বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াল
রমেন। নিজের মুখটা আয়নায় দেখল। তারপর গালে হাত দিয়ে পরখ করল দাড়িটা কামাতে হবে, নাকি না হ’লেও চলবে। দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল নিজেকে। চোখ ছুঁচলো করে
গোঁফটা দেখে নিল।
নাকের ফুটো দুই আঙ্গুলে করে ওপরে তুলে দেখল চুল গজিয়েছে কিনা।
তারপর আরো একবার গালে হাত বুলিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাঁক দিল নীপাকে,
----ভাত দাও, আমার হয়ে গেছে।‘
নীপা এসে দ্যাখে চান নেই, দাঁড়ি কামানো
নেই, উস্কো-খুস্কো একমাথা চুল আর চান না-করা চেহারা নিয়ে
তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রমেন।
--এ কি, এখনও তো চানই
হয়নি তোমার! তোমার না বড্ডো তাড়াতাড়ি। আরে, আগে চানটা তো
কর। আমার বেশী দেরি হবে না, তুমি চান করতে করতে হয়ে যাবে’
বলেই হাঁক দেয় রান্নাঘরে---বেলাদি..., দাদার
কিন্তু হয়ে এসেছে...’ বলেই জোর করে গায়ে হাত দিয়ে ঠ্যালা
দিল নীপা—যাও...’!
--চান করব না, শীত করছে’
ভুরু কোঁচকালো নীপা। গতকাল রাত্রেও
যেন একই কথা বলেছিল রমেন—শীত করছে।‘
অথচ কাল রাত্রে বেশ গরম ছিল, দুটো পাখা
একসঙ্গে চালিয়ে শুতে হয়েছিল। রমেন বলার পর একটা পাখা বন্ধ রেখেছিল নীপা। চাদর
লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল রমেন কে। লাগবে না বলেছিল রমেন, কিন্তু ভোরবেলায় নীপার শাড়ির আঁচল টেনে গায়ে মুড়ি দিয়েছিল। না, নীপা এখনকার মেয়েদের মতো নাইটি-ফাইটি পরে বাড়িতে থাকে না, রাত্রিতেও শোয় না। এতদিন বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়িমা ছিলেন। তাঁদের সামনে
ওসব পোষাকে নীপা খুব একটা স্বছন্দ বোধ করেনি কোনদিন, তাঁরাও
না। মুখে যদিও
কিছু বলেননি। নীপার স্বাধীনতায় তাঁরা যে খুব হস্তক্ষেপ করতেন,
তাও না। করলে এতদিন ধরে নীপা অফিসে চাকরি করতে পারত না। নীপা-রমেনের দুই মেয়েকে
তাঁরাই তো দেখেছেন ! আসলে নীপা নিজেই সেটা চায়নি।
শাড়ির আঁচলটা এমনভাবে জড়িয়ে
গুটি-সুটি মেরে শুয়ে ছিল রমেন, যেন ভীষণ শীত করছে। রমেনের দিকে চিন্তিত মুখে
চাইল নীপা। তারপর নিজের বাঁ হাত একবার রমেনের গলার কাছে রাখল, আর একবার নিজের গলায়। কিন্তু রমেনের গা ঠিক কতটা গরম বুঝতে পারল না।
বলল--কি জানি, বুঝতে পারছি না। ঠাকুরপোকে একবার ডাকব?’
রমেনের ভাই রণেন ডাক্তার, এবাড়িতেই থাকে,
তিনতলায়। রমেনরা থাকে দোতলায়। নীপা বিয়ে হয়ে যখন এবাড়িতে এসেছিল,
রণেন তখন স্কুলের শেষ ক্লাসের ছাত্র। আবদার করে বলেছিল—তুমি কিন্তু আমার বৌঠান, আর আমায় ঠাকুরপো বলে
ডাকবে’।
নীপা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন নাম ধরে
ডাকব না কেন, আমি তো বড়...’ মাথা
নাড়িয়েছিল রণেন---না, আমি মা’কে
বলেছি। মা ছোটকা’কে ঠাকুরপো বলত, কি সুন্দর লাগত, তুমিও বলবে।‘ আর কিছু বলেনি নীপা। কে জানে, হয়ত এই ডাকার
মধ্যে কোন স্মৃতি লুকিয়ে আছে ! ছোটকাকে দ্যাখেনি নীপা। ওদের দু-ভাইয়ের মাঝে এক
বোনও ছিল, ছোটবেলায় বাগানের পুকুরে পদ্মফুল তুলতে গিয়ে
জলে ডুবে মারা যায়, তাকেও দ্যাখেনি নীপা। ওই পুকুরটা এখন
মাটি দিয়ে বোজানো আছে, তার উপরে ফুলের টব রাখা। রণেনই সব
দেখিয়েছিল নীপাকে। সেসব অনেকদিনের কথা।
রণেনের বৌ শাশ্বতী, সেও ডাক্তার।
বিয়ের পর রণেনের দেখাদেখি সেও নীপাকে বলে বৌঠান। ওদের বাচ্চা-কাচ্চা নেই। নীপাদেরই
ছোটটাকে নিজের করে নিয়েছে। রণেনকে খবর দেওয়ার কথা শুনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল
রমেন, নীপা বাধা দিয়ে বললে—তুমি
সব তাতেই অমন না, না কোর না তো ! তারপর ঠাকুরপো শুনে একটা চ্যাঁচামেচি করুক। দাঁড়াও, আগে ওদের খবর
দিই।‘
(২)
আজ আর অফিসে যাওয়া হল না রমেনের।
নীপাও আজকে ছুটি নিয়ে নিল। যদি কিছু দরকার হয়! রণেনরা তো আর বাড়িতে বসে থাকতে
পারবে না, তাদের হাসপাতালের ডিউটি। শাশ্বতী চেম্বারে যাবার আগে রমেনের ঘরে ঢুকে
বলে গেল,-----আজ তুমি একদম বাইরে বেরোবে না , দাদা। মনে রেখো, এটা আমি বললাম। বৌঠানের কথা
তুমি শুনবে কি শুনবে না, তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি শুধু
শাশ্বতী নই, ডাক্তারও, এটা ভুলে
গেলে খুব খারাপ হবে। দাদা, বেরিয়ো না, শুয়ে থাকো আজকের দিনটা , কেমন?’
নিস্পৃহ মুখে শুনল রমেন, উত্তর দিল না।
সেই থেকে গায়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। এখন বেলা প্রায় একটার কাছাকাছি। রণেন
হাসপাতালে। শাশ্বতীও তার নিজের চেম্বারে। হঠাৎ
করে মাঝের একটা দিন ছুটিতে বাড়িতে বসে থাকতে ভালই লাগছিল নীপার। রমেনও শোবার ঘরে শুয়ে আছে, গায়ে হালকা
একটা চাদর। স্নানে যাবার আগে একবার ঘরে এলো নীপা। রমেনের গায়ে হাত দিয়ে দেখল,
তেমন গরম নয়। মাথার চুলে একটু বিলি কেটে দিল, রমেন
কোন কথা বলল না, চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। মনে হল ঘুমিয়ে
পড়েছে। মাথায় হাতটা একটু রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো নীপা, স্নানে
যাবে। স্নান সেরে এসে খেতে দেবে রমেনকে।
স্নান সেরে আরো দু/একটা টুকিটাকি
কাজ সেরে বেলাদিকে কি যেন বলে আবার ঘরে এলো নীপা। রমেনকে উঠিয়ে খেতে দেবে। ঘরে ঢুকে দ্যাখে বিছানা খালি, রমেন নেই। বাথরুমে গেছে হয়ত, ভেবে বিছানাটা
হাত দিয়ে একবার টেনে দিল নীপা। বাচ্চাদের মত স্বভাব রমেনের। শুয়েছে দ্যাখ, যেন একটা বাচ্চা ছেলে বিছানায় খেলা করেছে। হাসি হাসি মুখ
করে বাথরুমের দিকে চেয়ে রইল নীপা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝতে পারল, বাথরুমের দরজা
এদিক থেকে বন্ধ রয়েছে। সেকি, তাহলে কি বাইরের বাথরুমে গেল?
দোতলায় বারান্দার শেষে আরও একটা বাথরুম আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে
সেদিকেই গেল নীপা। কিন্তু সেই বাথরুমটাও বাইরে থেকে বন্ধ। চিন্তিত মুখে সিঁড়ির
মুখে এসে দাঁড়াল নীপা। তিনতলায় আগে যাবে, নাকি একতলায়
নেমে দেখবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। রমেন কি ওপরে রণেনের ঘরে নাকি মেয়েদের ঘরে
গেল! সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাঁক দিল---বুধুয়া, এই
বুধুয়া...’
বুধুয়া বাড়ির গ্যারাজ ধোয়া-মোছা, নিচে শাশ্বতীর
চেম্বার পরিষ্কার করার লোক। সপ্তাহে একটা দিন রবিবার শাশ্বতী বাড়িতে চেম্বার করে। সে বাচ্চাদের ডাক্তার। নিচে গ্যারাজের একটা দিকে ছোটোখাটো একটা চেম্বার
বানিয়ে নিয়েছে। রমেনই বলেছিল, একটা দিন অন্ততঃ বাড়িতেই থাকুক মেয়েটা, রুগী না এলে তো শাশ্বতীর ছুটি। নীপার ডাকে একতলায় সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল
বুধুয়া।
--দ্যাখ তো, দাদা নিচে কোথায়
গেছেন, দোতলায় নেই। চেম্বারে আছে কিনা...’ বলে ওপরে ছুটল নীপা। অসুস্থ মানুষ টা গেল কোথায়, এইতো তাকে শুইয়ে রেখে স্নানে গেল নীপা। এর মধ্যে যাবে কোথায়!
(৩)
আজ সাত বছর হল রমেনের কোন খোঁজ
পাওয়া যায়নি। রণেন, শাশ্বতী
খোঁজ পাওয়ার জন্য কিছু করতে বাকি রাখেনি। নীপা আর অফিসে যায় না।
রণেনই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। শাশ্বতী বাইরের চেম্বার ছেড়ে দিয়েছে, শুধু বাড়িতেই চেম্বার করে। তার সময়ের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সকাল
এগারোটা থেকে সে চেম্বারে যায়, ঠিক একটা বাজার কিছু আগে
দোতলায় উঠে আসে। নীপাকে নিয়ে খাবার পর
বেলা তিনটে নাগাদ
নীপা ঘুমিয়ে পড়লে সে আবার সন্ধ্যে অবধি চেম্বার করে। নীপা সারাদিন শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে
থাকে। মাঝে মাঝে বেলাদির সঙ্গে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করে রান্না ঘরে। মুখে কোন কথা বলে না।
শুধু বেলা একটার কাছাকাছি সময় হলে কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। দোতলা, তিনতলার বাথরুমগুলো খুলে উঁকি মারে, সিঁড়ির
মুখে এসে দাঁড়ায়, এদিক/ওদিক দ্যাখে আর তারপর চীৎকার করে
ডাকে----বুধুয়া...এই বুধুয়া...!’