গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

সম্বুদ্ধ সান্যাল

আত্মশুদ্ধি

হাত দিয়ে কপালটা ঘষতেই কেমন যেন বালিময় লাগলো। কতক্ষণ এভাবে বসে আছি জানিনা। পেছন থেকে আরো একটা লোকাল ট্রেন বেড়িয়ে গেলো। ক’টা বাজে তাও জানিনা। রেললাইনের অপর পাশে বাড়ির গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সূর্য্যটা নিভু নিভু। বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম খানিক। মাথাটা বড় ঝিমঝিম করছে।
বাচ্চাদুটো খেলছিলো যে, তারাও বোধ হয় চলে গেছে। ভাইবোনই হবেমনে হয়। ছোট ছেলেটা বানিয়ে দিচ্ছিলো বোনের রান্নাবাটির ঘর। কচি কচাপাতার মাংস, তাতে শাদা কষের ঝোল, সাথে বালির ভাত। ছোট্ট মেয়েটা দাদাকে ডাকছিলো খেতে। কানে বেজেছিলো, “তুই আগে বলে আসবি তো দাদা, আরো অনেক কিছু বানাতাম।” বলেছিলাম, “আজ কনফারেন্সটা সেরে এদিক দিয়ে যেতে যেতেই হটাৎ তোর বাড়ির কথা মনে পড়লো।” সবার মত করেই সেই একই উত্তর, “তোর শুধু কাজ আর কাজ। অনেক পালটে গেছিস দাদা।

প্লাস্টিকের গ্লাস খানিক দূরে পড়ে আছে বুকের মধ্যে একটা ফিল্টার ঠেকে যাওয়া পোড়া ফ্লেক নিয়ে। আগুনে পুড়ে যাওয়া শরীর আর কারোর কাজে লাগবে না। বহুদিন বাদে আই.বি. পাওয়া গেছিলো। ব্ল্যাক-এ। কিন্তু লেবেলটা আজ আর দেখতে চাইছি না। “কি মিষ্টার আচারিয়া, আজ কি ফাঁকা আছেন? একটা রেয়ার কোয়ালিটির রাম পাওয়া গেছে। ভিনটেজ। কত জানেন? সিক্সটি ইয়ারস।আসুনই না, আপনার জন্য আরও একটা ভালো অফার আছে।” তাকে না করতে পারিনি।

আইত্তারা, কে এসেচে দ্যাক। চিনিস ওকে? রাহুলদা। ওই যে বিশাল ব্যবসা কোলকাতায়, আমাদের পুজোয় প্রতিবার পঁচিস হাজার গোনা মাইরী।”  কানে আসাতে গর্ব্ব হ’ল না লজ্জা, ঠিক বুঝতে পারিনি তখন। তবে মাঝে মাঝেই শুনতে পাই এমন কথা। বহুদিন শ্মশানে আসিনি।এই জায়গাটা এককালে খুব প্রিয় ছিলো আমার। বিরাট জামগাছটার তলে গোল করে বাঁধানো শ্মশানবন্ধুদের ‘ওয়েট’ করার জায়গা। তাও ভেঙ্গে পড়ছে। নদীর জলটাও শুকিয়ে গেছে। মাঝের কালো জলে কয়েকটা বাঁশ পোঁতা। পঞ্চায়েত থেকে একটা টিউবয়েল লাগিয়ে রেখেছে চিতা নেভানোর জন্য। আগেও ছিলো, তবে তা ব্যবহার হতযখন গাঁজা টেনে গলা শুকিয়ে যেত।

এইখানে প্রথম আসি দুলালের সাথে। ক্লাসমেট। “ক্লাস কেটে যার সাথে মিট করতে হয়, সেই হল ক্লাসমেট।” না, এটা আমার কথা নয়, যদুদার। এই জামতলার নীচে বাঁধানো জায়গাটায় বসে গাঁজার ছিলিমে টান দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করেছিলো, “দুলালের সাথে চেনা কি করে?” আস্তে আস্তে যদুদার গান কি করে মনে বসে গেছিলো। স্কুল পালানোর সময় দুলাল বলেছিলো, “আজ এমন জায়গায় নিয়ে যাব তোকে যে নেশা লেগে যাবে।

যদুদা ছিলো এই শ্মশানের অধিপতি। মড়ার কাঠওয়ালাদের সাথে দড়াদড়ি থেকে শুরু করে পুলিশের সাথেগলাগলি পর্যন্ত। জামগাছের নীচে তার ছায়ায় আমাদের বড় হয়ে ওঠা। গাঁজা দু’দমচলার পর তার গান আর রাজাদার ঢোল। আশ্চর্য প্রতিভা মানুষটার, বাউলগানগুলো রাত জেগে নিজেই বানাতো, আর সুর দিত রাজাদা কে সঙ্গে নিয়ে। তার আগের জীবননিয়ে যেটুকু জানতাম তা হল লোকগীতি নিয়ে বাংলা ব্যান্ড খুলতে চেয়েছিলো, কিছুহিটও দিয়েছিলো, কিন্তু কোনদিন না জানতে চাওয়া কোনও কারনে ব্যাপারটা ভেঙেযায়। তারপর থেকেই সে ‘যদু গাঁজাখোর’ বলে পরিচিত। তার সঙ্গ মানে বাবারবকুনি।
কলেজ শেষ অবধি এখানেই থেকেছি, ঠেকেছিও। চাকরীটা আমার দ্বারা হতনা। পড়াশোনা শেখার থেকেও বেশি শিখতে ইচ্ছা করত যা সিলেবাসে নিষিদ্ধ। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগের দিনও বাঙলাদেশ থেকে বীরভূমে বাউলগান কি করে প্রবেশ করলো তা জানতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম। আর তার রসদ একমেবাদ্বিতীয়ম যদুদা। অনেক স্টক ছিল তার। তার ভাষায়, “যার স্টক আছে, তার টক আছে।” আর আমাদের ছিলো যদুদার টাকার মদ-গাঁজা। এমন এক সন্ধ্যায় সেই আমায় বলে, “তোর সুর না থাক, ইচ্ছে আছে। খেয়ে পড়ে বাঁচবি ব্যাটা।

পুরোপুরি কোলকাতাবাসী হওয়ার আগে যদুদা দেখা করতে বলেছিলো। সঙ্গে ওখানকার বন্ধুরাছিলো বলে আর শ্মশানে আসিনি। মাঝে গ্রামের বাড়িতেও এসেছি কয়েকবার। ক্লাসমেট বলতে মাঝে মাঝে অগ্নিশ্বরের সাথে ফোনে কথা হয় আর দুলালের মুদীখানার থেকেকিছু কিনতে গেলে তার সাথে ওই পর্যন্তই। দুলালই মাঝে মাঝে যদুদার খোঁজ আমায়দিত, আর আমার খোঁজ যদুদাকে। “যাকে খুঁজবি, তাকে পাবিই।” মিউজিক স্টুডিওতে বসে সারাদিন প্রতিভা খুঁজে বেড়াতে আর ইচ্ছা করে না। প্রতিভা এখন নিজেরাই ধরা দেয়। যদুদার কথাটা আজকাল মরচে পড়া মত শোনাত।

- “দাদা, দুলালদা তোমায় খুঁজছে।
- “হুম, বল গিয়ে আমি আসছি। কার্তিক কোথায় রে?”
- “ওই যে, মড়ার মাথাটা এখন ফাটাচ্ছে।
- “মড়া কাকে বললি? তুই মড়া কাকে বললি? জানিস ও কে? জানিস ও কে ছিলো? একটা চড় মারবো শালা শুওর।
- “এ রাহুল, কার সাথে ঝামেলা করছিস? ও বাচ্চা ছেলে একটা। ছাড়, ওদিকে চল।
- “বাচ্চা ছেলে হলে কি জানবে না ও কাকে কি বলছে? শুওরের বাচ্চার জানা উচিত কাকে কি বলতে হয়।
- “কি হয়েছে গো দুলালদা?”
- “কিছু হয়নি, এই কলটা একটু কেও পাম্প কর, মাথায় জল দিই, তারপর মন্দিরে শুইয়ে দিই, ঘুমোক।
- “এই যদুদার জন্য কি করেছি আমি, কি করেছি, তুই বল দুলাল, কি করেছি? সারাজীবন লোকটার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমি শালা কত বেফালতু মেয়ের সাথে শুয়ে তাকে সিঙ্গার বানিয়েছি, আর যদুদার যোগ্যতার কথাই মনে রাখিনি...
- কি হচ্ছে রে ওখানে?
- কে জানে সালা, মাল খেয়ে যত বাওয়াল, এতদিন পরে যদুদার জন্যে প্রেম জেগে উঠেচে। লোকটার যকন মুকে রক্ত উটতো, তখন কোথায় ছিলো? সবই একন লোক দেখানো মাইরী।
আজ আবার গলাটা শুকনো লাগছে।