রেশমিকাহিনি
শ্যামাপদ কদিন ধরে বাড়িবন্দি। কথাও বলছে
কম। যে মানুষটার দুতিনটে মোবাইল একসঙ্গে বেজে উঠত তার কাছে প্রায় কোনো কলই আসছে
না। বড়সড় ঝাড়, রেশমি আন্দাজ করে।
সারাজীবন জ্বালিয়েছে। পাকা দেখার পরে
বিয়ের দিন স্থির হয়েছে। নেমন্তন্নের চিঠিপত্র বিলি হচ্ছে। হঠাৎ সে কোনো অজুহাতও না দেখিয়েই বিয়ে করবে না
জানিয়ে দিল। রেশমির দুই দাদার সে কি হয়রানি! বাচ্চা পেটে এল। বলে কিনা তার বাচ্চা
নয়। রেশমি তখন আত্মহত্যার কথাও একবার ভেবেছিল। সে বাচ্চা বাঁচে নি। বাচ্চা আর আসেও নি। রেশমি আবদার করেছিল, মাদার তেরেসার
থান থেকে একটা অনাথ বাচ্চা এনে মানুষ করবে। শ্যামাপদ রাজি হয় নি।
ততদিনে শ্যামাপদ দলের ভেতরে প্রভাবশালী
নেতা। রেশমিকে পেছনের দরজা দিয়ে কলেজে ঢুকিয়ে নিজে কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। হোলটাইমার।
রেশমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকদিন নিজের
মুখ, মাথার চুল, শরীর, সমস্তই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। বুঝতে চেয়েছে সত্যিই সে
বিকর্ষণীয় কিনা। নাহলে সে জানে, শ্যামাপদর আসঙ্গলিপ্সা
প্রচণ্ডই, কিন্তু নিজের বউকে সে নিয়মিত অবহেলা করেছে। রেশমি আদর চাইত, ভিকিরির
মতো। শ্যামাপদ যন্ত্র। নিজের বীর্য বের করে ফেলাই তার কাজ। তারপরই সে নাশেষ হওয়া
হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়েছে, সিগারেট ধরিয়েছে।
মাঝে একসময় সুলেখা আর জুলেখাদের ফোন আসত।
রেশমির কাছেও আসত। তারা হয়ত দলের কেউ কিংবা সমাজের প্রতিপত্তিশালীদের কেউ। এমন
ভাবে কথা বলত যেন রেশমি কাজের মেয়ে। রেশমি পরে জেনেছে, জুলেখা কনসিভ করেছে আর দল
শ্যামাপদকে সেই কারণে দায়ী করেছে। তবে আজকের সঙ্কট সেই কারণে নয়, বড় কিছুর জন্যে
দল শ্যামাপদকে শাস্তি দিতে চাইছে।
দলের ছেলেরা ধর্ষণ করছে খুন করছে, রেশমি
খবর পেত। তোলাবাজি, প্রোমোটারি, জমিছিনতাই, এসব খবরও পেত। শ্যামাপদকে কখনো কখনো
প্রশ্ন করত। সে সঙ্গেসঙ্গেই উড়িয়ে দিত দলের সামনের সারির নেতারা যেমন সাংবাদিকদের
এসব প্রশ্ন মাছিতাড়ানোর মতো উড়িয়ে দেয়।
আজ আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল শ্যামাপদ।
একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে, এইরকমই বিড়বিড় করে বলতে বলতে বেরিয়েছিল। সন্ধের
আগে ফিরে এসেছে। বিধ্বস্ত।
রেশমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। ভাবল,
সবগুলোই এক পদ যেখানে, কে কার হেস্তনেস্ত করবে ?
শ্যামাপদ অস্বাভাবিক তাড়াতাড়ি আলো নিবিয়ে
দিল। এক চুমুকে গ্লাস খালি করে পুরনো মেজাজেই ডাক দিল, রেশমি!
এই ডাকের মানে রেশমির জানা। পরের দিন ক্লাস ছিল তার। সে পল সায়েন্স পড়ায়।
বিরক্তিকর। বরাবরই মনে হয়েছে, পলিটিক্যাল প্রোবাবিলিটি। সম্পত্তির উদ্ভব ও বিকাশ
নিয়ে একটা বই সে তখন পড়ছিল। শ্যামাপদ আবার ডাকল, রেশমি!
রেশমি বলল, না।
ফুল ফুটল না
যত ভিতরে পা ফেলি অন্ধকার বড়ো বেশি সরল। সেই গহন অন্ধকারে আলো বলতে
মাথার ওপর অগণ্য নক্ষত্র আর দামুচাচার উঠানে
বাঁশেঝোলানো দুটি হেরিকেন।
শুরুতেই গান। মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি,
সেদিন সুদূর নয় আর। তারপরই নাটক। শহরের পথনাটকে যে কজন ঘিরে দাঁড়ায় তার চেয়ে ভিড় একটু
বেশি। দেবাঞ্জনদা বলল --- দেখেছ কমরেড,
গ্রামের মানুষ জেগে উঠেছে।
সত্তরের দশক সেদিন মুক্তির দশক। সবুর সইছে
না। বিপ্লবীরা গ্রামে চলে গেছে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কর্মসূচি পার্টির। আমরা
বিপ্লবী নই। শহরের দেয়ালে মাওসেতুঙের মুখ আঁকছি। আমরা সহায়ক। গান গেয়ে নাটক করে
শহরগ্রামের মানুষদের চেতনা আনাই আমাদের কাজ।
নাটক আরম্ভ হতেই সামনেবসা বাচ্চারা গোলমাল
বন্ধ করে দিল। তাদের জড়িয়ে বসেছিল নানাবয়েসের মেয়ে। বয়স্ক ছেলেরা সব দাঁড়িয়েই ছিল,
পেছনে। ছোট নাটক। ফুলকাকা জোতদারের রোলটা চুটিয়ে করে। বিশেষত একটা দৃশ্যে --- যেখানে
দেনাশোধ করতে পারে নি চাষি আর জোতদার তার জমি হড়প করবে, জোর করে বুড়ো আঙুলের ছাপ
নেবে শাদা কাগজে, কালি শেষ, চাষির বুড়ো আঙুলে সে ছুরি চালিয়ে দিল আর সেই আঙুলের
রক্ত দিয়েই ...
আমরা রোমাঞ্চিত হতাম। দর্শকরাও হত।
আমাদের অভিনয় এখানেই শেষ --- বলার আগেই
তুমুল হাততালি।
দেবাঞ্জনদা আবার বলল --- দেখেছ কমরেড,
জনগণ তৈরি।
রাতে খাওয়ার আয়োজন ছিল। তখন দামুচাচা,
হাতে একটা বিড়ি, আমাদের সামনে।
দেবাঞ্জনদা জিগগেস করল --- কেমন লাগল,
দামুচাচা ?
--- দেখেছ ফুল কেমন ফুটে ?
--- সে কি কেউ দেখতে পায় ?
--- ধীরে ধীরে ফুটে। ভিতরে ঝড়, ভাঙচুর। রক্তঝরন।
চারপাশ অতি সুন্দর ছিঁড়ে সে। তারপর পাপড়ি মেলে, সাজায়, একটু একটু করে।
--- তো ?
--- নাটকখান ভালো। জোতদার নাকাল। ভালো।
কিন্তু কোথায় যেন তোমাদের তাড়াহুড়ো। ফুল ফুটাতে চাইলে, দুম করে। ফুল ফুটল না।