গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৫

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

অপবাদ


 এক যে ছিল মেয়ে।  নাম ছিল তার গুরুবারী। গুরুবারী মুর্মু। পাতু মুর্মুর একমাত্র মেয়ে। ঠাকুমা,বাবা আর মেয়ে নিয়ে  তিনজনের ছোট্ট সংসার।দারিদ্র সীমার নিচে থাকলেও সংসার ছিল হাসি খুশিতে প্রাণবন্ত। সেই ছোটবেলায় মা হারা মেয়েটাকে কোলেপিঠে মানুষ করে ঠাকুমা।বাবা পাতু জঙ্গলের জ্বালানি কাঠ কাঁধে নিয়ে যায় সুঁড়ি রাস্তা ধরে প্রায় আড়াই ক্রোশ দুরের গঞ্জে, বাগমুন্ডিতে। কাঠ বেচে যে কটা টাকা পায় তাই নিয়ে সংসারের চাল,ডাল,নুন আর লংকা নিয়ে বাড়ী ফেরে সন্ধ্যে বেলায়। সঙ্গে বনজ কন্দ আর শাকপাতা দিয়ে মোটামুটি দিন গুজরানটা হয়ে যায়। ওদিকে বুড়ি ঠাকুমা বিদরী মেঝান সকালবেলায় ফেনভাত বনকচু সেদ্ধ খেয়ে কাঠ, মানকচু,আর খামআলুর খোঁজে বেরিয়ে যায়। নাতনিকে পাঠিয়ে দেয় অযোধ্যা হাই স্কুলে।

পাতুর খুব ইচ্ছে গুরুবারী ভাল করে পড়াশুনা করুক, ভদ্রলোকের সঙ্গে মিশুক। সেও যেন একদিন মাষ্টারিণী হতে পারে।স্কুলের নুতুন মাষ্টার তো বলেছেন গুরুবারী খুব মেধাবী মেয়ে। পাতুর গর্বে বুক ফুলে উঠে।  গ্রামের নাম সাহারজুড়ি।ছবির মত গ্রাম। অযোধ্যা থেকে আধক্রোশ দুরে। পাশদিয়ে তির তির করে বয়ে যায় টুরগা নদী।শাল মহুল করঞ্জা,কেন্দু, গলগল, সৎসার গাছের ঘন জঙ্গল।তারই বুক চিরে সুঁড়ি পথ। মনের আনন্দে ফুরফুরে মেজাজে এ পথ দিয়েই গুরুবারী স্কুল যাতায়াত করে। মাঝে মাঝেই দেখতে পায় বাচ্চা খরগোস আর হরিণের দুষ্টুমি। ওরাই যেন ওর পথের সাথী। লালপাড় সাদা শাড়ী।পাতু বাগমুন্ডির কাপড় দোকান থেকে ধার করে এনে দিয়েছে। গুরুবারী মনের আনন্দে গুনগুন করে সারহুল আর বাহা গান করে।  দেখে বোঝা যায়না যে ও সাঁওতাল মেয়ে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। পান পাতার মত মুখের গড়ন। সতের বছরের সুঠাম কোঁদা শরীর। বর্তুলাকায় নিতম্ব। উছলে পড়া যৌবন।গভীর চোখ। গলায় সস্তা দামের ইমিটেশন সুত। বাঁ নাকে নকল পাথরের নাকছাবি। দেখলে চোখ ফেরানো দায়।

প্রধান শিক্ষক জীতন মাহাত প্রায়ই গর্ব করে বলেন, "গুরুবারী অনেক দুর যাবে। ও পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়ার গর্ব হবে একদিন ভবিষ্যতে। দেখেছো না সাঁওতাল মেয়ে হয়েও কেমন সুন্দর ইংরাজী বলতে পারে। অঙ্ক পদার্থবিদ্যায় আশ্চর্য দক্ষতা। এবার দেখে নিও উচ্চমাধ্যমিকে এক থেকে দশের মধ্যে হয়ে, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে।" ইংরাজী শিক্ষক নরেন ব্যানার্জীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বছর দুই আগে স্কুলে তিনি যোগদান করেছেন। এসেই গুরুবারীর প্রতিভা দেখে অবাক হয়েছেন। তিনি ভাবতেও পারেননি এই অজ পাহাড়ী ছোট্ট গ্রামের অর্ধভুক্ত একটা সাঁওতাল মেয়ের মধ্যে এমন বিরল প্রতিভা থাকতে পারে। তাই তিনি ঘষে মেজে আরও বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রায়ই টিফিন পিরিয়ডে বকুল গাছের ছায়ায় বসে গুরুবারীকে ইংরাজী পাঠ দিতেন,বাড়ীর কাজ দিতেন।গুরুবারী যেহেতু অত্যন্ত গরীব বাড়ীর মেয়ে তাই এভাবে টিউশানটা স্কুলেই সেরে দিতেন বিনাপারিশ্রমিকে। মাঝে মধ্যে খাতা কলম দিয়েও সাহায্য করতেন। এই ব্যাপারটা চোখে পড়ে বিশাই মাঝি আর কাতু হেমব্রমের। বিশাই দেড়বছর ধরে গুরুবারীর পেছনে পড়ে আছে। গুরুবারী ওকে পাত্তা দেয়না। বিশাই দুয়েক বার শুঁড়ি রাস্তায় আগলে ছিল বটে কিন্তু গুরুবারীর চ্যালাকাঠ হাতে রণমুর্তি দেখে সাহসে কুলোতে পারেনি।বিশাই আর কাতু বেশ কিছুদিন আগে থেকে একটা নিষিদ্ধ সংগঠনে যোগ দিয়েছে। মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে দিনরাত।বকুলতলায় ব্যানার্জী মাষ্টারের সঙ্গে দেখে মাথায় খুন চেপে বসে বিশাইয়ের। তক্কে তক্কে থাকে ব্যানার্জী মাষ্টার কবে বাড়ী যাবে তার অপেক্ষা করতে থাকে। গত শনিবার বিকালবেলায় হঠাৎ শোনা যায় স্কুলের ইংরেজী শিক্ষক নরেন ব্যানার্জী সপ্তাহান্তে বাড়ী যাওয়ার পথে বামনি ঝরণার কাছে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।তাঁর মোটরবাইক ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আরও শোনা গেল যে ব্যানার্জী মাষ্টার সাঁওতাল সমাজের পাতু মুর্মুর মেয়ে গুরুবারীর ইজ্জত লুঠ করার জন্যই এই কঠিন শাস্তি দেওয়া হযেছে।
 
সন্ধ্যের মধ্যে দাবানলের মত বার্তা ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ী গ্রামগুলোয়।  বিচার চাইতে টাঁড়পানিয়া, পিটিদিরি, হাতিনাদা ভুঁইঘরা গ্রাম থেকে দলেদলে সাঁওতালরা চলল সাহারজুড়ি।  কাতু হেমব্রম  সাহারজুড়ি গিয়ে প্রথমেই গাঁও বুড়োর কাছে গুরুবারীর সাথে ব্যানার্জী মাষ্টারের  ফষ্টিনষ্টির ব্যাপার ফলাও করে বললো সে নাকি নিজের চোখে সব দেখেছে। জরুরী ভিত্তিতে গাঁওবুড়ো সাঁওতাল সমাজের মাতব্বর,পাতু, মেয়ে গুরুবারী আর ছেলেছোকরাদের নিয়ে সালিশিসভা বসালো সন্ধ্যের মধ্যেই। চার পাঁচটা গ্রামের লোকের ভীড়। সবাই রোচক ঘটনার সাক্ষী হতে চায়। পাতু উপুড় হয় সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে গাঁওবুড়োর পা ধরে মৃতবৎ পড়ে থাকে। গুরুবারী মাথা উঁচু করে থাকলেও কিভাবে মোকাবিলা করবে সেটা ভেবে পায়না। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কাতু সর্বসমক্ষে সাক্ষ্য দেয়। সে বলে শুক্রবার নাকি সীতাচাটানির জঙ্গলে গুরুবারী আর ব্যানার্জী মাষ্টারকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছে। 

গুরুবারী গাঁওবুড়োকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে যে আদপেই এমন কোন সম্পর্ক ছিল না মাষ্টারের সঙ্গে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। নেতিয়ে পড়া পাতুর অনুনয়বিনয়ে গাঁওবুড়োর মন ভিজলো না। বিচারের রায় দিল গাঁওবুড়ো। গুরুবারীর মাথা ন্যাড়া করে উলঙ্গ অবস্থায় গ্রামটা তিনবার ঘুরে এই রাত্রেই ওকে গ্রাম ছাড়তে হবে। আর পাতুকে চার হাঁড়ি হাঁড়িয়া জরিমানা দিতে হবে। উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে উঠলো "তাই হোক,তাই হোক।"গুরুবারী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো নাঅগনিত যুক্তিহীন অশিক্ষিত মানুষকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। রায় মাফিক সমস্ত নির্দেশ পালন করে একরাশ মিথ্যাপবাদ মাথায় নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। 

গভীর অন্ধকারে শৈল শিরার শুঁড়ি পথ ধরে মাথান্যাড়া এক উলঙ্গ নারীমুর্তি মিলিয়ে গেল জঙ্গলের নিস্তব্ধতায়।