গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়

নিয়তি

অরুণাচল নামে নতুন রাজ্যের তখনও জন্ম হয় নি। সংক্ষেপে নেফা (N.E.F.A.) নামেই তার পরিচয়। জোরকদমে নতুন রাজ্য গঠনের কাজ চলছে। দুর্গম এলাকা, বহির্জগতের সাথে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, যানবাহন ব্যবস্থা প্রায় নেই, সর্বপরি সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় অনুমতিসাপেক্ষ যাতায়াত। এইরকম একটা অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী, সিভিল-ইঞ্জিনীয়ার স্বপনবাবু কর্মসুত্রে ওখানে গিয়ে হাজির হলেন। দৈনন্দিন জীবন ধারণের অস্বাচ্ছন্দ, এমনকী খাবার বা অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আকাশপথে সরবরাহ করা হলেও, অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কোন কার্পণ্য, সরকার করেন নি। গাড়ি, ভাল কোয়ার্টার্স, চাকর, বাবুর্চী, মালি, ইত্যাদি কোনকিছুরই অভাব নেই। অবিবাহিত স্বপনবাবু তাঁর কাজকর্ম নিয়ে পাহাড়ের কোলে ভালই ছিলেন।
এরমধ্যে স্বপনবাবু বোনের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি আসার জন্য ছুটির দরখাস্ত করলেন। এই বোনকে তিনি ভীষণ ভালবাসেন। ছোটবেলা থেকে সুখে-দুঃখে তাঁরা একসাথে বড় হয়েছেন। শুধু কী তাই? জন্মের আগে মাতৃগর্ভেও ভাই-বোন পাশাপাশি দশ মাস থেকেছেন। তাঁর বোন তাঁর থেকে মিনিট কয়েকের মাত্র ছোট। তাই ছুটি পাওয়া মুশকিল হলেও, অনেক চেষ্টায় সে ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। রিলিভার চার্জ বুঝে নিলেই তিনি গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন।
বাড়ি আসার ঠিক আগে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী প্রেমজী তাঁর সাথে আসার বায়না ধরলো। প্রেমজী সরকারী মাইনেতে তাঁর বাড়ির কাজকর্ম করে, বাগান পরিচর্যা করে। আদপে নেপালের অধিবাসী এই যুবকটি সর্বক্ষণ তাঁর কাছেই থাকে। স্ত্রী স্থানীয় কোন গ্রামে বসবাস করে। স্বপনবাবু তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার নানান অসুবিধার কথা বলেও, তাকে ক্ষান্ত করতে পারলেন না। সে তার মনিবের বহিনের সাদিতে যাবেই, সেইসঙ্গে কলকাতা শহরটাও ঘুরে দেখবে। বাধ্য হয়ে স্বপনবাবু তাঁর রিলিভার ভদ্রলোকটিকে সব খুলে বলে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন এইক’টা দিন হাজিরা খাতায় প্রেমজীকে হাজির দেখিয়ে দেন। কারণ প্রেমজী অত্যন্ত গরীব ও সৎ। নো ওয়ার্ক নো পে-র নিয়ম অনুযায়ী প্রেমজী এই ক’দিনের মাইনে না পেলে, তার পক্ষে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে। নতুন রিলিভার ভদ্রলোকটি সম্মতিসুচক মাথা নাড়ায়, অসুবিধার আর কোন কারণ থাকলো ন। নির্দিষ্ট দিনে প্রেমজীকে বগলদাবা করে স্বপনবাবু দেশের বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।  
স্বপনবাবুর পৈত্রিক বাড়িটি ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে, প্রায় কুড়ি-বাইশ বিঘা জমির ওপর। রাস্তার ধারে বড়  গেট। গেটের পরে ফুলগাছ ঘেরা একটু মোরাম ঢালা রাস্তা, তারপর পাকা বাড়ি। বাড়ির দুপাশে ও পিছনে, কলম করা নানা ফলের গাছ, সবজী বাগান। তাছাড়া বাড়ির পিছনে তিনটি পুকুর। বিয়ে বাড়ির মাছ এই পুকুর থেকেই তোলা হবে। মনিবের বাড়িতে এসে প্রেমজীর মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। এত জমি, এত গাছ, এত ফল, এত ফুল একটা বাড়িতে থাকতে পারে, একথা সে ভাবতেই পারছে না। পুকুর জিনিসটা তার আগে দেখার সৌভাগ্য হয় নি। হবার কথাও নয়। ছোটবেলা থেকে সে নেপালে পাহাড়ের কোলে বড় হয়েছে। সেখানে এ জিনিসটা দেখার সুযোগ ছিল না। বড় হয়ে নেফার জঙ্গলে। সেখানেও এ জিনিস চোখে পড়ে নি। অল্প সময়ের মধ্যে সে বাড়ির সবার আপনজন হয়ে গেল। বাড়ির সব কাজ, এমনকী বিয়েবাড়ি সংক্রান্ত কাজও সে একা হাতে করে দিতে চায়। স্বপনবাবু বাড়ির সকলকে বারবার সাবধান করে দেন— প্রেমজী এখানকার কোন জায়গা চেনে না, এত গাড়িঘোড়াও সে কখনও দেখে নি, তাই তাকে যেন বাড়ির বাইরে দোকান বাজার করতে পাঠানো না হয়।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল। ভোর থেকে প্রেমজীর ব্যস্ততার শেষ নেই। বিয়েটা সুষ্ঠভাবে সুসম্পন্ন করতে কন্যাকর্তার থেকে তার চিন্তা যেন অনেক বেশী বলেই মনে হচ্ছে। পুকুর থেকে মাছ তোলা হ’ল। প্রেমজী নিজ হাতে বড় বড় মাছগুলো একপাশে সাজিয়ে রাখলো। মাছধরা শেষ হলে মাছগুলোর সংখ্যা ও ওজন পরিমাপ করে বাড়ির ভিতর রান্নার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হ’ল। প্রেমজী হাসিমুখে সবাইকে জলখাবার ও চা পরিবেশন করে যাচ্ছে। সকলেই প্রেমজীকে সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য, স্বপনবাবুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
হঠাৎ বিয়েবাড়ির রান্নার জায়গা থেকে একটা চিৎকার চেঁচামিচি শোনা গেল। সকলের গলা ছাপিয়ে প্রেমজীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কী হয়েছে বুঝতে না পেরে স্বপনবাবু ছুটলেন গোলমালের জায়গায়। পিছন পিছন আরও অনেকেই বিপদের আশঙ্কায় স্বপনবাবুকে অনুসরণ করলেন। অকুস্থলে গিয়ে দেখা গেল গোলমালের কারণ মাছ চুরি। রান্নার কাজে ব্যস্ত ঠাকুর ও তার দলবল, তাকে মাছের লেজার দিকে আঙ্গুল দিয়ে গুণে  দেখালেও সে বিশ্বাস করছে না। তাকে গুণে দেখতে বললে সে বলছে যে সে বার বার গুণে দেখেছে দুটো  মাছ কম। স্বপনবাবু সব শুনে তাকে গুণে দেখতে বললে, সে আবার মাছের মুড়োগুলো গুণে দেখালো যে দুটো মাছ কম। এতক্ষণে আসল রহস্য প্রকাশ পেল। যতগুলো মাছ পুকুর থেকে ধরে আনা হয়েছিল, গুণতিতে সবকটা মাছ থাকলেও দুটো মাছ মুড়োহীন। দেহের প্রায় অর্ধেক অংশ নিয়ে তারা আর সব মাছের সঙ্গে একই জায়গায় শুয়ে আছে। আসলে ঐ দুটো মাছের মুড়ো অন্যান্য মাছের দেহের নীচে ঢুকে থাকায় তার হিসাব মিলছিলো না। একটা একটা করে সব মাছ তার সামনে গুণে দেখানোর পরে, সে তার অডিট পর্ব সম্পন্ন করে শান্ত হয়ে ফিরে এল।
সারাটা দিন হৈচৈ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। বিকালের দিকে প্রেমজীর খোঁজ পড়লো। বাড়িতে, বাগানে, পুকুর পাড়ে, রান্নার জায়গায়, বড় রাস্তার কোন দোকানে, কোথাও তার দেখা মিললো না। ক্রমে খোঁজার ধরন বদলে গেল। বাড়ির অতিথিরা, বিশেষ করে মেয়েরা, সে কিছু হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সকলের মন জয় করে কার বাড়ির কোন চাকর কিভাবে জিনিস হাতড়ে পালিয়েছে, তার বর্ণনায় ছোটখাটো একটা মহাভারতের আকার নিতে, বাড়ির মেয়েরা প্রেমজীকে খোঁজা ছেড়ে, নিজের পরিবারের কিছু খোয়া গেছে কিনা খুঁজতে বসে গেল।  
এইভাবে আরও অনেকটা সময় কেটে গেল। স্বপনবাবু এবার সত্যিই ভয় পেলেন। কোথায় যেতে পারে, ও তো এখানকার কিছুই চেনে না। এমন সময় একজন এসে খবর দিল, পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে একটা লাইফবয় সাবান রাখা আছে। স্বপনবাবু ছুটলেন পুকুর পাড়ে। পিছন পিছন অনেকেই ছুটে গেলেন। কোথাও কিছু দেখা গেল না। স্বপনবাবুর নির্দেশে দু’জন মালি পুকুরে নামলো এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রায় সিঁড়ির কাছ থেকেই প্রেমজীর দেহটা তুলে আনলো। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকা হ’ল। ডাক্তার জানালেন তার দেহে প্রাণ নেই। পুলিশে খবর দেওয়া হ’ল। পুলিশ না আসলে মৃতদেহ কোথাও নিয়ে যাওয়াও যাবে না। অথচ গোধুলি লগ্নে বিয়ে হওয়ায়, পাত্র আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে পুলিশ এসে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে মৃতদেহ নিয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাত্রপক্ষ এসে হাজির হ’ল।
স্বপনবাবু পাগলের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। প্রেমজী যে তাঁর সাথে এসেছে, এটা তাঁর রিলিভার ছাড়া আর কেউ জানে না। প্রেমজীর স্ত্রীকেও বলতে বারণ করা হয়েছিল, কারণ তাকে হাজিরা খাতায় হাজির দেখানোর ব্যবস্থা করে আসা হয়েছে। প্রেমজী তার স্ত্রীকে বলেছে কী না তাও জানা নেই। যাহোক শ্মশানের নীরবতায় বিবাহ সম্পন্ন হ’ল। রাত কাটলো, ক্রমে পাত্রপক্ষের ফিরে যাবার সময় হয়ে গেল। স্বপন বাবু কাল থেকে জল পর্যন্ত স্পর্শ করেন নি। তাঁর মুখ থেকে একটা কথাই বার বার শোনা যচ্ছে— “কোন মুখ নিয়ে ওখানে ফিরে যাব? ওর স্ত্রীকে কী জবাব দেব? অফিসেই বা কী বলবো”?
তিনদিন এভাবে কেটে গেল। বিবাহপর্ব সম্পন্ন হলে স্বপনবাবু রিলভারকে সমস্ত কথা ফোনে জানালেন। উত্তরে রিলিভার তাঁকে দ্রুত ফিরে আসতে উপদেশ দিলেন। একা ফিরে যাওয়ায় তাঁর ঝুঁকি কতটা, তাই নিয়ে বাড়িতে বিস্তর আলোচনা হলেও, এই অবস্থায় ঠিক কী করণীয়, কেউই ঠিক করে উঠতে পারলেন না। হুট করে ওখানে অন্য কারো যাওয়াও সহজসাধ্য নয়। শেষে ঠিক হ’ল প্রথমে স্বপনবাবুর দাদা ওখানে যাবেন। পরিস্থিতি বুঝে তারপর স্বপনবাবু নিজে যাবেন।
স্বপনবাবুর এক ভগ্নীপতি বনবিভাগের কর্মসুত্রে বনগাইগাঁও থাকেন। তিনি চোরা পথে সরকারী অনুমতি ছাড়াই স্বপনবাবুর দাদাকে নিয়ে একজন পরিচিত স্বানীয় লোকের সাথে ওখানে যাবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন। স্বপনবাবু তাঁর দাদার হাতে রিলিভারের উদ্দেশ্যে একটি চিঠিও লিখে দিলেন।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ওরা দু’জন এক বিকালে স্বপনবাবুর অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রিলিভার ভদ্রলোক  তখন কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। এদের দু’জনকে দেখে তিনি বাইরে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে আলোচনা শেষে সবাই চলে গেলে, রিলিভার ভদ্রলোক এদের দু’জনকে ডেকে বসতে বললেন। স্বপনবাবুর দাদা ও ভগ্নীপতি স্বপনবাবুর চিঠিটা তাঁর হাতে দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোক চিঠিটা পড়ে বললেন, “আমি অবশ্য প্রেমজীকে হাজিরা খাতায় একদিনও হাজির দেখাই নি। অবশ্য অনুপস্থিত হিসাবে অ্যাবসেন্ট্ মার্কিংও করি নি। আমি ভেবেছিলাম ফিরে এসে কাজে যোগ দিলে, স্বপনবাবু যা ভাল বোঝেন করবেন। এখনতো মনে হচ্ছে হাজির না দেখিয়ে ভালই হয়েছে, তা নাহলে বিপদে পড়তে হ’ত”।
জানা গেল প্রেমজীর মৃত্যু সংবাদ তার স্ত্রীকে জানানো হয়েছে। তার স্ত্রী একদিন এসে খুব কান্নাকাটি করে গেছে। যাহোক্, তার স্ত্রীকে খবর পাঠানো হ’ল। অনেক্ষণ পরে তার স্ত্রী আরও দু’চারজনকে সঙ্গে করে অফিসে এসে হাজির হলে স্বপনবাবুর দাদা তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। প্রেমজীর স্ত্রী বললো, যে তার স্বামী স্বপনবাবুকে ভীষণ ভালবাসতো বলে সে তাঁর সাথে কলকাতা যাওয়ায় কোন আপত্তি করে নি। তার কপাল মন্দ, তাই সেটাই তার শেষ যাওয়া হ’ল। তার হাতে বেশ কিছু টাকা সাহায্য হিসাবে দিয়ে স্বপনবাবুর দাদা বললেন যে তিনি তাঁর ভাইকে বলবেন, যাতে তার কোন একটা কাজের ব্যবস্থা করা যায়।
কোনরকম ঝামেলা না হওয়ায় পরদিন তাঁরা আবার আগের মতো চোরাপথেই বনগাইগাঁও যাত্রা করলেন। যথাসময়ে স্বপনবাবু কাজে যোগ দিলেন।