আমি
অহনা , একজন বাঙালি মেয়ে । গ্লোবাল
ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের সাউথ এশিয়ার বর্তমান কান্ট্রি ডিরেক্টর রঞ্জন রায়ের
একমাত্র মেয়ে আমি অহনা। আমার মা সোহিনী রায় আমাদের পরিবারের সর্বেসর্বা। আমার একমাত্র দাদা রোহন রায় মা- বাবার আদুরে ছেলে , আর আমি অহনা তাদের একমাত্র
আহ্লাদে মেয়ে।
বর্তমানে আমার মনটা বড়ই অশান্ত । বলতে গেলে এখন আমি এক
ধরনের ঘোরের মাঝে দিন কাটাচ্ছি। যে আমাকে ভালোবাসার জন্যে পাগল ছিল সে কি এখন আমাকে
আগের মত ভালবাসে, সে কি অধরা থেকে যাবে?
বহুজাতিক কোম্পানীর চাকরীর সূত্রে বাবা - মাকে নিয়ে এ শহর থেকে ও
শহরে, এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি দিতে
হয়েছিল এক সময়। নতুন নতুন জায়গা ও নতুন নতুন মানুষের দেখার অভিজ্ঞতা তাদের অনেক। দাদা
ও আমার জন্মের পর মা - বাবার সঙ্গী হয়ে দেশের বাইরে আর কখনো যাননি।
বাবা ঢাকা থেকে বদলীর খবর মাকে জানালে মা কেন যেন খেপে
যেতেন। বাবার কাছ থেকে খবর শুনে মা বিড় বিড় করে বলতেন- আর ভালো লাগে না, বাচ্চা বাচ্চা দুটো ছেলে
মেয়েকে আমার একার পক্ষে ঘর সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আবার
বদলীর অর্ডার,
তাও দেশের
বাইরে,দেশের ভেতরে হলেও কথা ছিল।
বাবা
ঢাকার অফিসের প্রধান হিসাবে কয়েক বছর আছেন। সেবার ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাবার প্রোমশন
ও বদলীর অর্ডার এলো, সামনের জানুয়ারির এক তারিখে দিল্লির রিজিওনাল অফিসে সিইও পদে জয়েন করতে
হবে। বাবার বদলীর খবর জেনে মায়ের মাথায় যেন পাহাড় ভেঙে পড়লো। বাবার বদলীর চাকরী, এনিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা
নেই। তিনি ঢাকা অফিসে প্রথম জয়েন করার পর এর মাঝে দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, গৌহাটি, চেন্নাই ও কোয়ালামপুরে চাকরী
করে এসেছেন।
আমার
মা গৌহাটির বাঙালি মেয়ে। মায়ের ঠাকুরদা বরদাপ্রসাদ চৌধুরী পৈত্রিক বাড়ি ছিল বরিশালের
আগৈলঝরায়, সাতচল্লিশের দেশভাগের কালপর্বে দাঙ্গায় ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ
হয়ে বহু হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করে । তাদের সঙ্গে চৌধুরী পরিবারও দেশ ছাড়ে। বরদাপ্রসাদের
পূর্বপুরুষদের আসাম মুলুকে কিছু জমাজমি ছিল। তাই বরদাপ্রসাদ অন্তসত্ত্বা স্ত্রী ও বৃদ্ধা
মাকে নিয়ে প্রথমে গৌহাটির শ্মরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ওই শ্মরণার্থী ক্যাম্পেই
মায়ের বাবা বিজন চৌধুরীর জন্ম । এক সময় অনেক সংগ্রাম করে মায়ের ঠাকুরদা বরদাপ্রসাদ
গৌহাটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তার একমাত্র ছেলে বিজনকে মানুষের মত মানুষ করাই
ছিল তার ধ্যানজ্ঞান । মৃত্যুর আগে তিনি দেখে যেতে পারেন
তার ছেলে বিজন সত্যিকারেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
বড়
পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বদলী হতে হয় মা তা জানলেও এবারও কিন্তু তিনি অস্বস্তি প্রকাশ
করে বাবাকে বললেন-রঞ্জন, আবার তোমার বদলীর অর্ডার ! রোহন , অনা’র পড়াশোনার ব্যাপার তাহলে আমার ঘাড়েই এসে পড়লো। তুমি এক জায়গায় স্থিতু
হয়ে চাকরী করতে পারলে না!
বাবা
মাকে বিস্মিত কন্ঠে বললেন - সোহানী, তুমি আমার বদলীর কথাটাই
ভাবলে, প্রোমোশনের কথাটা ভাবলে
না! তুমি হয়তো জান না, ঢাকা অফিসে সিইও এর কোন
পোস্টই নেই।
বাবার কথা শুনে মা অস্ফুটস্বরে কী যেন
বললেন - চাকরীর আগে তোমার সাথে আমার দেখা হলে তোমার কথা মতো এক
জায়গায় স্থিতু হবার মতো একটা চাকরী খুঁজে নেওয়া যেত।
একটা
বেসরকারী কলেজে মাস্টারী করলে বাড়ির ভাত খেয়ে বাড়িতে স্থিতু হতে পারতাম। কিন্তু তাহলে
কি গৌহাটি বসবাস করে তুমি আমার দেখা পেতে? আর আমার সাথে প্রেম করার
কথা নাই বা বললাম। বাবার কথা শুনে মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন ,- তোমার সঙ্গে প্রেম করতে
আমার বয়ে গিয়েছিল। তুমিই আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছিলে! ওই সময় আমি ও দাদা তাদের ধারে কাছেই আছি তা তারা ভুলেই গিয়েছিলেন।
বাবা
কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বলতে থাকলেন - এমবিএ শেষ করার পর চাকরীটা আমার ভাগ্যে জুটলো তোমার বাবারই দয়ায়। তখন
তিনি সাউথ এশিয়ান রিজনের কান্ট্রি ডিরেক্টর। হেড অফিস সিঙ্গাপুরে। তাদের ঢাকার গুলশান
অফিসের সেলস এক্সিকিউটিভ পদে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় আমি বুঝতে পারলাম, তিনি গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল
ইন্টারপ্রাইজের বড়সড় পদে আসীন। সত্যি সত্যি বলতে তিনিই ছিলেন ইন্টারভিউবোর্ডের সর্বেসর্বা।
তার মনে কী ছিল আমি সে সময় বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলাম তার মনে একটা সুপ্ত বাসনা
ছিল।
- রঞ্জন, তুমি কিন্ত্র তোমার সীমা
লঙ্ঘন করে যাচ্ছ! মা বাবার উপর কপট রাগ দেখিয়ে
বলে উঠলেন।
বাবা মায়ের কথায় কান না
দিয়ে বলে চললেন,- সেলসএক্সিকিউটিভ পদে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার আমি তোমার বাবার সঙ্গে
তার অফিসে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বললেন
- কনগ্রাচুলেশন
ইয়ং বয়, আই উইস ইওর বেস্ট লাক। ইউ
উইল বি ইয়োংগেস্ট এন্ড স্মার্ট অফিসার ইন আওয়ার ঢাকা অফিস। থাকস এ লট,স্যার। আই উইশ টুএক্সপেক্ট
ইওর ফুল কপারেশন এন্ড হেল্প টু বি এ গুড অফিসার।
আমি
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছে থেকে সব ধরনের সাহায্য ও সহানুভূতি
প্রত্যাশা করলাম।
তারপর পর থেকেই তিনি আমাকে স্নেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন। আমি তাদের ঢাকার অফিসে
জয়েন করার পর সেবার তোমার বাবা মাস ছয়েক ঢাকা অফিসে ছিলেন । মা আমার বাবার কথা শুনে বিরক্তির সাথে বললেন, --তুমি একই কাসুন্দি কত বার
ঘাটবে!
আমি
ঠাকুমার মুখে শুনেছিলাম, আমার বাবা রঞ্জন রায়ের সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠার মূলে ছিলেন আমার মায়ের
বাবা অর্থাৎ আমার দাদু বিজন চৌধুরী। বিজন চৌধুরী তাদের গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের সুদর্শন আর
চৌকষ অফিসার রঞ্জন রায়কে গৌহাটি অফিসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন হয়তো তার মনের সুপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার মানসে।
গৌহাটিতে
বদলী হয়ে রঞ্জন রায় নিজেকে ভাগ্যবান বলেই মনে করলেন। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের
কর্ণধার বিজন চৌধরীর সান্নিধ্য পাওয়াটাকে তিনি বড় করে দেখলেন। অন্যদিকে , বিজন চৌধুরী তার বিদুষী ও সুন্দরী মেয়ে সোহানীর জন্য এমন একটা চৌকস ছেলেই খুঁজছিলেন। আমার দাদু বিজন চৌধুরীর মনের ইচ্ছে পূরণ হতে কোন বিপত্তি
ঘটলো না। তিনি একমাত্র মেয়ে সোহানির সাথে রঞ্জন রায়ের বিয়ে সম্পন্ন হবার পর রঞ্জন রায়ের
পদোন্নতি কে আর রোখে!
দাদা
ও আমার জন্ম ঢাকায়। আমাদের পড়াশোনার হাতেখড়ি আমাদের গুলশানের নিজস্ব
ফ্লাটের বাসার পাশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সেবার আমি ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠব , আর দাদা সবে ইন্টার পাশ
করেছে নটর ডেম কলেজ থেকে। দাদা ঢাকার যে কোন সরকারী মেডিক্যাল কলেজে এম.বি.বিএস এ ভর্তির উদ্দেশে ফার্ম গেটের ওখানে নাম করা একটা কোচিং এ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমাদের
বাসায় দাদার বন্ধুবান্ধব তেমনটা কেউ আসতো না, তবে দাদার কথাবার্তায় আমি
বুঝতাম দাদার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে , আর তাদের মধ্যে একজন নাকি দক্ষিণ ভারতীয় আর কয়েকজন নাকি খৃষ্টান। আমাদের
বাসা স্কুলের পাশে হওয়ায় আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবীরা প্রায় প্রায় আমার সাথে আমাদের বাসায়
আসত। মা একদিন দাদাকে বললেন,- অনা এর তো অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, রোহন, তোর কি কোন বন্ধুবান্ধব
নেই?
দাদা বলল, -থাকবে না কেন, ওর মত আমি কাউকে বাসায় নিয়ে আসি নে তাই আর কী। অনা এর জন্মদিনে তোর বন্ধুদের
আসতে বলবি এবার।
- -ঠিক আছে মা।
মা আমাকে অনা বলে ডাকেন।
আমার ইলেভেনথ বার্থ ডে টা আমার জীবনে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
সেবার দাদা নটর ডেম কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ছয় মাস কেটেছে, আর আমি সবে ক্লাস সিক্সে
উঠেছি, ক্লাস তখনো শুরু হয়নি। সামনের
জানুয়ারির পনেরো তারিখে আমার বার্থ ডে। বাবা দেশেই ছিলেন । তাই
ঘটা করেই আমার ইলেভেনথ বার্থ ডে’র উৎসব হলো। আমার বান্ধবীরা তাদের মায়েদের সাথে, আর দাদার বন্ধুরা নিজেরাই
এলো। অনেক হৈহুল্লোড়, গান বাজনা আর খানাপিনার আগে দাদা তার বন্ধুদেরকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিল । দাদা তার অন্তরঙ্গ দক্ষিণ ভারতের কেরালার প্রীতম নামের ছেলেটির পরিচয় বিশেষ ভাবে
করালো। আমার বান্ধবীদের অনেককেই আমার বাবা মা চিনতেন। তাদের মায়েদের
তো চিনতেন না
, তাই আমিও
আমার বান্ধবীদের সাথে সাথে তাদের মায়েদেরও সবার সাথে পরিচয় করালাম। বয়সের তুলনায় শরীর
স্বাস্থ্যে আমি বেশ একটু বেড়ে ওঠায় আমার বান্ধবীদের চাইতে দেখতে আমি বড় ছিলাম। আমি
ও আমার বান্ধবীরা ছাড়াও দাদার বন্ধুদের কয়েকজন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইল। তাদের মধ্যে প্রীতম
নামের দক্ষিণ ভারতীয় অবাঙালি ছেলেটিও ছিল।
অনুষ্ঠানের
শেষ হওয়ার পর বাবা বললেন,- কেরালার ছেলেটি তো সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়! প্রীতমের মাতৃভাষা তামিল হলেও সে কিন্তু কলকাতায় মানুষ
হয়েছে। ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে কলকাতার কলাকেন্দ্র থেকে। ভাল বাংলা বলতে পারে। বাবার
মতো আমিও দাদার বন্ধু প্রীতমের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হলাম। -
রোহন, আসছে রবিবার সন্ধ্যায় আমি
বাসায় আছি,
তোমার বন্ধুর
গান শোনাতে পারবে? -অবশ্যই পারবো। দাদা বলল।
আমাদের
বাসাতে গানের রেওয়াজ ছিল। আমি মায়ের কাছে গান শিখতাম, দাদা ডুগি তবলা বাজাতো। বিয়ের আগে মা
গৌহাটির বাসায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখতেন ওস্তাদ বারীণবরণের কাছে। গৌহাটি সঙ্গীত কলাকেন্দ্রের
রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে মা গান গেয়ে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানের চিফ গেস্ট
ও গানের বিশেষ আকর্ষণ ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে স্থানীয় শিল্পীদের
গ্রুপ ফটোতে মাও ছিলেন। সেই গ্রুপ ফটোটা তখনো ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছিল।
রবিবার
সন্ধ্যায় দাদার বন্ধু প্রীতম এলো। বাবা বাসাতেই ছিলেন। চা পর্ব শেষে
গানের আসর বসল আমাদের বাসায়। বাবা রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত
। তিনি পূজা,
প্রেম ও প্রকৃতি
পর্যায়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। ডুগি তবলা নিয়ে বসলো দাদা । প্রীতম হারমোনিয়াম কাছে টেনে নিয়ে গান ধরলো: -বড়ো আশা করে এসেছি গো , কাছে ডেকে লও,/ ফিরায়ো না জননী--- তারপর সে পর পর আরো দুটো
পূজা পর্যায়ের গান গেল। -ওই আসনতলের মাটির ’পরে লুটিয়ে রব,/ তোমার চরণ- ধুলায় ধুলায় ধূসর হব----- এবং - আমার যে সব দিতে হবে সে
তো আমি জানি-/আমার যতবিত্ত , প্রভু আমার যত বাণী-----
-আন্টি, আপনি এবার গান হারমোনিয়ামটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল।
মা পূজা ও প্রেম পর্যায়ের দুটো গান গাইলেন। প্রীতম আরো
তিনটে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল। এবার বাবা আমাকে বললেন,-মা অহনা, তুমি তোমার গান দিয়ে এবার আসর শেষ কর, ডিনারের সময় বয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এই গানটি গাইলাম, যা আমি দিন দুয়েক আগে মায়ের
কাছ থেকে শিখেছি। -
রাঙিয়ে দিয়ে
যাও,যাও যাও গো এবার যাবার আগে-/ তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,/তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে/ অশ্রুজলের করুণ রাগে----।
তারপর
থেকে প্রীতম মাঝে মধ্যে এসে জানতে চাইতো দাদা বাসায় আছে কিনা। সে প্রথম প্রথম শুধুমাত্র
দাদাকে খুঁজলেও আমি তার চাহনি থেকে এক সময় বুঝতে পারলাম সে শুধুই দাদার খোঁজে আমাদের
বাসায় আসে না। আমি তো সবে এগার পেরিয়েছি, কিন্তু কেউ আমাকে দেখে ভাবতে না আমি সবেমাত্র এগার পেরিয়ে বার বছরে
পড়েছি, আমাকে কেউ পনেরো বছরের কিশোরী
ভাবলেও আমি অবাক হই না।। আমার মা দীর্ঘাঙ্গী ও সুদর্শনা , গায়ের রঙ দুধে আলতায় মেশানো। সবাই বলে
আমি নাকি আমার মায়ের চেহারা ও গড়ন পেয়েছি।
ছেলেটির
বয়স আঠারো থেকে ঊনিশের মধ্যে হবে। ছেলেটির গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণ হলেও সুদর্শন ও সুঠাম
দেহী। ছেলেটির বাড়ি ভারতের কেরালার রাজ্যের ত্রিচুর জেলার পুন্ন্যাউর্কুলামে। অল্প
বয়সে বাবা মা মারা যাওয়ায় ভাইদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় কলকাতায় পিসির কাছে মানুষ। তার
পিসি কেরালার মেয়ে হলেও তার স্বামী বাঙালি, তাই সে পিসতোত ভাইবোনদের সাথে বাঙ্গালিয়ানা
পরিবেশে মানুষ। চার বছরের একটা স্কালারসিপ পেয়ে সে ঢাকাতে পড়ছে। এক সাথে না পড়লেও প্রীতম দাদার প্রিয় বন্ধু , আমার বুঝতে বেশি দেরি হলো না। ও ভাল
কবিতা আবৃত্তি করে আর ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় এটা আমি অস্বীকার করি না। বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত
ভালোবাসলেও তার গান শোনার সময় কোথায়! মায়ের কিন্তু অঢেল সময়। প্রীতম মাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে
তার স্নেহ লাভ করে অল্পদিনের মধ্যেই। আমিও অল্পদিনের মধ্যে প্রীতমের গানের মুগ্ধ শ্রোতা
হয়ে উঠলাম।
এভাবে
তিনটে বছর গড়িয়ে গেল। এর মাঝে পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আমি কৈশোর পেরিয়ে বয়:সন্ধিক্ষণের মাঝামাঝি পর্যায়ে
উপনীত হলাম। উপলব্ধি করতে পারলাম আমি ধীরে ধীরে কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত
গোলাপে রূপান্তরিত হচ্ছি। পূর্ণ যৌবনবতী হয়ে উঠতে আমার আর বেশি দেরি নেই।
প্রীতমের
সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হয়েছে। প্রথম থেকেই প্রীতম আমার প্রতি অনুরক্ত
ছিল। কিন্তু সে সময় আমি ভালোবাসার অতশত বুঝতাম না।
সত্যি
কথা বলতে প্রীতমই আমার এত টুকু বয়সে আমাকে তাকে ভালবাসতে শেখালো। তাই দাদার প্রিয় বন্ধু প্রীতম একদিন আমার প্রিয়তম বন্ধু
হয়ে গেল। তার সুন্দর মুখশ্রীতে আমি মোহনীয়তার আভাস পেলাম। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি সে খবর জানতে মায়ের বাকি ছিল না, দাদাতো চাইছিলই আমি প্রীতমের
সাথে মেলামেশা করি।
বাবার
কার নিয়ে রাঙামাটিতে লং ড্রাইভে যাবার কথা এখনো মনে গাঁথা হয়ে আছে। দাদা ড্রাইভ সিটে, প্রীতম ও আমি পেছনের সিটে
বসলাম। দাদা কয়েক মাস আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে। রাঙামাটির প্রকৃতিক দৃশ্য দেখে
আমরা মুগ্ধ!
হৈহুল্লড় অনেক
হল, নানা ভাবে পোজ দিয়ে ফটো তোলা হল । মা বাড়ি থেকেই খাবার তৈরি করে দিয়েছিলেন।
সেই খাবার পরিতৃপ্তির সাথে খেলাম। ফেরবার পথে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সন্ধ্যা
ঘনিয়ে এলো। ভেতরের লাইট অফ করে দাদাকে সবধানে গাড়ি চালাতে
বলে সিটে গা এলিয়ে দিলাম। প্রীতম জানালার
পাশে
বসে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমার চোখে ঘুম নেমে এলো। এক সময় আমি বুঝতে পারলাম, প্রীতম আমার গা ঘেঁসে বসেছে।
কার ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে, আমার শরীরে হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার গোলাপী গালে আস্তে একটা চুমু দিয়ে
সে আমার স্তনে আলতো করে হাত ছোঁয়াল। আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। আমি ভাবলাম, আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে
স্পর্শ করার সাহস পায়নি। আমি কী করবো তা বুঝে ওঠার আগে প্রীতম যেন খেলায় মেতে উঠলো।
আমি শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ করতে চেয়েও করতে পারলাম না। বাসায় ফিরে বিছানায় চোখ বুঁজলে
ওই কথাটাই মনে ভেসে উঠলো। আমি মনকে এই বলে সান্ত¦না দিলাম, একদিন তো প্রীতম আমারই হবে।
সামনের বছর আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেবো। অন্যদিকে প্রীতমের
কোর্সও শেষ হবে আর একবছর বাকী। প্রীতমকে আমি ভালোবাসি । প্রীতমকে ছাড়া বাঁচবো না এমন
একটা আবেগ আমার মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছে, আমি এক সময় উপলব্ধি করলাম।
সামনে
এইচএসসি পরীক্ষা, পড়াশোনায় আমি খুবই ব্যস্ত, প্রীতমের পরীক্ষাও সামনে। বেশদিন আমাদের
দেখাসাক্ষাৎ নেই। পরীক্ষা শেষ হবার পর আমি ভাবলাম, প্রীতমের পরীক্ষাও তো শেষ হয়ে এলো ।
দু’জনের পরীক্ষা শেষ হওয়ার
পর----- চুটিয়ে প্রেম করা যাবে ভাবলাম
আমি। কিন্তু বিধি বাম। পরীক্ষার পর প্রীতম লাপাত্তা। দাদার সঙ্গেও তার কোন যোগাযোগ নেই। এক
সময় আমি জানতে পারলাম সে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই কলকাতা হয়ে সে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে
চলে গেছে। এও জানতে পারলাম সে নিউইয়র্কে , ওখানে নাকি অন্য মেয়েদের সাথে প্রেম করে বেরাচ্ছে। এব মধ্যে আরো কয়েক
বছর গড়িয়ে গেল। আমি এর মাঝে ইংরেজিতে অনার্স করে এম পাশ করেছি। কলকাতায় তার পিসিমার
কানে এটা ওঠায় তিনি প্রীতমকে দেশে ফিরিয়ে আনলো। দেশে ফিরে সে একবার ঢাকায় আসে। আমাদের
বাসায় দু’তিন দিন এলো। সে আমাকে ভুলে
ছিল বলে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। সে আমাকে জীবন সঙ্গিনী করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও
আমি তার চোখেমুখে আগেকার সেই আবেগ উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম না। তারপর সে আমার সঙ্গে ও
আমার দাদার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমি সুন্দরী ও বিদুষী, তাই অনেকেই আমাকে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করলে আমি কিন্তু প্রীতমের মুখ চেয়ে তাদেরকে প্রত্যাখান করেছি।
এখনো
আমি প্রীতমের অপেক্ষায় বসে বসে আছি। আমি মাঝেমাঝে ভাবি, প্রীতম কি চিরদিনের জন্যেই অধরা থেকে
যাবে।