বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়িতেছে। এমনদিনে মৌতাত বেশ জমে। কমলাকান্তের ন্যায় আফিঙ্গ না থাক, গঞ্জিকা আছে। কল্যাণী ঘোষপাড়া হইতে আনা গঞ্জিকার প্রথম কুণ্ডলী শেষ করিয়া দ্বিতীয়টার দিকে হাত বাড়াইব এমন সময় মনে হইল আমার ঘরে যেন একটি রেলগাড়ি চলিতেছে। প্রথমেই মনে হইল গঞ্জিকার প্রভাব। মস্তিষ্কে ধুঁয়া আজ বড্ড বেশি চলিয়া গিয়াছে। আর সেই গঞ্জিকাপ্রসূত ধুঁয়া রেলগাড়ির আকার ধারণ করিয়া ঘরময় বিচরণ করিতেছে। তাহা না হইলে রেলগাড়ি কল্যাণী ষ্টেশন ছাড়িয়া আমার ঘরে স্থান লইবে কেন। কিন্তু উহা যে প্রকৃতই কি তাহা জানিবার বড়ই ইচ্ছা হইল। তাই নিকটে গিয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। কিয়তক্ষন নিরীক্ষণ করিবার পর যাহা দেখিলাম তাহাতে মস্তিস্ক রক্তশূন্য হইয়া উঠিল। আমি কোনক্রমে বিছানায় গিয়া আশ্রয় লইলাম। ইতিমধ্যে আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। উহাকে বলিলাম, দেখ ভাই, আমি কোনক্রমে এই ধরণীর শস্যক্ষেত্র হইতে পটল তুলিলে তোমারও পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হইবে। সুতরাং কার্য বন্ধ করিয়ো না। তাহারপর বিছানা হইতেই ভালো করিয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া দেখিলাম উহা কোন রেলগাড়ি নহে, উহা একটি ভয়ানক বৃশ্চিক। প্রচলিত বাংলায় যাহাকে বলে তেঁতুলবিছা, উহা তাইই।
আমার গৃহসঙ্গীকে বৃশ্চিকটির ব্যাপারে অবগত করিলাম। উহার বিকট আকৃতি দেখিয়া তাহার দেহকম্প শুরু হইয়া গিয়াছে। তাহাকে জানাইলাম আমি ইহার উপর নজর রাখিতেছি। তুমি বাহিরে গিয়া আরক্ষাবাহিনীকে এই সংবাদ প্রদান কর। সে দ্রুতবেগে চলিয়া যাইল। কী করিব ভাবিতেছি এমন সময় দেখি সেটি আলমারির নীচে আশ্রয় গ্রহণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছে। উহা একবার কোনক্রমে আলমারির নীচে আশ্রয় গ্রহণ করিলে উহাকে দ্বিতীয়বার বাহির করা অসম্ভব কার্য বলিয়া বিবেচিত হইবে। সুতরাং আমি তৎপর হইয়া একটি দণ্ড লইয়া ধাবমান হইলাম। কিয়ৎক্ষন ছুটাছুটির পর উহা ক্লান্ত হইয়া গৃহের একটি কোনে আশ্রয় লইল। ইতিমধ্যে আরক্ষাবাহিনীর প্রধান আমার গৃহে উপস্থিত। তাহাকে দেখাইতেই তিনি তাঁহার দণ্ড দিয়ে উহাকে তীব্র বেগে ঠাসিয়া ধরিলেন। ইহার কারনে আমার সাধের মৌতাত ভঙ্গ হইয়াছে। শুধু তাহাই নহে, আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। সুতরাং ইহার মৃত্যুদণ্ড আবশ্যক স্থির করিয়া উহার ভবলীলা সাঙ্গ করিতে আদেশ করিলাম। তিনি তাঁহার দণ্ড দিয়া উহাকে বারংবার আঘাত করিতে উহা মৃত্যুমুখে পতিত হইল। তাহার পর উনি আমাদিগকে আশ্বস্ত করিয়া চলিয়া গেলেন।
ইহাকে তো আর গৃহে স্থান দেওয়া যায় না। ঠিক করিলাম বাহিরে ফেলিবার পূর্বে একটি ফটো লইয়া রাখি। আমার ফেসবুকীয় বন্ধুদের জানাইতে পারিব কত বড় বিপদ ঘটিতে যাইতেছিল আমার! সদ্য ক্রীত ডিএসএলআর যন্ত্রটি বাহির করিয়া সেই মহামূল্যবান কার্যটি সমাধা করিতে যাইব এমন সময় মনে হইল মৃত বৃশ্চিকটি যেন একটু নড়িয়া উঠল। আমি ভীত হইয়া তিন পা পিছাইয়া আসিলাম। হঠাৎ মনে হইল বৃশ্চিকটি বলিয়া উঠিল, 'তোমার বীরত্ব জ্ঞাত হইল।' আমি বিস্ময়ে অভিভূত হইলাম। এতক্ষন তো গঞ্জিকার আবেশ থাকিবার কথা নহে। তাহা হইলে কি...
ঈষৎ সাহস সংগ্রহ করিয়া আমি উহার নিকটে উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, 'তুমি কথা বলিতে পারো?'
পুনরায় শুনিতে পারিলাম সে বলিয়া উঠিল, 'শুধু কথা বলিতে পারি তাহা নহে, আমার মধ্যে এখনো যে পরিমান বিষ আছে তাহাতে তোমার বাক্যফুর্তি সারাজীবনের মত বন্ধ করিয়াও দিতে পারি।'
বলে কী? আমি দণ্ড লইয়া তাহাকে আঘাত করিতে উদ্যত হইলাম। সে বলিয়া উঠিল, 'থাক, আর অর্ধমৃত প্রানীর উপর বীরত্ব দেখাইতে হইবে না। খুব শীঘ্রই আমার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটিবে। তাহা ছাড়া আমরা তোমাদের মনুষ্যের ন্যায় হিংস্র প্রানী নহে যে যখনই সুযোগ পাইব বিষ ঢালিয়া দিব। বঙ্কিমচন্দ্রই তো বলিয়াছেন, তুমি অধম তাহা হইলে আমি উত্তম না হইব কেন? সুতরাং আমা হইতে তোমার আশঙ্কার কোন কারন নাই।'
আমি পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, 'নিশ্চিত করিয়া বলিতেছ তো?'
--তোমরা মনুষ্য প্রজাতি অত্যন্ত সংশয় প্রবন। এই কারনেই তোমাদের মধ্যে হানাহানি এত বৃদ্ধি পাইয়াছে। একটা মুমূর্ষু প্রানী কী কারনে মিথ্যাভাষ করিবে?
--প্রতিশোধস্পৃহা।
--আমরা বৃশ্চিকগণ কোন প্রকারেই প্রতিশোধস্পৃহ নই। প্রতিশোধ জিনিসটি তোমাদের মনুষ্যজাতির মজ্জাগত এবং জন্মগত হইয়া গিয়াছে। যে কারনে তোমরা আজ এত নীচে নামিয়া গিয়াছ। তাহা না হইলে তো আমি ভান করিয়া পড়িয়া থাকিয়া আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ লইতে পারিতাম।'
আমি প্রতিবাদ করিয়া উঠিলাম, 'আমি তোমার মৃত্যু ঘটাই নাই। তাহা হইলে আমার উপর প্রতিশোধের কারন কী?'
--কিন্তু তুমি ভীত না হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে ইহা হইত না। তুমি তাহা না করিয়া আরক্ষাবাহিনীর সাহায্য লইয়া আমাকে হত্যা করিলে। বল এইবার, তুমি আমার মৃত্যু ঘটাও নাই?
--সে ত্রুটি তোমার চরিত্রের। তুমি যাহাকে তাহাকে যখন তখন দংশন করিয়া বেড়াও।
--দেখ, চরিত্র তুলিয়া গালি দিও না। তোমাদিগের চরিত্র লইয়া আমি শুরু করিলে রামায়ণ-মহাভারত-ইলিয়াড-ওডিসি লিখিয়াও শেষ হইবে না। যাহা হউক, আমরা বিনা কারনে কাহাকেও দংশন করি না। তুমি তোমার প্রতিবেশীদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিও, কয়জনকে আমরা দংশন করিয়াছি আর কয়জন আমাদের হত্যা করিয়াছে।
--তাহা হইলে গত মাসে ঘোষবাবুর অমন সুন্দর সন্তানটিকে দংশন করিয়াছিলে কেন? বেচারাকে এক পক্ষকাল শুশ্রূষালয়ে কাটাইতে হইয়াছিল!
--তোমরা যদি জানিতে সেই গুণধর বালক কী করিয়াছিল। আমার সেই বৃশ্চিক বন্ধুটিকে দংশনের পূর্বে তিনবার বিনা কারনে জলপাত্র দিয়া আঘাত করিয়াছিল। তাহার বিনিময়ে তোমরা কী করিলে? তাহাকে হত্যা তো করিলেই। আমাদের গর্তে অ্যাসিড ঢালিয়া আমাদের পুরো বংশকে হত্যা করিলে। তোমরা এতটাই হিংস্র।
শেষে আর থাকিতে না পাড়িয়া বলিয়া উঠিলাম, 'দেখ বৃশ্চিকবর, তোমরা অত্যন্ত নিম্নজাতীয় প্রাণী। আমরা বিদ্যা-বুদ্ধিতে তোমাদিগ হইতে অনেক আগাইয়া আছি। সুতরাং, আমাদের বিচারই সর্বোত্তম বলিয়া গন্য হইবে।
--সে তোমাদিগের বিদ্যার বহর মুমূর্ষু প্রানীকে হত্যার প্রচেষ্টার মধ্যেই বোঝা গিয়াছে। এক্ষণে আর তর্ক করিয়ো না। বুদ্ধি যদি বল, বা কূটবুদ্ধি, তাহাতে তোমরা আমাদিগ হইতে অনেক আগাইয়া আছ। সে প্রভাবেই তোমরা আজ সর্বেসর্বা হইয়াছ। কিন্তু ভাবিয়া দেখিয়াছ কি, আমরাও ভীত হইলে যাহার ভয়ে ভীত তাহাকে হত্যা করিবার নীতি গ্রহণ করিলে কী হইত! গান্ধীজী বলিয়াছিলেন, 'চোখের বদলে চোখ এই যদি নীতি হয় তাহলে সমগ্র বিশ্বটাই অন্ধ হইয়া যাইবে।
বুঝিলাম আমি যদি বুনো ওল ভক্ষক হই তবে এও বাঘা তেতুল বিছা। বঙ্কিম থেকে গান্ধী, রামায়ণ থেকে ইলিয়াড, সর্বত্র ইহার যাতায়াত। আমার কোন যুক্তিই ইহার কাছে টিকিবে না। তাই কোন যোগ্য উত্তর না পাইয়া শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিলাম , 'কী কারনে তুমি ভান করিয়া পড়িয়াছিলে তখন?'
--তুমি গঞ্জিকা ভক্ষক। তাহা ছাড়া তোমাকে অন্য কোন নেশা করিতে দেখিনাই। সুতরাং তুমি উত্তম মনুষ্য ও উত্তম বিচারক। তাই ইচ্ছা হইয়াছিল তোমাকে মৃত্যুর পূর্বে কিছু বলিয়া যাই।
--বলিয়া ফেল। আমি আদেশ করিলাম।
--দেখ, তোমরা শক্তিমান ঠিকই কিন্তু সর্বশক্তিমান নও। সর্বশক্তিমান একজনই, তিনি পরমেশ্বর। তাহা ছাড়া শক্তিমান মাত্রেই স্বৈরতন্ত্রী নহে। এক্ষণে আমরা যদি তোমাদের শয়নকালে দংশন করিয়া যাই তাহা হইলে তোমার নিদ্রা আর ভাঙ্গিবে না। কিন্তু আমরা অত্যন্ত সহনশীল ও সৎ বলিয়াই বিশ্ব এখনো টিকিয়া আছে। তাই আমার বিনীত অনুরোধ, সর্বক্ষেত্রে বিচক্ষনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ো। আমাদের হিংস্র হইতে বাধ্য করিয়ো না। তোমরা আমাদিগ হইতে যে পরিমান উৎকৃষ্ট তাহা বজায় রাখিও। এই বলিয়া বৃশ্চিক ক্ষান্ত হইল।
আমি ভাবিলাম মরিয়া গিয়াছে হয়ত। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, 'বাঁচিয়া আছ?' সে উত্তর করিল, 'বাঁচিয়া আছি তবে আর কতক্ষন থাকিব নিশ্চিতভাবে বলিতে পারিতেছি না। আমার প্রাণবায়ু নির্গত হইলে আমাকে মৃত্তিকাতে রাখিয়া আসিও। পিপীলিকা আসিয়া আমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করিবে। আমাদিগকে দেখিয়া শিখিয়া লইয়। আমরা মৃত্যুর পরও নিজেদের উৎসর্গ করিয়া পুন্যার্জন করিতেছি। এই বলিয়া বৃশ্চিক চিরতরে চুপ হইল।
বৃশ্চিকের চক্ষু মুদিত হইল বটে কিন্তু আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইল। আমি পরেরদিন দোকান হইতে একটি কার্বলিক অ্যাসিডের শিশি কিনিয়া ঘরে ফিরিলাম।।