ঝোঁকের মাথায় কাজটা করে ফেলা ঠিক হয়নি । এখন রথিন বুঝতে পারে ‘ ভাবিয়া করিও
কাজ’ কথাটা কতখানি সত্যি । অফিসেও কানাঘুষো ছিল যে কোনও সময়ে ভি আর এস আসতে পারে ।
আগুপিছু না ভেবে দুম করে সিদ্ধান্তটা না নিলেই ভালো হত । সেদিন তনিমা নাচতে নাচতে
এসে বলল ওর কয়েকজন কলিগ গড়িয়ার কাছে যে নতুন নতুন ফ্ল্যাট হচ্ছে সেখানে এক চেনা
জানা প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট বুক করছে । প্রমোটারই নাকি ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা
করে দেবে । গড়িয়া এখন দারুন জায়গা । মেট্রো রেল চালু হয়ে গেছে । গড়িয়া রেল স্টেশনও
খুব কাছে । এছাড়া স্কুল কলেজ হাসপাতাল নার্সিংহোম বাস টার্মিনাস বাজার দোকান সবই
কাছাকাছি ফ্ল্যাটটার । টু বেডরুম থ্রি বেডরুম সবরকমই ফ্ল্যাট আছে । তনিমা একদিন
দেখতে গিয়ে একটা ফ্ল্যাটও পছন্দ করে ফেলেছে । দারুন পজিশন । দামও একটু সস্তা ।
তনিমা তো উচ্ছসিত । বারবার বলছে ‘ জানো কি সবুজ চারিদিকে । চোখ জুড়িয়ে যায় ।’ যে
ফ্ল্যাটটা পছন্দ করেছে সেটা পুরোপুরি দক্ষিণ খোলা । একটা ব্যালকনিও আছে । চেয়ার
পেতে ওখানে বসলে মনটা নাকি একেবারে শান্ত হয়ে যাবে । সব টেনশন পালাবে । বুক ভরে
নেওয়া পরিস্কার বাতাস শরীরটাকে চনমনে করে তুলবে । দেরি করলে ফ্ল্যাটটা হাতছাড়া হয়ে
যেতে পারে । প্রমোটার বলেছে মাস ছয় সাতের মধ্যে পজেশন দিয়ে দেবে ।
তনিমা তখন বলেছিল ‘ তুমি ডাউন পেমেন্টটা
করে দাও আমি ই এম আই গুলো দিয়ে দেব । তোমাকে এ ব্যাপারে কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না
।’ চিন্তা তো আসবেই । রথিন ভেবে পায় না কোথা থেকে কীভাবে সব ম্যানেজ করবে । এত খরচ
, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় । এখনই এতগুলো ই এম আই টানতে হচ্ছে ।
ওয়াশিং মেশিন , ফ্রিজ, কালার টিভি ,ল্যাপটপ সবই তো ইনস্টলমেন্টে কেনা । এর ওপর
ইন্সিওরেন্স , মেডিক্লেম , দেশের বাড়িতে বাবার কাছে টাকা পাঠানো ,সুমনের
স্কুলের খরচ ,লতিকা মাসির মাইনে সব মিলে
একেবারে নাজেহাল অবস্থা । নেহাত তনিমা চাকরি করে তাই দুজনে মিলে কোনরকমে সামাল
দিতে পারছে । আর জমানো টাকা বলতে তো পোস্টঅফিস আর মিউচুয়াল ফান্ডে ট্যাক্স
সেভিংসের জন্য করা কিছু ডিপোসিট । প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে বাবার বাইপাস সার্জারির
জন্য নেওয়া লোন এখনও কাটছে ।
তনিমার মতো রথিনেরও যে এরকম ইচ্ছে করে না
তা নয় তবে সাহস পায় না । স্বপ্নটা মনের মধ্যেই আটকে থাকে । নইলে ভাড়া বাড়িতে কারই
বা থাকতে ইচ্ছে করে । হাজারো নিষেধাজ্ঞা , বাড়িওলার খচখচানি অথচ সাত তারিখ হতে না
হতেই দরজায় ঠকঠকানি ভাড়ার তাগাদা । চারপাশ বদ্ধ ইঁট কাঠ পাথরের মধ্যে দম যেন আটকে
আসে । অফিস থেকে ফেরা ক্লান্ত শরীরটাকে টানতে টানতে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসার পর আরও
দম বন্ধ হয়ে যায় । নোনাধরা দেওয়ালে সাতজন্মে রঙ হয় না । দেওয়ালে নতুন করে
প্লাস্টার করে রঙ করার কথা বললে বাড়িওলা বলে ‘ ওসব করলে ভাড়া আরও বাড়াতে হবে ।’
এমনিতে ভাড়া তো কম নয় । দুটো ঘর বাথরুম রান্নাঘর মাসে সাড়ে পাঁচহাজার টাকা বেরিয়ে
যায় । ঠিকমত জল নেই রোজই লাইন খারাপ । একটা ভারি আছে রোজ দুবেলা জল দিয়ে যায় তাকেও
মাসে পাঁচশ টাকা দিতে হয় ।
সরু গলির মধ্যে পুরোনো এই বাড়িটা পেয়ে
একসময় বর্তে গিয়েছিল রথিন । এখন আর ভালো লাগে না । একটু বৃষ্টি হলেই গলির মধ্যে
একহাঁটু জল । কেউ দেখার নেই । এইসব থেকে মুক্তি পাবার স্বাদ পেতেই অনেক হিসেব
নিকেশ করে কিছু ডিপোসিট ভাঙ্গিয়ে টাকাটা জোগাড় করে ফেলেছিল । ভেবেছিল প্রমোটারের
কথামত ছ’মাস বাদেই তো পজেশন পেয়ে যাবে । তখন তো আর ভাবেনি এইরকম ঝামেলা আসতে পারে
। লোকাল কাউন্সিলার প্রমোটারের পেছনে লেগেছে । এর সঙ্গে লোকাল পার্টি পাড়ার
মাস্তান সকলেরই দিন কে দিন দাবির বহর বেড়েই চলেছে । আজ এই চাই কাল ওই চাই । ফ্ল্যাটের
প্ল্যান এখনও স্যাংশন হয়নি নানান বাহানায় আটকে
রয়েছে । ফলে ব্যাংক লোনও হয়নি ।
গোদের ওপর বিষফোড়ার মত জমিটার এক শরিক কোর্ট থেকে ইনজাংশন বার করে কাজ বন্ধ করে
দিয়েছে । তনিমার তো মাথায় হাত বারবার জিজ্ঞাসা করে ‘ কি হবে গো ?’ সুমন বাচ্ছা
ছেলে তারও প্রশ্ন ‘ বাবা আমরা নতুন বাড়িতে কবে যাব ?’ রথিন কোনও উত্তরই খুঁজে পায়
না । টাকাটা এই মুহুর্তে ফেরত পাবারও কোনও আশা নেই । প্রমোটার একরকম হাত তুলেই
দিয়েছে । প্রমোটারকে দোষ দেওয়াও যায় না । লোকটাকে খারাপ বলেও মনে হয়নি । অত্যন্ত
ভদ্র এই লাইনে একেবারে নতুন । তনিমার অফিস কলিগরা এরমধ্যে নিজেরা বসে ঠিক করেছে
প্রমোটার আর কাউন্সিলারকে নিয়ে লোকাল পার্টি অফিসে একটা মিটিং করবে । মনে হচ্ছে এই
সবকিছুর পেছনে ওখানকার এক বড় নেতা কলকাঠি নেড়েছেন । তার ক্ষমতা নাকি এখন এমন লোকাল
পার্টিও তার কথায় চলে । সামনাসামনি লোকটা ভালোমানুষের মুখোশ পড়ে থাকে । আড়াল থেকে
চাপ দিয়ে টাকা আদায় করে যার একটা অংশ
নিজের পকেটে ঢোকায় বাকিটা পার্টি ফান্ড আর অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় । এইভাবেই
নিজের একতলা বাড়িটাকে চারতলা করেছে । মনে হচ্ছে প্রমোটারকে ওদের সঙ্গে একটা
আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে আসতেই হবে ।
- কী ভাবছো বলোতো ? তখন থেকে দেখছি চোখ
বুঁজে চেয়ারে বসে রয়েছো । শরীর ঠিক আছে তো ? হাতের সিগারেট তো পুড়তে পুড়তে
ফিল্টারের কাছে এসে পড়েছে । ছুটির দিন বাজার করতে হবে । সব্জিপাতি মাছ সব বাড়ন্ত ।
কাল থেকে তো আবার দৌড় ।
তনিমার কথায় রথিন চোখ খোলে । সত্যিই
সিগারেটের ছাইটা লম্বা হয়ে রয়েছে । তাড়াতাড়ি এ্যাসট্রেতে সিগারেটটা গুঁজে দেয় রথিন
।
- কত বাজলো বলোতো ? রথিন জিজ্ঞেস করে ।
- তোমার হাতেই তো ঘড়ি । ন’টা বাজে ।
- ওরে বাবা অনেক দেরি হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি
ব্যাগগুলো গুছিয়ে দাও ।
- সব রেডি করাই আছে । তুমি কিন্তু বললে না
কী ভাবছিলে ।
- ও কিছু না । রথিনের ছোট্ট জবাব ।
- আমি কিন্তু তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি
কিছু একটা ভাবছ । ফ্ল্যাটের কথা ? দ্যাখো কিছু একটা হয়ে যাবে । আজকে তো রবিদাদের
সঙ্গে ওদের বসার কথা ।
- দ্যাখো কি হয় । আমার তো মনে হচ্ছে
অতগুলো টাকা জলে গেল ।
- না না , এখনই হতাশ হয়ো না । শুধুতো
আমাদের একার নয় আমাদের অফিসের আরও দশজন এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে । রবিদা ,শ্যামলদা,
সুরজিতদা ওদেরও তো অনেক জানাশোনা পার্টির ওপর মহলে ,পুলিশে, প্রশাসনেও হাত আছে ।
মনে হয় না এত সহজে ওরা ছেড়ে দেবে ।
- সময়টা ভালো যাচ্ছে না তনিমা । এত খারাপ
খারাপ খবর আসছে বুঝতে পারছি না কি হবে ।
- কেন আবার কী হল ?
- তোমায় বলেছিলাম না আমাদের অফিসে কানাঘুষো
চলছে ভি আর এস আসতে পারে । এই সময় যদি চাকরি চলে যায় টাকা পয়সা যা পাবো সেগুলো
ফিক্সড রাখলে ইন্টারেস্টের যা হাল হয়েছে সে তো কুলোবে না । সব চালাব কী করে । এই
সময় তাই অতগুলো টাকা যদি জলে যায় কি করব ভেবে পাচ্ছি না ।
- দ্যাখো আমরাতো কোনওদিন কারও ক্ষতি করিনি
। কারও ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করি না । মানুষের ভালো-মন্দে জড়িয়ে থাকি । সকলের
সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলি । সামর্থ মত প্রয়োজনে সাহায্যও করে থাকি । নিজেদের দায়িত্ব
কর্তব্য সাধ্যমত পালন করার চেষ্টা করি । ভগবান কি এতটা নির্দয় হবেন ? আমি বিশ্বাস
করি না । বিপদে পড়লে তিনিই রক্ষা করবেন ।
- তোমার বিশ্বাসে তুমি শক্তি পাও । আমার
বিশ্বাসের ভিতটা বড় দুর্বল । আমার চারপাশে শুধুই অন্ধকার । জানি না আলোর দিশা
কোনদিকে পাব । আমার মনে হয় আমাদের মত মধ্যবিত্তের স্বপ্ন দেখা বাতুলতা মাত্র ।
যাদের চাদর দিয়ে মাথা ঢাকলে পা বেড়িয়ে যায় তাদের স্বপ্ন দেখাটা দূরাশা ছাড়া আর
কিছু নয় ।
- তুমি এত হতাশ হয়ে পড়লে কি করে চলবে ।
নিজের শক্তির ওপর আস্থা তো তোমার বরাবরই
ছিল । হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে গেলে কী করে ?
এসব আগে থেকে ভেবে মন খারাপ করার কোনও যুক্তি নেই । আরে আমার তো চাকরিটা আছে যদি
সেরকম কিছু হয়ও আমরা দুজনে ভেবে ঠিক রাস্তা বের করে ফেলব ।
রথিনের চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ । শরীরটাও
ভালো যাচ্ছে না । অফিসে অত্যধিক পরিশ্রম তারপর এইসব দুঃশ্চিন্তা । ভালো লাগছে না
একদম ।
তনিমা বলে ওঠে ‘তাড়াতড়ি ফিরো । আজ আবার ডঃ
মুখার্জীর সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে । আসার সময় অঞ্জলি মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে
তোমার স্টুল আর ব্লাড রিপোর্টটা এনো । ওরা তো আজকেই দেবে বলেছিল । ডাক্তারবাবুকে
দেখাতে হবে ।’
রথিন বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ।
রোদ্দুরটাও যা উঠেছে হাঁটতে একদম ইচ্ছে করছে না । একটা খালি রিক্সা আসছিল রথিন
তাকে থামিয়ে রিক্সায় উঠে বসে ।
(দুই)
দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা মাস কেটে গেল । তনিমাদের ফ্ল্যাটের সমস্যা এখনও
মেটেনি । নেতা ভদ্রলোকটি প্রমোটারের কাছ থেকে দশ লাখ টাকা চেয়েছেন । প্রমোটার এখনও
রাজি হননি । প্রমোটার এবং তনিমার অফিস কলিগরা পার্টির আরও ওপর মহলে যোগাযোগ করেছেন
যাতে নেতা ভদ্রলোকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায় । এসব ছাড়াও তনিমা বড় চিন্তায় পড়ে
গেছে রথিনের শারীরিক অবস্থা নিয়ে । দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে রথিন । হিমোগ্লোবিন
কমে যাচ্ছে , প্রায় সাতে নেমে এসেছে । ডঃ
মুখার্জী খুব একটা ভালো বুজছেন না । পেটের ব্যাথাটাও কমছে না । আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করেও
যখন কিছু পাওয়া গেল না তখন এন্ডোস্কপি করে পাকস্থলির নিচে একটা ক্ষত পাওয়া গেল ।
ডাক্তারবাবু আবার ওখান থেকে স্যাম্পেল নিয়ে বায়োপ্সিতে পাঠিয়েছেন । আজকে রিপোর্টটা
পাওয়া যেতে পারে । তনিমা ঠিক করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে রিপোর্টটা নিয়ে আসবে ।
মনটা একদম ভালো নেই । রথিন আজকেও অফিস যায়নি । মাঝখানে জ্বর হয়েছিল । এত দুর্বল
হয়ে পড়েছে দেখলেই বোঝা যায় । ছেলেটাকে নিয়েও চিন্তা ওরও জ্বর হয়েছিল । শুধু তনিমাই
ঠিক আছে । বাড়ির এই অবস্থায় ক’দিন অফিস কামাই করতে হয়েছে । অফিসের কি অবস্থা কে
জানে । অফিসে ঢুকতে ঢুকতে ঘড়িতে দেখে দশ মিনিট লেট । সবাই অবশ্য জানে ওর বাড়ির
অবস্থার কথা । ওকে দেখে সবাই হই হই করে ওঠে । বড়বাবু থেকে সব কলিগরাই এগিয়ে এসে
খবর নেয় । রনিতা এগিয়ে এসে বলে ‘ দারুন সুখবর আছে রে তনিমা ।’
- কি ব্যাপার রে ? তোর কোনও প্রমোশন হল
নাকি ? তনিমা হেসে জিজ্ঞেস করে ।
- আরে না না । আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে
গেছে ।
তনিমা এবার বুঝতে পারে ওদের ফ্ল্যাটের
সমস্যা মিটে গেছে । রনিতাও ওখানে ফ্ল্যাট নিয়েছে ।
- প্রমোটার কি টাকা দিতে রাজি হয়েছে ?
- না রে । ওপর মহলের চাপে ওখানকার
নেতাটিকে পার্টি থেকে বহিস্কার করা হয়েছে । অনেকদিন ধরেই অনেক রিপোর্ট জমা পড়ছিল
ওই নেতার নামে । পার্টির গোপন তদন্তে সবকিছুই ওই নেতার বিরুদ্ধে যায় । ওনার জন্য
পার্টির খুব বদনাম হচ্ছিল । ওই এলাকা থেকে দ্রুত জনসমর্থন হারাচ্ছিল পার্টি । আর
কাউন্সিলারকেও রেসিগনেশন দিতে বাধ্য করেছে ।
- কোর্টের ইনজাংশন ?
- সেটাও মিটে গেছে । পার্টির চাপে কেসটা
উইথড্র করে নিয়েছে । তবে প্রমোটার তাকে কিছু টাকা দেবে বলেছে । আসলে পালিয়ে গিয়ে
বিয়ে করে বাপের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও মেয়ে তো । বাপের সম্পত্তিতে তারও অধিকার
আছে ।
তনিমা যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকে । ঈশ্বর ওর
পাশে আছেন । ছটফট করতে থাকে কখন বাড়ি ফিরে রথিনকে খবরটা জানাতে পারবে । একটা
স্বপ্ন সফল হতে চলেছে । কয়েকবার রথিনের মোবাইল নাম্বারে ডায়াল করে । সুইচড অফ । কে
জানে হয়তো ঘুমোচ্ছে । ল্যান্ড লাইনটাও ক’দিন ধরে খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে । সারানোর
নাম নেই । কবে রিপোর্ট করা হয়ে গেছে । লতিকা মাসি আছে বলে ভরসা । বাড়িতে তবু একজন
বয়স্ক কেউ আছে । রান্নাবান্না ,সুমনকে দেখাশোনা সবটাই নিজের মতো করেই করে । যেন
সত্যিই ওদের অভিভাবক । অবশ্য তনিমা রথিন ওরাও সম্মান দেয় । মাস পাঁচ ছয় আগে রথিনই
দেশ থেকে লতিকা মাসিকে নিয়ে আসে । মাসির এক মেয়ে ছিল বিয়ে হয়ে গেছে । মাসির বর
মারা যেতেই মাসি একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে । দেওররা কেউ দেখে না । বাপের বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ । দিদির দায়িত্ব নিতে হবে বলে
ভাইরাও কেউ পা মাড়ায় না এদিকে । এসব দেখেই রথিন মাসির কাছে প্রস্তাবটা দেয় । অবশ্য
ওদেরও এরকম একজনের দরকার ছিল । দুজনেই চাকরি করে সুমনকে নিয়েই সমস্যা । একটা ভালো
লোকও পাওয়া যায় না । এর আগেরজন তো সুমনের গায়ে হাতও তুলতো । লতিকা মাসি তো সুমনকে
পেয়ে আনন্দে তদগদ । নিজের নাতির মতই যত্ন করে । তনিমা দেখেছে সুমনও খুশি । মাসির
কাছেই চান করা খাওয়া ঘুম সবকিছু । তনিমা তো সুমনকে খাওয়াতে নাজেহাল হয়ে যেত ।
সুমনও ছুটছে পেছন পেছন খাবারের থালা হাতে তনিমাও । এখন কেমন মাসির কাছে গল্প শুনতে
শুনতে চুপচাপ খেয়ে নেয় । ভাবনায় ভাবনায় সময়টা কেটে যেতে থাকে । কাজে কিছুতেই মন
লাগছে না । ভেতর ভেতর একটা অদ্ভুত ছটফটানি মনটাকে কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছে না ।
বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে । বড়বাবুর নজরে পড়তেই মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেন ‘
কি রে ছটফট করছিস কেন ? বাড়ি যাবার তাড়া আছে ?
- না না । লজ্জা পেয়ে যায় তনিমা ।
- যা যা সাড়ে চারটে তো বাজল । বাড়ি যেতেও
তো দু’ঘণ্টা লাগবে । চলে যা আমি সামলে নেব ।
তনিমা যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেল । পেটের
ভেতরটা ফুলে উঠছে । যতক্ষণ না রথিনকে সুখবরটা শোনাতে পারছে শান্তি নেই । উড়তে উড়তে
বাড়ি ফেরে তনিমা । সন্ধের নরম কালো চাদরটা নেমে এসেছে প্রায় । লতিকা মাসি দরজা
খুলে দেয় । সুমন লতিকা মাসির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে । তনিমা ব্যাগ খুলে ক্যাডবেরিটা
সুমনকে দিয়ে কপালে একটা চুমু খায় । জিজ্ঞেস করে ‘ লক্ষ্মী হয়ে ছিলে তো ?’ সুমন ঘাড়
নাড়ে ।
- বাবা কোথায় ? কি করছে ?
- বাবা তো ঘরে শুয়ে আছে ।
তনিমা ঘরে ঢোকে । ঘর অন্ধকার দেখে বলে ওঠে
‘ কি গো লাইট জ্বালোনি কেন ? অন্ধকার করে শুয়ে আছো । শরীর খারাপ লাগছে ?’
তনিমা লাইটের সুইচটা অন করে । ঘরটা আলোয়
ভরে যায় । রথিন কপালের ওপর হাতটা আড়াআড়ি রেখে শুয়েছিল । তনিমা রথিনের পাশে বসে
কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে ‘ জানো দারুন সুখবর আছে । আমাদের স্বপ্নটা সফল হতে
চলেছে । ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন । ফ্ল্যাটের সমস্যাটা মিটে গেছে । প্রমোটার বলেছে
মাস ছয়েকের মধ্যে পজেশন দিতে পারবে । কি দারুন খবর না ?’
রথিনের বিষন্ন মুখ দেখে অবাক হয়ে যায়
তনিমা । প্রশ্ন করে ‘ তুমি খুশি হলে না ?’
- আমার খুশি হওয়া না হওয়ায় এখন আর কিছুই
এসে যায় না তনিমা । আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে । আমার চারপাশে এখন অন্ধকার ছাড়া
আর কিছুই নেই ।
- কি বলছ তুমি ! এরকম ভাবে ভাবছোই বা কেন
?
রথিন উত্তর দেয় না , হাত দিয়ে টেবিলের
দিকে ইঙ্গিত করে । তনিমা একটা খাম দেখতে পায় টেবিলের ওপর রয়েছে । তনিমা খামটা তুলে
নেয় । যে রিপোর্টটা তনিমার আনার কথা সেটা রথিন আগেই এনে রেখে দিয়েছে । খামটা খুলে
রিপোর্টটা বার করে । লেখাগুলো পড়তে একটুও অসুবিধা হয় না তনিমার । পরিস্কার ভাবে
লেখা ‘এডিনোকারসিনোমা’ । ঘামতে থাকে তনিমা । ভীষণ গরম লাগছে । সারা শরীরে কেমন এক অদ্ভুত অস্বস্তি ।
জানলাগুলো খোলা তো ! দম বন্ধ হয়ে আসছে
যেন । ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারের ওপর । চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে ওঠে ‘ পাখাটা
বাড়িয়ে দাও ।’
তনিমার বন্ধ চোখের সামনে তখন শুধু লাল
হলুদ নীল সবুজ রঙগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে ।
(এই লেখকের গল্প 'বদল' পড়ুন এই লিঙ্ক'এ http://galpogucchho.blogspot.in/2015/04/blog-post_96.html
(এই লেখকের গল্প 'বদল' পড়ুন এই লিঙ্ক'এ http://galpogucchho.blogspot.in/2015/04/blog-post_96.html