গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

কুসুম বুড়ির গল্প



এ তল্লাটে এমন কেউ নেই যে কুসুম বুড়িকে চেনে না বা তার গল্প শোনেনি। না। কুসুম বুড়ি কোন ভি আই পি মেয়ে ছিল না। নিতান্তই সাদামাটা মহিলা। উচ্চতায় প্রায় পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি। দোহারা গড়ন।গায়ের রং শ্যামলা। ঠোঁটের কোনায় ছিল একটা মানানসই আব্ যাকে আমরা ডাক্তারী পরিভাষায় বলি সিস্ট। বিশ্রী লাগতো না। বরং হাসলে এমন লাগতো যা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু মনে রাখার মত।
 

আমি ওকে বিধবা অবস্থাতেই দেখেছি। শুনেছি, দুর গাঁয়ের জমিদার বাড়ীর মেয়ে ছিল।কিন্তু এতটাই সাদামাটা জীবনযাপন করতো যে দেখে আমার অন্তত কোনদিন তা মনে হয়নি। বাড়ীতে সে একা। তার স্বামী অঘোর সেন ছিল বিশাল লাক্ষা কারবারী। কুসুম,পলাশ কুল গাছে লাক্ষা চাষ করত আর মরসুমে লাক্ষা গাছ থেকে কেটে নামিয়ে তা
  ছাড়িয়ে মন মন লাক্ষা বিক্রি করত বলরামপুর ঝালদার লাহাকুঠিতে। এ তল্লাটে লাক্ষাকে লাহা বা লা বলা হতো। লাক্ষা থেকে গালার বিস্কুট তৈরী করে একসময় বিদেশে রপ্তানী হতো।কুসুম গাছের ডাল থেকে লাক্ষা ছাড়াতো নিজের হাতে। ও এত পরিস্কার লাক্ষা ছাড়াতো যে ওর ছাড়ানো লাক্ষা নাকি দেড়গুন দরে বিক্রী হতো।

এহেন পয়মন্ত কুসুমের দুর্ভাগ্য একটাই, তার সাতটা সন্তানের কোনটাই বাঁচেনি। সন্তান জন্মানোর দু তিন মাসের মধ্যেই অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার,বদ্যি, কবিরাজ, বড় ডাক্তার, তাবিজ,কবচ মাদুলি, বা ঠাকুর থানে হত্যে দিয়েও কোন সুফল হয়নি। তাই হয়ত লাক্ষার কাজে ডুবে শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করত। শুনেছি অষ্টমবারের মত ও পোয়াতি হয়েছিল। সে যখন চার মাস পোয়াতি তখন অঘোর সেন কলেরায় মারা যায়।সে বছর কলেরায় গ্রামের অনেকেই মারা গেছিল।কেন যে কুসুম মরল না তা কুসুমের ভগবানই জানে। কেননা ওর স্বামীর মলমুত্র ঘেঁটেও কলেরাকে আলিঙ্গন করতে পারেনি। সে অফশোষ ও কোনদিন ভোলেনি।

ভেঙে পড়েনি কুসুম। মৃত্যু নিয়ে এতটাই নাড়াচাড়া করেছিল যে স্বামীর মৃত্যু তার মনে কোন রেখাপাতই করেনি। বরং সমস্ত শোক উপেক্ষা করে অষ্টম ও শেষবারের মত সন্তানের জন্ম দেওয়ার প্রস্তুতি নেয় সে। যথাসময়ে জন্মাষ্টমীর শুভলগ্নে জন্ম নিল এক ফুটফুটে পূত্র সন্তান। পড়শি ধাইমার অক্লান্ত পরিশ্রমে আঁতুড়ের ধকল পেরিয়ে সেরে উঠল।আর আর বারের মত ছয়দিনের মাথায় ষষ্ঠি পুজো বা ষাঠারো পুজো হলো, নয়দিনের দিনে নরাতো এবং একুশ দিনের দিন একুশা উদযাপণ করে আঁতুড় ছেড়ে স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে ছেলের পরিচর্যায় মেতে উঠল। ছেলের নাম দিল কেষ্ট। গ্রামের সবাই ভেবেছিল বড় জোর তিনমাস তারপর তো কুসুম আবারও একলা হবে।

না।এবার সংস্কারমুক্ত কুসুম আর পাঁচজনের কথা শুনে গ্রামীন সংস্কারে জড়িয়ে পড়ল। তখনকার দিনে নসংস্কার ছিল মৃতবৎসা বা যে মেয়ের সন্তান বারবার মারা যায় সে যদি তার সন্তান ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে বিক্রি করে এমন কোন মহিলাকে যার সন্তান অসময়ে মারা যায়নি তাহলে সেই বিক্রিত সন্তান দীর্ঘায়ু হয়ে বেঁচে থাকে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের নন্দ বাঁড়ুজ্যের স্ত্রী দামিনিকে একসের আতপ চাল আর পাঁচসিকে পয়সার বিনিময়ে কেষ্টকে বিক্রি করে দেয় শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ জিউকে সাক্ষী রেখে। তার কয়েক মাস পরে নন্দু বাঁড়ুজ্যে কেষ্টকে নিয়ে সপরিবারে স্থায়ীভাবে চলে যায় জামসেদপুর।
অশুভ ছায়া পড়ার ভয়ে নীরবে দামিনীর প্রস্তাব মেনে নেয় কুসুম।

এর পরেই কুসুমের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। জীবন
  অন্যখাতে বইতে শুরু করে। লাক্ষা ব্যাবসা ছেড়ে দেয়। সমস্ত গাছ বিক্রি করে দেয়।শুরু হয় নুতন জীবন। তালতাল মাটি আনতে থাকে পাশের জমি থেকে। সেই মাটি দিয়ে গড়তে থাকে মা ষষ্ঠির মুর্তি আর ছোট ছোট শিশুমুর্তি। অনেকেই ওকে ব্যাঙ্গ করে ষষ্ঠিবুড়ি বলে ডাকতো। কেউ কখনও ওকে রাগতে দেখেনি। এর সঙ্গে জঙলী গাছগাছড়া দিয়ে তৈরী করতো বাচ্চাদের নানারকম ঔষধ। আলই নামে কবিরাজী ঔষধটি ছিল ধন্বন্তরী। শিশুর জ্বর,তড়কা,অজীর্ণ,বদহজম,খোসপাঁচড়া সবকিছুর ঔষধ তৈরী শুরু করলো। রাতদিন মুর্তি ও ঔষধ তৈরী করত। আর গুনগুন করে শ্রীকৃষ্ঞের অষ্টোত্তর শতনাম আওড়াতো।

ছোটবেলায় দেখতাম যার বাড়ীতেই শিশু জন্মাতো কুসুম বুড়ি সেখানে হাজির। আঁতুড়ঘরে পুবদিকের দেওযালগোড়ায়
  একটি ষষ্ঠিমুর্তি ও একটি শিশুমুর্তি রেখে দিত।আর দেওয়ালে আলতা দিয়ে প্রতিদিন একটি পাঞ্জা ছাপ দিত। ছদিনের মাথায় ষাঠারো পুজা হতো আর কুসুম বিড়বিড় করে শিশুর সুস্থতা কামনা করতো। প্রয়োজনে সেদিন থেকেই আলই খাওয়াতো। এ নিয়ে কারো কোন অভিযোগ শুনিনি। বাচ্চাদের অসুধের পয়সাও নিতে দেখিনি। গ্রামের কোন বাচ্ছা ছেলে রাতবিরেতে কান্নাকাটি শুরু করলে কুসুম একছুট্টে গিয়ে হাজির হতো। রাত জেগে শিশুর পরিচর্যা করতো।

এহেন কুসুমবুড়ির শরীর ভাঙতে শুরু করলো। যেদিন শুনলো নন্দুর ছেলে কেষ্ট মস্তবড় ডাক্তার হয়ে বিলেত যাচ্ছে সেদিন থেকেই
  কুসুম মুষড়ে পড়ল। যদিও দীর্ঘ পঁচিশ বছরে পাঁচ বারের বেশী কেষ্টকে দেখেনি। তবু নাড়ীর টান তো। অজানা আশঙ্কায় ডুকরে উঠতো কুসুম।

কিছু দিনের মধ্যে কুসুম কুঁজো হয়ে পড়ল। গায়ের রঙ কেমন যেন কালো হয়ে গেল। মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা শনের মত হয়ে গেল। ছানিপড়া ফ্যাকাশে চোখ। হাতে ব্যাঁকাটেরা লাঠি। কাঁপাকাঁপা গলায় কথা বলা। এ এক অন্য কুসুম। প্রায়ই একে ওকে বলতো "আমিতো আর বেশিদিন বাঁচবো না,কেষ্টর
  হাতে অাগুনও পাবো না। আমাকে তোমরা সমাধি দিও।"

কোন এক বর্ষার রাত।ঘনঘন বিদ্যুত ঝলকানি।মুষলধারায় বৃষ্টির বিরাম নেই।রাস্তাঘাট চারদিক জল
  থৈ থৈ। একটানা বজ্রপাতের শব্দ।মনে হচ্ছে যেন প্রলয় হচ্ছে। লাহাবাড়ী থেকে ডাক পড়লো কুসুমের। ছেঁড়াছাতা নিয়ে বিদ্যুতের আলোয় ঠাহর করতে করতে লাহাবাড়ী গিয়ে দেখে বাচ্ছাটা চিঁ চিঁ করছে। পাতলা দাস্ত করে নেতিয়ে পড়েছে। কুসুম ছানিপড়া চোখ দিয়ে যেটুকু দেখলো আর স্পর্শ করে যা বুঝলো এ রোগের বিশল্যকরণী ওর কাছে নেই। ছেলের মাকে বললো, "মাগো এর ওষুধ আমার কাছে নেই। বড় ডাক্তারের কাছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও। আর মায়ের দুধ খাওয়াও। দুধ খাওয়াতে ছেড়োনি মা।"
এই বলে কোন ঔষধ না দিয়ে বাড়ী ফিরল কুসুম,আর সারারাত লাহাবাড়ীর বাচ্চ্ছাটার মঙ্গল কামনায় ভগবানকে ডেকে চললো।

ভোর বেলায় শোনা গেল লাহা বাড়ীর বাচ্ছা ছেলেটা ভোর রাতে মারা গেছে। হাতুড়ে ডাক্তার বলেছেন আন্ত্রিকে মারা গেছে। ডিহাইড্রেটেড হয়ে গিয়েছিল। ছেলের মা শুনেছে তান্ত্রিকে মেরেছে। অতএব আর যায় কোথা। ডাইনি বুড়ি কুসুম এসেছিল রাতে তাহলে ওই তুকতাক করে গেছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ষষ্ঠিবুড়ি ডাইনি হয়ে গেল। সকালে গুজব ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। কুসুম ডাইনি হয়েছে।

ডাইনির নজর এড়াতে সব ছেলের মা সাবধান হয়ে গেল। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দরজা কুসুমের কাছে বন্ধ হয়ে গেল। একটু বড় ছেলেরা রাস্তাঘাটে কুসুমকে দেখলেই ডাইনি বুড়ি বলে খেপাতে শুরু করল। দুঃখে অভিমানে কুসুম নিজেকে গৃহবন্দী করলো। অশক্ত অনাহারক্লিষ্ট কুসুমের দিন এমনিতেই শেষ আসছিল ক্রমশ।

আজও বেশ মনে পড়ে সেদিন দুর্গাষষ্ঠী। শিউলি পদ্মের গন্ধে ম ম আকাশ বাতাস। মন্ডপে রঙীন জামা কাপড়ে শিশুর কলরব।

হঠাৎ শোনা গেল কে বা কারা বাড়ীর মধ্যে পাথর দিয়ে কুসুমের মাথা থেঁতলে দিয়েছে। রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। মাটির ষষ্ঠী ও শিশুমুর্তি গুলো রক্ত স্নানে হাবুডুবু।

রক্তাক্ত মহাষষ্ঠীতে বিসর্জনের বিষন্ন সুরে মুহূর্তে থেমে গেল শিশুর কলরব।