আমি দীপান্বিতা
আমি দীপান্বিতা, আর পাঁচজন বাঙালি
মেয়ের মতো আমি নই কিন্তু। শিল্পপতি দ্বীপায়ন চৌধুরীর একমাত্র সন্তান
আমি দীপান্বিতা । আমি বাবার আদুরে মেয়ে। বাবা চান স্টেটসে
পড়াশোন করে চৌকস হয়ে দেশে ফিরে তার শিল্প সাম্রাজ্যের হাল ধরি। আমার মা নীলা চৌধুরীর ইচ্ছেটা
অন্যরকমের। আমি এযুগের মেয়ে দীপান্বিতা। আমার ইচচ্ছা অনিচ্ছার অবশ্যই একটা মূল্য
আছে।
চেহারা সুরতে আমি যেন মায়ের কার্বন কপি। কিন্তু
মনের দিক থেকে আমি কিন্তু মায়ের বিপরীত। আমার মনটা বাবার মতো।মা এখন ভাবেন, আমার বাবার
সঙ্গে তার বিয়ে না হলে কানন দেবীর মত সিনেমার নায়িকা হতে না পরলেও কাছাকাছি পৌঁছাতে
পারতেন। মা চান ,তিনি নিজে যা হতে পারেননি আমাকে তাই বানাতে চান।
তার মানে তিনি চান আমি সিনেমার হিরোইন যেন হতে পারি। এ নিয়েই বাবার সঙ্গে মায়ের দ্বন্দ্ব।
আমি দীপান্বিতা এখন আর ছোটটি নেই। বোঝবার মত বয়স আমার
হয়েছে। আমি এখন বুঝি, ঘটনাচক্রে আমার বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়ে হয়েছিল।
আমার বাবা মাকে বিয়ে করে করুণাই করেছিলেন বলতে হয়।
আমি এখন বুঝতে পারি, মা
নীলা চৌধুরী ও তার বাবা দুই মেরুর মানুষ । বাবা দ্বীপায়ন চৌধুরী আমার মাকে বিয়ে
করে করুণাই করেছিলেন।
আমার দাদু মনোমোহন রায় উদয়গড়ের শেষ জমিদার। তারই একমাত্র মেয়ে আমার
মা নীলা । জমিদারের একমাত্র সন্তান হিসাবে নীলা রায়ের কৈশোর আর বয়:সন্ধিক্ষণের দিনগুলো
কেমন ভাবে কেটেছিল তা আমার জানার কথা নয়। তবুও আমি যতটুকু জেনেছি তা থেকে মায়ের
প্রতি আমার তেমনটা শ্রদ্ধা জাগে না।
নাটক নভেল এবং ইতিহাস পড়ে আমি জেনেছি সেকালের জমিদারদের কীর্তিকলাপ
মোটেই সুখকর ছিল না। আর পাঁচটা জমিদার বংশের মতো উদয়গড়ের জমিদার বংশের ইতিহাসও ছিল
মসীলিপ্ত।
সাধারণ মানুষের রক্তশোষণ করে জমিদাররা বিলাসী জীবনযাপন করে এসেছে।
নিজের জমিদারীতে প্রজাদের সামনে ফষ্টিনষ্টি করা দৃষ্টিকটূ হওয়ায় অনেক জমিদারই
কলকাতার অভিজাত এলাকায় বাগান বাড়ি বানিয়ে সেই বাড়িতে রক্ষিতা রেখে আলাদা আর একটা
সংসার পেতে বিলাসব্যাসনের সাথে জীবনযাপন করতে দ্বিধা করেনি। বাঈজীদের গানের আসর,
নতর্কীদের উদ্যাম নাচ, রেসকোর্সের ঘোড়ার বাজি, ইয়ারবন্ধুদের ফুর্তিতে জমজমাট
জমিদারের বাগান বাড়ি।
সিপাহী বিদ্রোহের পর ১৮৭০ সালের দিকে ইংরেজরা কলকাতায় তাদের ব্যবসা
বাণিজ্য জোরেসোরে শুরু করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় যে সব ইংরেজ মেম
সাহেবদের নিয়ে ভারত ছেড়েছিল তারা আবার ফিরে আসতে থাকে সিপাহী বিদ্রোহকে দমন করার
পর। তারা আবার তাদের তেজারতি শুরু করে কলকাতায়।
উদয়গড়ের জমিদার বাড়ির ভগ্নদশার চিত্র আজও আমার চোখর সামনে ভাসে,
চকমেলানো দেতলা দালান বাড়ির কক্ষে উদয়গড়ের ইতিহাস একদিন ছড়ানো ছিটিয়ানো।
ওখানকার ফটো গ্যালারীতে আমি উদয়গড়ের প্রত্যেক জমিদারের ছবি দেখেছিলাম।
আলমারীতে রাখা লাল সালু কাপড়ে বাঁধানো খেরোখাতায় নিবের কালীতে লেখা তাদের ইতিহাস আমি পড়েছিলাম দিনের পর দিন
ধরে। উদয়গড়ের জমিদারদের যাপিতজীবনের ইতিহাসের
মাঝ থেকে সত্যানুসন্ধান করা সত্যি সত্যি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জমিদার বংশের ইতিহাস
লিখতে লেখকরা অতি সচেতন ছিলেন, তা বলা বাহুল্য।
উদয়গড়ের জমিদারীর প্রতিষ্ঠতা করেন রমেন্দ্রমোহন রায়। তিনি ১৮৭০
সালের শেষ দিকে উদয়গড় থেকে শূন্য হাতে কলকাতায় যান। ভাগীরথী নদীর সুতানটীর পাশ
দিয়ে ভবঘুরের মতো ঘুরতে তিনি দেখতে পান এক ইংরেজ সাহেব ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকে আসতে
দেখলেন। সুন্দর ছেলেটির সামনে সাহেব ঘোড়া থামিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে
বললেন- ইউ বেঙলি, ওয়ান্ট নোকড়ি? রমেন্দ্র
মাথা নেড়ে যা বোঝানের চেষ্টা করে তা থেকে সাহেব বুঝতে পারে সে নোকড়ি চায়। সাহেব
তাকে তার ঘোড়ার পেছনে বসিয়ে তার আস্তানায় নিয়ে যায়।
সেই থেকে রমেন্দ্রমোহনের ভাগ্যের চাকা সামনের দিকে ঘুরে যায়। সাহেব
তাকে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করে। রমেন্দ্র অল্পদিনের মধ্যে ইংরেজি শব্দগুলো রপ্ত
করে নেয়। ইংরেজ সাহেবটির অত্যন্ত বিশ্বস্ত হয়ে উঠে অল্পদিনের মধ্যে রমেন্দ্রমোহন।
সাহেব রমেন্দ্রের উপর ব্যবসা বাণিজ্যের অনেক দায়দায়িত্ব দেন। সাহেবের দৌলতে
রমেন্দ্রমোহন উদয়গড়ের জমিদারী হওয়ার সৌভাগ্য ঘটে এবং ইংরেজে সরকারের কাছ থেকে
রায়বাহাদুর খেতাব পান।
আমি লাল সালু কাপড়ে বাঁধানো খেরোখাতার এ পর্যন্ত পাঠ করে ভাবতে
লাগলাম, উদয়গড়ে রায় বংশে ব্রিটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল রমেন্দ্রমোহনের
জমিদারী লাভ আর রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়া। থরে থরে সাজানো লাল সালু কাপড়ে বাঁধানো
খেরোখাতাগুলো পড়ে দেখলে রায় বংশের সব জমিদারের র্কীতিকলাপ আমার নখদর্পনে এসে যাবে।
আমার মায়ের জমিদারী চালচলনের ইতিবৃত্তও জানা যাবে হয়তো।
উদয়গড়কে গড়ে তোলার পেছনে রমেন্দ্রমোহন রায়বাহাদুরের একমাত্র পুত্র
রাজমোহনের অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। তিনি কলকাতায় না থেকেও বাবা
রমেন্দ্রমোহন রায়বাহাদুরের নির্দেশনায় উদয়গড়ে দোতলাপাকা বাড়ি, মন্দির, রাজমহল গড়ে
তোলেন। এলাকার জলকষ্ট নিবারণের জন্যে পদ্মদীঘিও তিনিই খনন করেন।
রাজমোহনের প্রথমপুত্র রমণীমোহন উদয়গড়ের তৃতীয় জমিদার,ফটো
গ্যালারীতে তার ছবির দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি সত্যি সত্যি সুপুরুষ
ছিলেন। উদয়গড়ের প্রথম তিনি মানুষ হয়েছিলেন কলকাতার বনেদীপাড়ায় । সেকালের জমিদারদের
কুর্কীর্তির বহি:প্রকাশ ঘটে রমনীমোহেনের চরিত্রে।
উদয়গড়ের শেষ জমিদার আমার দাদু মনোমোহন রায়। ভারতে থেকে ব্রিটিশ
সরকারে বিদায় ঘন্টা বাজার সময়ের শেষ জমিদার আমার দাদু। তার একমাত্র মেয়ে নীলা রায়।জমিদারের
একমাত্র মেয়ে বলে কথা! দাদু চেয়েছিলেন , তার একমাত্র মেয়ে নীলা পড়াশোনায় চৌকস হয়ে
উঠুক। জমিদারীর রমরমা অবস্থা আর বেশী দিন থাকবে না। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীর যুগ
আসছে। মেয়েকে একজন বাণিজ্যে সমৃদ্ধশালী একজন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে। এমন একটা ছেলে
তার হাতে আছে। একদিন ছেলেটি তার শিল্পপতি বাবার ব্যবসার সর্বেসর্বা হবে।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন মনোমোহন রায়।
তার স্বপ্নকে সফল করার জন্যে তিনি কলকাতার থিয়েটার পাড়ায় নীলার মাসি দেবিকার
বাড়িতে রেখে নাম করা স্কুলে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। দেবিকার ওখানে থেকে আমার
মায়ের পড়াশোনা লাটে ওঠে।
মনোমোহন রায় জানতেন না তার নিজের ছোট শালিকা নীলার মাসি দেবিকা
কলকাতার তথাকথিত অভিজাত শ্রেণি মধ্যমণি। নাচ গান,পর্টি লেগেই থাকে তাদের বাড়িতে।
দেবিকা মিত্তির সম্পর্কে আমার দিদিমা, আর আমার মায়ের ছোট পিসি। আমার দেবিকা
দিদিমার স্বামী আর আমার মিত্তির দাদু একদিন থিয়েটারের হিরো ছিলেন। আর আমার দেবিকা
দিদিমাকেও হিরোইন বানিয়েছিলেন।
সেই বাড়িতে আমার দাদু মনোমোহন রায় কেন তার একমাত্র মেয়ে নীলা
লেখাপড়া শেখাতে কেন পাঠিয়েছিলে, তা আমার বোধগম্য হয় না। দাদু তো মাকে কলকাতার নাম
করা লেডিস হোস্টেলে রেখে পড়াতেন তবে মনোমোহন রায়কে নিজের মেয়ে নীলা রায়কে নিয়ে
ভাবনায় পড়তে হতো না।
উদয়গড়ের জমিদার বংশের সুন্দরী ছোট্ট মেয়ে নীলা একদিন কৈশোর পেরিয়ে
বয়:সন্ধিক্ষণে পৌছাল। দেবিকা পিসি ও তার ফ্যানরা একদিন নীলা রায়ের মন কেড়ে নিল। নি:সন্তান
দেবিকা পিসিও এমনটাই চাচ্ছিলেন। কলেজে উঠার পর নীলা রায় ডানা মেলে উড়ার অপেক্ষায়। তার
একমাত্র বাসনা দেবিকা পিসির হাত ধরে সিনেমার অভিনেত্রী হওয়া। কানন দেবীর মতো
নায়িকা। দেবিকা দেবীর স্বামী বোচা মিত্তির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভাবলেন, উদয়গড়ের
জমিদার বংশের মেয়ে নীলা মায়ের পথ এটা নয়। দেবিকা তার উপর রেগে গেলেও নীলা মাকে
বাঁচাতে হবে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, সব কথা নীলার বাবাকে জানিয়ে তাকে এখানকার
পরিবেশ থেকে বাঁচাতে হবে।
তারপর বোচা মিত্তির যা করলেন তাতে বি.এ. পাশ করার পর নীলা রায়ের আর
কলকাতায় পড়াশোনার সুযোগ থাকলো না। আমার দাদু মনোমোহন রায় স্থির করলেন তিনি তার
একমাত্র মেয়েকে জমিদার বংশে বিয়ে না দিয়ে তার কাঙ্খিত ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার
জন্যে চেষ্টা করে যাবেন। তিনি মনে মনে খুঁজতে থাকলেন নীলা মায়ের জন্য তার জানা
শোনা ভাল ক্যারিয়ারের ছেলেকে।নীলা রায় কলকাতার পাঠ চুকিয়ে উদয়গড়ে ফিরে এলেও বায়না
ধরলো কলকাতায় ফিরে যাওয়ার। কিন্তু আমার দাদু ও দিদিমা তাদের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার
জন্যে উঠে পড়ে লাগলেন। একদিন আমার দাদু দিদিমার ইচ্ছে পূরণ হলো শিল্পপতি দ্বীপায়ন
চৌধুরীর সাথে তাদের একমাত্র মেয়ে নীলা রায়ের মাধ্যমে।
স্পষ্ট অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখা খাতায় আমার মায়ের সম্বন্ধে আর কোন
কথা লেখা না থাকায় আমার মনে খটকা লাগলো। তবে কি মা সে সময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে
আপত্তি জানিয়েছিলেন, নাকি তিনি নিজেই কলকাতায় তার পিসির বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন।
তারপরের বিষয়গুলো জানার জন্যে আমার মনটা আইঢাই করতে থাকে। মাকে জিজ্ঞেস করে কোন
কিছুই জানা যাবে না, আমি ভাল মতোই জানি।
আমি দ্বীপান্বিতা, উদয়গড়ের শেষ জমিদার মনোমোহন রায়ের একমাত্র
নাতনী, আর শিল্পপতি দ্বীপায়ন চৌধুরীর একমাত্র সন্তান
হয়ে এখন আর বাবা মায়ের বিয়ের খোঁজ নিয়ে কাজ নেই। এখন আমার একটাই কাজ চৌধুরী
ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমাকে আমার বাবা
দ্বীপায়ন চৌধুরীর ইচ্ছে পূরণের উদ্দেশ্যে স্টেটসে গিয়ে পড়াশোনা করে বিজিনেস দুনিয়ায় চৌকস হওয়া।