টানা গা-জ্বলানো
গরমের পর অবশেষে বর্ষা এসেছে। বুদ্ধিটা কূটজীবি উকিল ভানু মিত্তিরই বাতলে ছিল, নব-বর্ষার আগমন উপলক্ষে আমাদের আদি-অকৃত্রিম
অকৃতদার ভুলোদা অর্থাৎ ভোলানাথ সমাদ্দারের দক্ষিণ কলকাতায় পৈত্রিক বাড়ির তিনতলার
বিশাল ঘরে জমিয়ে ফিস্টি হবে। সরু চাল আর ভাজা মুগডালের খিচুড়ি সঙ্গে ইলিশ
মাছ ভাজা। ইলিশটা আমাদের বলাই, অর্থাৎ পাতিয়ালার বলবিন্দর সিং স্বতঃপ্রনোদিত হয়েই স্পনসর
করেছে। আমি আর রেণু মানে বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা রেণুকা বসু রান্নার দায়িত্বে।
খিচুড়ির তোড়জোড় শেষ, অথচ বলাইচাঁদের পাত্তা নেই। আমরা উদ্বিঘ্ন চিত্তে তাঁর (ইলিশ সহ) আসার প্রতীক্ষায়। রুপোর কেস থেকে পরপর দুটো
সিগারেট যে ভাবে উড়ে গেল, তা দেখে মনে হচ্ছে অমন শান্ত,
সমাহিত ভুলোদাও যেন কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। সিঁড়িতে দশাসই দেহের
ভারি জুতোর শব্দের সঙ্গে দরাজ গলায় “মনো মোওর মেঘেরোওও সঙ্গীইইইই --উড়েএ চলে দিক-দিগন্তেরোও পানেএএএ ----” গাইতে গাইতে
হাতে এক জোড়া নধর ইলিশ নিয়ে বারমুডা পরিহিত
রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ বলাই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। গরমের দোহাই দিয়ে ভুলোদা এ ক’দিন যে ভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে সে আর কহতব্য
নয়। আমরা চার মূর্তি অনেক চেষ্টা করেও তাঁর মুখ থেকে কোন কথামৃত বের করতে না পেরে
শেষে আজকের এই মরিয়া প্রচেষ্টা। বলাই দুহাতে দুই মৎস সুন্দরীকে ঝুলিয়ে খানিকটা ভাংরা আর
কিছুটা ভারত নাট্যমের ভঙ্গীতে ভূলোদার নাকের ডগায় একটা কিম্ভূত নাচের মুদ্রা করে
বলল, এক্কেবারে পদ্মার
ম্যাডাম দাদা, কেনার
সময় পরিস্কার ঢাকাইয়া বাঙাল ভাষায় দর কষাকষি করল জানেন! --- “তোমার কীর্তির
চেয়ে তুমি যে মহৎ, তাই তব জীবনের রথ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।” আমিই বা কম যাই কেন! কালোয়াতি কায়দায় গলাটা একটু খেলিয়ে ঠাকুরের ‘শাজাহান’ ঝেড়ে
দিলাম। --- তা ঠিক,
ভানু মিত্তির ওর হাত থেকে মাছ দুটো নিতে নিতে
সোল্লাসে ঠেকা দিল, বলাই সিং-এর
এমন ইলিশ-কীর্তির জন্য ওর সব কু-কীর্তি ঢাকা পরে গেল আজ। --- আরে স্বামিজী বলেছেন না, ‘জন্মেছিস যখন একটা দাগ রেখে যা।’
তাই বলাই একবারে ডাবল দাগ টেনে দিয়েছে। কোমরে
আঁচল জড়িয়ে আঁশ-বঁটিটা
নিয়ে গুছিয়ে বসে রেনু ফুট কাটল। --- বলাই এর ককটেল নাচটা মন্দ না, তবে চণ্ডীগড়ের ভি. পি. রামন কিন্তু একটা দারুণ কীর্তি করে গিয়েছেন
সেটা জানি, তিনি ১৯৯০ সালে ৭ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল
পর্যন্ত একনাগারে ৪৮১ ঘন্টা ৩০ মিনিট ডিস্কো নেচেছিলেন। সোনার ফ্রেমের চশমার পিছনে
দুটো চোখে সেই বিখ্যাত চিকচিকে হাসি দিয়ে যেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজের একটা ছোট্ট
নাচের মুদ্রা দেখিয়ে দিয়ে বললেন ভুলোদা, তা তোমার এত দেরি হল কেন গো বলাইবাবু?
--- আর কেন! কলকাতায় সাড়ে সতেরো ফোঁটা বৃষ্টি হলেই তো ট্রাফিক ঘেঁটে
ঘনীভূত হয়ে যায়, গাড়ি নিয়ে আসাটাই তো ঝকমারি,
তাই অগত্যা খানিকটা টানা রিক্সায় আর খানিকটা
পয়দলমে দাদা। --- তা
বটে! অবশ্য কলকাতার রিক্সা আর উত্তরমেরুর
স্লেজগাড়ির মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। বিখ্যাত অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন এম.লিন্ডসে
১৯৩৪ সালের ১৮জুন থেকে ৫
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত বরফে ঢাকা ১৭৩৮
কিলোমিটার পথ একা একটি স্লেজগাড়িতে চেপে আড়াআড়ি পাড়ি দিয়েছিলেন সেটা জানো কি?
ভুলোদার ব্রেকিং নিউজ শুনে বলাই সর্দার ওর
রবি-গান আর ‘ভাংরা-নাট্যম’ থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে
আছে দেখে ভুলোদা বলে উঠলেন, --- এ কী! বলাই, অমন একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন সেই থেকে? বসো বসো। আর এ রকম দাঁড়নোর আগে মনে রেখো,
তামিলনাড়ুর এন, রবি ১৯৮২ সালের ১৭-১৮ এপ্রিল একটানা ৩৪ ঘন্টা
এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি দিন একটানা দাঁড়িয়ে থাকার রেকর্ড
করেছেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের স্বামী মৌজগিরি মহারাজ। তিনি ১৯৫৫ থেকে
১৯৭৩ সাল অবধি একটানা ১৮ বছর দাঁড়িয় তপস্যা করেছিলেন। ঘুমানোর
সময় তিনি একটা কাঠের তক্তায় হেলান দিয়ে ঘুমোতেন। ১৯৮০ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি
দেহত্যাগ করেন। --- ভানু
তোর খিচুড়ি-ইলিশের
জোড়া নৈবেদ্যয় ভুলোদার জিভে যে আজ মা সরস্বতী রে!
ভানুর কানের কাছে
বলে আমি ওর ডান হাতটা টেনে নিয়ে খুব জোরে ঝাঁকিয়ে দিলাম।
--- হ্যান্ডশেক করলে না কি হে
চাটুজ্জে!
বেশ বেশ, ভুলোদার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে চিকচিক করছে আবার, তবে হ্যান্ডশেকের বিশ্ব রেকর্ডটাও জেনে রাখো,
ফিনল্যান্ডের রেইনার ভিক্সট্রম ১৯৮৮ সালের ১৫
মে মাত্র আট ঘন্টায় ১৯৫৯২ জনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। মানে ঘন্টায় গড়ে ২৪৪৯
জন। --- বোঝো কান্ড!! আমি অস্ফুটে বললাম। --- নে,
এবার সামলা! মাছের টুকরোগুলোয় নুন-হলুদ মাখিয়ে কড়াইয়ে ছাড়তে ছাড়তে হাতের উলটো
পিঠ দিয়ে নাকের ডগায় ঝুলে আসা মোটা চশমাটা ঠেলে জায়গায় পাঠিয়ে ফিসফিস করে বলল
রেণু। --- কথা বলেও বিশ্ব রেকর্ড করা যায় বুঝলে রেণু,
রেণুর ফিসফিসানি শুনে ভুলোদা মুচকি হেসে
বললেন, মাদ্রাজের এস,
ই, জয়রামন নামে এক ভদ্রলোক ১৯৮৯ সালের ৮ জুন থেকে ২৩ জুন
পর্যন্ত একনাগারে ৩৬০ ঘন্টা কথা বলে রেকর্ড করেছেন।
সবাই মেঝের ওপর গোল হয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছি। ভুলোদার বশংবদ চাকর গোবিন্দ কলা
পাতায় গরমগরম খিচুড়ি পরিবেশন করেছে, সঙ্গে ইলিশের গোবদা গোবদা ভাজা পেটি। আহা! ঝমঝমে বর্ষায় এর চেয়ে উপাদেয় আর কিছু হতে
পারে না কি! --- উফ্! এই ভানুটা নির্ঘাত মহাভারতের আমলে রাক্ষস ছিল
আর ভীমের হাতে মরেছিল, এ জন্মে বদ উকিল হয়েও স্বভাব যায়নি! মনে হচ্ছে হাঁরি কড়াইগুলো অ খেয়ে শেষ
করবে আজ!
ভানুকে এক গামলা
খিচুড়ি তিনটে পেটি দিয়ে শেষ করে এক চোখ বন্ধ করে মনের সুখে কড়মড় করে একটা মুড়ো
চিবুচ্ছে দেখে রেণু আর না বলে পারল না। --- আহা! ও আর এমন কি খেয়েছে! ভুলদা
মাছের ডিমের বড়ায় কামড় দিয়ে বললেন, ফ্রান্সের মাইকেল
লোটিটো এক আশ্চর্য মানুষ। ১৯৫৯ সাল থেকে তিনি ধাতু ও কাঁচ খাচ্ছেন। চিকিৎসকরা তাঁর
পেটে এক্স-রে করে দেখেছেন তিনি প্রতিদিন ৯০০ গ্রাম
ধাতু অনায়াসে খেয়ে হজম করে ফেলতে পারেন। ১৯৬৬
সাল থেকে তিনি যা
খেয়েছেন তা হল, ১০টি বাইসাইকেল,
সাড়ে চার দিনে একটি ধাতু নির্মিত সুপার
মার্কেটের ট্রলি, ৭টা বড় টেলিভিশন সেট, ৬টি ঝাড়লন্ঠন, ভেনজুয়েলার ক্যারাকাসে একটা সেশনা এরোপ্লেন এবং এরকম আরও অনেক কিছু। সে তুলনায়
ভানু তো নেহাৎই দুগ্ধপোষ্য শিশু। --- বাপ্ রে!! আমাদের চোখ ছানাবড়া।
আষাঢ়ের সন্ধ্যে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, আড্ডা আর গল্পের মাঝে রেণু আর বলাই-এর দ্বৈতকন্ঠে ‘মধু গন্ধে ভরা,
মৃদু স্নিগ্ধ ছায়া ---‘ শুনে দিল তর হয়ে
গেল। আমরা স্বতঃস্ফুর্ত মনেই হাততালি দিয়ে উঠলাম। --- এত সুন্দর গলার গান এইটুকু শুনে কি মন ভরে! ভুলোদা যেন নিজের মনেই বললেন, ১৯৮৯ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত একটানা ২৬২ ঘন্টা গান গেয়েছিলেন
প্যাস্টর এস. জেয়াশীলান।
অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ভারতের রামনাদের এশিয়ান গ্লাসহাউস বিল্ডিং-এ।
আর এই হাততালিরও একটা বিশ্বরেকর্ড আছে মনে পড়ে গেল, তামিলনাড়ুর ভি.জয়রামন ১৯৮৮
সালের ১২ ফেব্রুয়ারী
থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী টানা ৫৮
ঘন্টা ৯ মিনিট হাততালি দিয়েছিলেন। প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬০ বার
তালি দিয়েছিলেন।
সারা দিনের জমাটি আড্ডার শেষ পর্বে ভুলোদার প্রিয় মকাইবাড়ি বাগানের দারুণ
ফ্লেভারের চা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি আমরা। চায়ে আরাম করে চুমুক দিয়ে কেস থেকে
সিগারেট বাছতে বাছতে ভুলোদা বললেন, --- দুজন অসাধারণ মানুষের কথা আজ না বললে ভারি
অন্যায় হবে বুঝলে! একজন
হলেন পৃথিবীর বিস্ময়কর প্রতিভা মোজার্ট। তিনি তিন বছর বয়সে বীণা বাজান, প্রথম সুর সৃষ্টি করেন পাঁচ বছর বয়সে, প্রথম সোনাটা রচনা করেন সাত বছর বয়সে এবং প্রথম সম্পূর্ণ
সিম্ফনী তৈরি করেন আট বছর বয়সে। তিনি প্রতি বছর একটি করে সিম্ফনী তৈরি করেন। মোজার্ট
মাত্র পঁচিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সামান্য সময়ে তিনি ৬০০-র মত সিম্ফনী, অপেরা,
সোনাটা, মাসেস ইত্যাদি সঙ্গীতের বিভিন্ন বিষয় রচনা করে গিয়েছেন। আর একজন হেলেন
কেলার। তাঁর নাম তো জানোই তোমরা। মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে
অন্ধ ও বধির হয়ে যান। ছ’ বছর বয়স থেকে অ্যান সুলিভান নামে এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় তিনি লিখতে ও পড়তে
এবং বলতে শেখেন। পরে তিনি ব্যাদক্লিফ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৪ সালে অনার্সে সেরা
নম্বর নিয়ে স্নাতক হন। তিনি বহু বই লিখেছেন এবং অন্ধ ও বধিরদের উন্নতির জন্য
দৃষ্টান্তমূলক কাজ করে গিয়েছেন। আমরা চারজন অর্বাচীন বিস্ময়ে একেবারে হতবাক।
এবার ঘরে ফেরার পালা। দু ঘন্টার টানা বৃষ্টিতে নীচের রাস্তায় জল থৈ থৈ করছে।
বলাই আর আমি যাব উত্তরে, ভানু আর রেণু দক্ষিণে। --- এই বর্ষায় গাড়ি-টারি পাওয়ার সম্ভাবনা বোধ হয় নেই,
কপালে বহুৎ তকলিফ আজ। অগত্যা ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা ---” বলাই রবি ছেড়ে
কাজীদাকে স্মরণ করল। --- ওটা কোন ব্যাপারই নয়, ভুলোদা নির্বিকার গলায় বললেন, ১৯০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার যোহান হারলিংগার
ভিয়েনা থেকে প্যারিস পর্যন্ত মত ১৪০০ কিলোমিটার পথ পায়ের বদলে হাতে হেঁটে
বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন গড়ে ১০ঘন্টা করে মোট ৫৫ দিনে ঐ পথ
হেঁটেছিলেন। নীচে নেমে এসে একহাঁটু জল ভেঙে এগোতে এগোতে কোন কষ্ট আর অসুবিধার কথা আর
মাথাতেই এলো না।
(এই লেখকের গল্প 'চিঠিচাপাটি' পড়ুব এই লিঙ্কে http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_53.html)
(এই লেখকের গল্প 'চিঠিচাপাটি' পড়ুব এই লিঙ্কে http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_53.html)