প্রতিদান
সুমনবাবু
আর তপতী সল্ট লেকে তাঁদের ছোট্ট সুন্দর বাড়িতে থাকেন,
একমাত্র ছেলে অসীম কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ায়
ভাল চাকরী করছে। কখন ছেলে ফোন বা স্কাইপ-এতে কথা বলবে তার জন্য দুজনেই সারাটা দিন
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। ছেলের চাকরীর ক্ষেত্রে কোন সম্মান লাভ, একটু উন্নতি বা সে দেশের কত রকম চমকপ্রদ ঘটনা ও খবর শোনেন তাদের আদরের
বাবাই-এর মুখে। তারপর সেই সব সংবাদ আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাঁদের সোসাইটির
চেনা-পরিচিত বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছে বলে পরম তৃপ্তি পান। প্রতিদিন বিকালে সুমনবাবু
আর তপতী বেড়াতে বেরোন, হাঁটতে হাঁটতে কত গল্প আর কত না
ছোট ছোট স্বপ্নের জাল বোনেন দুজনে, বেশীর ভাগই বাবাই-কে
নিয়ে। এই ভাবেই সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে দিন কাটছিল তাঁদের। বছর ঘুরতেই অসীম দশ
দিনের ছুটিতে বাড়ি এলো। কত রকম যে উপহার এনেছে! শুধু বাবা-মার জন্যই নয়, মামা, মাসী কাকা পিসি সবার জন্যই কিছু না কিছু,
কারো কথাই সে ভোলেনি। তপতী আনন্দে ডগমগ হয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে
সেগুলো দিয়ে বললেন, –- দেখেছো আমার বাবাই বিদেশে এত বড়
চাকরী করলেও তোমাদেরও কেমন মনে রেখেছে! ও আমার হীরের টুকরো ছেলে। তপতীর কথায়
তাঁরাও একবাক্যে সায় দেয়, উপহার পেয়ে সকলেই খুব খুশী।
--- কাদের ছেলে দেখতে হবে! দিদি, তোমাদের
মতই মন পেয়েছে বাবাই, ছোট জা বলল। --- বৌদি, তুমি যেমন সবার প্রতি কর্তব্য করতে ভোল
না, বাবাইও সেরকম হয়েছে, ননদ বলল,
এবার ওর একটা বিয়ে দাও। --- আরে সে তো
আমি আর ওর বাবা কবে থেকেই বলছি, তপতী ছদ্ম রাগ দেখিয়ে
বলেন, তা সে শুনলে তো আমাদের কথা! বিয়ের কথা বললেই বলে,
আগে তোমাদের সুখী করি, তারপর ওসব ভাবব। খাওয়া-দাওয়া,
বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে দশটা দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল। অসীম ফিরে গেল
তার কর্মক্ষেত্রে। আবার আগের মতই দিন কাটছে। বিকালে বেড়াতে বেরিয়ে ছেলের বিয়ে নিয়ে
কথা হয় দুজনে। বিয়েতে কেমন জাঁকজমক হবে, কাকে কাকে
নিমন্ত্রণ করা হবে, বিয়ের আগে বাড়িটা কি ভাবে সাজানো হবে
এই সব কত পরিকল্পনা! এই নিয়ে দুজনে ঝগড়াও লেগে যায় বেশ। --- আমার ছেলে আমি যা বলব সেটাই হবে বুঝলে! সুমন বলেন। --- আরে রাখো তো! বাবাই আমি যা বলব সেটাই করবে, তপতী
ঘাড় বেঁকিয়ে উত্তর দেন, ছেলেবেলা থেকেই ও আমার ন্যাওটা,
তোমার কাছে তো ঘেঁষতোই না। মা ছাড়া সে কিছু জানেই না। ---
আরে কার ছেলে সেটা ত দেখো! সুমনও ছাড়বার পাত্র নন। বাপ কা ব্যাটা
---বুঝলে!
এই
ভাবে নানা সুখের স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক সময় প্রৌঢ় দম্পতির ঝগড়ার সমাপ্তি ঘটে। আর
একটা বছর ঘুরতে চলল। --- এবার বাবাই এলে ওর
একেবারে বিয়ে দিয়ে পাঠাব, তপতী বলেন, একা একা থাকে, কি যে খায় কে জানে! --- আমিও ভাবছি ওকে জিজ্ঞেস করে এবার কাগজে পাত্রীর জন্যে বিজ্ঞাপন দেব।
সুমনবাবু হেসে বললেন। --- সেই ভাল গো, আজ যখন রাত্রে ফোন করবে আমিই না হয় জিজ্ঞেস করে নেবো। তপতীর মুখে
তৃপ্তির আলো খেলা করে, মেয়ে কিন্তু আমি পছন্দ করব,
বাবাই আমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করবে দেখ।
কিন্তু
সেদিন কোন ফোনই এলো না অসীমের। হয়তো কাজের চাপে বা ফোনের গণ্ডগোল হবে! পর পর সাত
দিন কেটে গেল।, সুমনবাবু অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ
করতে পারলে না। উৎকণ্ঠায়, দুশ্চিন্তায় দুজনেই অস্থির,
খাবার মুখে রোচে না, ঘুম নেই চোখে।
হোয়াটসআপ-এ একটা মেসেজ এল শুধু – ‘ এবার আমি যেতে পারছি
না। অফিসে কাজের খুব চাপ, এখন যেখানে আছি, সেখান থেকে ফোন করার অসুবিধা --- পরে জানাব সব।’ তপতী আর সুমনবাবুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু
কিছু তো করারও নেই! এখন বাবাই-এর উন্নতির সময়, আর কতই বা
বয়স! বিয়ে না হয় কটা দিন পরেই হবে। --- এই সব ভেবে মনকে প্রবোধ দিলেন দুজনে।
সপ্তা
খানেক পরে এক সকালে তপতী রান্না ঘরে ব্যস্ত, অসীমের
ফোন এল। সুমন ধরলেন, অন্য দিকে ছেলের গলা। –-- বাবা, তোমাদের ইচ্ছা পূরণ করতে বিয়েটা করেই
নিলাম, কি খুশি হয়েছো তো এবার! সুমন উত্তর দেবেন কি!
শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা হিমজলের স্রোত নেমে গেল। অসীম আবার বলল, এখানকারই মেয়ে, আমার কোলীগ, বিদেশী হলেও খুব ভাল মেয়ে। দেশে ফিরে সব আত্মীয়-বন্ধুদের খুব বড় করে
পার্টি দেব, মাকে বোল। তপতীকে কি করে বলবেন এটা সুমন! সে
যে ভীষণ কষ্ট পাবে শুনলে! একটু ধাতস্থ হয়ে শুধু বললেন, -- ভাল করেছিস, সুখী হ তোরা।
ফোনটা
কেটে গেল, সুমনবাবু চুপ করে বসে ভাবতে লাগলেন স্ত্রীর কথা,
তার এত দিনের আশা, কল্পনার প্রাসাদটা
যেন এক নিমেষে তাসের ঘরের মতই ভেঙে পড়ল! রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তপতি স্বামীকে
বিমর্ষ ভাবে বসে থাকতে দেখে চিন্তিত গলায় বলেন, এভাবে বসে
আছো কেন গো? শরীর খারাপ লাগছে! ডাক্তার ডাকবো? বাবাইকে খবর দেব? --- না না, সে রকম কিছু নয়, সুমন বললেন, এই গরমে একটু --- ও কিছু না। স্ত্রীকে খবরটা দিয়ে আর কষ্ট দিতে চাইলেন
না তিনি। অন্য দিনের মতই বিকালে স্বামী-স্ত্রী বেড়াতে বেরিয়েছেন, তপতী নিজের মনেই কত কথাই বলে চলেছেন, সবই তাঁর
আদরের বাবাইকে নিয়ে। তাঁর কোন কথাই কিন্তু আজ সুমনবাবুর কানে যাচ্ছে না, চুপচাপ গম্ভীর মুখে পাশে পাশে হেঁটে চলেছেন। তিনি শুধু ভাবছেন, তপতী যে এত বড় মুখ করে সোসাইটি আর আত্মীয়স্বজনদের কাছে ছেলের কথা বলে
গর্ব করে, এই ঘটনা জানাজানি হলে কি হবে! সুমনবাবুর সেই
রাত্রেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল। প্রতিবেশীরা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নামকরা নার্সিং
হোমে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ডাক্তাররা সে রকম কোন আশার কথা শোনাতে পারলেন না, একটা দিক প্যারালাইজড হয়ে গেছে, কথাও বলতে
পারছেন না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। অসীমকে সেই
রাত্রেই জানানো হয়েছে, সেও তার পরের দিন ছুটে এল কলকাতায়।
ছেলেকে দেখার পর দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল সুমনবাবুর চোখ থেকে, তারপরেই সব শেষ। তপতী এর মধ্যে ওর বিয়ের কথাটা তুললেন না দেখে অসীম
বুঝে গেল, বাবা খবরটা মাকে দেননি, তার মনের চাপা অস্বস্তিটা কমে গেল, সেও আর
কথাটা তুলল না। সুমনবাবুর পারলৌকিক কাজ শেষ হলে অসীম মাকে বলল, মা, আমি তো আর বেশিদিন কাজ ফেলে এখানে থাকতে
পারবো না, সামনেই একটা বড় প্রমোশন হবে আমার, অনেক দায়িত্ব, এদিকে তোমাকেও এখানে একা ফেলে
যেতে মন চাইছে না। --- আচ্ছা, তুই
যা তাহলে, আমি একাই থাকতে পারবো, ভাবিস না। --- না মা, সে হয় না, অসীম জোর দিয়ে বলল, দরকার হলে আমি ওখানের চাকরি ছেড়ে দেব, কিন্তু
তোমাকে একা রেখে কিছুতেই যেতে পারব না। --- দূর বোকা
ছেলে! এমন সোনার চাকরী কেউ বুড়ি মায়ের জন্যে ছাড়ে! আমি আর ক’দিন! --- ও রকম বোল না তো মা! আচ্ছা মা,
তুমি একা আর এখানে থেকে কি করবে? তার
চেয়ে তুমিই চল না আমার সঙ্গে ওদেশে, এখানে আমাদের তো
পিছুটানও তেমন কিছু নেই। কলকাতার এই বিশ্রী পরিবেশ, আর
ওখানে যেমন সুন্দর জায়গা, তেমনি কত আনন্দ আর সুখ!
--- না রে বাবাই, তোর বাবা আর আমি কত
স্বপ্ন আর সাধ নিয়ে, কত প্ল্যান করে এই বাড়িটা করেছিলাম,
আমি চলে গেলে কে এটা দেখবে বল? বেদখল
হয়ে যাবে যে! --- সেটাই তো আর কষ্টের মা! বাবার স্মৃতি
ধরে বসে থাকলে তুমি শুধু দুঃখই পাবে। মানুষটাই যখন চলে গেল, এই সম্পত্তি আঁকড়ে থেকে কি করবে বল! তার চেয়ে এসব বিক্রি করে এখানকার
পার্ট চুকিয়ে চল --- যে কটা দিন বাঁচবে, একটু সুখে বাঁচবে,
জীবন তো একটাই মা। আত্মীয়স্বজন যারা ছিল তারাও অসীমের কথায় সায়
দিল। বলল, ও তো বেশ ভাল কথাই বলছে, ওর কথা ফেলো না তুমি। ঐ রকম সোনার টুকরো ছেলে তোমার, তোমাকে রাণী করে রাখবে ঠিক। তপতী শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। বাড়িটা বিক্রি
করে, আর বাবার জমানো যা কিছু ছিল সব টাকা এক করে এক কোটির
বেশী টাকা পাওয়া গেল। অসীম মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সব টাকা বিদেশী ব্যাঙ্কে
লেনদেনের সুবিধার জন্য নিজের একাউন্টে জমা করে ঝাড়া হাত পা হয়ে অস্ট্রেলিয়ার টিকিট
কাটল। বেশি লটবহর না বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় সামান্য কিছু জিনিস সঙ্গে নিয়ে এক ভোরে মা
কে এ.সি ট্যাক্সি তে চড়িয়ে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাল। ফ্লাইটের অনেক দেরি আছে,
মাকে এক জায়গায় বসিয়ে অসীম বলল, মা,
এখানে বস তুমি, আমি টিকিটটা চেক করিয়ে
আসি আর তোমার জন্য কিছু খাবার আর চা নিয়ে আসছি। দেখো, কোথাও
আবার উঠে যেও না, জিনিসগুলো খেয়াল রেখো, যা চোর-বাটপার এখানে!
কত
সময় কেটে গেল। তপতী বসে আছেন তো আছেন, অসীমের
আসার নামই নেই, একটার পর একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে, খিদে-তেষ্টাও পেয়েছে খুব। সেই কাল রাত্রে একটু যা খেয়েছেন, এদিকে তাঁর কাছে তো কোন টাকা-পয়সাও নেই, সবই
তো ছেলের কাছে! আর এখানে তো কাউকে চেনেনও না। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে,
এবার আর থাকতে না পেরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকলেন তপতী। পাশে বসা
সহযাত্রীরা অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করেছেন, তাঁকে ওই ভাবে
কাঁদতে দেখে এগিয়ে এলেন,এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি গার্ডরাও
এসে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। তপতী হাতের টিকিটটা দেখিয়ে সব বললেন। বিমানবন্দরের
কর্মচারীরা সেটা পরীক্ষা করে বললেন, এটা তো ভুয়ো টিকিট
মাসীমা, আর অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট তো সকালেই চলে গিয়েছে! স্বামীহীনা,
নিঃসহায়, নিঃসম্বল তপতী কি করবেন এখন!
কৃতি পুত্রের গর্ভধারিণী নারী আজ সর্বস্ব হারিয়ে অনুভব করলেন, আজ তিনি যদি সন্তানহীনা হতেন তাহলে এভাবে হয়তো সব দিক থেকে তাঁকে
নিঃস্ব হতে হত না। তার যে কোথাও যাবার জায়গা নেই! বিমানবন্দরের কর্মচারীরা তপতীর
অসহায় অবস্থা বুঝতে পেরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কে সব জানিয়ে ফোন করলেন। তাঁরা
এসে সব কিছু শুনে বললেন, যে ভাবেই হোক তাঁর দুর্বৃত্ত
ছেলেকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবেনই। চলুন মাসীমা আমরা তো আছি! তাঁরা
পরম যত্নে ও ভালোবাসায় জড়িয়ে তপতীকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।