গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

পুজোর গন্ধ


"
কিরে,বাবলি হাত কাটবি তো" শিবানি কাকিমার স্নেহের ধমকে সচেতন হয় বাবলি। আবাসনের অষ্টমী পুজোর ফল কাটতে বসেছে বাবলি আর সেই সময়েই কাঁথা কাজের পাঞ্জাবী পরিহিত পল্লবের আগমন। কী করে নিজেকে সামলায় বাবলি? পল্লবের মতো রূপবান গুনবান ছেলে তাদের কেন, আশেপাশের আবাসন গুলোতেও নেই। তার হাঁটার স্টাইল, পোশাক, এমনকি নাকের ওপরে চশমাটা কে ঠেলে দেবার স্টাইলটাও যেন স্বতন্ত্র। সে গান গাইতে উঠলে মেয়েরা অজ্ঞান হবার যোগার, তার ঢাক বাজানোর স্টাইলে মেয়েদের মনে ঢাকেরবাদ্যি, পল্লবের ধুনুচি নাচ কেউ মিস করে না, অঞ্জলির ফুলগুলো নেবার ঝুড়ি বাড়িয়ে দিলে সবাই পল্লবের পাতা ঝুড়িতেই দিতে চায়। আর সবাইই ভাবে যদি কোনোক্রমে পল্লবের চোখে লেগে যাওয়া যায় তাই পুজোর সাজের কম্পিটিশন লেগে যায়। সে হেন একটা মানুষ কিনা বাবলির মতো সাধারণ দেখতে তস্য সাধারণ মানের একটা মেয়েকে পছন্দ করে। এটা জানার পরেও পল্লব সামনে এলে বাবলির হাত কাঁপবে না, এতোটা উদাসীন সে নয়। শিবানি কাকিমার কাছে ধরা পড়ে গেল নাকি ভাবে, শত হলেও পল্লবদা'র মা তো। পল্লব এসেই ধুনুচিতে অকারণ ধুনো ঢালল, "এই গন্ধটা ছাড়া পুজোই জমে না।" বাবলি বুঝতেই পারছে পল্লবদা কাজের বাহানা করে এখন থাকবে এখানে।

অঞ্জলির সময় বাবলি সবাইকে ফুল দেয় আবার অঞ্জলি হয়ে গেলে পর পল্লব ঝুড়ি করে সেই ফুল মায়ের পায়ে দেয়। তাদের দু'জনকে একসাথে দেখে পটাশ পটাশ মন্তব্য উড়ে আসে বিভিন্ন দিক থেকে। সব কাজের মধ্যেই কেমন অদ্ভূত চোখে তাকায় পল্লব। শেষ ব্যাচে বাবলির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অঞ্জলী দিল। সেখানে অঞ্জলীর ফুল নেবার সময়ে আবার প্রসাদী ফুল দেবার অছিলায় দু' দু'বার এমন কায়দা করে হাতটা ধরল সবার সামনে, কেউ খেয়াল না করলেও, বাবলি কেঁপে, লাল হয়ে একাকার। সকালে সাদা খোলের লাল পেড়ে শাড়ি, খোলা চুলেই হোক বা সন্ধ্যায় জমকালো শাড়ি, সবেতেই বাবলিও যেন সুন্দরী।

পরের দিন সকালে জিনস্ টি-শার্টে আরেক রূপের পল্লব তাদের ঘরে হাজির, বড় এক ঝুড়ি শিউলি ফুল নিয়ে। বাবলি জানে,সে যেমন শিউলিফুলের গোড়ে মালা গাঁথে আর কেউ সেটা পারে না, তাই নবমীর দিন এ কাজটা তার ভাগে পড়বেই। তবে ফুল দিতে পল্লব আসবে ভাবেনি। ঝুড়িটা দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পল্লব। বাবলির জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বলে "আমি আজই চলে যাচ্ছি।" কথাটা শুনছিল কয়েকদিন ধরেই, এমন মেধাবী ছাত্র, সে কতো ভালো চাকরি পেয়েছে, আর চলে যাবে সেই কোন দেশে। তবে সেটা যে এমন পুজোর মধ্যেই হবে বুঝতে পারেনি বাবলি। পল্লবের কথায় একটা কেমন রাগ, দুঃখ, অভিমান গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে, টসটস করে চোখ দিয়ে জল পড়ে। সারাঘর শিউলির গন্ধে ভরে দিয়ে 'চলে যাচ্ছি' বলে চলেই গেল পল্লব, বাবলির তরফে কিছু বলার সুযোগ দিল না। অবশ্য সুযোগ পেলেও বাবলি কি সত্যিই কিছু বলতে পারত? তখন তো তার স্বর বন্ধ হয়ে গেছে।

"
এখন আপনাদের মিসেস সেনগুপ্তর লেখা একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছি । আমাদের এবছরের নতুন সদস্য ডক্টর সেনগুপ্তর ওয়াইফ শ্রীমতি বাবলি সেনগুপ্ত। আমায় বলা হ', এইটি উনি নাকি এই মাত্র লিখেছেন। কবিতার নাম, নস্টালজিয়া
"
আঙ্গুলের ফাঁক গলে, পড়ে যাচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো স্মৃতি।
এতো বছর, ভেজা বালির মতো চেপে রেখেছিলাম মুঠিতে।
আজ, ধুনোর গন্ধে মুঠি আলগা হতেই,
রঙিন পুঁতির মতো ওরা লাফালাফি চতুর্দিকে।
সুখস্মৃতিরা, ধুনোর ধোঁওয়ায় মিশে,
 
সৃষ্টি করল রামধনু নস্টালজিয়া।
দুঃখরা শিশির হয়ে ভিজিয়ে দিল ঘাস।
আমরা সকলেই হয়ত কম বেশি পরিস্থিতির শিকার,
পুজোর গন্ধ সাময়িক ফিরিয়ে দেয় হারানো সময়।"
চারদিকে হাততালির ফোয়ারার মধ্যে মুখ নিচু করে মালিনী, পূরবী জিজ্ঞেস করে
"
কি হল বাবলিদি? শরীর খারাপ লাগছে? জল খাবে? বাড়ি যাবে? ডক্টর সেনগুপ্তকে ডাকব?"
"
কিছু নাঃ। আসলে এমন বিখ্যাত একজন আবৃত্তিকারের মুখে নিজের কবিতা, নিজের নাম শুনে, ওইঃ, একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম আরকি"
"
কি তোমায় বলেছিলাম না? দেখো তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিলে। আরে বাবা, 'রতনে রতন চেনে' তোমার এতো গুণ, মুখার্জীদার মতো মানুষ তার কদর বুঝবেন না?"
"
কেমন ভালো লাগল না বলো? তুমি এতো বছর, এতো দেশ বিদেশের পুজো দেখেছ, কিন্তু আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের পুজো, ছোটো হলেও, টোটালি ডিফরেন্ট। মি. মুখার্জীই সেই আমাদের ছোটোবেলার পুজোর ফ্লেভারটা ধরে রেখেছেন। দেখলে না? এসেই কেমন জমিয়ে দিলেন ঢাক বাজিয়ে, ফায়ার অ্যালার্মকে ঘোল খাইয়ে ধুনো জ্বালিয়ে। সত্যি বাবা, ঢাকের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ ছাড়া পুজো পুজো লাগে না, বলো?"
"
ভদ্রলোক, এতো বয়সেও কি ফিট আর কি হ্যান্ডসাম"
"
কতো যে গুণ কি বলব, উনি পারেন না, এমন কোনো কাজ বোধহয় নেই। সাথে কোনো অহঙ্কার নেই"
"
আবার দেখো, কাল যখন নবমীর পুজো হবে, উনি একটা অসাধারণ শিউলি ফুলের মালা, মা কে পরাবেন"
"
হ্যাঁ, গো! শেফালি ফুল দিয়ে যে অমন গোড়ে মালা হয়, না দেখলে বিশ্বাসই করবে না"
"
কে গাঁথেন মালা? মিসেস মুখার্জী? মানে, কোথায় পান শিউলি ফুল?"
"
না, না, দেশের থেকে আনান গো। এদেশে শিউলি ফুল কোথায়? তাছাড়া, উনি তো বিয়ে করেননি"
"
কেন?"
"
সে, অনেক গল্প। ওর বাবা মা বলে চূড়ান্ত অর্থডক্স ছিল"
"
আরে, মুখুজ্জে ব্রামহিন বাড়ির ছেলে হয়ে, সে কোন নন-ব্রামহিন মেয়েকে নাকি বিয়ে করতে চেয়েছিল___" আর কিছু কানে ঢোকে না বাবলির।

তাই বুঝি, মা মরা মেয়েটার বিয়ের বিষয়ে শিবানি কাকিমার উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি? সম্বন্ধ আনা থেকে মেয়ে বিদায় অবধি পরম আত্মীয়ার রোল প্লে করেছিলেন? ধন্যি ধন্যি করেছিল প্রতিবেশীরা। নিশ্চিন্ত হয়েছিল বাবা। সেই পুজোর পরের অঘ্রাণেই বিদায় নিয়েছিল বাবলি। বিয়ের দিনকেও কান্না, রাগ, অভিমান জমছিল, কার ওপর, শুধু বাবলির মনই সেটা জানত। অথচ, কেউ তো বাবলিকে অপেক্ষা করতে বলে যায়নি, এমনকি তাকে বিয়ে করবার, ভালোবাসবার মৌখিক প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যায়নি। তবু, বাবলির প্রতি কারোর আচরণ তাকে মনেমনে আশা জাগিয়েছিল।
"
ডক্টর সেনগুপ্তকে একটু ডেকে দাও না, ভাই"
এখন সত্যিই শরীর খারাপ লাগছে বাবলির; কেমন রাগ, অভিমান, দুঃখ, কান্না, দলা পাকিয়ে আসছে গলার কাছে। বাড়ি যেতে মন চাইছে, ধুনোর ধোঁওয়া টা বড্ড সাফোকেটিং।