গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

শমিতা চ্যাটার্জী

নিষিদ্ধ নির্জনে
গাড়িটা ছুটে চলেছে ফাঁকা রাস্তা ধরে। স্টিয়ারিং-এ রুদ্র, বছর পঁয়ত্রিশের সুঠাম দেহ, ঘন চুল, অফ হোয়াইট শার্ট, ব্লু জিনস, চোখে রে-ব্যান-এর গগলস। পাশে বৃষ্টি, ত্রিশের আশপাশে বয়স, তন্বি-সুন্দরী, মাখনের মত রঙ, ত্বক পরণে মেরুন রঙের কুর্তা-শালোয়ার, রেশমের মত চুল খোলা জানালার হাওয়ায় উড়ছে, সে গুণগুণ করে একটা গান গাইছে, এক অনাস্বাদিত সুখের আশায় বড় তৃপ্তি তারচোখেমুখে।  
 
ফেসবুকের মাধ্যমে রুদ্র আর বৃষ্টির পরিচয়। তারপর দিনের পর দিন ধরে প্রথমে ফেসবুক আর হোয়াটসাঅ্যাপে চ্যাট, পরে ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে দুজনে দুজনের মনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ওরা জানে না। মাত্র চার মাসের আলাপেই ওরা বুঝেছিল কি অদ্ভুত মনের মিল দুজনের! যেন কতদিনের চেনা, যেন জন্ম জন্মান্তর ধরে একে অপরকে ভালোবাসছে৷ নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বৃষ্টি ওকে রোদ্দুর বলে, আর রুদ্র ডাকে সোনামন বলে --- এ নামদুটো ওদের একান্ত নিজস্ব।  
 
প্রস্তাবটা রুদ্রই একদিন দিয়েছিল, আমরা শুধু কি ছবি দেখে আর কথা বলেই যাব সোনামন? তোমাকে একটা দিন যে নিজের করে পেতে চাই, সব কিছু উজার করে দিতে চাই। বৃষ্টিও সায় দিয়েছিল ওর রোদ্দুরেরকথায়।    
অনেক পরিকল্পনার পর আজ সেই দিন। খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়েছে ওরা রুদ্রর গাড়িতে, কোলাহল থেকে দুরে, কোন এক নাম না জানা অজানার খোঁজে। কোথায় যে আজ ওরা ঠিক চলেছে তা অনেক বার প্রশ্ন করেও বৃষ্টি জানতে পারেনি, রুদ্র ওকে সারপ্রাইজ দিতে চায়৷   
 
বড় রাস্তা থেকে যখন গাড়িটা বাঁক নিল লাল মাটির রাস্তা ধরে, তখন বেলা বেশ বেড়ে গেছে৷ দুদিকে বিশাল বিশাল গাছের সারি, আর মাঝে সরু লাল মাটির রাস্তা ধরে গভীর বনের আরও গভীরে কিছু আরও মনোরম, আরও কিছু গভীরতর পাওয়ার নেশায় বেশ কিছুটা এগিয়ে ওরা এসে পড়লো একটা নির্জন রিসর্টে। গেটের বাইরে কাঠের ফলকে নাম লেখা --বনবীথিবড় বড় গাছ বৃত্তাকারে যেন প্রাচীর তুলে সেই জায়গাটুকু সীমানার মধ্যে আটকে রেখেছে৷ মাঝখানে অদ্ভুত সুন্দর একটা ছোট্ট ট্রী হাউস, সামনে একটা বড় গাছের নীচে দুটো চেয়ার পাতা --অতিথির অপেক্ষায়৷ ঘিরে রেখেছে জায়গাটা। অবাক হয়ে দুজনে দেখলো মানব-শিল্প বা সৃষ্টির নৈপুণ্য প্রকৃতির রূপ এতটুকুও নষ্ট না করে জংলী আদিমতা কে বজায় রেখেছে, অথচ অতিথিদের বিলাসিতার জন্য বনভুমির মধ্যে বিলাসিতার কোন অভাব রাখেনি৷ গাড়ি থামতে না থামতেই বৃষ্টি এক ছুটে গিয়ে বসে পড়লো একটা চেয়ারে, রুদ্র এগিয়ে গেল কেয়ারটেকারের ঘরের দিকে। ওদের কোন ব্যবস্থায় যেন ত্রুটি না হয় দেখতে। নির্জন জঙ্গল জায়গায় খাবার ইত্যাদির রসদ বেশ কয়েক মাইল দুর থেকে ওদের আনতে হয়, তাই আগে থেকে সব না বলে দিলে হয় না।  
 
বৃষ্টি একা বসে বসে আনমনা হয়ে পড়লো৷ এখনও ভাবতে পারছে না কি কোরে ওরা আজ এখানে! সে তো সবকিছুই পেয়েছে! স্বামী, সংসার, একমাত্র ছেলে রন্টু এখন পাঁচ বছরের; বেশীর ভাগ সময়ই সে তার ঠাকুমার কাছেই থাকতে ভালবাসে, তাই ওকে নিয়ে বৃষ্টির খুব একটা চিন্তা নেই। স্বামী সমরেশ একটা মাল্ঢিন্যাশানাল কোম্পানির ডাইরেক্টর; সুদর্শন, ভদ্র, কর্তব্যপরায়ণ, কোন জিনিসেরই সে খামতি রাখেনি বৃষ্টির জীবনে৷ কিন্তু মনের মধ্যে যে ফাঁকটা বৃষ্টি অনুভব করে সেটা কেউ বোঝেনা। সে অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, সংসারের কাজের ফাঁকে নিজের অবসর সময়ে, মন খারাপের সময়েকত কিছুই তো লেখে সে!কবিতা গল্প। কিন্তু তার সেই লেখা কোনদিন পড়েও দেখেনি সমরেশ৷, তার অত সময়ও নেই, রুচিও নেই সে দিকে৷ সে শুধু আরো টাকা আরো প্রতিপত্তি চায়। সারাদিন যন্ত্রের মত কাজের পরে ক্লান্ত সমরেশ কতদিন যে বৃষ্টিকে ভালো করে দেখেওনি! নানা ঐশ্বর্য-বিলাসিতা দিয়ে ভরিয়ে রাখলেও বৃষ্টির মনের কোণে একটু একটু করে যে মেঘ জমে উঠেছে তার খোঁজ রাখেনি সমরেশ। তার হদিস পেয়েছে শুধু রুদ্র, সেও যে তার নিজের মনের ফাঁকটুকু ভাগ করে নিয়েছে, বলতে পেরেছে তার এই অভাবটুকু একমাত্র বৃষ্টিকেই৷       
  
রুদ্র গান ভালোবাসে, ভালোবাসে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে, মাঝে মাঝেই সে চলে যায় কোন নির্জন জায়গায় প্রকৃতির মাঝে। যেখানে এই সংসার, বৈষয়িক যান্ত্রিকতা কে দুরে সরিয়ে, নিয়ম-নীতির বেড়া টপকে একটু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারে মুক্ত বাতাসে৷ কিন্তু রুদ্রর স্ত্রী রুমা তার এই মনের কোন খবরই রাখেনা৷ সে তার ক্লাব, পার্টি, বন্ধু-বান্ধবী নিয়েই ব্যস্ত। মেকি শহুরে বিলাসিতাই তার বেশী প্রিয়৷
দুজনে ফ্রেস হয়ে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লো, ট্রী-হাউসের পিছনে গাছ গাছালি তে ঘেরা সুইমিং পুলের দিকে৷ বৃষ্টি পরেছে ফিকে গোলাপী রঙের একটা কসট্যুম, ওপরে জড়িয়ে নিয়েছে গাঢ় নীল রঙের বাথরোব, চুলগুলো উঁচু করে ওপরের দিকে তুলে বেঁধে রেখেছে ক্লাচার দিয়ে৷ রুদ্রর পরণে গোল গলা ঢিলা টিসার্ট আর খাঁকি রঙের বারমুডা৷ দুজনে হাতে হাত দিয়ে, কোমর জড়িয়ে হেঁটে গেল পুলের দিকে,... আরো কাছে পাওয়ার নেশায়৷ দুজনে গিয়ে বসলো পুলের ধারে৷ বৃষ্টি তার বাথরোব পাশেই খুলে রেখে জলে পা ডুবিয়ে বসলো৷ রোদের আলোয় এখন আরও ঊজ্জল দেখাচ্ছে আজ বৃষ্টি কে, গায়ের রঙের সাথে হালকা গোলাপী কসট্যুম যেন মিলেমিশে একাকার। বৃষ্টি তার ছেলেমানুষী স্বভাবে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে জল ছিটিয়ে চলেছে রুদ্রকে আরও আকর্ষণ করছে৷ বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে রুদ্র আরও কাছ ঘেঁসে বসলো, কিছু সময় কথার মধ্যে কাটলো, তারপর দুজনে জলে নামল। নিস্তব্ধ বনবিথী, নির্মল জলের ওপর দুই নারী পুরুষ ভাসছে একসাথে, নিজেদের মনের নানান ইচ্ছা কে সঙ্গে নিয়ে, মাথার ওপরে অসীম আকাশে কল্পনার ডানা মেলে আরও আরও কত স্বপ্ন দেখতে চায় যে ওরা! কতক্ষণ যে এভাবেই ভাসলো ওরা তার কোন সময় মাপেনি, তবু যেন অনন্তকালের ভেসে যাওয়া একসাথে গায়ে গা ঘেঁসে, মনের নিশ্চিন্তে, কোন সময়ের মাপা গণ্ডী নেই সেখানে৷   
 
জল থেকেদুজনেই উঠে এসেছেবৃষ্টিকে দেখে তো চোখ ফেরানো যায়না, নিটোল শরীর যেন শীতল জলের ছোঁয়ায় সদ্য ফোটা একটি সকালের পদ্ম -তার থেকে চুয়ে চুয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জল,পাপড়ি তে আঁকা ভিজে ভিজে শিশিরের আল্পনা৷ রুদ্র দেখছে তার প্রিয়তমাকে,--- কত দেখবে রুদ্র! দেখে তো আর আশই মেটে না তার। রুদ্রকেও কি অপরূপ লাগছে! সুঠাম দেহ, পেটানো চেহারা, কোথাও একটু মেদ নেই। শরীরে যেন ভরে রেখেছে পৌরুষের অহঙ্কার। কোন আর্য সভ্যতার আদিম মানব যেন দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির মুগ্ধ চোখের সামনে৷ রাত্রি ঘন হচ্ছে। দুজন এখন পাণীয়ের প্রভাবে উচ্ছল। রুদ্র উঠে ঘর থেকে একটা প্যাকেট এনে বৃষ্টির হাতে দিয়ে বলল, আজ এই তোমার উপহার সোনামন, তুমি আজ আমার মনের মতো করে নিজেকে সাজাও। ভিতরে একটা ক্রীম রঙের দামি নাইটি। বৃষ্টি তো দারুণ খুশী, ওর এই ক্রিম রঙটা খুব পছন্দের, কিন্তু এ কি! একটু যেন বেশী খোলামেলা! হাঁটু পর্যন্ত ঝুল। একতু ইতস্তত করেও পরে ফেলল। হাউস কোটটা জড়িয়ে নিতে গেল, রুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ল, --- একি করছ সোনামন! আমি যে আজ এই রুপেই তোমাকে দেখতে চাই। এই রাতের পোশাকে তোমাকে স্বর্গের পরী মনে হচ্ছে;  তুমি আর আমি আজ একই সত্বা, পৃথিবী আজ স্তব্ধ হয়ে দেখবে, আমাদের ভালোবাসা।  
 
রাত্রি গভীর। সব শব্দ যেন থেমে গেছে এক লহমায়। জ্যোৎস্নার আলো লুটিয়ে পড়েছে ঘরের মধ্যে, সাদা ধবধবে চাদর পাতা বিছানায় শায়িত বৃষ্টি কে আরও রহস্যময়ী মনে হচ্ছে ৷ সে আজ হারিয়ে যেতে চায় রুদ্রর শক্ত সুঠাম দেহের মাঝে। 
    
   রুদ্র হাঁটু মুড়ে বসে বৃষ্টির দুই পায়ের পাতায় চুমু দিতেই বৃষ্টির সারা দেহ এক অনাস্বাদিত শিহরণে কেঁপে উঠল। ওর অশান্ত হাতদুটো ঘুরে বেড়াচ্ছে খাজুরাহের মূর্তির মত এক পরম রমনীয় নারীশরীরে, ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির সারা দেহ। ধীরে ধীরে ওর সারা শরীরে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে রুদ্র। বৃষ্টিও আজ তার সমস্ত শরীর-মন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন করেছে তার দয়িতের দুই বাহুর আলিঙ্গনে। বৃষ্টির সুধা রসে রুদ্র এখন আপ্লুত --- মাতোয়ারা৷ দুজনে এক হয়ে, নিজেদের সত্বা ভুলে আদিম খেলায় মেতে উঠল, যেখানে কোন বাধা নেই, নিষেধ নেই। একে অপর কে আঁকড়ে ধরে আর ওবেশী আপন করে নিয়েছে ওরা, আজ পরস্পরকে তৃপ্ত করতে বদ্ধপরিকর৷  
  --- আজ শুধু চাঁদের আলোর আবরণটুকুই থাক না সোনামন, বৃষ্টির শেষ আবরণটুকুও উন্মোচন করতে করতে কানের লতিতে আলতো কামড় দিয়ে বলল রুদ্র, আজ আমাদের দেহ-মনে ভেসে যাক না এক অজানা তৃপ্তির ,পরম পাওয়ার সুখ! সুখে অবশ বৃষ্টিও রুদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে সাড়া দিল তার আহ্বানে। বনদেবী যেন আজ জ্যোৎস্না আলোকে ফুটিয়ে তুলেছে নিজেকে, তার রূপ যেন আদিম কোন মানবীর শ্বেতপাথরের প্রতিমা। রুদ্র পেশল দুই বাহু তার শরীরের পেলবতাকে অনুভব করছে, মুখ ডুবিয়ে তার প্রতিটি অঙ্গের মাধুর্য যেন প্রাণ ভরে পান করছে তৃষাতুর রুদ্র। আদরে আদরে রুদ্র পাগল করে তুলল বৃষ্টিকে। আরও চাই, আরও -- আরও, এ তৃষ্ণা যেন জন্ম-জন্মান্তরের, এতো অল্পেতে তো মিটবে না!    
  পৃথিবী আবর্তন থমকে গেছে। ওরা জানেনা কতক্ষণ চলেছে এই খেলা। এক চরম তৃপ্তির আস্বাদন, যার আজ প্রথম স্বাদ পেল বৃষ্টি।  
  রতিক্লান্ত দুটি শরীর একে অপরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল; শুধু চাঁদের জ্যোৎস্না দেখে গেল ওদের জীবন থেকে চুরি করে আনা ভালোবাসার এক রাত্রির পরম তৃপ্তির খেলা ৷  
  অনেক বেলায় একটা খুটখুট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল বৃষ্টির। আকাশ  জুড়ে মেঘ করেছে, ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে মনে হচ্ছে। কাঁচের জানলার ওপাশে একটা পাখী, অদ্ভুত সুন্দর, হলুদ আর নীলে মেশানো রঙ, কাঁচে ঠোক্কর মেরে ভেতরে আসার চেষ্টা করছে। পাশে রুদ্র নেই, সে যে কোন সকালে উঠে পড়েছে! ওর তো আবার ভোরে জগিং করার অভ্যাস৷ সারা রাতের আদরের রেশটুকু ছেড়ে বৃষ্টির এখনই উঠতে ইচ্ছে করছে না বিছানা ছেড়ে। তাও উঠতেই হলো।
কোনরকমে উঠে হাউসকোট জড়িয়ে চলে এল বারান্দায়, সেখানে রোদ্দুর নেই, কোথায় গেল এত সকালে! আজ তো সকালেই ওদের বেরিয়ে যাবার কথা! কেয়ারটেকাররাও তো আজ ছুটিতে, কাল রাতেই ওদের পেমেন্ট মিটিয়ে দিয়েছিল রুদ্র৷ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো বৃষ্টি। চীৎকার করে ডাকলো রোদ্দুর, রোদ্দুর কোথায় তুমি? ওর কথাই যেন ফিরে ফিরে এলো কানে ৷ একবার সুইমিং পুলটা দেখে আসার জন্য ছুটলো সেদিকে, চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে --- যেন গলা দিয়ে শব্দ  বেরোচ্ছেনা, স্বর কেঁপে যাচ্ছে। এখানে যখন নেই তখন জঙ্গলে বা নদীরধারে গেছে হয়তো! এখনই ফিরে আসবে,এই ভেবে বৃষ্টি ফিরে এল। নীচের কিচেনে গিয়ে একটু কফি করলো। কফি ও কেক খেতে খেতে মনে যে কত কুচিন্তা ঘুরছে তার অন্ত নেই ৷ এবার একটা ভয় মনের মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগলো।  হঠাৎ খেয়াল হতে দেখল রুদ্রর গাড়িটা নেই। তাহলে কি রোদ্দুর গাড়ি নিয়ে আশেপাশে কোথাও গেছে! কিন্তু ওকে না বলে কেন যাবে ভেবে পেল না। মোবাইলগুলো না আনায় এখন আফশোস হতে লাগল বৃষ্টির। রুদ্রই তো বলেছিল, আমাদের এই চুরি করা  দিনটার মধ্যে আর কেউ কোনভাবে যেন ঢুকতে না পারে! তাই তো ওরা দুজনেই মোবাইল রেখে এসেছিল বাড়িতে! কি যে করবে কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছেনা বৃষ্টি।     
  বেলা বাড়ছে, তবুও দেখা নেই রুদ্রর ৷ এদিকে মেঘ করে এসেছে, ঝোড়ো মাতাল হাওয়া দিতে শুরু করেছে, জঙ্গলের মধ্যে যেন দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে অসময়ে। কি করবে এখন বৃষ্টি!  আজ এই বনবীথিতে একটা মানুষ নেই, কাল যেখানে এসে স্বপ্নপুরী মনে হয়েছিল,আজ যেন কেমন একটা ভয় ও রহস্য লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছে ৷ এলোমেলো হাওয়া শুকনো পাতার দানা বেঁধে আছে। শুকনো পাতার সরসর শব্দ, কখনো বিশাল মহিরুহ শাখা প্রশাখা নাড়িয়ে যেন অট্টহাস্যে ফেটে পড়ছে ---  বৃষ্টি কাঁদতেও তো পারছেনা। পায়ে পায়ে ওপরের বারান্দায় উঠে এল সে। কোথা থেকে দুটো বাদুড় ডানা ঝটপট করতে করতে বারান্দার কার্ণিশে এসে ঝুলতে লাগলো৷ ভয়ে বৃষ্টির মুখ লাল হয়ে গেছে, কাঁপছে সারা শরীর, কোথায় যাবে? কি করবে? এখনও তো রোদ্দুর এলো না৷ এই মেঘের ঘনঘটা, বিদ্যুৎ চমকানোর মাঝে ওকে একা ফেলে রেখে কোথায় গেলো! একবারও কি বৃষ্টির কথা মনে পড়ছেনা ওর! কয়েকটা পাখী কর্কশ শব্দে এ-গাছ ও-গাছ করছে, আজ যেন কোন কিছুই আর মধুর লাগছেনা, সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা ভয়ের সংকেত! একি হলো!
   হঠাৎ গাড়ির শব্দে চমক ভাঙলো বৃষ্টির। ওদের গাড়িটা ঢুকছে গেটের মধ্যে, খুশীতে ছুটে নেমে এলো নিচে, যেন স্বর্গ পেল বৃষ্টি। কিন্তু একি! কোথায় রোদ্দুর! একজন মাঝবয়সী লোক নেমে এল, দেখে কোন গ্যারাজের মেকানিক বা ড্রাইভার মনে হল। খুব অবাক হয়ে গেল বৃষ্টি৷ তবু ওর সামনে যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়ালো৷ লোকটা একটা চিঠি হাতে দিয়ে বলল, মেমসাব, সাহেব এটা দিয়েছেন। 
   চিঠি! কি আছে ওতে যে রোদ্দুর কে চিঠি লিখে জানাতে হয়েছে! কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নিয়ে ভাবল বৃষ্টি, নিজে কোথায় সে! ---উফঃ! আর ভাবতে পারছেনা বৃষ্টি; খামটা খুলে দেখলো, তাতে রোদ্দুর লিখেছে --- 
প্রিয় সোনামন,  
    এভাবে তোমাকে রেখে চলে আসতে হবে আমাকে, তা আমি নিজেও আগে ভাবিনি। তোমাকে সব বুঝিয়ে বললেও তুমি মানতে না জানি, আর আমিও তোমার সামনে এই কথাগুলো কিচুতেই বলতে পারতাম না। তাই এ ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না।  
    তোমায় দেখার, তোমাকে কাছে পাওয়ার যে ইচ্ছে তা মিটলো, এভাবে যে তোমকে পাবো তা কোন দিন কল্পনাও করিনি, আর তোমাকে ছেড়ে যেতে হবে সেটাও কোনদিন ভাবতে পারিনি। কিন্ত আমাদের সমাজ, পরিবার এই সম্পর্ক কোনদিন মেনে নেবে না৷ ওদের চোখে এটা ব্যাভিচার, প্রেমের কোন মূল্যই নেই ওদের চোখে। তোমাকে দেওয়ার আর আমার কিছু নেই,  তাই এই একটা দিন আমরা আমাদের জীবন থেকে চুরি দুজন দুজনকে উপহার দিলাম। সারা জীবন এটা আমরা যত্নে রেখে দেব নিজেদের মনের মণিকোঠায়৷      
হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না, দেখা করতেও চাই না৷ আমাদের সম্পর্ক, এই দেখা হওয়া, কাছে পাওয়া, সেটা  আমাদের নিজেদের জগত হয়েই থাক, কিন্তু বাস্তব কে তো অস্বীকার করা যায় না, আবার স্বাভাবিক জীবনে যে আমাদের  ফিরে যেতেই হবে সোনামন! তবে ফোন বা নেট-এ আমাদের সম্পর্ক একই থাকবে, ভেঙে দিওনা ৷ আমি তোমায় সোনামন  বলে ডাকলে সাড়া দিও কিন্তু! নাহলে তোমার রোদ্দুর কিন্তু বড় একা হয়ে যাবে৷ ড্রাইভার ও গাড়ি পাঠালাম, ও তোমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দেবে, ভয় নেই, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিও না। ভালো থেকো, ভালোবাসার এই রেশটুকু রেখো, যা আমাদের সারা জীবনের সম্পদ হয়ে রইলো৷
                                                    তোমার রোদ্দুর।
                                                   
চিঠিটা পড়তে পড়তে বৃষ্টির দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা সে, হাঁটু মুড়ে ওখানেই বসে পড়ে হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো৷ শুধু একটা কথাই ও তখনও অস্পষ্ট ভাবে বলে চলেছে, এরকম শাস্তি কেন দিলে আমায় রোদ্দুর! আমরা তো নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে পারতাম! আমায় এ ভাবে একা ফেলে কেন চলে গেলে তুমি?  বৃষ্টির করুণ কান্নায় বনবীথিও আজ নিশ্চুপ৷ ঝড় থেমে রইল, মেঘ বোধহয় এবার বৃষ্টিধারায় ধরাতল সিক্ত করবে৷ 
বৃষ্টি নেমে এলো --- বৃষ্টিও ভিজছে তার নিঃসঙ্গ একাকিত্বের মাঝে ---ভিজছে-ভিজছে -----