গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

অসমাপ্ত সংলাপ

মেঘের দুপুরে নিজের ছায়াকে সনাক্ত করা যতটা কঠিন তার চেয়েও জটিল অনীকদাকে চেনা ।কখন যে কি করে বসে তা আন্দাজ করা মুশকিল । শুধু মুশকিল নয় বিশ্বাস করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে অনেক সময় । প্রথম পরিচয় কখন কিভাবে হয়েছিল মনে নেই তবে প্রতিদিনই তাকে রহস্যময় মনে হত । মানুষটাকে কি আমি আজও চিনি ? নিজেই তো জানিনা । চেনা অঙ্কের মত মনে হলেও শেষ লাইনে এসে থমকে গেছে উত্তর । ধরতে গিয়েও চ্যাং মাছের মত পিছলে গেছে বারবার । এখন যে মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে কি সত্যিই অনীকদা ? নিজেকেই প্রশ্ন করি ।জিজ্ঞাসার বৃত্তে ঘুরে যায় স্নায়ু । বহিরঙ্গে অনীকদার কোন ছাপ নেই । লাল টুপি যা তার অবয়বের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবেই, আজ নেই । দাড়ি গোঁফ সুন্দর ভাবে কামানো । অথচ অনীকদা মানেই এলোমেলো বিন্যাস বর্জিত ফিদেল কাস্ত্রো দাড়ি । ছন্নছাড়া আধ ময়লা হাফ সার্ট । উদভ্রান্তের মত এক দীর্ঘশ্বাস । আজ সেসব কিছুই নেই । বেশ স্মার্ট , রিলাক্সড ও সুন্দর লাগছে তাকে । ডাকলাম কি ব্যাপার অনীকদা , তোমাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে , ফ্রেশ । তুমি তো এমন ছিলেনা । প্রেমে পড়লে না কি ? - খেপেছিস ? - দেখে তো তাই মনে হচ্ছে । কি ব্যাপার দাদা ? - পরে শুনিস। সে অনেক গল্প ।কেমন আছিস ? - ভাল নেই । - -কেন ? কি হল ? - অনেকদিন তোমাকে দেখিনি প্রান ভরে। - তাই ? ফুসফুস ভরা এক অলৌকিক হাসি হাসল অনীকদা - এবার রোজ দেখা হবে । প্রাণ ভরে যতখুশি দেখিস । ডেলি দেখলে ভাল লাগবেনা, আকর্ষণ কমে যাবে বৈচিত্র্য মুগ্ধতাও । - বাড়তেও তো পারে ।

- চান্স নেই। গালাগালি ছাড়া আমার আর কোনো পুরস্কার নেই। আসি রে, অনেক কাজ । পরে কথা বলব । - হ্যাঁ , দাদা । তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে । - অফিস ? সে তো চারদিন হল ছেড়ে দিয়েছি । তোরা জানিস না ? অনীকদা ফিরে তাকাল আমার দিকে । - ফালতু ইয়ার্কি করছ কেন বস । ঠিক এভাবেই বেরিয়ে এল কথাগুলো । - অন গড বলছি । তবু বিশ্বাস হয়না । এরকম কথা অনীকদা বহুবার বলেছে । বারবার শুনতে শুনতে কবেই তো গুরুত্ব কমে গেছে সেসব কথার । -বিশ্বাস কর দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে গিয়ে অনেক ভুগেছি। না নাটক না চাকরি কিছুই তো সামলাতে পারিনি । চা না কফি এই দ্বন্দ্বেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর । ভুল রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কবেই তো হারিয়ে গেছে আসল রাস্তা । আমি অনীকদার দিকে তাকাই , তার চোখের লিপি পড়তে থাকি , এ কি কোনও নাটকের সংলাপ ? -শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি । অনেক দিন পর ... অনীকদা কে থামিয়ে দিই মাঝপথে । তুমি কি পাগল হয়ে গেছ দাদা ? -আজ নয় অনেকদিন আগেই । পাগল ছাড়া কেউ নাটক করেনা, কবিতা লেখেনা । জানে এতে পয়সা নেই , যশ ভালোবাসা , খ্যাতি নেই... শুধু গালি। তালি দেওয়ার কেউ নেই । আজ চলি । বলে ঝড়ের গতিতে চলে গেল অনীকদা । ব্যাপারটাকে আমি সত্যি মনে করিনি সেদিন । প্রলাপ নাট্য সংস্থার সাথে আমার যোগাযোগ অনেকদিনের । শিশুশিল্পী হিসেবে দু একবার অভিনয়ও করেছি ছোটবেলায় । প্রলাপ অনীকদার নিজের হাতে তৈরি । তার ঘর উঠোন । তার জীয়ন কাঠি । ততটা সংসারী নয় অনীকদা । বউ ছেলে মেয়ে সবই আছে অথচ সম্পর্কহীন নিরাসক্ত । একে একে সবাই ছেড়ে গেছে তাকে । ছাড়তে পারেনি তার মা । রোজগার পাতি মন্দ নয়। বেসরকারি চাকরি । চাকরি ভাল লাগেনা বলে মাঝে মাঝে without pay . নাটকের দল নিয়ে দূর দূরান্তে যেতে হয় , অফিস কামাই । নাটকের প্রস্তুতি ,অফিস কামাই । প্রচুর মাইনে কাটা যায় । চাকরিটা যাব যাব করেও যায়নি । এসব নিয়ে সংসারে নানা অশান্তি ।ঝুট ঝামেলা দাম্পত্য কলহ । সুমিতা বৌদি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই অনীকদাকে ছেড়ে চলে যায় । ছেলে মেয়ে দুটো তখন ছোট । এসবকথাও নিঃসংকোচে অনীকদা বলেছে আমার কাছে সবার কি আর সংসার ভাল লাগে ? - এখনও সময় আছে , তুমি বৌদিকে বোঝাও । - বুঝিয়ে হয়ত আবার নিয়ে এলাম । কিন্তু আমার জীবন তো বদলাতে পারব না । - নিজেকে অন্তত একটু বদলাও , সামান্য । - পারবোনা , বিশ্বাস কর আমি পারবো না । এসব কথা বলার সময় তার গলার কম্পাঙ্ক আমি অনুভব করেছি । চোখে অশ্রুভাস কিম্বা মুখে দুর্ভাগ্যের কোন অভিব্যক্তি লক্ষ করিনি সেদিন । পরে অনেক পরে একদিন কথায় কথায় বলেছিল সুমিতাও ভুল বুঝল , দুজন মানুষের বাঁচার সংজ্ঞা যখন পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায় তখন হাত ছেড়ে দেওয়াই উচিত । ...। এই প্রথম আমি অনীকদা কে মঞ্চের বাইরে কাঁদতে দেখেছিলাম । আরও অনেককথা ছিল হৃদয়স্পর্শী আত্মা নিংড়ানো । আজকের অনীকদাকে কিন্তু ততখানি সিরিয়াস মনে হল না আমার ।

২ ঐ দেখ স্বর্ণ মৃগ দূরে...। মায়ার ছলনে ভুলি

কি যেন হারায়ে খুঁজি আজ । কই সীতা ? আনন্দ উৎসব সুখ চুরি করে নিয়ে গেছ তুমি তো রাবণ ।

মাইল মাইল দীর্ঘ বনভূমি ...। - কি বকছ অনীকদা ? - প্রলাপ । রামের ডায়লগ বলছি । আমার নতুন নাটক । - ডায়লগ শুনতে আসিনি দাদা । - তবে - তুমি কি সত্যিই চাকরিটা ছেড়ে দিলে ? - কেন ? তোর বিশ্বাস হচ্ছেনা ? তবে দেখ বলে পকেট থেকে রেজিগনেশন লেটার বার করে আনে অনীকদা । এখনও অ্যাকসেপ্ট করেনি , দু এক দিনের মধ্যেই করবে । দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালই ভাল , তা ওরা ভাল করেই জানে। - আরও ভাবা উচিৎ ছিল তোমার - অসম্ভব । অনেক ভেবেছি , বারবার পিছিয়ে এসেছি । আর নয় । - খাবে কি ? তোমার তো জমানো টাকাও নেই । - চলে যাবে । যাদের চাকরি নেই তাদের যেভাবে চলে । আমি চুপ করে থাকি । বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি । কোথায় দাঁড়িয়ে আছি । - চিন্তা নেই । ৩/৪ টে সিরিয়াল আমার হাতে । যা পাব , আমি আর মা দুটো তো প্রানি ঠিক চলে যাবে । বুঝতে পারি ফালতু বকছে অনীকদা । কোথাও কিছু নেই । বিরক্ত হয়ে উঠি থামো তো , কি মনে কর তুমি জীবনটাকে ? নাটক ? থিয়েটার ? রঙ্গমঞ্চ ? - একদম তাই । জীবন তো এক প্রলম্বিত নাটক । তার বেশি কিছু নয় । অনীকদার হাতেপায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম । শোনেনি আমার কথা । এরপর আর কোন যোগাযোগ ছিলনা । অভিমান হয়েছিল ভীষণ ।পরে সুমিতা বউদির সাথে একদিন দেখা হয়েছিল অশোক বস্ত্রালয়ে । সঙ্গে ঋদ্ধি ও ছিল , অনীকদার মেয়ে , এখন কলেজে পড়ে । সব খুলে বলেছিলাম । - তাহলেই ভাবো এইসব পাগল ছাগল নিয়ে সংসার করা কত জটিল । - কেমন আছ বৌদি ? - আছি একরকম । জীবনের চলার পথ অনেকসময় পা ও ঠিকমত খুঁজে নিতে পারেনা । আসি ভাই । মানুষটাকে দ্যাখো , খুব চিন্তা হয় ...। এরপর অনেক ধুলোবালি জমেছে স্নায়ুর পর্দায় । আমাকেও পেটের দায়ে চলে আসতে হয়েছে অনেক দূরে । ৩ অনীকদার মায়ের মৃত্যুর সময় ওর পাশে থাকতে পারিনি । অফিসের কাজে হায়দ্রাবাদে ব্যস্ত ছিলাম তখন । ফিরে এসে শুনি সরমামাসি আর নেই । আফসোস হয়েছিল খুব । অনীকদার চোখমুখ তখন পাগলের মত । অনর্গল বকে চলেছে অসংলগ্ন কথা । অর্থহীন প্রলাপ । দেখতেও ঠিক স্বাভাবিক লাগছে না । চোখে জল এল । মানুষের গতিপথে কত বাঁক । বিচিত্র রঙের খেলা ছবিঘরের দেওয়ালে । মাসীমার কথা স্মরনে এল । কত যন্ত্রনা আর কষ্ট নিয়ে বেঁচেছিল একটু সুখ দেখবে বলে । দেখতে পেল কি ? অনীকদার মুখোমুখি দাঁড়ালাম এবার । আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল অনীকদা । চোখের জলের ধারাস্নানে ভিজে যেতে লাগলাম আমরা দুজনে ।
৪ কখনও কখনো খুব দাম্ভিক মনে হত তাকে । যখন বলত আমার ঐ সংলাপটা শুনেছিস তোদের শম্ভু মিত্র সাতজন্মেও পারত ওরকম ডায়লগ ছাড়তে ? রক্তকরবী , চাঁদ বনিকের পালা যদি আমার হাতে পড়ত কাকে অভিনয় বলে দেখিয়ে দিতাম । শম্ভু মিত্র একদম বোগাস । শুনে যেতাম সেসব কথা । লোকটা বলে কি আকাশের চাঁদ আর চাঁদু পরামানিকের তুলনা । অদ্ভুত মায়া হত । জানতাম বুকের ভেতর কোথাও তরল কষ্ট আছে । শুধু শিশির ভাদুড়ির প্রসঙ্গ এলে চুপ করে যেত। হাত দুটো মাথার উপর তুলে প্রনাম করে বলত গুরুদেব । যেমন শিক্ষিত মানুষ সেরকম ই প্রতিভাবান । নানা ধরনের নাটক শোনাত । বিদেশি নাটক নিয়েও অদ্ভুত সব কথা বলত , সব বুঝতাম না । - একটা নতুন নাটক নামাচ্ছি । একদম টাটকা । থিয়েট্রন কনসেপ্টে লেখা । সুন্দর এক্সপেরিমেন্ট বলে শুনিয়ে যেত পাতার পর পাতা । শ্রদ্ধায় প্রনত হয়ে উঠতাম । নির্ভার মমতায় গিলে খেতাম তার অভিব্যক্তি । যদিও সংলাপ তেমন গতিশীল নয় । আর্থিক অসঙ্গতি মঞ্চস্থ হতে দেয়নি সেই নাট্যরূপ । সরমামাসিমনির মৃত্যুর পর আরও অভাব নেমে এসেছিল ঘরে । অগোছালো ছন্নছাড়া ভাব । অনীকদাকে বলতাম ঘরের দিকে মন দাও । বউদিকে নিয়ে এসো , আর কেন অভিমান অট্টহাসিতে আকাশ কাপিয়ে হেসে উঠত অনীকদা দুদিনের এই মোহ একে তুমি ঘর বল । যে ঘরের স্বপ্ন দেখে এতদূর হেঁটেছি অক্লেশে ... আর বেশি দূরে নেই...। -তুমি কি সংলাপ বলছ দাদা ? -না তো । স্টেজের বাইরের আলোকিত সত্য । - তোমার আজকের জীবন এ তো শুধু নাটকের জন্য । সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এভাবে বেঁচে থাকতে ভাল লাগে ? - পছন্দ না হলেও রোলটা খুব চ্যালেঞ্জিং । কাউকে কাউকে তো এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতেই হবে । ভারি হয়ে যেত বুকের বাতাস । জমাট বাঁধা কষ্টের পাহাড় ঠেলে বেরিয়ে আসত দীর্ঘশ্বাস । ৫ অনীকদাকে সম্বর্ধনা জানানোর আয়োজন করেছিলাম আমরা । তার সমস্ত জীবন তো নাটকের জন্য উৎসর্গীকৃত । ফুল মালা মানপত্র আর কিছু সাম্মানিক । সবাই ঝাপিয়ে পড়েছিল কাজটিকে সফল সুন্দর করার জন্য । অনীকদার জীবন ও কাজ নিয়ে একটা বইও করা হয়েছিল । মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই বার্তা । হাজার হাজার মানুষ এসে যুক্ত হয়েছিল আমাদের কাজে । কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন তাকে আর খুঁজে পাইনি আমরা । মঞ্চ আর আলোর পৃথিবী থেকে সে তখন দূরে অনেকদূরে । তার পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে রাখি । অগোছালো অর্ধসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে হবে এখন । পাতার পর পাতা উল্টে যাই । সাজাই । কিছু কাজ তো বাকি থাকেই মানুষের জীবনে । আবার কেউ আসবে মঞ্চে ঠিক তার ই মত ...।

স্টেজ অন্ধকার করে দিওনা কেউ আসছে ...।