আজ অনেক বছর পরে এক মামা-ভাগনীর
কথা মনে পড়লো। তাদের দেখা, তাদের সাথে আলাপ হওয়া, ও তাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ সময়
কাটানোর স্মৃতি, আজও আমার কাছে একটা অসামান্য প্রাপ্তি হয়ে আছে। তাই প্রায় কুড়ি
বছর আগের সেই সুখস্মৃতিকে একটু ঘষেমেজে পরিস্কার করার প্রয়াস নিতেই আজ কলম ধরা।
সেবছর আমরা চারজন উত্তর বঙ্গের বেশ
কিছু জায়গা ঘুরে, এক বিকালে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের ভিতর হলং বনবাংলোয় এসে হাজির
হলাম। সঙ্গে একজন দু’বছরের ও একজন সাত বছরের শিশু। পথশ্রমে আমরা কিছু ক্লান্ত হয়ে
পড়লেও, বাচ্চাদুটোকে দেখে একবারও মনে হয়নি তারাও সারাটা পথ আমাদের সাথেই এসেছে।
বাংলোতে ঢোকার আগেই, দু’জন এসে আগামীকাল ভোরে হাতির পিঠে (এলিফ্যান্ট সাফারি) জঙ্গল
দর্শনের আর্জি জানালো। আমরা আরও দু’টো দিন
এখানে থাকবো, তাই তাড়াহুড়ো না করে আগামীকালের পরিবর্তে তারপরের দিন যাবার কথা বলে
বাংলোয় প্রবেশ করলাম। আজ ভাবি, পরেও ওখানে গেছি, কিন্তু হলং বনবাংলোয় ঘর পাওয়া যত
শক্ত, তার থেকেও শক্ত এই হাতির পিঠে জঙ্গল
দর্শনের সুযোগ পাওয়া, বিশেষ করে খুব ভোরে প্রথম ট্র্রিপে।
পরদিন খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে
আমাদের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি একজন দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে দেখে সে খুব নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলো, আমরা এখন হাতির পিঠে জঙ্গলে যাব কী না।
তাকে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “আমরা
আগামীকাল ভোরে যাব, এটা তো গতকাল আসার সময়েই বলে দিয়েছি। আজ ভোরে কী করতে এসেছো”?
লোকটি কিন্ত ফিরে না গিয়ে বললো, “বাবু,
সব হাতিতে লোক উঠে গেছে, কিন্তু দুটো হাতি লোক না পেয়ে ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা
যদি এখন যান, তাহলে খুব ভাল হয়”।
এই মুহুর্তে সেটা সম্ভব নয়, কারণ
ছোট বাচ্চাটা এখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি। কাজেই লোকটিকে পরিস্কার জানিয়ে দিলাম যে, “আজ
এই ভোরে ঠান্ডায় বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে তৈরী করে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া গতকাল
আমরা অনেকটা পথ পার হয়ে এখানে আসায়, ওরা খুব ক্লান্ত। কাজেই আগামীকাল ভোরেই যাব”।
লোকটি ফিরে না গিয়ে পুনরায় বললো
“বাবু সব হাতি একসাথে জঙ্গলে যায়, এই দুটো হাতির জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা
দয়া করে একটু তৈরী হয়ে নিন। খুব বেশী সময় তো লাগে না, ফিরে এসে সারাদিন বিশ্রাম
নিন। তা নাহলে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি নীচে অপেক্ষা করছি, খুব দেরী করবেন
না”।
কী আর করা যাবে, সবাইকে ডেকে তুলে
তৈরী হয়ে নীচে নেমে এসে দেখি, অন্য হাতিগুলোয় পর্যটকরা উঠে বসে আমাদের জন্য
অপেক্ষা করছে। সবথেকে বড় ও স্বাস্থবান হাতিটা বিদেশীরা দখল করেছে। সেটা নাকি দলমা
থেকে আসা বিখ্যাত কুনকী হাতি। আমাদের জন্য পড়ে থাকা হাতিদুটোরই পায়ের ফাঁকে দুটো
বাচ্চা ঘুরঘুর করছে। বুঝতে পারছি সকলে পছন্দ মতো হাতির পিঠে উঠে বসে আমাদের জন্য
অবশিষ্ট নিকৃষ্ট হাতিদু’টো রেখে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ছোট ছোট বাচ্চা সমেত
হাতিদু’টো দেখে জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা উবে গেল। লোকটাকে বললাম “এই হাতিদু’টো আমাদের
দিলে আজ আমরা যাব না। দু’টো হাতির সঙ্গেই ছোট বাচ্চা আছে, রাস্তায় অসবিধা হতে
পারে। কাল সকালে আমাদের জন্য ভাল হাতি
রেখ, আমরা আগামীকাল যাব”। লোকটা হাল না ছেড়ে আমাদের আশ্বস্ত করে যে তথ্যটি জানালো,
তাতে এই হাতি যুগলের পিঠে জঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছা তলানিতে এসে ঠেকলো। হাতিদু’টির
সম্পর্ক মা ও মেয়ের। তাদের বাচ্ছা দু’টোর
বয়স দশ মাস ও বার মাস। তাদের নাম ফকলু ও ডলি। অর্থাৎ তাদের সম্পর্ক অতি আদরের—“মামা ও ভাগনী”। এত ছোট বাচ্চা সঙ্গে
করে জঙ্গল ভ্রমণ আর যাই হোক, সুখকর হবে না। কিন্তু নছোড়-বান্দা লোকটির অনুরোধে,
শেষপর্যন্ত আমাদের ভাগ করে হাতিদু’টোর পিঠে উঠে বসতেই হ’ল।
একসাথে লাইন দিয়ে সবাই যাত্রা শুরু
করলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই একে অপরের থেকে অনেক এগিয়ে পিছিয়ে আলাদা হয়ে গেল। আমরা
যে ডলি-ফকলুর কৃপায় সবার থেকে পিছিয়ে পড়লাম, এটা বোধহয় উল্লেখ করার প্রয়োজন রাখে
না। যথারীতি ক্রমে ক্রমে আমরা অন্যান্য হাতিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।
হেলেদুলে বেশ চলেছি। হাতিদু’টোর
একবার পাশেপাশে, প্রায় মায়ের শরীর লেপ্টে বাচ্চাদুটো চলেছে। স্ত্রী, কন্যা ও অপর
শিশুটিকে নিয়ে, আমি ডলির মার পিঠে বসে। ভোরের শিশিরে জঙ্গলের ঘাস, লতাপাতা এখনও
বেশ ভিজে। হঠাৎ আমাদের হাতিটা একটা ফ্যাঁচ করে বিকট আওয়াজ করে, মুখ ঘুরিয়ে
মুহুর্তের মধ্যে পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। পেট ও পিঠের রোমগুলো কী রকম সুচের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে
গেল। ঘটনাটা এবার বোঝা গেল। গাছের ঝুরির মতো একটা বেশ শক্ত সরু লতায় পা জড়িয়ে ভিজে
মাটিতে ডলি আছাড় খেয়েছে। মা হাতি তার শুঁড় দিয়ে লতাটা ছিঁড়ে, বাচ্ছাকে টেনে তুলে,
আবার মুখ ঘুরিয়ে আগের মতো এগিয়ে চললো। এখন তার শরীর ও পথ চলা, আবার আগের মতোই
স্বাভাবিক। শুধু ডলি পাশ থেকে একটু সরে
গেলেই, শুঁড় দিয়ে টেনে প্রায় চার পায়ের নীচে টেনে নিয়ে আসছে। বড় বড় কানের জন্য
হাতির নাকি পিছনে দেখতে অসুবিধা হয় শুনতাম, এখন তো দেখছি পিছনের দিকে থাকলেও
সন্তানের প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি আছে।
আরও কিছুটা পথ এগিয়ে, আমরা একটা সরু
খালের মতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। আমাদের ঠিক পিছনে ফকলু তার মার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। নীচু খালের মতো
জায়গাটায় জল নেই বটে, কিন্তু নরম কাদায় ভর্তি। আগের হাতিগুলোর কৃপায় তার হাল বড়ই
শোচনীয়। হাতিটা মাথা নীচু করে কাদামাখা পিচ্ছিল খালটায় নামার উপক্রম করতেই, আমার
একটা ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো— হাতিটা পা পিছলে পড়ে যাবে নাতো? তাহলে হাতিটার কিছু
না হলেও, আমাদের হাতি চাপা পড়ে মারা গিয়ে Guinness World Records এ নাম ওঠা কেউ আটকাতে
পারবে না। মাহুতটি আবার জাতীয় ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে না। সে তখন মাথা নীচু করা
হাতির মাথার ওপর প্রায় আধঝোলা অবস্থায় বসে, হাতি সামলাতে ব্যস্ত। তবু তাকে আমার
বিশুদ্ধ হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করলাম—“ও ভাই, তুমারা হাতি কাদায় পা পিছলে গির যায়গা তো
নেহি? মেরা সাথ বাচ্চি হায়। হাতি গির জায়গা, তো হামারা প্রাণ নিকাল যায়গা”। মাহুত মাথা নীচু করা হাতির মাথায় নীচের
দিকে মাথা করে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় একটু বিরক্ত হয়েই বললো, “কুছ হোগা নেহি,
প্রেমসে বৈঠিয়ে”। আমরাও এবার সামনে নীচের দিকে ঝুঁকে বসে আবার সেই একই কথা বলতে
যাব, এমন সময় ঐ কাদামাখা খালে সামনের দু’পা, আর খালের ওপরে পিছনের দু’পা অবস্থায়
হাতিটা আগের মতোই রোম খাড়া করে, বিকট আওয়াজ করে ঘুরে দাঁড়ালো। না আমরা কেউ পড়ে যাই
নি, তবে ডলি খালের কাদায় আবার পা পিছলে পড়েছে। ফকলু ওর থেকে দু’মাসের ছোট হলেও,
মামা হবার সুবাদে সম্মানের দিক থেকে বড় বলেই বোধহয় অনেক স্মার্ট। এখনও একবারও
পড়েনি। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, তাই বোধহয় হাতির এই বিপদের কথা চিন্তা করেই তাদের শরীরে
শুঁড় নামক একটি ক্রেন জুড়ে দিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। ঐ ক্রেনের সাহায্যেই
এবারও ডলি উদ্ধারপর্ব সমাপ্ত হল।
আমরা খানতিনেক গন্ডার, দু’টো
বাইসন, কয়েকটা হরিণ, ময়ুর ইত্যাদি দেখে ফেরার পথে সঙ্গের শিশুটি হঠাৎ তার এক হাতের
গ্লাভস্ খুলে মাটিতে ফেলে দিল। কী করবো ভাববার আগেই, ফকলুর মা শুঁড় দিয়ে গ্লাভসটা
তুলে আমাদের হাতে দিয়ে দিল। আরও কিছুটা পথ এসে হঠাৎ আমাদের হাতিটা দাঁড়িয়ে পড়ে
আস্তে আস্তে একদিকে কাত হতে শুরু করলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো, যে আমরা হাতির পিঠে
কাত হয়ে পড়ে যাবার ভয়ে, হাওদার লোহার সিক ধরে বসে আছি। মাহুত জানালো ডলি দুধ খাবে।
আমাদের প্রমোদ ভ্রমণের চেয়ে একটি শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান করা অনেক জরুরী, তাই ঐভাবে
অনেকক্ষণ কাত হয়ে হাতির পিঠে বসে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডলির গ্রীন সিগনাল পেয়ে,
আমরা আবার সোজা হয়ে বসে এগিয়ে যাবার সুযোগ পেলাম।
ফিরে এসে একে একে হাতির পিঠ থেকে
নামার পরে ডলি ও ফকলু একসাথে শুঁড় উঁচিয়ে আমার স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো। ও ভয় পেয়ে প্রায়
ছুটেই পিছিয়ে যেতে লাগলো। মা হাতিদু’টো ও মাহুত যুগলকে দেখে মনে হ’ল, তারা এই দৃশ্য বেশ উপভোগ করছে।
ডলি ও ফকলুকেও যতটা নিরীহ ও শান্ত মনে করেছিলাম, এখন দেখছি তারা আদৌ তা নয়।
মাহুতরা জানালো ওরা খাবার চাইছে। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে ছোট ছোট করে ভেঙ্গে ওদের
মুখে দিলেও, অর্ধেক পাশ দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের ভাত খাওয়াবার সময় যে দৃশ্য
মায়েদের রোজ দেখতে হয়, অনেকটা সেইরকম।
পরে দেখেছিলাম বড় হাতিদের খিচুড়ির মতো খাবার কলাপাতায় মুড়ে খেতে দেওয়া হচ্ছে, আর
মাহুতরা ঐ খাবারের ছোট ছোট গ্রাস, পরম যত্নে ডলি, ফকলুকে মাতৃস্নেহে হাতে করে
খাওয়াচ্ছে। খাওয়াবার চেষ্টা করছে বললেই বোধহয় ঠিক বলা হবে, কারণ সেই গ্রাসের
সিংহভাগই মুখ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
আমরা পশু দর্শন থেকে একেবারে
বঞ্চিত হই নি। কিন্তু তবু মনে হচ্ছিল, আজ একটা পাখির দর্শন না পেলেও আমাদের দুঃখ
পাওয়া উচিৎ হ’ত না। জঙ্গলে গিয়ে পশুপাখির দর্শন তো অনেকেই পায়, আমরাও পেয়েছি,
ভবিষ্যতেও পাব। কিন্তু আজকের ভ্রমণের এই অদ্ভুত স্বাদ, ক’জনের ভাগ্যে জোটে? আমরা
ভাগ্যবান, তাই ডলি ও ফকলুর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। মনে মনে কামনা করলাম
মামা-ভাগনী সুখে শান্তিতে থাকুক।