গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

ঝর্না চট্টোপাধ্যায়

সিনেমা


রবিবারের দুপুরবেলা।  খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় এসে বসল শুভা। অবিনাশ একটু আগেই এসে বসেছে এঘরে। খাবার পরে টেবিল পরিষ্কার,বাড়তি খাবার-দাবার ফ্রিজে তুলে রাখা, রান্নাঘরের তাক, ওভেন এসব পরিষ্কার করা, আরো দু-একটা টুকিটাকি কাজ সেরে তবে তো আসা। এসে দেখল অবিনাশ শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছে, শুভাকে বিছানায় বসতে দেখে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। শুভা বিছানায় বসে আলগোছে একবার চুলের গোড়ায় হাত বোলাল, ভিজে আছে কিনা দেখে নিল তারপর আলগা একটা হাতখোঁপা করে পা তুলে ভাল করে বসল বিছানায়। অবিনাশের  ওদিকে আরো একটা কাগজ পড়েছিল, অবিনাশকে ডিঙ্গিয়ে হাত দিয়ে কাগজটা টেনে নিল। 
রবিবারের এই দুপুরটুকু ওদের আলস্যের সময়। রোজ যে ঘুমোয় তা নয়, অনেক সময় কিছু সাংসারিক কথাবার্তাও হয়, মেয়ের হোস্টেলের কথা, পড়াশোনা এসব কথাও থাকে, কোথাও বেড়াতে যাবার প্রোগ্রাম,  তাও হয়। আবার ভালবাসাবাসি যে হয় না সেকথাও বলতে পারবে না শুভা। মাঝে মাঝে অবিনাশের সে আবদারও মেটাতে হয়। মোটের ওপর এই সময়টুকু তাদের একেবারে নিজস্ব সময়।
কাগজটা দেখতে দেখতে একজায়গায় চোখ আটকালো শুভার।  একটা সিনেমার রিভিউ। অনেকদিন ধরেই বলছে শুভা অবিনাশকে এই সিনেমা টা দেখতে যাবার জন্য। অবিনাশের সেই এক কথা----আমার সময় নেই। তুমি একা চলে যাও না! আজকাল মেয়েরা একা কত জায়গায় যায়, তোমার সেই মিস্টার এন্ড  মিসেসের রোল মডেল, দুজনে নাহলে যাওয়া চলে না! এবার থেকে একা থাকার অভ্যাস কর, বয়স  হচ্ছে...এরপর আর সিনেমার কথা বলা চলে না। আসলে অবিনাশ এই ধরণের সিরিয়াস সিনেমা দেখা ঠিক পছন্দ করে না। তার কথা হল---অফিসে চাপ, বাড়িতে চাপ, মেয়ের কথা, তার পড়াশোনা, বাবা-মায়ের কথা...এতেই কেত্‌রে আছি, দু ঘণ্টার জন্য গিয়ে আবার বাড়তি চাপ নেবার কোনো মানে হয়! যাবো, খাবো-দাবো, হই-চই করব, ব্যস...মেজাজ একেবারে শরীফ...
শুভা আবার একটু অন্য ধরণের সিনেমা পছন্দ করে। ভাল গল্প, ভাল অভিনয়, একটা সোস্যাল মেসেজ থাকবে, জীবনের কোন একটা দিককে প্রতিফলিত করবে, তবেই তো ভালো সিনেমা হবে! অবিনাশ যেতে চায় না, তবু মাঝে মাঝে যে তাকে টেনে নিয়ে যায় না তা নয়। কিন্তু নিয়ে গিয়ে দেখেছে, অবিনাশ পপকর্ন-কোল্ড ড্রিংস্‌ খেয়ে ঘুমোয়...কি লাভ! এখন তাই সিনেমা যাওয়া একরকম বন্ধই। অনেকদিন  যাওয়া হয়নি।

কাগজে রিভিউটা পড়তে পড়তে বললে শুভা---এই, আজকে সিনেমা যাবে?
কোন উত্তর দিল না অবিনাশ।
শুভা আবার বলল---এ...ই,যাবে আজ সন্ধ্যেবেলায় সিনেমা?
জড়ানো গলায় উত্তর দিল অবিনাশ---কোন সিনেমা?
সিনেমার নাম বলল শুভা। পাশ ফিরে ভাল করে শুতে শুতে বলল অবিনাশ-----তুমি যাও, আমায় মহিমের কাছে যেতে হবে।
---কোন মহিম?’
---আছে...তুমি দেখে এসো...
--কোন মহিম, বল না! আমি জানি তাঁকে...
---হুঁ...চার্চ গেটের কাছে।
--ওঃ ...সেই সুলেখাদির স্বামী, যাঁর কারখানা আছে!
--হুঁ...আর কোন উত্তর নেই অবিনাশের।
---অন্যদিন যেও, অফিস থেকে। চল না...আজকে সিনেমা যাই, প্লিজ...অনুনয় করে শুভা। কোনো উত্তর নেই। শুভা আরো একবার ঠ্যালা মারে স্বামীকে, ---এই, শুনছ! কি গো, যাবে?
--বললাম তো, আমার আজ কাজ আছে, তুমি দেখে এসো না...উঃ, একটু ঘুমোতে দাও...শুয়ে পড়বলে আরো  একটু বিছানায় জায়গা করে দেয় অবিনাশ। স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে দেখল শুভা। ঘুমিয়ে পড়েছে। দেখলে কে বলবে এইমাত্র জেগে ছিল। অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তবে কি অবিনাশ খুব ক্লান্ত, কই, বলেনি তো ! মায়া হল শুভার। আহা, রে! বেচারি একটা দিন ছুটি পায়...ঘুমোক, বিরক্ত করবেনা শুভা। তার তো রোজকার দিন পড়ে আছে।

(২)

অবিনাশ বেরিয়ে গেল বেলা সাড়ে চারটের সময়। বলে গেল ফিরতে রাত হবে। শুভা ইচ্ছে করলে সিনেমা দেখে আসতে পারে। যদি যায়, ফোন করে দিলে সুধীর এসে সিনেমা হলে শুভাকে পৌঁছে দিয়ে আবার অবিনাশের কাছে চলে যাবে। অবিনাশ চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ফিরতে। যদি শুভা সিনেমা যায়, সেক্ষেত্রে শুভাকে হল থেকে তুলে নিয়েও বাড়ি আসতে পারে সে। এতসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট,ড্রাইভার,আসা-যাওয়া  ...শুভা যাবে না ঠিকই করে ফেলল। মাথা  নাড়ল।  না, যাবে না...,আজ অবিনাশ নিজের কাজ সেরে  ফিরুক।  শুভার তো সময় পালিয়ে যাচ্ছে না, সিনেমাও নয়।
---তাহলে আর বাড়ির চাবি নিয়ে গেলাম না...বেরোবার মুখে শুভার দিকে তাকিয়ে বলল অবিনাশ।
মাথা নাড়ল শুভা। অবিনাশ বেরিয়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবিনাশের যাওয়া দেখল। ড্রাইভার সুধীর একটা গেঞ্জি টাইপের নতুন বাহারি জামা পড়েছে, তাও দেখল। ছেলেটা মন্দ নয়, একটু হীরো হীরো ভাব আছে তবে  ভাল গাড়িটা ভাল চালায়। দরজা বন্ধ করে ভিতরে এলো শুভা।

ঘরে ঢুকে বসার ঘরের সোফায় এসে বসল শুভা। তারপর কি মনে করে উঠে বাঁদিকের ঘরটায় এলো। এই ঘরটা মিতুনের, তাদের মেয়ের। এখন কলেজে পড়ে,  হোস্টেলে থাকে। মিতুনের পড়ার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল শুভা। সেই  কোন ছোটবেলার একটা ছবি আছে, রোগা, বোকা বোকা মিতুন। এখন দেখলে কে বলবে এই সেই মেয়ে! হাসি হাসি মুখ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে ছবিটা মুছে আবার টেবিলের উপরে রাখল শুভা। একটা কি ফোন করবে ওকে এখন? পরক্ষণেই ভাবল,না থাক্‌...রাতে করবে। রাতে খাওয়ার পর হোস্টেলে অনেক্ষণ জেগে থাকে মিতুনরা, তখন কথা বলবে, বাবার সঙ্গেও কথা হবে। মিতুনের ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে পাশে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে এল সে।
কয়েকদিন হল তাঁরা দুজনেই হরিদ্বার গেছেন, ওখানে থাকবেন দিন দশেক। আরো দু-একজন বন্ধুরাও  আছেন সঙ্গে। বাড়ি-ঘর তাই আরো ফাঁকা। ওনারা থাকলে শাশুড়ির সঙ্গে গল্পগুজব হয়। মাঝে মাঝে  শ্বশুরমশাইয়ের চা কিংবা কফির আবদার হয়, সময়টা কাটে। এখন যেন কাটতেই চাইছে না। ঘরে এসে শাশুড়ির বিছানায় বসল শুভা। তাকিয়ে দেখল আলনায় একটা  ছাড়া শাড়ী রাখা আছে,ওটা নিয়ে যেতে হবে, ধুয়ে রাখতে হবে। উঠল, বিছানার চাদরটা একটু হাত দিয়ে টেনে ঠিক করে দিল। শ্বশুর মশাইয়ের বসার চেয়ারে কি একটা ছিল,হাত দিয়ে সেটা তুলে ফেলে দিল, আলনা থেকে না-কাচা শাড়িটা  হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো।

নিজের ঘরে বসে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল শুভা। সিনেমাটা দেখে এলেও হয়। এখনো হাতে কিছুটা সময় আছে। তৈরি হতে কত আর সময় লাগবে, মিনিট পনেরো! তার বেশী সময় তার লাগার কথা নয়।  সাজগোজের বাহার শুভার তেমন নেই। তাছাড়া আজ সঙ্গে অবিনাশও নেই। সিনেমাহলের অন্ধকার ঘরে সাজগোজের দরকারটাই  বা কি! এখান থেকে ট্যাক্সি করে যেতে বড়জোর মিনিট কুড়ি। তার পরেও হাতে আধঘন্টা সময়। টিকিট কাটতে বেশী সময় লাগবে কি! দুসপ্তাহ হতে চলল,এখন কি আর অত ভিড় হবে, ঘুরে আসাই যাক্‌।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। চুলে চটপট চিরুনী  চালিয়ে একটা বিনুনি করে ফেলল শুভা। মুখটা মুছে আলমারি থেকে হাতের কাছে যে শাড়িটা  পেল, তাই টেনে নিয়ে পরতে শুরু করল। হাতে হাতঘড়ি পরে টাকা-পয়সা, মশলার কৌটো, ঘরের চাবি সব গুছিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে গেটে তালা দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সি...এই ট্যাক্সি...! 

(৩)
অন্ধকার ঘরে বিছানাটা বড্ড বেশী বড় মনে হচ্ছে। দুজনে দুইদিকে শুয়ে। কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। কেন গেল শুভা সিনেমাটা দেখতে! না গেলে তো জানতে পারত না
,এত কষ্টও হত না। অবিনাশই তো তাকে বারবার একা সিনেমা যাওয়ার জন্য বলেছিল। তাহলে তারপরেও কেন অমন করল! সব জেনেও সে সুলেখাদিকে নিয়ে সিনেমা গেল কেন! কতদিন যাচ্ছে তারা এইভাবে, শুভা তো জানতেও পারেনি।  অবিনাশ কি একবারও ভাবে নি যে শুভা যেতে পারে! নাকি সেইজন্যই বারবার জিজ্ঞেস করে আশ্বস্ত হয়েছিল যে শুভা যাবে না! তাহলে তাঁকে মহিমদের বাড়ি যাবার কথাই বা বলতে গেল কেন? তাহলে অবিনাশ চুপ করে আছে কেন? কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সে। সমস্ত ঘটনা যেন সিনেমার মতই মনে হচ্ছিল। জীবনও তাহলে কখনও কখনও সিনেমার মত হয়! কিন্তু অবিনাশ......আর ভাবতে পারছিল না শুভা, অব্যক্ত যন্ত্রণায় বালিশে মুখ গুঁজে দিল ...।