"নমস্কার, মহিলাদের
জন্য এই বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অদ্বিতীয়া'তে আপনাদের স্বাগত জানাই। আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন এমন কিছু নারী
যাঁরা নিজ নিজ কর্ম্মক্ষেত্রে তো সফল বটেই, রোজকার জীবনে
তাঁরা এমন কিছু নজীর রেখেছেন যা তাঁদেরকে মানুষ হিসাবে আরোও অনেকটা উচ্চস্তরে নিয়ে
গেছে, তাঁরা সত্যিই অদ্বিতীয়া, আসুন
দেখেনি তাঁরা কারা। আমার ডানদিকে রয়েছেন ডক্টর অনুরাধা যিনি শুধু মাত্র একজন
ডাক্তার নন উনি একটি অনাথ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতি রবিবার মানে যে দিনটা
ডাক্তার দেরও ছুটির দিন বলেই জানি আমরা সেই দিনেও উনি পেশেন্ট দেখেন। এভাবে বললে
প্রায় কিছুই বলা হয়না। রবিবারদিন গুলোয় উনি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় নিখরচায়
চিকিৎসা করতে যান। গত পাঁচ বছর নিরলস ভাবে উনি এই কাজ করছেন। মানুষের সেবার জন্য
উনি বিয়ে করেননি; বৃহত্তর সংসার কে পরিপূর্ন সময় দিয়ে
চলেছেন।
অনুরাধার পাশে আছেন চিত্রকর মেঘলা।
মেঘলা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন দারিদ্রের
সাথে লড়াই করে। এখন ফুটপাথবাসী শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর পাশাপাশি তাদের জন্য রোজ
এক বেলার খাবারের বন্দোবস্ত ও করেন। এটা উনি করেন ওনার স্বচ্ছল পরিবারের
ছেলেমেয়েদের আঁকা শেখার যে স্কুল আছে তার থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে। মেঘলার ছবি
দেশে বিদেশে বহু এগ্জিবিশনে আমাদের গর্ব বাড়িয়েছে। বিয়ে করার কথা এক্ষনি ভাবছেন না,
আরোও কিছুদিন এই কাজ গুলোকে একটা অন্যমাত্রায় নিয়ে তবে নিজের
জীবন সঙ্গী খুঁজবেন জানিয়েছেন।
আমার বাঁ দিকে গায়িকা পামেলা। যমজ
সন্তানের জননী পামেলা যখন তাঁর স্বামীকে হারান তখন তাঁর নিজের বয়স মাত্র সাতাশ আর
সন্তানদের দুই। পামেলার মাথার ওপর ছাদ টুকু ছাড়া আর ছিলো তাঁর ভগবান প্রদত্ত গলা।
একা হাতে সন্তানদের মানুষ করা, সাথে গানের টিউশনি; চূড়ান্ত
ঝড় তুফানের মধে্য দিয়ে সব দিক সামলে আজ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। উনি মানসিক ভারসাম্যহীন
শিশুদের গান শেখান এবং সেই কাজেও অত্যন্ত সফল।
সর্ব শেষ রয়েছেন বিউটি। পেশায় একজন
শিক্ষিকা, কিন্তু ব্যাক্তিগত জীবনে উনি অসামান্যা। ওনার কথা দিয়েই শুরু করি
আমাদের অনুষ্ঠান, পরে এক এক করে শুনছি বাকি দের কথাও।
আসুন বিউটির কথা ওঁর মুখ থেকেই শুনি বরং। বিউটি আপনি বলুন যে আপনার ছোটোবেলা কেমন
ছিলো, আর আপনার জীবনের মোড় ঘোরানো সেই ঘটনা।"
"নমস্কার এলিনা, আজ
আমাদের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন জানানোর জন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি অত্যন্ত
দরিদ্র পরিবারেরই মেয়ে। ছোটোতে আমরা একটা জবরদখল কলোনি টাইপের বস্তি এলাকায়
থাকতাম। আমার মা লোকের বাড়ী কাজ করতেন, ইন ফ্যাক্ট,
আমি আর আমার দিদি, মায়ের শরীর খারাপ হলে
আমরাও মায়ের কাজের বাড়ী কাজ করে দিয়ে এসেছি। সাথে নাক চোখ বুজে লেখাপড়া করতাম।
ভদ্রস্থ ভাবে নিজের পায়ে যাতে দাঁড়াতে পারি। আমাদের এলাকায় খারাপ ছেলেপুলের ছড়াছড়ি
ছিলো। সব সময় আমরা চেষ্টা করতাম যাতে বিকেলের পর আর না বেরোতে হয়। পড়তে যাবার
সামর্থ্য ছিলোনা তবে কিছু মাস্টাররা ফ্রীতে পড়াতেন তাঁদের কাছে যাওয়াও সম্ভব
হোতোনা শুধু সন্ধ্যের পর বলে। যাইহোক দুই বোনে আমরা অনেক খেটে কলেজ পৌঁছলাম। কলেজে
পড়া কালীন দিদির খুব ভালো সম্মন্ধ আসায় ওর বিয়ে হয়ে গেলো। যদিও দিদির পড়াশোনা বন্ধ
হয়নি; কিন্তু এই সময় থেকে সবখানে আমার একার যেতে আসতে
হোতো। আমি যখন মাস্টার্সে চান্স পেলাম__"
"একটু জিজ্ঞেস করি, কি সাবজেক্ট?"
"অঙ্ক"
"আচ্ছা, হ্যাঁ
তারপরে?"
"মাস্টার্স পড়ার সময়ে আমি প্রচুর টিউশানিও
শুরু করি, কারন আমার গ্রাজুয়েশনের রেজাল্ট খুবই ভালো
ছিলো। তো সেই সময়ে প্রায়শঃই সন্ধে্য হয়ে যেতো ঘরে ফিরতে, মা
চেষ্টা করতেন বাসস্ট্যান্ডে থাকার। সেদিন মায়ের শরীর খারাপ থাকায় আমি একাই
ফিরছিলাম। সুযোগ সন্ধানিরা ওঁত পেতেই থাকত, ওরা ঠিক এই
দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলো। বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের এলাকার মধে্য বেশ খানিকটা
রাস্তা শুনশান থাকে। বাস থেকে নামার পর টের পেলাম বেশ পাঁচ ছয় জনের একটা গ্রুপ
ঘিরে ধরল আমায় আর অশ্রাব্য সব কথা বার্তা। আমি যখন ভাবছি যে আজ আর বাঁচার উপায় নেই
ঠিক সেই সময়ে একটা গাড়ী এসে দাঁড়ায় এবং তার থেকে একজন নেমে এই ছেলেগুলোর সাথে কথা
বলতে শুরু করে। স্বাভাবিক ভাবেই শীকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ওই
বন্যপশুগুলো প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে ওই ভদ্রলোক কে নিয়ে পড়ল; আমি সেই সুযোগে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দৌড়ে বাড়ী পৌঁছলাম। পৌঁছে
মাকে সব কথা জানালাম এবং শুনলাম যে আমার জামাইবাবুর এক বন্ধু নাকি আমার খোঁজে
আমাদের বাড়ী এসেছিলেন। এই ভদ্রলোক সম্পর্কে একটু বলি"
"হ্যাঁ বিউটিদি আপনার বাকি কথা শুনবো তার
আগে ছোট্টো একটা বিরতি"
"ফিরে এলাম বিরতির পর, বিউটিদির কাছ থেকে তাঁর কথা শুনছিলাম আমরা। বলুন বিউটিদি তারপর কি
হোলো"
"আমার জামাইবাবু দারুন পড়াশোনা করা, এবং অত্যন্ত ভালো মানুষ। উনি আমার দিদির কলেজের পড়ান, সেই সুবাদেই বিয়ে হয়। ওঁর এক ছাত্র কাম বন্ধুর সাথে ওঁদের বাড়ীতেই
পরিচয় হয়, আর আমার দিদি জানান যে দারুন সুপুরুষ এবং উচ্চ
প্রতিষ্ঠিত সেই মানুষটি আমায় ভালোবেসে ফেলেছেন। ব্যাপারটাকে আমি আমল দেইনি কারন
আমার তখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই ধ্যান জ্ঞান। এইদিন উনিই আমাদের বাড়ী এসেছিলেন আর
ঘটনাক্রমে আমায় বাঁচিয়েও দিলেন। এরপর ওই পাড়া থেকে বলতে গেলে, রাতারাতি আমি দিদির বাড়ী থাকার জন্য চলে গেলাম। নাহলে ওই ছেলেগুলো তো
ছেড়ে দেবে না। তবে দিদির বাড়ী থাকতে শুরু করার পর জানতে পারলাম সেই রাতে ওই
পশুগুলো আমায় না পেয়ে ওই মানুষটাকেই যথেচ্ছ পিটিয়ে তার পিঠের কোমোরের হাড় ভেঙ্গে
দিয়েছে আর তাতেই ক্ষান্ত হয়নি ওনার মুখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। কথাটা শোনার পর
থেকেই আমার অসম্ভব বিবেক দংশন শুরু হয়। আমি ভাবি যে ওই মানুষটাই আমায়
ভালোবেসেছিলেন, আর সেদিন নিজের জীবন বিপন্ন করে আমায়
বাঁচালেন, ওঁর প্রতি আমারও তো কিছু করনীয় থাকে। চুপিচুপি
একদিন গিয়ে উপস্থিত হলাম ওনার বাড়ী। সে বাড়ী তো নয় যেন হিন্দী সিরিয়ালের বাড়ী। কিন্তু
অবাক কান্ড বাড়ীর মানুষ যে এতো পাষন্ড হতে পারে আমি না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।
অশক্ত অসহায় মানুষটাকে বাড়ীর সব থেকে বাজে ঘরে আলোবাতাস ঢোকেনা এমন একটা ঘরে ফেলে
রেখে দিয়েছে। ঠিক করে খেতেও দেয়না, একজন কাজের লোক
সারাদিনে একবার তাকে পরিস্কার করে। যে মানুষের উঠে বাথরুম যাবার ও ক্ষমতা নেই তার
কি হাল হতে পারে আশাকরি আন্দাজ করতে পারছেন। অমন রূপবান মানুষটা কে এমন বানিয়েছে
ওই পশুগুলো যে দিনের আলোতে ও ওই মুখ দেখলে ভয় হবে। মানুষটার এই দশার জন্য আমি
সম্পূর্ন দায় স্বীকার করলাম, নিজের কাছেই; যদিও হয়ত সত্যিই আমার কোনো হাত ছিলোনা ওঁর এই দুর্দশার পিছনে তবু কেমন
জানি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম আর ওনাকে ওই নরক থেকে উদ্ধার করবো ঠিক করলাম।
বাড়ীর মানুষজন যেই টের পেলেন ওমনি
আমার সাথেও অকথ্য দুর্ব্যবহার শুরু করলেন, এবং স্পষ্ট জানিয়ে দেন আমি যদি ওনাকে ওই বাড়ীর
থেকে বের করে আনি তাহলে ওনারা ওনাদের ছেলেকে আর কোনোদিনও ঘরে ঢুকতে দেবেন না। আমি
ধরেই নিয়েছিলাম যে দিদির বাড়ী থাকতে পারবো, কিন্তু যখন
দিদিদের জানাই ওনারা সাফ সাফ বলে দেন কোনো রকম বিতর্কিত বিষয়ে ওনারা নিজেদের জড়াতে
চান না। অতএব আমার মায়ের কাছে ফিরে আসা ছাড়া আর গতি রইলো না। সেখানে তো পদে পদে
বিপদ। তাও তখনকার মতো অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানীর সহযোগীতায় নিয়ে এলাম বস্তিতেই।
কিন্তু সেখানে কিছু দিন মানে দিন পাঁচ সাত যেতে যেতেই আশপাশের লোকজন এসে বলল যে
অবিবাহীত মেয়ে একজন অবিবাহীত পুরুষের সাথে থাকছে এই সব অনাচার এই এলাকায় থেকে করা
যাবে না। বেশ ওই অবস্থাতেই ওঁর হাতে সিঁদুর পরে নিলাম। তাতেও হোলোনা বস্তির
বাচ্চারা নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ছে এই মানুষটা নিজে সুস্থ হবার জন্য তাদের ক্ষতি করছে।
এমন উৎপাত শুরু হোলো, আমি পড়াশোনা করবো? নাকি এই মানুষটার দেখভাল করবো? না কি ওই মানুষ
রূপী পশুদের ঠেকাবো? তবে এই কয়দিনেই আমার স্বামীর মুখের
একটু একটু বুলি ফিরে এসেছে, ঠিক সময়ে ওষুধ পথ্য আর তার
ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে। উনি আর আমার মা পরামর্শ দেওয়ায় আমরা সম্পূর্ন
অন্যখানে বাড়ী ভাড়া করে উঠে যাই। আমার স্বামীর ব্যাঙ্ক ব্যালান্সও খুব খারাপ
ছিলোনা সাথে তখন আমার টিউশনি ও পরবর্তীতে সরকারী স্কুলে টিচারের চাকরি পাই,
কাজেই ওনার চিকিৎসা করিয়েও মোটামুটি সুস্থ ভাবেই থাকতে শুরু করি।
আর আজ আমার স্বামী অনেকটা সুস্থ, ওনাদের বাড়ীর ড্রাইভার
কাকুও আমাদের খুঁজে পেয়ে আমার স্বামীর গাড়ীটা নিয়েই আমাদের কাছে চলে আসেন। আজও
কিছু কিছু বিষয় নিয়ে কিছু মানুষের সাথে লড়াই অব্যাহত, আইনি
ঘোরপ্যাঁচও কিছু চলছে, তবু বলবো আমরা ভীষন ভীষন
হ্যাপি।"
"তার মানে বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্টস্ বলা
ভালো আপনার ঘটনা কে"
"একদম, আমার
চারপাশে বীস্ট ভর্তি, আমার ঘরে সেই রাজপুত্র"
"আপনার মতো বিউটিদের উদ্দেশে্য যদি কিছু
বলেন, কিছু পরামর্শ তাদের জন্য"
"সেই সব বিউটিদের কাছে আমার অনুরোধ তোমরা
তোমাদের রাজপুত্রকে নিয়ে সুখী থাকো বাইরের বীস্টদের সাথে লড়াই করো, হার মেনো না। একটা মানুষের রূপই কিন্তু সব নয়, তার ভালোবাসা, মানবিকতা, এইগুলোই বোধহয় সব"
"অবশ্যই অসাধারন অভিজ্ঞতা, ধন্যবাদ বিউটি দিকে ওনার জীবনের এমন ঘটনা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
আমাদের আজকের মতো সময় শেষ বাকিদের কথা শুনবো পরের এপিসোডে। আমাদের সাথে থাকার জন্য
অনেক ধন্যবাদ, নমস্কার"