মিয়া বাড়ির মসজিদে ফজরের আযান
ধ্বনিত হলে নিশিতে নিদ্রিত মানুষগুলোর নিদ্রা ভাঙে । রাতের গায়ে জোছনা শোভিত
অন্ধকার তখন আরেকটি নতুন প্রভাতের ডাক শুনে দিনের আলোয় মুখ লোকায় । গেরস্ত বাড়ির
মোরগটাও নিদ্রা ভাঙার গান জুড়ে এ সময় । শব্দ শুনে ঘুম কাতর শিশুগুলোকে মায়েরা
ঠেলা দিয়ে তুলে দেয় । আধো ঘুমে ঢল ঢল শিশুগুলো বাইরে এসে ছাইয়ের গাঁদি থেকে পুড়া
কাঠের কয়লা তুলে মাজন করতে করতে পুকুরের দিকে চলে যায় । একসময় প্রভাত কাকলীর মধ্যে
আগমন ঘটে দিনের সূর্যটার ।
গ্রামের নাম চৌহালি । তার জন্মের ইতিহাস
কালগর্ভে বিলীন । ওর বুক জুড়ে বহমান কালী নদীর স্রোত প্রবাহ এ গ্রামকে
হিন্দু-মুসলমান পাড়ায় বিভাজিত করেছে । নদী নারী পুরুষের মিলনস্থল । স্থান,কাল নির্বিশেষে
একই নদীর স্রোত জলে স্নান করে শুদ্ধ হয় সবাই ।এ গাঁয়ে মুসলমান পাড়ার উত্তরে
মিয়াদের বাস । অপেক্ষাকৃত জনবহুল এ জায়গাটা গাঁয়ে টুগিপাড়া নামে পরিচিত । এখানে
ভূমিহীন ঐ মানুষগুলো বসবাস করে নিম্নবিত্তের দৃষ্টিতেও যারা ছোটলোক । ছোটলোকদের
থাকার জায়গাও সামান্য । ঘরগুলো একটার সাথে আরেকটা লাগানো ।
বুড়ো বাহারুদ্দিন মিয়াবাড়িতে
বয়োজ্যেষ্ঠ । সংসারে স্ত্রী ছাড়াও
একমাত্র মেয়ে আছে তার । নাম জরি । কয়েক বছর আগে উজানতলীর হাসেমের সাথে বিয়ে হয়েছিল ওর । সংসার
টিকেনি সেখানে । স্বামী তালাক দিলে এখন বাপের বাড়ি এসে থাকে সে । বাহারুদ্দিনের
ঘরের সাথে লাগানো ছোট ছাপরা ঘরগুলো আহালু,আরজ আর মধুর ।
চৈত্রের আকালে মধু ভাঙ্গুরা বাজারে
বড়কর্তার আরতে কাজ করে । সাথে হিন্দু পাড়ার ভোদড়ও । কাজ শেষে একই পথে বাড়ি ফিরে
ওরা । রাতে মধু যখন বাড়ি ফিরে মিয়া বাড়ির ঘরগুলোতে পিদিমের শেষ আলোটা নিবুনিবু করে
তখন। ভেতরে ডুকে ম্যাচের
কাঠি জ্বালালে জরির রেখে যাওয়া কিছু একটা চোখে পড়ে তার । আনন্দে চোখগুলো জ্বলজ্বল
করে তখন । খেতে বসলে জরির কণ্ঠ শুনা যায় ।
-মধু ভাই আইলা ?
-হ,ঘুমাস নাই অহনো ?
-চইত মাসের গরমে পুইড়ে মরি ।
-হাচানি ? গতরে সার পাইনে
আইজ, জার করে কেবল ।
-কি কও,জরনি আহে দেহি ?
তারপর মধুর কপালে হাত দিয়ে শিউরে
উঠে জরি । কখন যেন জ্বর এসেছে ওর । পরক্ষনে রসুন সমেত তেল গরম করে এনে দেয় তাকে ।
রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবনায় পড়ে মধু । ভাবনার জগতে সমস্ত জায়গা জুড়ে বিচরণ করে জরি ।
শেষরাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে ওর ।সকালে বাইরে এসে জরিকে খুঁজে সে । দেখা পায়না
কোথাও । আহালুর মেয়ে বুচি জানায় ভোরে মামার বাড়ি গেছে সে, আসবে
ভরসন্ধ্যায় ।
মুসলমানপাড়ার খড়িমণ্ডল সচ্ছল
গেরস্ত । ঘরে জোড়া বউ তার,
সন্তান নেই । এ পাড়ায় সালিশ করে বেড়ায় সে । বাহারি পণ্যের ব্যবসা আছে বাজারে ।
একই পাড়ার শুলাই মণ্ডলের খাস লোক । মণ্ডলের ব্যবসা দেখাশুনা করে সে । বিকেলে ভাঙ্গুরা বাজারে নিজের
আরতে বসলে লাভের টাকাগুলো শুলাই তুলে দেয় তার হাতে । সন্ধ্যায় ফেরার আগে এক অচেনা রমণীকে দেখলে খড়িমণ্ডলের চোখ আটকে
থাকে সেদিকে । মাঝে মাঝে ডানে বামে তাকায় মেয়েটি । সন্ধানী চক্ষুযুগল পরিচিত কাউকে
খুঁজে ফিরে হয়তো । ব্যর্থ হলে আবার স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে সে । ফেরার পথে
খড়িমণ্ডল নিজের নৌকায় তুলে নেয় তাকে । মণ্ডল বলে,
-কাগো বাড়ির বেটিগো মাইয়া ?
-টুগি পাড়া মিয়া বাড়ি ।
-গেছিলা কই ?
-ধানশাইল মামুগো বাড়ি ।
-একলানি গেচিলা,মাইয়া লোকের ডর
নাই ?
মণ্ডলের কথার জবাব দেয়না জরি । ও
কথা না বললে মণ্ডলও চুপ হয়ে যায় একসময় । পরক্ষনে নৌকার পাটাতনের উপর একজোড়া সাদা
পা দৃষ্টিগোচর হলে চক্ষু পড়ে থাকে সেদিকে । সে পা সহসা চোখের আড়াল হয়না,জরির প্রস্থানেও
।
কর্তার আরতে কাজ না থাকলে বাড়িতে
অলস সময় কাটায় মধু । ও বাড়ি থাকলে ট্রাঙ্কে রাখা আসমানিরঙা শাড়িটা পড়ে জরি, মাথায় জবজবে
তেল দেয় । তারপর ওর সামনে পায়চারী করে অনেকবার । মধু নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে হুঁকা
টানে । মাঝেমাঝে আড়চোখে জরিকে দেখে সে । এরমধ্যে একদিন কালবৈশাখী ঝড় হয় গ্রামে ।
টুগি পাড়ায় আহালুর ঘর পড়ে যায় ঝড়ে । সে উছিলায় একদিন মিয়া বাড়িতে আগমন ঘটে
খড়িমণ্ডলের । মণ্ডল এলে বাহারুদ্দিনের ঘরের দাওয়ায় বসতে দেওয়া হয় তাকে । মনে মনে
জরিকে খুঁজে সে । দৃষ্টিগোচর হলে পুলকিত হয় মণ্ডল । যাওয়ার সময় বলে যায়-
-আহালু একবার আইয়ো আমার বাড়ি, কিছু টেহা
দিমুনি । ঘরখান তুলো শিগগির ।
রাতে বাড়ি ফিরে ভাবনায় পড়ে মণ্ডল ।
নৌকার পাটাতনে দেখা একজোড়া সাদা পা আর বাহারুদ্দিনের বাড়ির দহলিজে দেখা একটা মেয়ে
মানুষের মুখশ্রী ভেতরে জ্বালা ধরায় তার । মনে মনে ঘরে তৃতীয় স্ত্রী আনার পাঁয়তারা করে সে । হ্যাঁ, আরেকটা নিকা
করবে খড়িমণ্ডল । নিকা করবে নৌকার পাটাতনে দেখা সেই সাদা পায়ের রমনিকেই ।
এরপর মাঝেমাঝেই শুলাইকে মিয়া বাড়ির
আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় । জরিকে খুঁজে সে । দৃষ্টিগোচর হলে খড়িমণ্ডলের
দেওয়া জিনিসগুলো তুলে দেয় ওর হাতে । জরি নিতে না চাইলে শুলাই বলে-
-ডরাও ক্যান, আমিনা তোমার
কাহা অই ?
বৈশাখ মাসের শেষের দিকে ব্যস্ততা
বাড়ে ছেলেদের । ব্যস্ত হয় মেয়েরাও । সামনে আগত বর্ষাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান
পাড়ার ঘরে ঘরে জাল তৈরির সরঞ্জাম শোভা পায় । বড় ঘরের দাওয়ায় বসে দিনমান জাল বুননের
কাজ করে সবাই । আরজের ছেলে হুলু বাজার থেকে সুতা আর বঁড়শি কিনে এনে মধুর জন্য
অপেক্ষা করে । মধুর কাছে মাছ ধরার ছিপ বানিয়ে নিবে
সে । কিন্তু সহসা সময় হয়না মধুর । ও এখন হিন্দু পাড়ায় নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত ।
ভোদড় কে সাথে নিয়ে আগামী বর্ষাটা বড়কর্তার নৌকায় কাটানোর ইচ্ছে তার ।এর মধ্যে
একদিন রাতে বাড়ি ফিরলে দেখা
হয় জরির সাথে । জরি বলে-
-হারাদিন কই থাহ মধু ভাই, দেহিনা যে ?
-কর্তার নাওয়ে কাম নিছি,বানের মসুম
নাওয়ে থাকুম ।
-হলু হুতা,বশি কিননে আনছে
। হেরে বশি বানায় দিও একখান ।
আরজের বউ জুলেখা মারা গেছে একবছর
হতে চলল । মরার সময় কলেরা হয়েছিল
ওর । স্ত্রী শোকে এখনো বিয়ে
করেনি আরজ । মা মরা হুলু সারাদিন পোষা কুকুরের ন্যায় এ বাড়ি ও বাড়ি আনাগোনা করে । ওর দিকে দৃষ্টি গেলে
ভেতরটা হাহাকার করে আরজ আলীর । মেয়ে মানুষহীন সংসার হয়না । যে ব্যাঘ্র একবার
মাংসের সন্ধান পায়, পরমুহূর্তে লোভ সংবরণ করতে পারেনা সে । আজকাল একাকি বিছানায় শুয়ে মেয়ে
মানুষের অভাববোধ করে আরজ । নারী সত্ত্বার যে স্বাদ পেয়েছে সে, তার লোভ সামলানোর সাধ্য কই ? এখন ঘরে বউ দরকার ।
এরই মধ্যে হঠাৎ শুলাইয়ের সাথে কলহ
হয় মধুর । একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে জরিকে হেসে কথা বলতে দেখে সে । শুধু কথা বললে হয়তো কলহ
করতনা মধু । শুলাইয়ের দেওয়া জিনিসগুলো যখন জরি নিল তখনই রেগে গেল সে । পরক্ষনে
শুলাইকে একটা ঘুষি মেরেছে মধু । তারপর চিৎকার করেছে ওর সাথে-
-হারামিরপুলা ইনু কি ?
-আমি আইছিনি, তোমার বইন আইতে
কয়যে ?তারপর যাওয়ার সময় শাসিয়ে যায় শুলাই । “ ছাড়ুমনা, মণ্ডলরে কয়ে শাস্তা করুম তরে” ।
সেদিন জরির সাথে কথা বলেনা মধু ।
বড়ঘরের দাওয়ায় থ মেরে বসে থাকে অনেকক্ষণ । খড়িমণ্ডলের কথা মনে হলে অজানা আশংকা এসে
ভিড় করে নিজের মধ্যে । মুসলমানপাড়ায় এ মানুষটাকে যমের মত ভয় পায় সবাই । শুলাইকে
মারার খেসারত দিতে হবে নিশ্চয় । শুলাই কি আর যে সে মানুষ । স্বয়ং খড়িমণ্ডলের খাস
লোক সে । এ পাড়ায় সবাই সমীহ করে তাকে ।পরদিন দাওয়ায় বসে থাকলে এগিয়ে আসে জরি, মধুর মান ভাঙানোর চেষ্টা করে সে।
-গোসসা অইছেনি মধু ভাই ? মধু সহসা জবাব
না দিলে জরি আবার বলে-“ শুলাইরে হগল ফিরত দিমু, গোসসা ছাড়ান দেও অহন” ।
এরপর ভাঙ্গুরা বাজারে গেলে ভয়ে ভয়ে
থাকে মধু । সহসা খড়িমণ্ডলের সামনে পড়ার সাহস করেনা সে ।তবুও হঠাৎ একদিন আচমকা ডাক
পড়ে ওর । পরক্ষনে খড়িমণ্ডলের
আরতে গিয়ে বসতে হয় তাকে । মণ্ডল বলে-
-মধু মিয়া যে, ভালা আছ মুনে
কয় ?
-হ, ভালাই । জলদি কয়ে ছাড়ান দেন কাম
আছে মেলা ।
-বহ মিয়া তাড়া কিয়ের ? মনা একখান বিড়ি
দে মধুরে । শুলাইরে মারছ হুনলাম,বিবাদ ছাড়ান দেও । হেতো তোমার কাহা অয় ।
-কাহানি ? আরেকদিন আইলে
ঠ্যাংখান ভাঙে দিমু ।
তারপর আর কথা বাড়ায়না মধু । সোজা
গাঁয়ের পথ ধরে সে । আরতে বসে রাগে ফোঁপায় শুলাই । খড়ি মণ্ডল ধমক দেয়-
-চেতস ক্যান হারামিরপুলা, গোসসানি তর
একলা অয় । ছাড়ুমনা নিজ্জস ।
বর্ষা মওসুমে হিন্দু-মুসলমান পাড়ার
ছেলেরা কাজে ব্যস্ত হয় । কালিনদীর উত্তাল ঢেউয়ের সাথে তখন সম্পর্ক গড়ে ওরা । মধুকে
মালবোঝাই নৌকা নিয়ে যেতে হয় ইছামতী । বর্ডারে পণ্য চোরাচালানের ব্যবসা করে বড়কর্তা
। এদিকে চৌহালি কাজ না পেলে বিপাকে পড়ে
আরজ । নৌকা,জাল কোনকিছুই
নেই তার । হিন্দু পাড়ার যোগেশ ওর নৌকায় কাজ দিতে চেয়েছিল তাকে, গতকাল এসে না করে গেছে সে । অবশেষে উপায় না দেখে গণেশের নৌকায়
দিনমজুরির কাজ নেয় আরজ আলী । একদিন সন্ধ্যায় সওদা করে ফেরার পথে খড়িমণ্ডলের সাথে দেখা হয় তার ।মণ্ডল বলে-
-কার নাওয়ে কাম নিছ আরজ, ভালানি ?
-হিন্দু পাড়ার গনশা । দিনমজুরি জুত
নাইগো ।
-তাইলে আমার নায়ে আহ মিয়া, ভালা মজুরি
দিমু নিজ্জস ।
হিন্দু-মুসলমান পাড়ার দরিদ্র জেলে
সম্প্রদায় বর্ষার এ সময়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন দেখে । চৈত্র মাসের ধরুন
অভাবে জমানো অর্থ খরচ করতে হয় তাদের । আজকের এই দুঃসময়ে খড়িমণ্ডলের প্রস্তাবটা মনে মনে পুলকিত করে আরজকে
। অবশেষে মণ্ডলের নৌকায় কাজ নেয় সে । বর্ষার মওসম শেষ হলে অলস সময় কাটাতে হয় সবাইকে । আশ্বিন মাসে কর্তার আরতে কাজ পাবে মধু । কালিনদীর পশ্চিমে
দ্বীপসদৃশ খানিকটা জায়গা । বহুকাল ধরে চর জাগার পাঁয়তারা চলে সেখানে । নদিতে যখন
থৈ থৈ পানি তখনো ওটা সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে স্বস্থানে । লোকে বলে ভাসান চর । অবসরে
মধু জরিকে নিয়ে ভাসান চরে সময় কাটায় । অস্ফুট আর্তিগুলো দিনমান প্রকাশ করেনা কেউ,মনে মনে নিজেদের
সহচর ভাবে ওরা । এক এক করে দিন যায় । না বলা পিছুটান গভীর থেকে গভীরতর হয় ।
টুগি পাড়ার আরজ আলী বর্ষা মওসুমে
বড়কর্তার নৌকায় কাজ করে মোটা টাকার মালিক হয় । বাড়িতে টিনের দুচালা ঘর উঠে তার । এ
পাড়ার সবাই এখন সমীহ করে তাকে । পলিসটার কাপড়ের একটা শার্ট আর সাদা লুঙ্গিটা পড়ে
বাইরে বেড় হলে সালাম দেয় কেউ কেউ । এগুলো ভাল লাগে আরজের । পাড়ায় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ভাবে সে । ভাববেইতো খড়িমণ্ডলের খাস লোক যে । এ সম্মান টুগি পাড়ায় একমাত্র তারই । বর্ষা মওসুম শেষ হলে
খড়িমণ্ডলের আরতে আবার কাজ পায় আরজ । বিকেলে মণ্ডল এলে খোশ গল্প করে দুজন । মণ্ডল
বলে-
-এবার একখান নিকা কর আরজ,একলানি থাহুন
যায় ?
খড়িমণ্ডলের কথা শুনে লজ্জা পায় আরজ
আলী । কথার জবাব দেয়না সহসা ।পরক্ষনে বলে-
-নিকানি ? মাইয়া দেহেন
তাইলে মিয়া ভাই ।
-মাইয়া একখান দেহা আছে, মত দেও মিয়া ।
-কেডা, খুললে কন হুনি ?
-বাহারুদ্দিনের বেটি জরি । সুরতখান
দলা দেহি ?
-হাচা । তই কাহা মত দিবনি ?
- নিজ্জস মালুম অয় । চাইলে কতা কই ।
খড়িমণ্ডলের কথায় মত দেয় আরজ । জরি
মেয়ে ভাল,দেখতেও বেশ । মেয়ে মানুষহীন সংসারে আরজের স্ত্রীর পাশাপাশি হুলুর জন্য
একজন মা দরকার । অপরিচিত মেয়ে মানুষের মা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু ? জরি থাকলে সে সন্দেহ নেই । এরপর হঠাৎ নিজের মধ্যে কামনা তৈরি হয় আরজের । বাড়ি ফিরে জরিকে নিয়ে
ভাবে সে । অথচ জরির প্রতি এ
ভাললাগা কয়েকদিন আগেও ছিলনা তার । খড়িমণ্ডলের বলা আচমকা কথাটা যেন প্রেমিক বানিয়ে
দেয় তাকে । চোখের সামনে আনাগোনা করলে আড়চোখে জরিকে দেখে সে । বাড়ন্ত শরীরের
প্রতিটি ভাজেভাজে উত্তাল যৌবন খেলা করে ওর । দেখলে জ্বালা করে চোখে ।
অবশেষে একদিন খড়িমণ্ডল স্বয়ং নিকার
প্রস্তাব নিয়ে যায় বাহারুদ্দিনের কাছে । বাহারুদ্দিন আপত্তি করেনা তাতে । অভাবের
সংসারে যেখানে দুমুঠো ভাত জোগার করার সামর্থ্য নেই তার , সেখানে আরজ সচ্ছল গেরস্ত । প্রস্তাব মন্দ
নয় । সুখী হবে জরি ।বিয়ে আগামী মাঘ মাসে হোক তাহলে । সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে বুচির মুখে সব শুনে মধু । জরিকে দেখা যায়না কোথাও ।
পরদিন ধলপ্রহরে আচমকা মধুর ঘরে এসে হাজির হয় সে । জরি বলে-
-হুনছনি হগল ?তাৎক্ষণিক জবাব
দেয়না মধু । ও জবাব না দিলে রেগে যায় জরি । তারপর আবার বলে-“ চুপ মাইরে আছ যে, বোবা অইছ মুনে কয়” ।
মধুর মধ্যে অস্ফুট আর্তনাদ তৈরি হয়
তখন । মনে মনে জরির জন্য ভালবাসা উথলে উঠে তার কিন্তু সত্যি বলার সাহস পায়না সে । সত্যি বলে লাভ কি, যন্ত্রণা ছাড়া ?
মধু খুব ভাল করে জানে যেখানে খড়িমণ্ডল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে,
সেখানে ওর কথা শুনবেনা বাহারুদ্দিন । বিয়ে জরির ঠিকই হবে । বিয়ে
হবে আরজের সাথেই । পরক্ষনে মধু বলে দেয়-
-আমার কিছু কওনের নাই, হুলুর মা অ তুই
।
মধুর কথা মনে ধরেনা জরির । কাল
চোখে দুঃখের ফোয়ারা বয় তার । সেও বলে দেয় –
-দিলে ঘা দিলা মধু ভাই । ভুলুমনা
তোমারে নিজ্জস ।
অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কালিনদীর পানি
শুকায় । স্রোতস্বিনী নদী তখন কৃপণ হয় । ঢেউ থাকেনা কোথাও,দু একটা মাছ
ধরার ডিঙ্গি নৌকা চোখে পড়ে শুধু । সওদাগরের নাও ভাসেনা আর । নদীর উপর জেগে থাকা
ভাসানচর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় দিনে দিনে । চর দখলকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষ
বিভক্ত হয় । লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে বড়কর্তা আর খড়িমণ্ডল দুজনই । লাঠি চালনায়
বিশেষ দক্ষতা থাকায় হিন্দু পাড়ার দায়িত্ব নিতে হয় মধুকে । এ নিয়ে একদিন আরজের সাথে
বেশ কলহ হয় তার । আরজ বলে-
-লাঠি চালন ছাড়ান দে মধু । চরের
দহল মণ্ডলরে দিমু । আরজের কথায় রাজি হয়না মধু । সেও বলে দেয়-
-জান দিমু, চর দিমুনা
মণ্ডলরে ।
এরপর একদিন টুগি পাড়ায় শোকের মাতম
উঠে ঘরে ঘরে । মাতম উঠে মিয়া বাড়িতেও । বুড়ি হবিরন বিবি অভিসম্পাত করে মধুকে – দিলে সবুর নাই
হারামির, ভাইডারেই খাইল আইজ ।
চরদখলকে কেন্দ্র করে কর্তাবাহিনী
আর মণ্ডলবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয় চৌহালিতে । ক্ষুদ্র ভাসানচর রঞ্জিত হয় মানুষের রক্তে । আরজ আলী চর দখলে বাঁধা
দিলে মধুর সাথে কলহ হয় তার ।
ক্ষুব্ধ মধু নিজের কাছে থাকা ধারাল কোঁচটা ছুড়ে দিলে ওটা গিয়ে পীঠে বিঁধে ওর ।
পরক্ষনে খুন খুন রব উঠে উপস্থিত সবার মুখে মুখে । মধু মিয়া খুন করেছে ওর ভাইকে ।
তারপর জেলে পড়ার ভয়ে গ্রামটা পুরুষশূন্য হয়ে যায় চোখের পলকে । হিন্দু পাড়ার ভোদড়
পালানোর সময় মধুকে সাথে নিতে চাই তার । সে বলে-
-মধু বইনের বাড়ি পলামু, ল যাই ।
অকস্মাৎ কথা বলেনা মধু । স্বস্থানে
থ মেরে বসে থাকে সে । তারপর বলে দেয়-
-যামুনা, ছাড়ান দে আইজ ।
ভাসানচর সংঘর্ষ মামলায় জেল হয় মধুর
। খড়িমণ্ডল ভূমি অফিসের লোকদের হাত করে চরের অধিকার নেয় । পরিস্থিতি শান্ত হলে
আবার সবাই ফিরে আসে চৌহালি । ভাসানচরে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস শুনা যায় । ওরা মধুর
কথা জানেনা । মধু এ পাড়ায় অতীত এখন । গ্রামে ফিরে ভোদড় দু একবার মধুর খোঁজ নিয়েছিল । তারপর আর খোঁজরাখা হয়নি
ওর ।
এরপর হঠাৎ একদিন খড়িমণ্ডলের ঘরে
নবজাতকের ক্রন্দন শুনা যায় । খুশিতে জোড়া বলদ জবাই করে চৌহালি ভোগ দেয় সে । টুগি
পাড়ার মেয়েরা বলাবলি করে-
-হুনছনি, মণ্ডলের ঘরে
পুলা আইছে । পুলার দেহি চাঁদরূপ ।
-কার কুলে অইলোগো বুচির মা ?
-আমাগো জরির ।
জরি এখন সংসার করছে খড়িমণ্ডলের ঘরে
। মধুর খোঁজ আর সবার মত তারও অজানা ।