বাইরে ধু ধু রোদ্দুর। গেটটা অনেক উঁচুতে। বেয়ে উঠার ক্যারিক্যাচারটা তখনো ঠিক জানেনা
রুমকি। বিশাল এই বাড়িটাই ওর স্বপ্নের জগত। বাগানের বড় বড় গাছের সাথে মুখ উঁচু করে গল্প করে। গান শোনায়। নতুন
শেখা কবিতা শুনিয়ে জানতে চায়, কেমন হলো ? মা শিখিয়ে দিয়েছে কাল রাতে। গাছেরা মুচকি
হাসে। হিংসুটে গলায় কাঁটাঝোপের ষড়াগাছটি বলে ওঠে, একদম মিথ্যা কথা। ওর মা ত খুব অসুস্থ সেই কবে থেকে। কথা বলবে কেমন করে
যে কবিতা শেখাবে?” মহাশিরিষ বকে দেয় ষড়াগাছকে। রুমকি সরে আসে কাঁটাঝোপকে এড়িয়ে। ওর মা সত্যি অসুস্থ। কিছুদিন হাসপাতাল কিছুদিন বাসা। কেবল
শুয়ে থাকে। মার রুম থেকে ওষুধের গন্ধের সাথে ভেসে আসে মিস জোন্স আর মুটকি এক
নার্সের সদা ব্যস্ততা। রুমকি কৃষ্ণচূড়ার হলুদ গা জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। মিথ্যে বলেছে
সে।
মা
যেদিন শাড়ি ধুতে দিত একসঙ্গে অনেকগুলো শাড়ি দিত। শাড়িগুলো ছিল অন্যরকম সুন্দর। ঘন
বড় পাড় আর আঁচল জুড়ে কারুকাজের রহস্য বুনট। সারা দুপুর রুমকি রোদ্দুরে নেড়ে দেওয়া
শাড়ির নীচে টমির সাথে খেলত, গল্প করত। ভাইয়াটা একদলা সাদা চর্বির মত ঘুমিয়ে থাকত
রেনুদির কোলে। মাঝে মাঝে কোনো শাড়ির উড়ে আসা
আঁচল খুব কাছে টানত রুমকিকে। আরে এটা ত
কথা ও কহানী শাড়ি। মানুষ আছে,পাখী, ফুল,নৌকা,স্বস্তিকা আরো কত কিছু। সারা দুপুর
বসে থেকেও রুমকি কোন কহানি খুঁজে পেত না । বয়েই গেল। নিজেই গল্প বানিয়ে টমিকে শুনাত। সেই গল্পে রাজা
আসত, রাক্ষস, জলদৈত্য, দুটো তিনটে ধূলো
ওড়ানো যুদ্ধ ত থাকতই । কিন্তু সব গল্পের শেষে একজন মা থাকত। খুব হাসি খুশী সুস্থ মা। তার চুলে
বেলিফুলের মালা দোল খেত। চোখে কাজল। রুমকির মার মত রোগা অসুস্থ ফ্যাঁকাসে মরা মরা
মা নয়।
রেণুদি
মার শাড়িগুলো রোদ্দুরে মেলে দিয়ে গেছে। একটা কালো কাঞ্জিভরমে মন আটকে যায় রুমকির ।
লাল মেরুনে ঘন কাজের পাড় আঁচল। বাপি যখন শরতের আকাশে মেঘের খেলা দেখাতে মধুমতি নদীর পাড়ে নিয়ে যায়
রুমকি আকাশ দেখে না। নৌকা দেখে। জীর্ণ পাল খাটিয়ে কোথায় যে যাচ্ছে নৌকাগুলো!
বাতাসে ফুলে ওঠছে পাল। কাঞ্জিভরমটা রোদ্দুরে দিলে এরকম ফুলে
ফুলে দুলে ওঠে । রুমকি আর টমি সেদিন নদী নদী খেলা খেলে। রুমকি কল্পনা করে সেই নদীর
ঘাটে কালো মেরুন কাঞ্জিভরম পরে কাশফুল হাতে নিয়ে বাপিকে গান শোনাচ্ছে মা, অমল ধবল
পালে লেগেছে – রুমকি টমির গলা জড়িয়ে চুপিচুপি
বলে, দেখিস টমি, মা একদিন ঠিক ভাল হয়ে যাবে!” টমিও লেজ নেড়ে সায় দেয়।
ওরা
চলে আসে দেওয়াল ঘেঁষে লিলি ফুলগাছের কাছে। দুপুরটা যখন নরম হয়ে বিকেলের হাত ধরে
গল্প করে তখন লিলিফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। ঠায় বসে থাকে রুমকি। লিলি কুঁড়িটি একটু
ফুলে ওঠে কাঁপতে কাঁপতে একটা পাপড়ি তার সাদা হাত বাড়িয়ে দেয়। ওমনি একটু হলুদ রেনু
সুগন্ধ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর একটি একটি করে পাপড়িগুলো খুলে হেসে হেসে লিলিফুল হয়ে যায়। একটি ফুল ফুটে উঠলে রুমকি আর একটি কুঁড়ির
সামনে ছুটে যায়। মিস জোন্স বলেছে, লিলিগাছ মা হচ্ছে। এরকম সময়ে ঈশ্বরের কাছে যা চাইবে ঈশ্বর তোমাকে তাই দেবে।”
রুমকি সেই সদ্য ফোটা লিলিফুলকে আকুল হয়ে বলে, আমার মাকে ভাল করে দাও লিলিফুল।”
খুঁজে
খুঁজে রেণুদি জোর করে ধরে এনেছে। হাত মুখ ধুয়ে দিতে দিতে বুনো বাউরা বলে বকাঝকা
করে রুমকিকে নিয়ে আসে মার রুমে। মার বিছানায় কোল জড়িয়ে শুয়ে আছে ভাইয়া। রুমকি
দরোজার কাছে পর্দা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাক্ষণ শুয়ে থাকা মাকে আজকাল ওর ভাল লাগে
না। একটু কাছে গেলেই মুটকি নার্স হিস হিস করে। ভয়ংকর শাসায়, যেওনা যেওনা, শব্দ করোনা, আস্তে ধর, কি মেয়েরে বাবা, ছেলে হলে ভাল
হত। সেদিন বাপির শেখানো কবিতা শোনাতে
গিয়েছিল। এমন জোরে হাত মুচড়ে দিয়েছে যে এখনো ব্যাথা পায় রুমকি। চোখ দিয়ে কাছে ডাকে মা। রেনুদি
ঠেলে দেয়, যা সোনা। রুমকি যায় না। ওর গা থেকে মাটি ফুল আর বুনো ঘাসের সবুজ গন্ধ
ভেসে আসছে। গন্ধটা গলে গলে অভিমানে ভাসিয়ে
নিচ্ছে রুমকিকে । মার দিকেও তাকাচ্ছে না। কালো শালের নিচ থেকে লম্বা সুন্দর একটি সাদা হাত অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িয়ে দেয়
মা। গোলাপবালাটা যেন আলোকস্তম্ভ। রুমকি রেনুদির হাত ছাড়িয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে, এরকম মা চাইনা। চাইনা। রুমকির পায়ের নিচে
অভিমান। সামনে পেছনে আকাশে বাতাসে অভিমানে
ডুবে যাচ্ছে সব । সমস্ত অভিমান নিয়ে রুমকি
লিলিবনে ঘাসের উপর কেঁদে লুটিয়ে পড়ে, আমার মাকে ভাল করে দাও ঈশ্বর। আগের মত করে
দাও।”
ছোটচাচা মোগলাই কাপে চা খাচ্ছে আর খুব হাসছে।
সেজচাচা জমানো চুটকিগুলো মাকে শোনাচ্ছে। মাঝে মাঝেই চোখ মুছে নিচ্ছে। বাগানের এক
কোণে শুধু সাদা ফুলের গাছ। বাপির পছন্দ। রুমকি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। চৌধুরী
শাড়ি বিতানের বেস্ট শাড়িটা পরেছে মা। মিস জোন্স আর মুটকি নার্স টেবিল সাজাচ্ছে। রেনুদি সেনাপতির
মত ডিরেকশন দিচ্ছে। একটা সাদা পিরিচে মার প্রিয় বেলিফুল তুলেছে বাপি আর ভাইয়া। তাতে
একটি সাদা গোলাপ শুভ কামনা হয়ে সবার সাথে হাসছে। মুটকি নার্স হেসে বলছে, মেয়ে তো
নয়, যেন ঝড়!” মা রুমকিকে দুহাতে আরো গভীর করে
জড়িয়ে ধরে। মার কোলে মার গন্ধ নিতে নিতে
লিলির পাপড়ির মত সাদা সুন্দর হাত ধরে রুমকি বলে, জানো মা আমি লিলি ফুল ফুটতে
দেখেছি!”