জলকাদা আগাছায় ভরা ছোট্ট একটা গ্রাম, কে যে এহেন গ্রামের নাম সাধ করে কুসুমপুর
রেখেছিল কেউ জানেও না, জানার
প্রয়োজনও বোধ করেনা। কুসুম বলতে আকন্দ, ঘেঁটু, পার্থেনিয়াম
জাতীয় কিছু জংলি ফুল, আর
কলকে, মাদার
বা নাম না জানা কিছু গাছের ফুল। রাস্তাঘাটের বালাই নেই, নিজেরাই নির্দিষ্ট পথে
পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে করে ঘাসহীন কিছু পায়ে চলার রাস্তা তৈরী করে নিয়েছে, আর তার
ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যে ভ্যান রিক্সা যাতায়াত করে, শেষ কবে গ্রামে মোটর ঢুকেছে হিসাব
করে বলতে হবে। আর তারই একপ্রান্তে এক বহু প্রাচীন ভাঙাচোরা প্রকান্ড বাড়ি অযত্নে,
অবহেলায়, অতীতের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের মানুষ সেটাকে রাজবাড়ি বলেই
জানে। বর্ষায় বা বণ্যায় গ্রামের লোকেরা জীবন হাতে করে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বেশ কিছু
হিন্দু ও মুসলমান পরিবার এ গ্রামে পাশাপাশি বাস করে। নাম না বললে কে হিন্দু, কে মুসলমান আলাদা করে চেনা অসম্ভব।
এরা নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদন ও জীবন যুদ্ধে সারাদিন এতটাই ব্যস্ত থাকে, যে ধর্ম,
রাজনীতি, বা নিজেদের মধ্যে লোভ লালসার কথা ভাববার সময়ও পায় না। বাইরের জগৎ থেকে
এরা একপ্রকার বিচ্ছিন্ন, কারণ বাইরের কেউ এদের খবরও রাখে না, রাখার প্রয়োজনও বোধ
করে না। ঠিক সময়ে হলে, প্রতি পাঁচ বছর পর পর তারা কিছু বাইরের লোকের মুখ দেখতে
পায়, জানতে পেরে আশ্বস্ত হয়, যে এইসব মানুষগুলো তাদের জন্য কত চিন্তা করে, তাদের অর্থনৈতিক
উন্নতির জন্য কী কী পরিকল্পনা নিয়েছে বা
ভবিষ্যতে নিতে চলেছে।
এই
গ্রামে প্রায় পাশাপাশি বাস করে বছর সাতেকের আকবর ও কানাই। তাদের মধ্যে গভীর
বন্ধুত্ব, যাকে হরিহর আত্মাও বলা যেতে পারে। আর তাদের বন্ধুত্বের যোগসুত্রটি অশীতিপর,
মাজা ভাঙ্গা, প্রায় চলৎশক্তিহীন কানাই এর বড়ঠাম্মা, অর্থাৎ কানাই-এর বাবার ঠাকুমা—
সাবিত্রী দেবী, বা গ্রামের সবার সাবি ঠাকরুণ। নাতির সন্তান দেখতে পাওয়া, তাকে
চোখের সামনে ঘুরে ফিরে বড় হতে দেখতে পাওয়াটাকে তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে ভাবতেন। তাঁর
কাছে জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া ছিল এটাই।
প্রতিদিন
সন্ধ্যার পর বড়ঠাম্মা তাঁর কানাইকে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প, ঘ্যাঁঘাসুরের গল্প, তেপান্তরের
মাঠ, লালকমল-নীলকমল, রাজকুমার-রাজকুমারী, আলাদিন, কত গল্পই যে বলতেন তার ইয়ত্তা
নেই। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি ঝাঁসির রানি লক্ষীবাই, নেতাজী, শিবাজী, স্বামীজী,
মাস্টারদা সূর্য সেন, খান আবদুল গফফর খান, হাবিবুর রহমান, ভগৎ সিং, রাজগুরু, আরও
অনেকের কথাই এই সান্ধ্য আসরে আলোচনা হ’ত। কানাই ও তার বড়ঠাম্মা, দু’জনেই যেন এই
সন্ধ্যার সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। প্রতিদিনই কানাই পরম আগ্রহে ও বিষ্ময়ে
বড়ঠাম্মার গল্প শুনে অবাক হ’ত, আর পরদিন রাজ বাড়ির ছাদে সেই গল্প আকবর ও গ্রামের
অন্যান্য সমবয়সি বন্ধু, অনিমেষ, নিতাই, রঘু, জামশেদ, আলী, লক্ষণ, হাবিবদের শুনিয়ে
বাহবা পেত, গর্ব বোধ করতো। তারা নিজেরা গল্পের সেই সব চরিত্র সেজে খেলা করে আনন্দ
পেত। ক্রমে একে একে প্রায় গ্রামের সব বাচ্চারাই সন্ধ্যার পর বড়ঠাম্মার গল্পের আসরে
নিয়মিত আসতে শুরু করলো।
কানাই
এর বড়ঠাম্মা যখন বিয়ের পর স্বামীর হাত ধরে এই গ্রামে প্রথম আসেন, তখন প্রায় গোটা
গ্রামের লোক তাঁকে দেখতে আসে। আসার যথেষ্ট
কারণও তো ছিল। কারণ এই অজ্ গ্রামে মহিলা তো দুরের কথা, পুরুষরাই অধিকাংশ নিরক্ষর।
আজও প্রায় সেই একই দশা। এদের দোষ দেওয়াও যায় না। না, কোন কুসংস্কার নয়, অর্থাভাব,
খাদ্যাভাব, নানাবিধ ব্যাধি ও প্রকৃত শিক্ষার সুযোগের অভাবই এর মূল কারণ। আর আজ
থেকে অত বছর আগে এই সাবিত্রী দেবী বই পড়তে পারতেন, চিঠি লিখতে পারতেন, বেশ কিছু ইংরাজী শব্দের মানে পর্যন্ত জানতেন। শুধু তাই নয়,
স্ত্রীর গুণে গুণমুগ্ধ কানাই এর বড়ঠাকুরদা-হারাধনের কাছ থেকে তাঁর ঘনিষ্টরা এও
জানতে পেরেছিলেন যে, দেশের স্বাধীনতার
জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে সাবিত্রী দেবী তিন-তিনবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন, একবার
মাস ছয়েক জেলও খেটেছেন। দেশের তৎকালীন অনেক নামজাদা বিপ্লবীর সাথে তাঁর ওঠাবসা
ছিল। বিয়ের পরে রাত জেগে হারাধন সেইসব গল্প স্ত্রীর কাছ থেকে শুনতেন।
আজ
সন্ধ্যায় সিপাই বিদ্রোহ ও আরও কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা প্রসঙ্গে বাচ্চাদের নানান
প্রশ্নের উত্তরে হিন্দু-মুসলমানের রাইয়ট প্রসঙ্গ এসে পড়ে। সাবিত্রী দেবী বাচ্চাদের
সেই সব প্রশ্নের উত্তর বাচ্চাদের মতো করেই দেবার চেষ্টা করেন। বাচ্চারাও তাদের মতো
করে ইংরেজদের সঙ্গে ভারতীয়দের যুদ্ধের মতো, হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ
হিসাবেই ধরে নেয়।
পরদিন
বিকেলে সেই ভাঙাচোরা রাজবাড়ির ছাদে বাচ্চারা সব জড়ো হয়েছে। আজকের খেলা
হিন্দু-মুসলমানের রাইয়ট। যুদ্ধে সেনাপতির প্রয়োজন, তারাই যুদ্ধ পরিচালনা করে। ঠিক
হ’ল দু’ই
দলের দু’ই
সেনাপতি হবে কানাই আর আকবর। লুডো খেলায় কে লাল ঘুঁটি নেবে আর কে নীল ঘুঁটি নেবের
মতো এ ক্ষেত্রেও কে কে হিন্দু হবে আর কে কে মুসলমান হবে, তাই নিয়ে ঝামেলা দেখা
দিল। দল বাছাইয়ের প্রথম সুযোগ দলনেতাদের। আকবর প্রথমেই বললো যে সে তার বাড়িতে
শুনেছে,
যে তারা নাকি মুসলমান। রোজ রোজ একদলে সে থাকতে রাজী নয়, তাই আজ সে হিন্দু হয়ে
হিন্দুদের দল পরিচালনা করবে। উত্তরে কানাই তার প্রাণের বন্ধু আকবরকে জানালো যে
তাতে তার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু সে ভেবে পায় না যে তাদের বাড়ির লোকেরা কিভাবে
বোঝে যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান। তাদের তো একই রকম দেখতে। আলোচনা শেষে হিন্দু ও
মুসলমান, দু’টো দল ঠিক হ’ল। হিন্দুদের দলে থাকবে আকবর, অনিমেষ, জামশেদ ও রঘু আর
মুসলমানদের দলে কানাই, আলী, লক্ষণ ও হাবিব।
আজ
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মজা-ই আলদা ধরণের। সীতা হরণ খেলাতেও আনন্দ আছে, কিন্তু সে তো লুকোচুরি
বা চোর-পুলিশ খেলার মতো। যুদ্ধের সুযোগ সেখানে খুবই কম। কিন্তু আজ প্রত্যেকের হাতে
তরোয়াল, অর্থাৎ কঞ্চি। কঞ্চি ঘুরিয়ে হা-রে-রে-রে-রে করে একে অপরের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর বিশ্রাম। সবাই গোল হয়ে বসে কানাইয়ের বাড়ি
থেকে আনা পাকা তেঁতুল ভাগ করে খেয়ে, আবার যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়লো। হঠাৎ আকবরের
কঞ্চি দিয়ে কানাইয়ের চোখে খোঁচা লেগে যেতেই, মুসলমান সেনাপতি কানাই কঞ্চি ফেলে
একহাতে চোখ চেপে ধরে অন্য হাতে শত্রুপক্ষের
সেনাপতিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। কিন্তু খেলায় মত্ত যোদ্ধারা বুঝতেও পারেনি যে
তারা ভাঙ্গা ছাদের একবারে প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। ফলে কানাইয়ের ধাক্কায় আকবর ছাদ
থেকে পাক খেয়ে নীচের ইঁট-পাটকেলের ওপর পড়ে ছটফট্ করতে করতে স্থির হয়ে গেল।
বাচ্চাদের
কান্না ও চিৎকার চেঁচামিচিতে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই ছুটে এসে আকবরকে তুলে নিয়ে এল।
তার দেহে তখনও প্রাণ আছে, তবে আঘাতের গভীরতা কতটা বোঝা মুশকিল। রাগে গজগজ্ করতে
করতে কানাইয়ের বাবা শ্যামাপদ, ভয়ে, শোকে, নির্বাক হয়ে যাওয়া কানাইকে একটা চড়
কষালো। আকবরের বাবা তাকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললো, “ও কী ইচ্ছা করে ফেলেছে? ছি ছি
ছি, বাচ্চাকে কেউ ঐভাবে মারে”? এদিকে আকবরের মাথার গভীর ক্ষত থেকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। গ্রামে কোন
স্বাস্থ্যকেন্দ্রও নেই। দু’জন সাইকেল নিয়ে ছুটলো পাঁচ কিলোমিটার দুরের গ্রাম থেকে
ডাক্তার ডেকে আনতে। অনেক চেষ্টা করেও এই সন্ধ্যায় কোন ডাক্তারকে নিয়ে আসা বা আকবরকে
নিয়ে যাবার জন্য কোন গাড়ির ব্যবস্থা করতে না পেরে তারা যখন নিজের গ্রামে ফিরে আসলো
তখন সব শেষ। সারা রাত আকবরের মা ছেলের মৃতদেহ আগলে পাথরের মতো বসে থাকলো, পাশে
অপরাধীর মতো কানাইয়ের মা। ডাক্তার, পুলিশ বা ভিন গ্রামের কারো দেখা পাওয়া গেল না।
পরদিন
গ্রামের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই যখন আকবরের দেহে মাটি দেবে বলে রওনা দেবে,
তখন দু’-তিনজন পুলিশ এসে বাধা দিল। মৃতদেহের পোষ্টমর্টেম না করে কবর দেওয়া যাবে
না। মৃতদেহ এবং আকবর ও কানাই, উভয়েরই বাবাকে নিয়ে তারা যখন পাশের গ্রামের থানায় যাবার জন্য
প্রস্তুত, ঠিক সেই সময় হলুদ ঝান্ডা হাতে স্লোগান দিতে দিতে একদল মানুষ এসে উপস্থিত
হ’ল। মৃতদেহ ঘিরে রেখে তারা স্লোগান দিতে শুরু করে দিল—সংখ্যালঘু মুসলমান হত্যা
মানছি না মানবো না। আমাদের দলীয় কর্মী শেখ হায়দার আলীর সন্তান আকবরের হত্যাকারীর
চরম শাস্তি দিতে হবে, দিতে হবে। দুধের শিশু মরলো কেন নীল ঝান্ডা পার্টি জবাব দাও
জবাব দাও। আকবরের বাবা তাদের জোর হাত করে বুঝিয়ে ছেলের সৎকারের ব্যবস্থা করার জন্য
পুলিশের সঙ্গে এগিয়ে যেতে গিয়েও ব্যর্থ হ’ল।
ইতিমধ্যে
নতুন আর একদল নীল ঝান্ডা হাতে চিৎকার করে স্লোগান দিতে দিতে মৃতদেহের কাছে হাজির
হ’ল। এরাও স্লোগান দিতে শরু করে দিল— আমাদের কর্মী শেখ হায়দার আলীর সন্তান খুন হ’ল
কেন রাজ্য সরকার জবাব দাও জবাব দাও। শহীদ আকবর অমর রহে। এরই মধ্যে মৃতদেহ ঘিরেই
একদল বিচার সভা বসিয়ে ফেললো, এবং বিচার শেষে তারা ঘোষণা করলো— কানাইয়ের বড়ঠাম্মা ডাইনি। তার জন্যই আকবরের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু।
সে গ্রামে থাকলে আরও অনেকের, বিশেষ করে বাচ্চাদের ওপর এই জাতীয় ঘটনা নতুন করে আবার
হবে। গ্রামের উন্নতি ও মঙ্গলের জন্য তাকে,
দরকার হলে তার বাড়ির সকলকেই গ্রাম ছাড়া করা প্রয়োজন।
গ্রামের মানুষদের শান্তিতে ও নিরাপদে থাকার চটজলদি উপায় বাতলে দিয়ে তারা যেভাবে
হৈহৈ করে এসেছিল, সেভাবেই হৈহৈ করে ফিরে গেল।
আকবরের
বাবা শেখ হায়দার আলী বুঝে উঠতে পারলো না যে সামান্য একটা বি. পি. এল.
কার্ডের জন্য এত আবেদন নিবেদন করেও পাওয়া সম্ভব হয় নি, অথচ বিনা আবেদনেই রাতারাতি
সে দু’-দু’টো রাজনৈতিক দলের সভ্য কিভাবে হয়ে গেল। তাই সে রুখে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, তার
জীবন থাকতে কেউ তার শুভাকাঙ্খী বন্ধু শ্যামাপদকে গ্রাম ছাড়া করতে পারবে না। কিন্তু
ততক্ষণে কিছু সভ্য মানুষদের কথায়, আশ্বাসে, অনেকেই বুঝে ফেলেছে, যে এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা নয়। হোক না মাজা ভাঙ্গা, হোক না চলৎশক্তিহীন, তবু শিক্ষিত সাবিত্রী দেবীর পক্ষেই ডাইন
হয়ে এ কাজ করা সম্ভব। আর এই ঘটনা যে বিভিন্ন জায়গায় আকছার হচ্ছে, তার প্রমাণ ও ফর্দ তো বাইরের সভ্য মানুষেরা
দিয়েই গেল। তারা তো আর সাবিত্রী দেবী বা শ্যামাপদর শত্রু নয়। কিন্ত পুলিশ মৃতদেহ
নিয়ে চলে যাবার সময় আকবর ও কানাই, উভয়ের বাবাকেই সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায়, এই নিয়ে কেউ
কোন কথা বলার সুযোগ পেল না।
পরদিন
আকবরের মৃতদেহ নিয়ে উভয়ে ফিরে আসার পরে গ্রামে মৃত্যু শোক এক নতুন মাত্রা পেল, এবং
কালো মেঘ টাইফুন ঝড়ের আকার পেতে বিলম্ব হ’ল না। উত্তেজিত মুসলমান সম্প্রদায় একজোট
হয়ে সাবিত্রী দেবীকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বার করে নিয়ে এসে প্রহার শুরু করলো।
তাদের হাত থেকে আকবরের সমবয়সি কানাই ও ছাড় পেল না। যারা প্রতিদিন গ্রামের সবথেকে
বয়স্কা ও শিক্ষিতা মহিলাকে মায়ের মতো প্রণাম করতো, শ্রদ্ধা করতো, তারাই মূহুর্তের
মধ্যে তাকে ডাইনি বানিয়ে ফেলে তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। শত চেষ্টা করেও হায়দার আলী
তা ঠেকাতে পারলো না।
এবার
কিন্তু হিন্দুরা বাঁচার তাগিদে একজোট হয়ে গেল। এবার কিন্তু কে কে হিন্দু হবে, কে
কে মুসলমান হবে আলোচনা করে ঠিক করতে হ’ল না। একে একে উভয় পক্ষের ঘরগুলোয় আগুন
জ্বলতে লাগলো। আগুনে পুড়ে, লাঠির আঘাতে, বেশ কিছু গ্রামবাসী গুরুতর আহত হওয়ার পর
যখন পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হ’ল, তখন দেখা গেল সাবিত্রী দেবীর দেহে প্রাণ নেই, আর
তাকে জড়িয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, অর্ধমৃত রক্তাক্ত কানাই। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একজোট হয়ে ভষ্মীভুত ঘরগুলোয় যখন আগুন
নেভাতে সক্ষম হ’ল, তখন সেগুলোর আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
সারা
রাত দগ্ধ, আহত, অর্ধমৃত মানুষগুলো একবারে নিঃস্ব হয়ে রাজবাড়ির ছাদে ও তার আশেপাশে
কোনমতে রাত কাটিয়ে, ভোরবেলা ছুটলো পাশের সেই গ্রামে ডাক্তারের সন্ধানে। এতগুলো
মানুষের হতাহতের কথা শুনেও কোন ডাক্তারকে নিয়ে আসা সম্ভব হ’ল না। অনেক বেলায় পুলিশ
এসে সাবিত্রী দেবীর মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। এবার কিন্তু ঝান্ডাধারী সমাজসেবী
মানুষগুলোর আর দেখা পাওয়া গেল না। গ্রামের অর্ধ ভিখারি মানুষগুলোর মাথার ওপরের ছাদ
কেড়ে নিয়ে পূর্ণ ভিখারি করে দিয়ে শেষ হ’ল আবার একটি রায়ট রাইয়ট খেলা।