সোনাতলা গ্রামের রমিজা এখন ঘোমটা পরা পল্লীবধূ । ওকে প্রথম দেখে শতরূপী
সূর্য মনে হয়েছিল আমার । সকালে সূর্য দেখেছ কেউ ? ও যখন ভূমিষ্ঠ হয় তাকালে রক্তাক্ত
আভা দেখা যায় । ভেতরে তার আগ্নেয়গিরি আর তপ্ত লাভা । যে পুড়ে সে অঙ্গার হয়।
আবার মরণকালে লালরঙা শাড়ি পড়ে সে । রমিজারা সূর্যের ন্যায় । ওদের চোখে তাকিয়ে দেখ
সূর্যের সমস্ত রূপ সেখানে বিদ্যমান ।
আটপাড়া গ্রামের দিলু শেখের সাথে
বিয়ে হয়েছে রমিজার । শহরমুখী সড়কটার কোল ঘেষে ওদের বাড়িটা । ভেতরে টিনের দুচালা ঘর
। পর্দা রক্ষার খাতিরে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে চারপাশে । বড় ঘরের মেঝেতে বসে
দিনমান কাঁথা সেলাই রমিজা । ভেতরে ভেতরে ভালবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে সে ।
দিলু শেখ বাড়ি ফিরলে অজুর পানি এগিয়ে দেয়, খেতে বসলে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে তাকে । দিলু
বলে-
-একখান নলা খাবানি বউ, দেই ?
রমিজা কথা বলেনা সহসা । লজ্জায়
চোখগুলো নিচে নামিয়ে নেয় সে । তারপর ঘোমটাটা আরেকটু লম্বা করে টেনে দেয় মাথার উপর
। দিলু শেখ আবার বলে-
-শরমাও ক্যান, আমি না তোমার
সোয়ামী ? নেও একখান নলা খাও বউ ।
রাতে বিছানায় শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প
করে দুজন । কত কত কথা বলে সময় ধরে । চাঁদটা জ্বলতে জ্বলতে একসময় নিভু নিভু ভাব আসে ওর । দিলু শেখের কথা
ফুরায়না সহসা । কথার পিঠে কথা চড়ে ওরা রূপকথার গল্প তৈরি করে যেন, সে গল্পে না
বলা কত কথা ভাষা পায় !
প্রথম কয়েক বছর রমিজার সংসারটা
এমনই ছিল । তারপর কেমন করে যেন দিলু শেখ বদলে গেল হঠাৎ করেই ।এখন কাজের অজুহাতে
মোরগ ডাকা ভোরে বাড়ি ছাড়ে সে । তারপর আর সারাদিন দেখা পাওয়া যায়না তার । ও যখন
বাড়ি ফিরে জলন্ত প্রদীপটা তখন নিভু নিভু । এসে কথা বলেনা রমিজার সাথে । রমিজা
নিঃসন্তান । পাশের বাড়ির করিম শেখ, এক বছর হল বিয়ে করেছে সে । এর মধ্যেই ঘরে
ফুটফুটে সন্তান তার । ওর বউ নংক বিকেলে ছেলেকে কোলে নিয়ে পাড়া ঘুরে । দেখলে রমিজার
মধ্যেও মাতৃত্ব জেগে ওঠে তখন । বিয়ের পর মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোর মধ্যে
সন্তানের বাসনা থাকে খুব । রমিজার কেবলই মনে হয় দিলু শেখের দুঃখটা হয়তো এ কারণেই ।
সে জন্য মনে মনে নিজেকেই অপরাধী ভাবে সে । রাতে সংসারের কাজ সেরে ও যখন বিছানায় যায় দেখে দিলু শেখ শুয়ে পড়েছে
আগেই । রমিজা এলে পেছন ফিরে শোয় দিলু । সোহাগী রমিজা স্বামীর জন্য উতলা হয় তখন ।
সংকোচ বোধ করলে ভেতরের মানুষটা যেন বিদ্রোহ করে তার সাথে । রমিজা বলে-
-অমন কইরে শুইছেন যে,শরীর নি ভালা
আপনের ?
-ভালাই । ঘুমাও । জালায়ওনা অহন ।
-আপনেরে কেমুন অচেনা ঠেকে আজ
-সুরতনি বদলায়ছে আমার । দিলে ঘা
দিওনা কইলাম ।
কথা বাড়ায়না রমিজা । বাড়ানোর
প্রয়োজনও নেই । ভালবাসাহীন এ সংসারে তার কথা যে ফলহীন এটা সে জনে । পরমুহূর্তে
স্বামীর পাশে শুয়ে বালিশে হেলান দেয় রমিজা । শত সহস্র ভাবনা এলে ভেতরটা আঁকুপাঁকু করে তখন । অন্তরচক্ষু আস্ফালন
করে সময় ধরে । একসময় রাতের নিস্তব্ধতার কাছে নিজেকে সঁপে দেয় সে । সকালে রমিজা ঘুম
থেকে উঠে দেখে দিলু বিছানায় নেই । তারপর আর সারাদিন খোঁজ পাওয়া যায়না তার ।
তাড়াইল গ্রামের টঙ্কু বাবা মারা
গেলে পিতার ব্যবসার উত্তরসুরি হয় । পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের প্রসাধনী ফেরি করে বেড়ায়
সে । এখন তাড়াইল গ্রামে ওর খোঁজ পাওয়া দুষ্কর । সকাল-সন্ধা বাইরে থাকে টঙ্কু ।
বাড়ি ফিরে রাত করে । এখানে ওর বাড়িটা গোমতী নদীর উত্তরে ।খোলা বাড়ি, চারপাশে
দৈন্যতার ছাপ । গোমতী পাড়ে দাঁড়ালে ভেতরটা চোখে পড়ে সহসায় । বাড়ির পেছনে একটা
পুরনো কবর । জংলা হয়ে আছে । ভেতরে একটা গর্ত হয়েছে ওর । গরীব মানুষের কবর পরিচর্যা করেনা কেউ ।
আর কবছর পর হয়তো অস্তিত্ব হারাবে ওটা ।
একই পাড়ার আনাড়ির সাথে মন দেওয়া
নেওয়া করে টঙ্কু । গোমতী পাড়ে পুরনো নৌকা
মেরামতের অপেক্ষায় থাকে । বিকেলে নৌকার গলুইয়ে বসে গল্প করে দুজন । আনাড়ি হাঁক
দেয়-
-রূপসী মাইয়া দেইখা ভুইলনা আমারে ।
-ডরাসনি, ভরসা নাই ?
-আছে নিযজস । তবু মুনে ডর আহে যে ?
-তাইলে বশীকরণ তাবিজ দে আমারে ।
টঙ্কুর কথা মনে ধরে আনাড়ির । তারপর
ঠিকই একদিন টঙ্কুর হাতে বশীকরণ তাবিজ বেঁধে দেয় সে । তখন আনাড়ির কৈশোরিক চপলতাগুলো
মুগ্ধ করে টঙ্কুকে । ভেতরে ভেতরে অস্ফুট ভালবাসা জেগে উঠে তার । রাতে সঙ্গীহীন
বিছানায় শুয়ে ঘরে বউ আনার পাঁয়তারা করে সে । সামনে মাঘ মাস । হ্যা, এবার মাঘের
শীতেই আনাড়িকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে টঙ্কু ।
দিলু শেখ বাড়ি না থাকলে আজকাল
প্রায়ই নংক এসে গল্প করে রমিজার সাথে । দুজনের মধ্যে সখ্যতা হয় দিনে দিনে । নংক
বলে-
-ওবু ভাইজান অহনো গোসসা কয়রে আছেনি
?
-কি জানি ? মানুষটা
বদলায়ছে মেলা ।
-সবুর দেও । পুলার খায়েশ অইছে মুনে
কয় ।
নংকর কথার সহসা জবাব দেয়না রমিজা ।
ভেতরটা তখন হাহাকার করে তার । করিমের ছেলেটা উঠানে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় । ওর দিকে
দৃষ্টি গেলে একাকি আনমনা হয় সে । কিছুক্ষণ পর নংক আবার হাঁক দেয়-
-বুজান পুলারে দেইখো, আমি আহি ।
নংক চলে গেলে রমিজা উঠে আসে দাওয়া
থেকে । শিশুটাকে কোলে তুলে নেয় সে । তারপর নরম হাতে হাত রাখে ওর । এরমধ্যে একদিন
আটপাড়া গ্রামে ফেরি করতে আসে টঙ্কু । দিলু শেখের বাড়ির দহলিজে ফেরিওয়ালার ডাক
শুনলে নংক এসে ভেতরে নিয়ে যায় তাকে । তারপর কাঁচের চুড়ি আর মাথার ফিতা সওদা করে
ওরা । রমিজার দিকে দৃষ্টি গেলে পলকহীন তাকিয়ে থাকে টঙ্কু । আচমকা ওর চাহনি দৃষ্টি
এড়ায়না রমিজার । নিজের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করে তখন । পরক্ষণে ভেতরে চলে যায় সে ।
টঙ্কু চলে গেলে হাঁক দেয় নংক –
-ও বু, আয়ে পড়লা যে ?
-পুলাডার চাওন দেখছনি, গাও জলে ।
- ছাড়ান দেও পুরুষ মানুষ অমনি ।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবনায়
পড়ে টঙ্কু । আটপাড়া গ্রামে দেখে আসা অচেনা রমণীর চক্ষুযুগল ভেতরে জ্বালা ধরায় তার
। তার পুষ্পিত মুখশ্রীতে নিজের সত্তাকে খুঁজে ফিরে সে । এরপর ফেরি করার নাম করে
মাঝেমাঝেই আটপাড়া যায় টঙ্কু । সন্ধানী চোখ দুটো মনে মনে রমিজাকে খোঁজে । কিন্তু সহসা দেখা পায়না
ওর ।
অগ্রহায়ণ মাস- ধান কাঁটার মওসম । এ
সময় নতুন ধান উঠে গেরস্তের গুলায় । ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব করে মেয়েরা । পাড়ায়
পাড়ায় ফেরিওয়ালাদের আনাগুনা বাড়ে । বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাতায়াত করে
ছেলেরা । টঙ্কুও ব্যস্ত হয় সবার সাথে । কদিন থেকে আনাড়ির সাথে দেখা হয়না তার । ও
যখন বাড়ি ফেরে গ্রামের পথে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার । বাঁশবনে ঝি ঝি পোকাদের অবিশ্রাম
আওয়াজ শুনা যায় । ওরা জেগে থাকে রাতের
শেষ অবধি । রাতে ঘরে ফিরে টঙ্কু
আনাড়ির রেখে যাওয়া তরকারি পায় । চপলার কথা মনে হয় তখন । পরদিন আবার ভোরে বাড়ি ছাড়ে সে । সকালে আনাড়ি এসে দেখে
টঙ্কুর ঘরে তালা দেওয়া । রৌদ্রোজ্জল মুখে আমাবস্যার বান ডাকে তখন । বেশ কদিন ধরে
মনে মনে টঙ্কুকে খোঁজে আনাড়ি ।
আজ রমিজার মন খারাপ । রাতে কোন
একটা ব্যাপার নিয়ে দিলুর সাথে কলহ হয়েছে তার । দিলু মেরেছে তাকে । চোখগুলো ফুলে
আছে এখন । যে দেহ ভালবাসার কাঙাল, তাকে ভালবাসা দিয়েই তুষ্ট করতে হয় । মন খারাপ
হলে বড় ঘরের জানালার পাশে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে রমিজা । মেঘাচ্ছন্ন
আকাশে তখন শালিকের আনাগুনা বাড়ে । ওদের দিকে তাকিয়ে রমিজা নিজের মধ্যে লুকায়িত কোন
অস্তিত্বকে খোঁজে বেড়ায় হয়তো, যার কাছে নিজেকে বিসর্জন
দিতে ইচ্ছে করে তার । ভালবাসাপূর্ণ যে দেহে ভাটা পড়েছে এখন, একদিনতো সেখানেই জোয়ার ছিল তার । আবার অস্তিত্বে ঢেউ লাগলে জোয়ার হতে
কতক্ষণ । রমিজা মনগাঙে জোয়ারের অপেক্ষা করে দিনের পর দিন । দিলু শেখ বাড়ি না থাকলে
এরমধ্যে আবার একদিন দহলিজে ফেরিওয়ালার আওয়াজ শুনা যায় । আজ নংক নয়,রমিজা ডেকে ভেতরে বসায় তাকে । তারপর আবার পলকহীন চক্ষুযুগল দৃষ্টিগোচর
হলে প্রশ্ন করে –
-অমন কইরে কি দেহ, রূপ জালাইছে
মুনে কয় ?
-তোমারেই দেহিগো আপনা মুনে অয় যে ।
-কেমুন কতা কও,গাও জলে কইলাম
-জলেনি ? গাওযে আমারো
জ্বলে, বুঝনা ?
টঙ্কু চলে গেলে ভাবনায় পড়ে রমিজা ।
এরপর কিছুদিন অচেনা মানুষটার দেখা পায়না সে । কয়েকদিন বাড়িতে অলস সময় কাটায় টঙ্কু
। বড় ঘরের পেছনের পুরনো কবরটা পরিষ্কার করে । তারপর বাঁশের বেড়া দেয় চারপাশে । এটা নহিলার কবর । টঙ্কুর বড় বোন । নহিলার
কথা মনে আছে কারো ?
আহ! কি স্নেহভরা চাহনি ছিল ওর । মরার আগে জন্ডিস
হয়েছিলো নহিলার, মুখটা কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গিয়েছিল তখন, হলুদ
হলুদ । জন্মের পর মাকে দেখেনি টঙ্কু । ওকে ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে নহিলা । কদিন ধরে ওর কথা মনে হয়
তাই । তখন বন্ধুহীন বন্ধুর
পরিবেশে একটা স্নেহময়ী হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে ।
এখন আটপাড়া গ্রামে গেলেই রমিজার
সাথে দেখা হয় টঙ্কুর । রমিজা ডেকে নিয়ে ভেতরে বসায় তাকে । সুখ-দুঃখের গল্প করে
দুজন । বিকেলে ক্ষুধার্ত টঙ্কু আহার করে বাড়ি ফেরে । এগুলো দৃষ্টি এড়ায়না নংকর ।
টঙ্কু এলে এ বাড়িতে আনাগুনা বাড়ে তার । গতিবিধি লক্ষ্য করে রমিজার । টঙ্কু বলে-
-ভাই জানলে গোসসা অইবোনি ?
রমিজা বলে-ছাড়ান দেও । দিল পাক
থাকলে ডর কিয়ের ?
টঙ্কু চলে গেলে বড়ঘরের মেঝেতে বসে
কাঁথা সেলাই রমিজা । খানিক পরে হাতে একটা বাটি নিয়ে এগিয়ে আসে নংক । তারপর হাঁক
দেয়-
-ছালুননি আছে বুজান ? দিবানি,
ভাত খামু ।
-ছালুননি ? বিয়ানেই শেষ ।
-মিছা কও ক্যান, ফেরিওয়ালা
খাইলো দেখলাম । অত দরদ কিয়ের কওতো ?
-কেমুন কতা কও, মুখ সামাল দিও
কইলাম ।
-মিছানি বুবু ? হাঁচা কইতে দোষ
কি ?
পরক্ষণে এক দুই কথায় কলহ করে ওরা ।
রাতে দিলু শেখ বাড়ি ফিরলে টঙ্কুকে নিয়ে বিভিন্ন আশালীন কথার তুবড়ি ছুটে নংকর মুখে । তারপর দিলু শেখের ঘরে
মেয়ে মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনা যায় । টঙ্কুকে খেতে দেওয়ায় রমিজাকে মারে দিলু শেখ
। দিলু মারলে ডাঙায় তোলা চিতল মাছের মত কাতরায় রমিজা । পাষণ্ডটা ভ্রূক্ষেপ করেনা
সে দিকে । সকালে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে যায় সে । পথিমধ্যে রমিজার সাথে দেখা হয় তার ।
দিলু বলে-
-আজ আর ছাড়িনায় গো । বাঞ্জা মাগীর
বিষ অইছে মুনে কয় ।
সহসা কথা বলেনা নংক । দিলু চলে
গেলে ভেতরে ভেতরে বুনো হাঁসি হাঁসে সে ।
রমিজার পিঠে দিলু শেখের মারের
দাগগুলো কাল হয়ে থাকে । টঙ্কুর দৃষ্টিগোচর হলে শিউরে উঠে সে । তারপর বলে-
-লও যাই ।
-কই ?
-বদরগঞ্জ বড় হুজুরের দরগা, হেরে কইলে সব
ঠিক কইরে দিব নিজ্জস ।
তারপর একদিন টঙ্কুর হাত ধরে বাইরে
পা রাখে রমিজা । উদ্দেশ্য বদরগঞ্জ, বড় হুজুরের দরগাহ । এ ব্যাপারটা দৃষ্টি
এড়ায়না এ পাড়ার কারোরই ।ওরা গেলে এক এক করে কানাকানি করে লোকজন ।
-ও আহালুর মাও,রশিদের বউ,
পেচির নানি খবর হুনছনি ?
-কি কওতো ?
-দিলুর বউনি বাড়ায় গেছে হুনলাম ।
-সব্বনাস, দিলু কই খবর
দেও হেরে ।
দিলুকে খবর দেওয়ার প্রয়োজন হয়না ।
পাড়াপড়শিরা কানাকানি করলে জেনে যায় সে । করিমের বউ নংক সত্য মিথ্যা মিশ্রিত করে
কুৎসা রটনা করে গ্রামে ।
-বারো ভাতারি মাইয়া এমুনি,হুনছনি চাচি
অচিন পুলা তার লগে কি ডলাডলি । সুরত দেখলে পিত্ত জ্বলে ।
আটপাড়া গ্রামের জুলু মাতব্বর ।
মুখে বাদশাহি গোঁফ তার,
লোকে বলে ওসমানী গোঁফ । এ গাঁয়ে সালিশ করে বেড়ায় সে ।
গাঁয়ের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ গুলো জমের মত ভয় পায় তাকে । জুলু
মাতব্বরের কানে খবর পৌঁছলে, এখান থেকে কয়েকজন লোক পাঠায় সে টঙ্কুকে ধরে
আনতে । বদরগঞ্জ বাজারে গিয়ে
খোঁজ পাওয়া যায় ওদের । তারপর আটপাড়া এনে বেঁধে রাখা হয় টঙ্কুকে । গাঁয়ের ছেলেরা সুযোগ
বুঝে প্রহার করে তাকে । কেউ কেউ অশ্লীল ভাষায় গালি দেয় মাঝে মাঝে । পরদিন তাড়াইল
থেকে লোক গেলে সালিশ হয় আটপাড়া গ্রামে । দিলু শেখের মত জিজ্ঞেস করলে বলে দেয়-
-ঐ বউ ঘরে নিমুনা আমি । অবশেষে
জুলু মাতব্বর মীমাংসা দেয় সালিশের ।
-তাইলে রমিজারে টঙ্কুই নিকা করবো, কি কন হগলে ?
-হ, ঠিক কতা ।সমস্বরে সায় দেয় সবাই ।
-নিকা আগামী শুক্কুরবারে অইবো
তাইলে ।
জলু মাতব্বরের কথায় রাজি হয়না
টঙ্কু । ও রাজি না হলে গ্রামের ছেলেরা চড়াও হয় আবার । অবশেষে জুলু মাতব্বরের কথায় ঠিক থাকে । আগামী শুক্রবারই হুজুর ডেকে
টঙ্কুর সাথে রমিজার নিকা পড়াবে সবাই । টঙ্কু বাড়ি ফিরলে ওর সাথে কথা বলেনা আনাড়ি ।
নিজের ঘরে শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় মেয়েটা । পরদিন বিকেলে টঙ্কুর দেওয়া জিনিস ফেরত দিতে আসে সে । তারপর বলে-
-মুখখান আর দেখায়োনা আমারে,মুনে এই আছিল
কওনাই ক্যান ?
টঙ্কু কোন কথা বলেনা । বলার প্রয়োজনও নেই । ও
অনুভব করে,বিশ্বাসে যখন ফাটল ধরে তখন সম্পর্ক কাঁচের ন্যায় । সে সম্পর্কে আর যায়
হোক সারাজীবন একসাথে থাকা যায়না ।
রমিজা এখন সোনাতলা বাবার বাড়িতে
থাকে । দিলু শেখের ঘরে জায়গা হয়নি তার । অথচ একদিন এ মানুষটাকেই নিজের সর্বস্ব
বিলিয়ে দিয়েছিল সে । কি দেহ,কি আত্মা । সেদিন ওকে ফিরে পেতেই বদরগঞ্জ গেছিল
রমিজা । বশীকরণ তাবিজ এনেছিল সে । এখনও রমিজা অপেক্ষা করে শুক্রবারের আগেই ফিরে
আসুক দিলু । কিন্তু সে আর ফিরে আসেনা তার কাছে ।
বিকেলে বাড়ির বাইরে এলে নহিলার
কবরটা চোখে পড়ে টঙ্কুর । কদিন আগে সেটা পরিষ্কার করেছে সে । দশ বছরের স্নেহ পাগল যে
মানুষটাকে রেখে নহিলা পরবাসী হয়েছে,সে নহিলাকে আবার টঙ্কু খুঁজে পেয়েছিল রমিজার চোখে । ভেজা ভেজা
চক্ষুযুগল দেখে মনে হয়েছিল, ওটা ওর বোনের চোখ ।
এখন সম্পর্কের দোলাচলে দোদুল্যমান
তিনটি প্রাণ আস্ফালন করে নিজেদের মধ্যে । সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়েও সঠিক পথের সন্ধান
করতে পারেনা কেউ । এক এক করে দিন ঘনিয়ে যায় । তারপর একদিন সকালে বুকফাটা আর্তনাদ
করে আনাড়ি । এ পাড়ায় মরেছে কেউ । বিকেলে অস্তগামী সূর্যটার দিকে তাকিয়ে দেখে
রক্তাক্ত সেও ।