গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়

কমল 

নতুন চাকরীতে ঢুকেই কমলকে সহকর্মী হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ওর সব ভালো, শুধু কানে বেশ কম শোনা, সব কথায় মাইরি বলা ও চুড়ান্ত কৃপণতাই ওকে আদর্শ মুরগীতে রূপান্তরিত করে ছেড়েছে। আমার থেকে তার নিজের ও চাকরীর, উভয়েরই বয়স অনেকটাই বেশী।
এ হেন কমলের বিয়েতে অফিসের সবার নিমন্ত্রণ। অফিসের ঠিক নীচের ফুলের দোকানের তপনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে ইঞ্চি দু’-এক আকন্দ তারপরে ইঞ্চি খানেক জবা দিয়ে মোটা দুটো গোড়ের মালা তৈরী করে দিতে পারবে কী না। মালা দুটোয় ইঞ্চি তিনেক লম্বা অপরাজিতার লকেট মতো থাকবে। আমার কথা শুনে তপন তো অবাক। বললো, “তা পারবো, কিন্তু ঐ মালা নিয়ে আপনি কী করবেন”? বললাম “সেটা তোর জানার দরকার নেই, তুই দুটো মালা তৈরী করে দিতে পারবি কী না সেটা বল, আর জবা ফুলগুলো কালী পূজার জবা দিবি, যেগুলো অনেক রাতে ফুটে বড় আকার ধারণ করে”। সে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। 

খবর পেয়ে ম্যানেজার জানালেন ঐ সব সঙ্গে নিয়ে গেলে, তিনি আমার সাথে যাবেন না। বললাম অফিস থেকে সকলে মিলে একটা উপহার তো দেওয়াই হচ্ছে। এটা আমরা কয়েকজন, বন্ধু হিসাবে অতিরিক্ত দেব। যাহোক্, সন্ধ্যার পর মালা নিয়ে বিয়েবাড়ি যাবার পথে দোকান থেকে একটা মাত্র নিরোধ কনডোম প্রায় বিনা পয়সায় কিনে, ফুলের মালার সাথে নিয়ে যাওয়া হ’ল।
 
বিয়ে বাড়িতে নতুন বরকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা হয়েই থকে। এটাই রীতি, কিন্তু সেটা বিয়ের দিন। বৌভাতের দিন এই জাতীয় ব্যাপার, বিশেষ হতে দেখি না। কিন্তু এখানে দেখছি পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে, এক ঝাঁক নিমন্ত্রিত কমলের ওপর হামলে পড়েছে। যেন তার পিছনে লাগার জন্যই তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এসেছে। হঠাৎ আলো চলে যাওয়ায় দেখা গেল জেনারেটার তো দুরের কথা, একটা মোমবাতি পর্যন্ত বাড়িতে নেই। অন্ধকারে বেশ কিছুক্ষণ বসার পর আলো আসলে পরেশ বললো, “কমল তুমিও একটা ফুলের মালা গলায় দাও। বিয়ের দিন তো দু’জনের তেমন ভালো ফটো তোলা যায় নি, আজ তোমাদের দু’জনের একটা ভালো ফটো তুলে দিচ্ছি, বড় করে বাঁধিয়ে নিও”। কমল একটা চেয়ারের ওপর উঠে বাবার ফটোতে ঝোলানো মালাটা খুলে নিজের গলায় পরতে পরতে বললো, “ফটোর দাম কী  আমায় দিতে হবে মাইরি”? 

খেতে যাবার পথে একটা খুব সুন্দর দেখতে মেয়েকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে কমলকে বললাম, “তোমার তো একটা হিল্লে হয়ে গেল, ঐ মেয়েটার সাথে আমার একটা ব্যবস্থা করে দাও না”। উত্তরে সে শুধু বললো “কী যে বল মাইরি”। দোতলায় খাবার জায়গায় যাওয়ার পথে নতুন বউকে মালার প্যাকেটটা দিয়ে বললাম, “বৌদি প্যাকেটটা এখন খুলবেন না”। কমল চিৎকার করে “সুবীর, চ্যাংড়ামো কোরনা মাইরি” বলতে বলতে খাবার জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসালো। মুখোমুখি দুটো সারিতে আমরা অফিস কর্মীরা বসেছি, শুধু আমার ঠিক সামনে একজন অপরিচিত ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারার ভদ্রলোক মোটা কাচের চশমা পরে খেতে বসেছেন। কিছুক্ষণ পরে কমল খাবার জায়গায় হঠাৎ এসে হাজির হয়ে ভদ্রলোকের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বেশ জোরে জোরে বললো, “সুবীর তুমি যে মেয়েটাকে বিয়ে করার কথা তখন বলছিলে, সে এনার মেয়ে। ইনি একটা কলেজের হেড অফ্ দি ডিপার্টমেন্ট”। আমার তো খাওয়া মাথায় উঠলো। ভদ্রলোক একবার শুধু তাঁর মোটা কাচের চশমার ভিতর দিয়ে আমাকে জরিপ করে নিলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষে নীচে এসে নতুন বউ-এর কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খুলে দেখি, জবা ফুলগুলো বেশ বড় বড় হয়ে গেছে। আহা! মালার কী রূপ। একটা মালা কমলকে পরিয়ে দিয়ে নতুন বউকে বললাম, “বৌদি রাতে এই মালাটা কমলকে বলবেন আপনাকে পরিয়ে দিতে।”। কমল চিৎকার শুরু করে দিল— সুবীর চ্যাংড়ামো কোর না মাইরি। যাহোক্ আমরা ফিরে এলাম। পরে কাজে যোগ দিয়ে সে জানালো, “তোমাদের নামে খুব নিন্দা হয়েছে মাইরি”।

দিন যায়, কমলকে নিয়ে ভালই সময় কাটে। বছর খানেক পরে একদিন, সেদিন সে অফিস আসে নি, বিকালের দিকে অফিসে এসে জানালো যে তার মার অবস্থা খুব খারাপ। সে কিছু টাকা তুলতে চায়। তার ব্যাঙ্ক এাকাউন্টে সবসময় অনেক টাকা থাকলেও, সাধারণত সে খুব একটা টাকা তোলে না। তার মা অনেকদিন ক্যানসারে ভুগছেন জানতাম, তাই জিজ্ঞাসা করলাম “মা এখন কেমন আছেন”? সে করুণ স্বরে উত্তর দিল ভালো না গো। সেফে টাকা উঠে যাওয়ায় তাকে টাকা তুলতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেল না। অগত্যা যার পকেটে যা ছিল তাই দিয়ে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল।

পরদিন কাছা নিয়ে কমল অফিস জয়েন করলো। গতকাল তার মা মারা গেছেন জেনে, আমরা সবাই তাকে সহানুভুতি জানালাম। ম্যানেজার বললেন “গতকাল তোমার মা মারা গেছেন, আজ অফিস জয়েন না করলেই ভাল করতে। এই সময়টা খুব সাবধানে থাকতে হয়, তার ওপর গতকাল তোমার ঝামেলাও গেছে। দু’চারদিন ছুটি নিয়ে অফিসে আসা উচিৎ ছিল।

উত্তরে কমল বললো “আমিতো মাকে কনট্রাক্টে পুড়িয়েছি, তাই আমার তেমন কষ্ট বা ঝামেলা পোহাতে হয় নি। আমি শ্মশানে গিয়ে মুখাগ্নি করে চলে এসেছি, আবার ঘন্টা দেড়েক পরে একবার গিয়ে গঙ্গায় অস্থি ফেলে কাছা নিয়ে ফিরে এসেছি। বাকী সব ঝামেলা ওরাই সামলেছে। কিছু ফালতু খরচা হয়ে গেল, তা আর কী করা যাবে মাইরি। তাছাড়া বাড়িতে থাকলে অনেক ঝামেলা। অনবরত লোক আসবে। তাদের চা খাওয়াও, মিষ্টি খাওয়াও। তার থেকে অফিসে  থাকা অনেক ভাল”। 

আসল খবরটা আরও পরে জানা গেল। সেদিন কমল যখন অফিসে টাকার জন্য এসেছিল, তার অনেক আগেই তার মার মৃত্যু হয়। পাছে সহকর্মীর মার মৃত্যুর খবর পেয়ে অফিসের কেউ তার বাড়ি বা শ্মশানে যায়, সেই ভয়ে সে তার মার অবস্থা খারাপ বলেছিল। কারণ তাহলে তাদের আবার শ্মশানবন্ধু হিসাবে শ্রাদ্ধে বা নিয়মভঙ্গে নিমন্ত্রণ করার প্রশ্ন আসবে। 

নিয়মভঙ্গ তো দুরের কথা, কমলের মার শ্রাদ্ধেও যে অফিসের কেউ তার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পায় নি, একথাটা বোধহয় না বললেও চলবে।