পোষা মানুষ আমিও ঠিক তাই । আমাকে কেন ও সব বিষয় জড়াচ্ছেন বলুন তো ?
দেখুন দাদা মানুষের উপকার ছাড়া  আমি অপকার করি না । আর তার জন্য যদি কেউ দু পয়সা দেয় না তো করতে পারিনা । আমাকেও ত খাটতে হয় বলুন!
আমার ও সব কথা শোনার প্রয়োজন নেই । আপনি যা আপনার মন চায় করুন না আমাকে কেন ও সব কথা শোনাচ্ছেন?
সাধে কি শোনাচ্ছি দাদা । আপনি হলেন ডাক্তার বাবুর খাস লোক । আপনি বললে ডাক্তার বাবু না শুনে পারবে না । আমাকে এইটুকু সাহায্য করবেন না?

দেখুন আপনি বাড়া  বাডি করছেন এবং আমার সরলতার সুযোগ নিচ্ছেন। আপনি কি ভাবেন মশাই , লোকগুলো কি বোকা না হাঁদা । যান আমি আপনার কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নই । এই বলে চলে গেলাম ওখান থেকে ।
বিকেলে আমার ঘরে ধীরেন বাবু এসে হাজির। আমাকে অনুনয় করে বলেন দাদা আপনি বললে সার্টিফিকেট গুলো সই করবেন নাহলে নয় ।
কিসের সার্টিফিকেট ? আমি বললেই বা সই করবেন কেন ? আপনি আমাকে কেন বিরক্ত করছেন । গ্রামের লোক আপনাকে কেউ পছন্দ করেন না তা জানেন ?আপনি আসুন ।
বাজ পডে মৃত্যু হলে আসে পাসের গ্রামের লোক যে টাকা পায় তার সার্টিফিকেট টা কে লেখে শুনি? আমার লেখাতে ডাক্তার সই করেন মেডিক্যাল রিপোর্ট  । ওটা কি আপনি না গ্রামের লোক করে দেবেন । বাজ পডে মৃত্যু হলে  সরকার ৫০০০ টাকা আপাত কালীন সাহায্য দেন । সেটা তো নাও পেতে পারে গ্রামের লোক । আমি একটা সার্টিফিকেট লিখে দি ; যে যা দেয় খুশি মনে তাই নি । এতে দোষের কি হল?আমি ত জোর জুলুম করি না! তবে !
আপনার বলতে লজ্জা করে না? যান মশাই আপনি যান। আমার মাথা খাবেন না দয়া করে।
এ বছর আগস্ট সেপ্টেম্বরে  ঘন ঘন  বাজ পড়াতে  অনেক লোক মারা গিয়েছেন এবং আঘাত পেয়ে শয্যাশায়ী । আর সেই বাজ পড়াটা ধীরেন বাবুর মত লোকের জন্য এক রোজগারের সহজ উপায় । লোকে বলে ধীরেন বাবু নাকি বাজ পডলে আনন্দে ঘরে নাচেন। একটা  সার্টিফিকেট পিছু ৫০০ টাকা রোজগার । একে চিত্রগুপ্ত বলবনা  তো কি বলব বলুন ?
একটা ডাক্তারের সার্টিফিকেট এর জন্য সাধারণ লোকদের  অপেক্ষা করে থাকতে হয়। ডাক্তার  বাবু এসবের কিছুই জানেন না হয়ত  । উনি রোগীদের নিয়ে এবং অপারেশন ক্যাম্পে এতো ব্যস্ত থাকেন যে ফিরেই সব সার্টিফিকেটে সই করে দেন শুধু মাত্র  বিশ্বাসে । তার মধ্যে কিছু  মিথ্যে সার্টিফিকেট থাকলে ওনার চাকরি নিয়ে টানা টানি হতে পারে ।
আজ শুনলাম ডাক্তার সবকটা কেস নিজে যাচাই করে তবেই সই করবেন সার্টিফিকেটে । প্রায় ৫০ টা সার্টিফিকেট আছে ওই ফাইলে । ডেথ সার্টিফিকেট ।
ধীরেন মল্লিক আর বাজ পডলে নাচবেন ! ওর রোজগারের রাস্তা বন্ধ । ডাক্তার বাবু ওনাকে সাসপেন্ডের জন্য সুপারিশ করতে পারেন । তাই ধীরেন বাবু এখন চুপ ।