গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

বাল্মীকি উপাখ্যান


এক

শুন সব নরনারী শুন দিয়া মন
মহর্ষি বাল্মিকী কথা করি নিবেদন।
রত্নাকর মহাদস্যু পেটে নাই ভাত
ঘরে তার মেম্বার সব মিলে সাত।
অর্ধাহারে দিন কাটে  চুরিবিদ্যা সার
ধীরে ধীরে হয়ে গেল ওয়াগন ব্রেকার ।


চুরি বাদ দিয়ে রতন অন্যকিছু পারেনা । কিন্তু এই একটি ব্যাপারে সে দক্ষ । তার হাতযশ প্রশ্নাতীত । একডাকে চেনেও সবাই । তার নামে সারা  তল্লাট কাঁপে ।  সাহসী জোয়ানও  বাপের নাম ভুলে যায় সদর্প হুঙ্কারে । কোথাও কোনও চুরি ডাকাতি হলে  সবাই জানে – এ রতনের কাণ্ড । রাত হলেই তার ভূত তাড়া করে । পুলিশের বাঘা বাঘা সাহেবরা  স্যালুট দেয় ।মাঝে একবার চোররত্ন দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল । কে যেন ব্যাপারটা কেঁচিয়ে দিয়েছে । সুবল দারোগা রতনকে মাঝে মাঝে বাড়িতে কল করে – বাপ রতন, তোমার কেরদানি একটু মিনিমাইজ কর  , সামনে পঞ্চায়েতের ভোট , চাকরি রাখা দায় । বলা বাহুল্য রতন শুনেও শুনে না । শুনলে তার দিন চলে না ।   রতন বলে – সাহেব মা বাপ, উসব রিকুয়েস্ট নাই কইরবেন। পুলিশদের সাথে কথা বলার সময় সে অল্পস্বল্প ইংলিশ গুঁজে দেয় । এর কারণ দুটো । প্রথমত রতন  প্রমান করতে চায় সে ওঁচা চোর নয়, পেটের মধ্যে বিদ্যে পুরে রাখা একজন কোয়ালিফায়েড চোর । তার জাত আলাদা। দ্বিতীয়ত সাহেবরা খাতির করলে নিজেকেও ভদ্দরলোকের মতন লাগে। তখন ভস ভস করে ইংলিশ বলে নিজের পেস্টিজ বজায় রাখতে হয় । সুবল দারোগা অবশ্য বেশি অনুরোধ করেনা । জানে এরা সুবোধ বালক হয়ে পড়লে তারই সমুহ বিপদ । গিন্নীর  রাইস কুকার টি এদের প্রাইজ মানির উপর নির্ভরশীল । মা কালীর দয়ায় বেতনের টাকা ছোঁয়াই হয়না তার । ব্যাঙ্কের গোকুলে  সমূলে তা বাড়তেই থাকে প্রিয় ভুঁড়িটির মত । ভাগ্যিস সার্ভিস লাইফের প্রথমদিকে বেশ কিছু গুনধর মানুষের সাথে সংযোগ হয়েছিল তার , এই অভিজ্ঞতা  আজ খুব কাজে লাগে । বাতাসে চোরের গন্ধ সে বুঝতে পারে  । মন্দ লাগেনা এই সৌরভ । অদ্ভুত এক  গৌরবে ও মাদকতায়  ভরে যায়  বুকপকেট ।  নতুন থানায় পা রাখলেই বাতাস কানে কানে বলে দেয় এখানের  চোরঘনত্ব কত। অপরাধমাত্রার জটিল অঙ্ক গুলি অনায়াসেই কষতে পারে একদা মাধ্যমিকে অঙ্কে কুড়ি পেয়ে পাশ করা সুবলবাবু। চোরঘনত্বের সাথে আয়ের সমানুপাতিক সম্পর্কটি তার করায়ত্ব ।মদনপুর থানায় পা রেখেই সুবল বুঝতে পেরেছিল  এ মাটি সোনা ।দুনম্বরি কয়লা খাদান , কোল মাফিয়া আর ওয়াগন ব্রেকারি । শালা  বৈকুণ্ঠে চলে এসেছি । গিন্নিকেও বলেছিল সে কথা  
বুঝলে গিন্নি এখানে চার বছর থাকলেই মার্সিডিজ কার  কলকাতায় ষোলশ স্কোয়ার ফুটের দুটো ফ্ল্যাট ,  আর বেনামে  পঞ্চাশ লাখ ।
তার মত সৎ পুলিশ অফিসারের চাহিদা আর কতটুকু । গিন্নি তো আনন্দে বিশ বাঁও জলে । টুক করে কর্তাকে কিস করে গেয়ে ওঠে সাতকাহন –তোমার মত সৎ লোক পুলিশ লাইনে থাকলে দেশে আইনের শাসন চলত, দেশ টা সগগো হত।  বউয়ের শংসা পত্রের ছত্রে ছত্রে সুখ । বুক ভরে ওঠে । রতনদের ডেকে মিষ্টি খাওয়ায় । রতনের দল ও আনন্দে নাচে – বাপের জম্মে বহুত লাল পাগড়ি দেইখলম  , হুজুর আপনি গড । চোর ছ্যাঁচোড়দেরও ইজ্জত দিতে জানেন ।
সুবল দারোগা রতনের পিঠে হাত রাখে । চোর বলে নিজেকে ছোট করিস কেন? তোরা আমাদের বন্ধু । তোদের পাশে থাকাই আমাদের কাজ । দেশ শুদ্ধু শান্তিনিকেতন হলে খাব কি ? যেখানে রোগ বালাই নেই সেখানে ডাক্তার মাছি তাড়ায় ।তোরাই তো আমাদের ভাতঘর  বাপধন ।
                        
রতন বুঝতে পারে – এ জীবনটা ফ্যালনা নয় , বেফালতু নয় ।কত উবগারে লাগে। পড়াশুনা করেও যখন চাকরি বাকরি হল না ( পড়াশুনা বলতে অষ্টমমান ) তখন বাপ বলেছিল - খালি আড়বাঁশি বাজাল্যে দিন চইলবেক ? ইস্টেজে কিস্ট সাইজে গান কইরল্যে রাই ভুইলবেক কিন্তুক আড়াই সের পেট  নাই ভইরবেক । তার চাইয়ে জুতা পালিশ করগা যা। 

আঁতে ঘা লেগেছিল রতনের । সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে উপোষ করে বুঝেছিল জীবনটা দমতক তিতা ।গলায়  দড়ি বাঁধার ইচ্ছে হলেও পারেনি ভয়ে । কানকাটা ফতুয়াদার সঙ্গে ঠিক তখনই আলাপ। ফতুয়াদা বলেছিল – ই বয়সে সুইসাইড । নেভার । আয় তকে বাইচবার মন্তর শিখাব ...  বেঁচে গেল রতন ।কিন্তু মাঝে মাঝে বিপ্লবী মনটা খচ খচ করে। আজ ওসি সাহেবের ঘরে বসে সে বুঝল চোরদেরও ইজ্জত থাকে । লোকটা মাইরি গুরুদেব ।
      
দুই

রাতারাতি হিসেব বদলে গেল । এ এলাকায় কলকাঠি নাড়ার লোকের অভাব নেই। চার বছরের যে অঙ্ক কষে সুবল বাগচি মদনপুরে এসেছিল চার মাসের মাথায় তা  ছিচ্ছাতুর । বিনা মেঘে বজ্রপাত । রাতারাতি অন্যত্র বদলির অর্ডার  ।সরকারি কাজ তো আর থামেনা ।থানায় নতুন ওসি দীনেশ তালুকদার ।অদ্ভুত মানুষ । পাগলাটে টাইপের । মাথায় ছিট আছে  ।দুপুররোদে বনবাদাড়ে ঘুর ঘুর করে ।টহল দেয় । অপরাধীদের ধরে এনে থানার মধ্যে পড়তে বসায় । যোগ বিয়োগ শেখায় , রোগ অসুখে ওষুধপত্তর দেয় ।তবু সারা এলাকা আতঙ্কগ্রস্ত । চুরিচামারি খতম হওয়ার উপক্রম । দমবন্ধ অবস্থা ।রতনদের যে গ্রুপটা ওয়াগন ব্রেকারীতে হাত পাকাচ্ছিল তারা পড়ল ফাঁপরে । কেমন যেন মিইয়ে গেল সবাই । ফতুয়াদার মাথায় হাত- ভাই রতন পাততাড়ি গুটাও , চুরির রাবণরাজ আর নাই রে , সব লাটে উইঠল । জগুয়া বরাবরের ভীতু, বলল – কি হবেক  ফতুয়াদা । ইবরে কি বইপত্তর লিয়ে ইস্কুল যাব ?
কভি নেহি, ম্যায় হুঁ না ।
কনহ রাস্তা পাইল্যে। 

কদিন লুকাই থাক। তারপর জয় রাবন বলে আবার সগগের সিঁড়ি বানাবো ।
রতন বুঝতে পারে এসব প্রবোধ মাত্র। এতদিনের মান সম্মান সব ধুলায় গেল। পেটে কুলুপ । চুপ করে  বসে  থাকলে সাত সাতটা প্রানি অনাহারে মরবে ।চোখে জল এল রতনের  ।কানকাটা ফতুয়াদার মত বিপ্লবী চোরও ভয়ে কিসমিস । শেষবারের মত এক নতুন রাস্তা খুঁজে বের করার কউসিস করছিল রতন ।প্ল্যান টা তখনই তার মাথায় এল ।

চল একদিন সারের সঙ্গে ভেট করি ।যাইয়্যে বলি চুরি ছাইড়্যে দিতে পারি সার , যদি হামদের প্যাটের ভাতের কনহ বেবস্থা হয় । দুসরা কনহ জীবিকা। এতগুলা ছিলাপিলা লিয়ে কুথাকে যাব কি কইরব বইলে দেন আইজ্ঞা ।  লতুন বড়হ বাবু কনহ বন্দবস্ত কইরত্যে লাইরবেক , তখন বইলবেক  বাপধন যা করছিলিস করগা । ব্যাস খেল খতম ।
কথাটা লুফে নিল ফতুয়াদা - দা আইডিয়া, চোর না হইল্যে তুই শালা পধানমন্তিরি হতিস । 

                    এসব কাজে দেরি করার কোনও মানে হয়না ।সেই অনুযায়ী শুক্রবার বিকেল চারটায় মুখরিত হয়ে ওঠে মদনপুরের আকাশ বাতাশ, পুয়াপুর মোড় ।“ দুনিয়ার চোর জোট বান্দহ , চুরি হামরা ছাইড়তে চাই যদি  দুসরা জীবিকা পাই ‘’ এইসব শ্লোগানে মুখরিত চারপাশ ।মদনপুর এর আগে এমন দৃশ্য দেখেনি । সব ভাবনা এক সময় পরবের আকার নেয় । 

            থানার সামনে বিশাল সমাবেশ দেখে একসময় বেরিয়ে আসে দীনেশ তালুকদার ।পিলে চমকে যায় তার মতন ঝানু ওসিরও ।দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে – কি ব্যাপার ?
আমরা আপনার সংগে দেখা কইত্তে চাই ।
ঠিক আছে , একজন ।
বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হয় রতনকেই । দাবি দাওয়া লেখা কাগজ টা দারোগা বাবুর হাতে দিয়ে  নিজেকে খানিক হাল্কা অনুভব করে রতন । তালুকদার সাহেব পড়তে থাকে কাগজটা

মাননীয় ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক
মদনপুর থানা  
  
আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে জীবিকাটির সাথে যুক্ত আজ তা আপনার আবির্ভাবে এক উজ্জ্বল প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে । আগামী দিনে বিপন্ন মানুষ এই রাস্তায় হাঁটবে কিনা তা নিয়েও সংশয় , ভয় । যেহেতু আমরা আর কোনও কারগরি বিদ্যা অর্জন করিনি তাই বর্তমানে অনাহারে  বা অর্ধাহারে দিনযাপন করতে হচ্ছে এই বিধ্বস্ত পরিবারগুলিকে ।পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই ।আপনি অবগত আছেন – বিপুল ঐশ্বর্যময় এই ঈশ্বরের দুনিয়ায় উপোষ করে মৃত্যু বরণ এক নারকীয় অপরাধ এবং করুণার অযোগ্য । আপনার হৃদয়হীনতার কারনে আমাদের চুরিশিল্প সংকটের সামনে দাড়িয়ে। বিলুপ্তপ্রায় এই কুটীরশিল্পটিকে আঁকড়ে এখনও যারা প্রাণপণ অক্সিজেন  নেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের দুর্দিন আসন্ন ।অপরাধ দমনে আপনার প্রয়াসকে আমরা সাধুবাদ  জানালেও আমাদের সাম্প্রতিক দুরবস্থার জন্য আপনার ভুমিকাকে অস্বীকার করা যাবেনা । এরপর যে মৃত্যুর মিছিল শুরু হবে  সেই মরন উপত্যকা রচনার জন্য ইতিহাস কি আপনাকে ক্ষমা করবে ? সংবিধানের কত নম্বর ধারায় আছে জানিনা  কিন্তু সেই ধারা অনুসারে মানুষের বিকল্প জীবিকার ব্যাবস্থা না করে  তার পেশায় হস্তক্ষেপ  তার পেটে লাথি মারা এক ন্যাক্কারজনক কর্ম ।আমরা মানবাধিকার কমিশনে বা তস্কর উন্নয়ন মঞ্চে যেতে পারতাম .।যাইনি  .। আগে বিষয়টি  আপনাকে জানানো জরুরী তাই । আমরা জানি আপনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে এই সমস্যাগুলি বিবেবনা করবেন । দাবীগুলি নিম্নরূপ

১ সমস্ত তস্কর শিল্পিদের বিকল্প জীবিকার বন্দোবস্ত করতে হবে
২ বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না হলে মাসান্তে চোরভাতা মঞ্জুর করতে হবে।
৩ দীর্ঘদিন এই পেশায় যুক্ত থেকে যারা আজ বৃদ্ধ , অথর্ব ... তাদের অবদানের কথা স্মরনে রেখে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
৪ এই দাবিগুলি পূরণ না হলে আমাদের কর্মসূচী বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে  যাবে , আমরন চলবে ।
                            
                             সারা ভারত তস্কর শিল্পী সংসদ
                               মদনপুর শাখা ।

তালুকদার সাহেব মন দিয়ে কাগজটি পড়তে থাকে । একবার  দুবার  তিনবার । পড়া শেষ হলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় – কার লেখা ?
রতন বলে – সার ।আমার ।
নিজে লিখেছ ?
আজ্ঞে ।
চুরি ছেড়ে দাও ।
খাব কি হুজুর ?
এই প্রতিভা নিয়ে তুমি ছিচকে চুরি কর , এ আমার লজ্জা । দেশের লজ্জা ।
তবে কি কইরব সার ।
রাজনীতি কর ।চুরি করার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম । পুকুর চুরি দেশ চুরি কত কি করতে পারবে । তোমার হাই অ্যাম্বিশান নেই ?
আছে ।

তাহলে অইসব চুনোপুঁটি ভাবনা ছেড়ে বড় কিছু ভাব । রাজনীতিতে এখন তোমাদেরই রমরমা । যাও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে দিলাম , কেমন ?

অতপর রত্নাকর জয়রাম বলে
রাজনীতি আঙিনাতে আইল সদলে ।
দিন রাত কাটে তার হায়ার স্ট্যাটাসে
কৃপা প্রার্থী ভিড় করে তার চারপাশে ।
রত্নাকর নামে তাকে ডাকে না তো কেহ
উইঢিবি ভেঙে উঠে অন্য কোন দেহ ।
মহামুনি বাল্মীকির ফুরালো আখ্যান
হরিদাস পাল কহে শুন পুণ্যবান ।

(এই লেখকের আর একটি সুখপাঠ্য গল্প পড়ুন এই লিঙ্ক'এ http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_89.html)