হঠাৎ
একটা সিঁটকে গন্ধে নরহরিবাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্ত্রী মেনকা চলে যাবার পর থেকে, তার ভাল ঘুমও হয় না। তিনি
পাশ ফিরে শুয়ে নতুন করে ঘুমবার চেষ্টা করলেন।
নাঃ! গন্ধটা কী রকম অস্বস্তিকর।
আরও অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে, কারণ এই জাতীয় একটা গন্ধই তার জীবনে যত দুঃখ, যত একাকীত্ব এনে দিয়েছে।
অন্ধকারে
একা একা শুয়ে নরহরিবাবু সেই সব সুখের দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। তিনি তার তেলের কল থেকে
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আসতেন স্ত্রীর টানে। বাড়ি ফিরে চা জলখাবার খেয়ে, স্ত্রীর সাথে লুডো খেলে, তাস খেলে, সময় কাটাতেন। রাতে খেয়েদেয়ে
দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে, অনেকক্ষণ গল্প করতেন। সকালবেলা
স্নান সেরে খেয়েদেয়ে, আবার নিজের তেলকলে চলে যেতেন। আবার সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে ফেরা।
মাঝেমধ্যেই সাধ্যের বাইরে দামী দামী শাড়ী, গহনা ও অন্যান্য উপহার নিয়ে আসা। একই
রুটিন।
বিয়ের
আগে তিনি তার তেলকলে অনেক রাত পর্যন্ত কাটাতেন। আয়ও বেশ ভালই ছিল। কিন্তু বিয়ের পর
থেকে স্ত্রীর জন্য বেশী সময় ব্যয় করায়, কারবারে প্রয়োজন মতো সময় দিতে পারতেন না। ফলে তার আয়ও অনেক কমে গেল।
তা যাক্, টাকাই জীবনের সব নয়। স্ত্রীকে
নিয়ে দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিল। একদিনের জন্যও ঝগড়াঝাটি হয় নি। কিন্তু ঝামেলা শুরু
হ’ল বছর সাতেক আগে, বিয়ের পঁচিশ বছর পরে, পঞ্চান্ন বছর বয়সে।
বেশ
চলছিল, হঠাৎ স্ত্রীর কেন যেন মনে
হ’ল, তার স্বামীর গায়ে একটা সিঁটকে
বিশ্রী গন্ধ। কারবারে বেরনোর সময়, তেলকল থেকে ফেরার পর, সব সময় মেনকা তার গায়ে ঐ গন্ধটা পেতেন। বাধ্য হয়ে তিনি দামী সাবান কিনে
আনলেন, বুড়ো বয়সে আতর মাখা শুরু
করলেন। কিন্তু লাভ কিছুই হ’ল না। যতক্ষণ তিনি বাড়িতে থাকেন, স্ত্রী মেনকা, নাকে আঁচল চাপা দিয়ে
থাকেন। লুডো,
তাসে ধুলো
জমতে শুরু করলো। ঘরে আর শান্তি নেই। রাতে মেনকা নাকে আঁচল চাপা দিয়ে, অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে
থাকেন।
এইভাবে
কিছুদিন কাটার পর অশান্তি আরও বাড়লো। মেনকা দুর থেকে কথা বলেন, তার ধারেকাছেও আসেন না।
রাতে অন্য ঘরে আলাদা বিছানা। ফলে দু’জনের একসাথে থাকাখাওয়া, লুডো খেলা, তাস খেলা, ঘুমতে যাওয়া তো দুরের কথা, তার হাত থেকে উপহার গ্রহন করা বা কথা
বলাও প্রায় বন্ধ হ’ল।
শেষ
একদিন রাতে বাড়ি ফিরে, তিনি মেনকার হাতে লেখা একটা চিরকুট পেলেন— “দম বন্ধ হওয়া সিঁটকে আঁশটে গন্ধে অতিষ্ঠ
হয়ে, বাপের বাড়ি চললাম। আমাকে
ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর না, তোমার সাথে এক ছাদের নীচে থাকা আর সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা কর”।
চিরকুটটা
দেখে তিনি রাগে, দুঃখে, অভিমানে ঠিক করলেন, বাকী জীবনটা একাই কাটিয়ে দেবেন। বছর পাঁচেক তিনি একাই আছেন। স্ত্রীর
কোন খোঁজ নেন নি। স্ত্রীও কোনদিন তার খোঁজখবর নেন নি। নাঃ! গন্ধটা কোথা থেকে আসছে দেখা দরকার।
বিছানা ছেড়ে উঠে, আলো জ্বেলে চারিদিক খুঁজেও, তিনি কিছুই পেলেন না। তবে গন্ধটা কিছু
কমেছে বলে মনে হ’ল।
কিন্তু
এরপর থেকে তিনি মাঝেমাঝেই এই উৎকট গন্ধটা রাতে পেতেন। তার যেন মনে হতে লাগলো, তার অনুপস্থিতিতে কেউ তার
ঘরে ঢোকে। কারণ সকালের অগোছালো ঘর, সন্ধ্যায় এসে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতেন। একদিন তো রাতে ফিরে
খাবার টেবিলে একটা পাত্রে থালা চাপা দেওয়া আছে দেখলেন। পাত্রের নীচে আবার একটা মেয়েলি
হাতের লেখা চিঠি—“তোমার জন্য ল্যাঠামাছ পোড়া রেখে গেলাম। কী শরীর বানিয়েছ? মন খারাপ কর না, শরীরের যত্ন নাও। মাছটা
খেয়ে নিও। রাগ কর না লক্ষ্মীটি”।
নরহরিবাবু
তার স্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় লেখা চিঠিটা বার করে এনে হাতের লেখা মিলিয়ে একই
হাতের লেখা কিনা দেখবার চেষ্টা করেও কিছু বুঝতে পারলেন না। তার মনে হ’ল মেনকা এসে ঘর পরিস্কার
করে দিয়ে যায়। আজ তার জন্য আবার ল্যাঠামাছ পোড়া রেখে গেছে। ল্যাঠামাছ তিনি কোনদিন খান
না, তাও আবার পোড়া। একবার ভাবলেন
টান মেরে ছুড়ে ফেলে দেবেন। আবার তার মনটা নরম হ’ল। যাহোক্ মেনকা তার ভুল বুঝতে পেরেছে।
স্ত্রী ভালবেসে রেখে গেছে, তাই রাতে মাছটা খাবার চেষ্টা করলেন। তীব্র একটা সিঁটকে আঁশটে গন্ধ, তবু তিনি কোন মতে মাছটা
খেয়ে নিলেন।
রাতে
আবার সেই একই গন্ধ, ঘুম আসছে না। তিনি একবার ভাবলেন কাল সকালেই গিয়ে মেনকাকে নিয়ে আসবেন।
কিন্তু তার পৌরুষে বাধলো। সে নিজে হতে চলে গেছে, নিজে হতে ফিরে না আসলে, তাকে তিনি আনতে যাবেন কেন? আবার ভাবলেন, একা একা থাকতে আর ভালও লাগছে
না। রাগ, অভিমান ভুলে, লজ্জার মাথা খেয়ে, কাল তাকে নিয়েই আসবেন। এই
সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হঠাৎ
বরফের মতো ঠান্ডা কিছুতে হাত লাগায়, তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই তিনি খুব কাছে
সেই গন্ধটা পেলেন। ভয়ে তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। ভাঙ্গা গলায় একবার কোন মতে বললেন-কে?
কেউ
কোন উত্তর দিল না। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেলেও তিনি নিশ্চিত, ঘরে কাছেপিঠে দ্বিতীয় কেউ
আছে। সারারাত ভয়ে আধ ঘুম আধ জাগা অবস্থায় কাটিয়ে, পরদিন ভোরে উঠে স্নান সেরে তেলকলে বেড়িয়ে
গেলেন। সারাদিন ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় কাটিয়ে, রাতে বাড়ি ফিরে প্রথমেই নজর পড়লো খাবার
টেবিলে, সেখানে যত্ন করে কী সব খাবার
ঢাকা আছে। উৎকট গন্ধে সে সব খাওয়া তো দুরের কথা, কাছে যাওয়াই যায় না। এবারে কোন চিঠি
নেই, তবে কিছু কলকে ও ধুতরো ফুল
রাখা আছে।
রাতে
ভয়ে আজ অন্যঘরে মৃদু আলো জ্বেলে শুলেন। সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, হঠাৎ ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতেই
আবার সেই শীতল স্পর্শ। ঘুম চোখে উঠে বসে তিনি ভয়ে রামনাম জপ করতে শুরু করলেন। এবার
কিন্তু তার বিছানায় ছায়া মতো কী যেন দেখতেও পেলেন। আস্তে আস্তে সেটা এক মহিলার আকার
নিল। বছর পঞ্চাশ বয়স, গোল গোল উজ্জল চোখ, দাঁতগুলো বেশ বড় বড়। সে শুধু মিনতি করলো “ঐ নাঁম নিয়ে আঁমায় আর কষ্ট দিঁও না।
জীবনে অঁনেক দুঃখ কঁষ্ট পেয়েছি। তোমার কোঁন ক্ষতি কঁরতে আমি আঁসি নি। ভয় পেঁয় না”।
নরহরিবাবু
অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে দেখলেন, মহিলাটি তার চোখে মুখে জল ছেটাচ্ছেন। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান
ফিরতে তিনি দেখলেন, মহিলাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বুঝলেন যে এখনও তিনি
বেঁচে আছেন,
অর্থাৎ মহিলাটি
সত্যিই তার কোন ক্ষতি করে নি।
মৃদু
গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন “তুমি কে? এখানে কেন এসেছ? কী চাও তুমি”?
মহিলাটি
বললো তার স্বামী অনেকদিন আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তার স্বামী নাকি তার গায়ের উৎকট
গন্ধে টিকতে পারছিলেন না। শেষে রাগে, অভিমানে, স্বামীকে জব্দ করার জন্য তিনি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
তারপর থেকে এ গাছে ও গাছে, এ বাড়িতে ও বাড়িতে, ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একা একা থেকে যখন হাঁফিয়ে উঠেছেন, তখন এ বাড়িতে এসে নরহরিবাবুদের
দেখে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে
সাংসারিক সুখ কাকে বলে। তখন থেকেই তার নরহরিবাবুকে পছন্দ। শেষে তার গায়ের উৎকট গন্ধে
অতিষ্ঠ হয়ে তার স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যেতে, সে নিশ্চিত, আজ নাহয় কাল সে সুযোগ আসবেই।
নরহরিবাবু
কিছু বলার আগেই সে আবার বলতে শুরু করলো “আঁমার নাম মাঁনদাসুন্দরী। তোঁমারও তো আমার মঁতোই অবস্থা। আমাকে পঁছন্দ
হয়? এঁস না আমরা এঁক সাথে থাকি।
তোঁমরা যেমন আঁগে দু’টিতে ছিঁলে। তুঁমি কাজ সেরে ফেঁরার পথে ল্যাঠামাছ নিয়ে আঁসবে, আমি পোঁড়াব।
নরহরিবাবু
এ প্রস্তাব শুনে এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে, লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছুটে পালাতে
গেলেন। টলমল্ পায়ে পালাতে গিয়ে, হোঁচট্ খেয়ে পরে ঘরের কোনের টেবিলটায় মাথার পিছনে ভীষণ আঘাত পেয়ে, আবার জ্ঞান হারালেন। অনেকক্ষণ
পর উঠে বসে ঘোলাটে চোখে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন “ কী যেঁন নাম বঁললে তোঁমার? মাঁনদা না? ভাঁরী মিষ্টি নাঁম। কঁ’টা ল্যাঠামাঁছ আনবোঁ”?
মানদাসুন্দরী
ফিক্ করে হেসে বললো “এই বেঁশ ভাল হ’ল বঁল? তোমাকে আঁমাকে আঁর কেউ আঁলাদা কঁরতে পাঁরবে না। পঁরে মাছ আনা যাঁবে, এঁখন এস দু’জনে সুঁখ দুঃখের গঁল্প করি”।
নরহরিবাবু
এখন ভীষণ সুখী পুরুষ। তেলকলে যাওয়া নেই, কোন কাজ করা নেই, বাজার দোকান যাওয়া নেই, শুধু ফুরফুরে হাওয়ায় গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানো, আর সন্ধ্যায় মানদাকে নিয়ে
ঘরে বসে মাছ পোড়া খেতে খেতে লুডো খেলা, তাস খেলা।