গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

সকাল রয়

কেউ কেউ হারিয়ে যায় নাগরিক কোলাহলে

সে রাতে পূর্নিমা ছিল না, বাতাসের গান ছিল না। শুধু নিরবতা রাতকে নিয়ে ডুবে ছিল কল্পনার অদৃশ্য সমুদ্রে। সেই অদৃশ্য সমুদ্রের সমস্ত দুঃখ গায়ে মেখে ছাদ থেকে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগ পর্যন্ত রুপু ভাবছিলো, ‘মরে গেলে মানুষের সাথে সম্পর্ক থাকেনা তবুও মৃত সম্পর্কের ইতিহাস কেউ চাইলেও সহজে মুছে ফেলতে পারেনা। যে ভালোবাসার মায়াজাল থেকে নিজেকে ফেরানো সম্ভব নয় সে ভালোবাসার মানুষ যখন আর কারও হয়ে যায় তখন কারো কারো কাছে মহাপ্রয়াণ হয় সমাধান। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে অনেক সম্ভব কিছু অসম্ভব হয়ে উঠে আর তখন কেউ কেউ ইচ্ছে করে নিজের মুখোশ খুলে দেখিয়ে দেয় তার আসল রুপ।
অভিরূপের সাথে রুপুর প্রেমের সম্পর্ক তিন বছরে পরলো। চাকুরীতে পদার্পন করার শুরুতেই প্রেমটা জমে উঠেছিল জল নূপুরের মতো। তারপর আর দশটা প্রেমের মতো পার্ক, গঙ্গা, রেস্তোরাঁ সব পেরিয়ে শুভ পরিণয়ের দিকে যখন ধাবমান ঠিক তখনি অনাকাঙ্খিত একটা ঘটনায় দুজনার দুমুখী আস্ফালনের সূচনা। ওদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে কখনো কথা উঠেনি। অভিরুপ প্রেমের চুড়ান্ত রুপ দেবার ব্যাপারে সিরিয়াস না হলেও রুপু বিশ্বাসের জলটা এতবেশি খেয়ে নিয়েছিল যে সেটার ঘোর কেটে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পরিচিতদের মাঝেও বিয়েতে পাত্রীকে দেখার একটা আনুষ্ঠানিকতা থাকে। রুপু সেভাবেই সেদিন সেজেছিল। অভিরুপের মা-বাবা সহ বেশ কজন আত্বীয় স্বজন আসবে। ওদের বসার ঘরেই সবাই বসেছিল। অভিরূপের মা অবশ্য এ বিয়েতে রাজী নয় কিন্তু এতদিন ধরে ছেলের সম্পর্কের কথা সব আত্মীয়-স্বজন বলাবলি করে আসছে এখন কোন কারণ ছাড়া ভন্ডুল করে দিলে লোকের কথা বলবার একটা ইস্যু হবে। পরিচয় পর্বের পর হাতে আংটি নেবার জন্য রুপু হাত পেতে ছিল।। রুপুদের হয়ে যারা আয়োজন করেছে তাদের অপেক্ষা ক্রমশই ঘর ভর্তি হয়ে যাচ্ছিল। অভিরুপের বাবা রুপুর হাতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন! হাতের মধ্যমায় একটা রুবীর আংটি দেখতে পেয়ে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে রইলেন।
রুপু ভাবছিল ওর হাতটা ধরে নিয়ে অভিরূপের বাবা কিসের কোন দ্বিধা ধন্দে পড়ে গেলেন? ‘ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল। রুবী পাথর খচিত আংটিখানা অনেকক্ষণ ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, -এই আংটি কোথায় পেলে? রুপু কিছু বলবার আগেই ওর মা বললেন, রুপুর বাবা অনেক আগে এনে দিয়েছিল। ঘরের সবার দৃষ্টি তখন আংটিকে ঘিরে। হঠাৎ যেন পিন-পতন নিরবতা ভর করলো ঘরময়। রুবী পাথরের এই আংটি বেশ কবছর আগে, যখন রুপুর বাবা বেঁচে ছিলেন তখন এনে রেখেছিলেন ওদের পুরোনো আলমিরার একটা বাক্সে। এতদিন সেখানেই ছিল আজ পুরোনো কাপড় সরাতে গিয়ে দেখা মিলল তার। রুপুর মা ভাবলেন, পড়ে থাকা আংটি রুপুর হাতে থাকলে ক্ষতি কি। রুপুও খুশি হয়েছিল আংটি হাতে পেয়ে তবে ওরা কিন্তু আচ করতে পারেনি উজ্জল পাথরের এই আংটিটা আসলে রুবীর আংটি।
সে বিকালে বিয়ের আংটি আর পড়ানো হলোনা। অভিরুপের বাবা বললেন রুবী পাথরের আংটি তাদের অফিসের ড্রয়ার থেকে বেশ কবছর আগে চুরি গেছিল। রুপুর বাবা ছিল তখন ওই অফিসের ম্যানেজার। খোয়া যাওয়া আংটির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। আজ স্বচক্ষে দেখে পুরোনো ব্যাথাটা জেগে উঠেছে। আর যাই হোক চোরের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হতে পারেনা
পরদিন এক দুপুর কেঁদেও অভিরূপকে বোঝাতে ব্যার্থ হলো রুপু। তার বাবা চোর যে হতে পারে নাএটা অবিশ্বাস্য। তাছাড়া ওই আংটি চুরির কথা এতকাল তো কেউ জানতো না। এতদিন পর কেন প্রসঙ্গ আসলো?
অভিরুপ শুধু বলেছিল ওই আংটির পেছনে পিঠে একটা চিহ্ন রয়েছে, যা ওর বাবা জানতো। রুপুর বাবা বেচেঁ থাকলে হয়তো সত্যিটা জানা যেত। কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব নয়। উপায়হীন হয়ে গেলো রুপু আর ওর মা। অভিরূপের এ বিয়ে না হলে হয়তো কিছু হবেনা। কিন্তু রুপু? সে-যে প্রেমের পাগল পাড়ায় সব কিছু খুইয়েছে। তার কি হবে?
এতদিনকার ভালবাসা সামান্য আংটিকে কেন্দ্র করে শেষ হয়ে যাবে। সত্যিই কি রুপুকে ভালোবাসতে অভিরুপ? নাকি ফুলের গায়ে প্রজাপ্রতি হয়ে পরশ বুলিয়ে একদিন ফুলটাকেই দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে যাবার আশায় ছিল। জীবন থেমে থাকেনা তবে রুপু এতটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যের সব রঙ কেই অসহ্য লাগতে শুরু করলো।
আত্মার মরন হয়না, দেহ পাল্টে হয়তো হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় কিন্তু প্রত্যেকটা ব্যাক্তি প্রেমের মরন হয়। প্রেম একবারই হয় দ্বিতীয় বার হলে সেটা হয় অভিনয়। অভিরুপকে ছাড়া রুপুর জীবন পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। দিন যাচ্ছিল এভাবেই একসময় অভিরূপ তার মুখোশ খুলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নির্দ্বিধায় বলে যায় কোন চোরের মেয়েকে ঘরে তোলা সম্ভব নয়। ব্যাপার সামান্য হলেও সুযোগটা মস্ত বড়ই মনে হয় অভিরুপের কাছে। সে যা চেয়েছিল তা পেয়ে গেছে অনেক আগেই। অভিরুপের মা সেদিন-ই এই বিষয়টা নিয়ে দারুণ রকমের বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। মনে মনে শঙ্কিত হলেও মুখে প্রকাশ করেন নি।তিনিও আত্মীয়-স্বজনদের বলে বেড়ালেন আর যাই হোক চোরের মেয়েকে আমরা নিশ্চয়ই ঘরের বউ করতে পারিনা
রুপুর মৃতদেহ নিয়ে যখন আনটোল্ড স্টোরি বে্রিয়েছে পত্রিকায়। চারপাশে যখন গুঞ্জন আহা! মেয়েটা খুব ভালো ছিল। তখনো চাপা পড়ে আছে সেই আংটির সত্যি খবরটা। জীবনের পথে অনেক কিছুই অপ্রকাশিত থেকে যায়। সামান্য কিছুর জন্যই হয়তো কেউ কেউ নিজেকে নিয়ে ঝাঁপ দেয় অন্তিম অদৃশ্য সমুদ্রের মাঝে। সপ্তা পেরুতেই থেমে যায় সব। মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। মুল কাহিনী চাপা পড়ে যায় নগর যাত্রার জাঁতাকলে এবং কেউ জানতে পারেনা অভিরূপের মা কোন একদিন ওই আংটি লুকিয়ে রুপুর বাবাকে উপহার দিয়েছিল ভালোবেসে।