ক্যারাটে শেখে একটা ৬ বছরের ছেলে
লাপ্পু, এই নামেই সে বেশি পরিচিত সবার কাছে। লাপ্পু থাকে নিউ ইয়র্কের লং
আইল্যান্ডে। ১১ বছরের টুকিদিদি আর ছোট্ট ভাই যায় ক্যারাটে শিখতে...দিদি হলুদ বেল্ট
পেয়েছে । তাই দিদির ক্লাশ ১ ঘন্টা বেশী। প্রথম প্রথম খুব কেঁদেছে লাপ্পু, কারণ দিদি কেন বেশি করবে আর দিদির বেল্ট এর রং কেন হলুদ। সে তো কালো
বেল্ট পরে। দিদি আবার ছোড়া নিয়েও কি সুন্দর খেলা শেখে। মাথায় হেলমেট পরে। একটা বডি
গার্ডদের মতন আবার ব্লেজার গায়ে দেয়, হাতে থাকে কি সুন্দর
গ্লাভস। কিন্তু ও তো সবার ছোট তাই লাপ্পুর ড্যাডির ইচ্ছে নয় ওর চেয়ে বড়দের সাথে ও
শিখুক। পরীক্ষাও দিতে হবে। তাই লাপ্পুর মাম্মি-ড্যাডি আর গা করেন নি। লাপ্পুর আধ
ঘন্টার ক্লাশ হয়। আর দিদি করে এক ঘন্টা। ওই সময় দিদির শেখার ঘরেই এক কোণে লাপ্পু
বসে থাকে মাম্মির সাথে একটা লম্বা স্টুলে। আরো অনেকজন থাকে সেখানে। একদিন ক্যারাটে
স্কুলর ইনচার্জ মিঃ রবার্ট পাওনে এসে লাপ্পুর পাশে বসলেন। নাদুস-নুদুস ছেলেটাকে
যেই দেখে সেই ভালবেসে ফেলে। কাজেই উনি এসেই লাপ্পুর পাশটিতে বসলেন। এইবার লাপ্পুর
সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। “তোমার স্কুলের নাম কি? তুমি কোন ক্লাশে পড়ো? পড়তে ভালো লাগে তোমার?
কোথায় থাকো? বাড়িতে কে কে আছে? তোমার জন্মদিন কবে?” লাপ্পু তো কুটুস কুটুস
করে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। জন্মদিন তার ১৪ই এপ্রিল তাও বলেছে। তখন মিঃ পাওনে
ওকে জিগেস করেছে্ন তাহলে জন্মদিন তো চলে গেছে। তুমি কি করেছ তোমার জন্মদিনে।
লাপ্পু আবার টুক টুক করে বলেছে, সে ড্যাডির সাথে সকালে
বলিং করতে গেছিল বাড়ির সামনের পার্কে। তারপর সেখান থেকে সুইমিং করে, আর সব ওর বন্ধুদের সাথে 'চাকি চীজ' এ খেয়েছে পিসজা আর চকলেট আইস্ক্রিম। সে চকলেট আইস্ক্রিম খেতে খুব
ভালবাসে তাও বলে নিয়েছে। তখন মিঃ পাওনে আবার জিগেস করেছেন, “তুমি গিফট ভালবাসো?” -হ্যাঁ, আমি অনেক গিফট পেয়েছি। -তোমার কোন গিফট টা
সবচেয়ে ভালো লেগেছে? বলবে? একটু
চুপ থেকে লাপ্পুর তুড়ুক জবাবঃ -আমার কাকু এসেছিল, ওটাই আমার বেস্ট গিফট।
মিঃ পাওনে 'কাকু' মানে বুঝতে পারেন নি। লাপ্পুর মাম্মিকে জিগেস করেছেন, “ কাকু কথাটার মানে কি?” মাম্মি বলেছেন ওর আঙ্কল
হয়। তখন মিঃ পাওনের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। অবাক হয়ে জিগেস করেছেন? “কেন ওর কাকু কি আসেন না?” মাম্মির উত্তর,-
“আসলে কাকু ত ডাক্তার । তাই আসতে পারেন না ৮ ঘন্টা ড্রাইভ করে সব
সময়।” অবাক হয়ে মিঃ পাওনের আবার প্রশ্ন লাপ্পুকেঃ “
কেন তুমি অন্য গিফট এর চেয়ে তোমার কাকুর আসার গিফট টা বেস্ট?
বলবে্” -ছোট্ট লাপ্পু আর দেরী করল না। ভাবার
সময়ও দিল না নিজেকে, বললঃ “আমি
ভালবাসি কাকুকে। তাই কাকু আমার বেস্ট গিফট।” সত্যি এর ওপর
আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। রবিঠাকুর থাকলে বলতাম তোমার প্রশ্ন ছিল, “ভালবাসা কারে কয়?” ভালবাসার কোন সঠিক
ভোকাবোলারি নেই, রবিঠাকুর। এর কোন ব্যাখ্যা নেই। কে বলল
ছোটদের মানবিকতা প্রকাশ পায় না। তাহলে না শেখালেও কিভাবে বলল ৬ বছরের লাপ্পু।
দুনিয়াটা কি আবার আগের যায়গায় ফিরে যাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ
এক যায়গায় বলেছিলেনঃ শিশুদের বুদ্ধির কাছে আমাদের ও হার মানতে হয় মাঝে মাঝে”।
গুড্ডু
গুড্ডু থাকে টেক্সাস এর
ফ্রিস্কোতে। সেদিন ওর বাড়ির সামনের বাড়িতে ছিল একটা জন্মদিনের পার্টি। গুড্ডুর
বন্ধু হল আয়ন। আয়নের দিদি মিস্টির ১৩ বছরের জন্মদিন। মিস্টির এক মাসী থাকে
ফ্রিস্কো থেকে বেশ একটু দূরে । মাসী আর মেসো ড্রাইভ করে আসবেন মিস্টির জন্মদিন
উপলক্ষ্যে। মিস্টির ড্যাডি গিয়ে ওনাদের নিয়ে আসবেন। কথা সেই রকম কথা হয়ে আছে। নির্দ্দিষ্ট
দিনে ওনারা মিস্টির ড্যাডির সাথে গিয়ে পৌঁছলেন বাড়িতে। মাসী যেই গাড়ি থেকে নেমেছেন
হঠাৎ ধুপ করে একটা প্রণাম এসে পরল পায়ে। সব কিছুই কিন্তু চোখের নিমেষে ঘটে গেল।
মাসী ভাবলেন, আয়ন বোধহয়। তাই এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও আয়নকে আর দেখতে পেলেন না। একটা
ছিপছিপে গড়নের ছেলে ওনারা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। মাসী মেসো ত অবাক। মাসীর ছোট বোন তখন
দিদি জামাইবাবুকে আপ্যায়ন করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মাসীর চোখ সেই খুদেটার
দিকে।। -হ্যাঁরে বনু! এই ছেলেটা কে তো চিনতে পারলাম না
রে। কে রে, এই সোনা ছেলেটা? -ওহ!
গুড্ডু? ও আমাদের বাড়ির সামনে থাকে। ওরা পাজ্ঞাবী। আয়নেরই
বয়সি। -তাই নাকি? হঠাত আমাকে
প্রণাম করল কেন রে? -জানি না অতসব! তোমার হয়েছে সবটাতেই
খুঁটিনাটি জানতে হবে। চলো তো ভেতরে। মাসী গুড্ডুকে বুকে চেপে ধরলেন চোখভরা জলে।
মনে মনে ভাবলেন, আজকাল তো প্রণাম এর চল উঠে গেছে। এমন কি
ফোনেও একটু প্রণাম, তাও বলতে পেছপা হয় আজকালকার জেনারাশন।
সেখানে এমন সুন্দর ভাবে প্রণাম, একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে
পড়লেন। চলে গেলেন সেই আগেকার দিনে। বাড়িতে বড় কেউ এলেই বাড়ির সবাই আগে প্রণাম দিয়ে
আপ্যায়ন করত। আর এখন তো দেখাই যায় না বাড়ির ছোটদের। জন্মদিনেও দেখা যায় বাচ্ছারা
এসে চুপচাপ চলে যায় বন্ধুদের ঘরে। যেন একটা সোজা ইকোয়েশন। এইবার এল গুড্ডুর মা। গুড্ডূর
মার নাম সুপ্রিয়া। ওর সাথে আলাপ করিয়ে দিল। মিস্টি্র মাসী বরাবরই কলকাতার বাইরের
প্রবাসি বাঙালি। হিন্দিটা মোটামুটি ভালই পারেন বলতে। আলাপ জমে উঠল।মাসী এবা রজিগেস
করলেন সুপ্রিয়া কে, “ আমি অবাক হয়ে গেছি তোমার ওইটুকু
ছেলের কান্ড দেখে। সে তো ঘাবড়ে গিয়ে বলে ওঠে, “কোই খাস
বাত হ্যায় , দিদি?” -না
না...উস্কো প্রণাম কিসনে শিখায়া সুপ্রিয়া? -ম্যানে দিদি। বলিঃ
কোই শাড়ি পহেনকে আয়ে গি তো প্রণাম করনা বেটা। -আমি ওকেও
জড়িয়ে দরলাম। বল্লাম, আমি তো স্ট্রেঞ্জার, কিন্তু ও তোমার কথা রেখেছে। খুব খুশি হয়েছি সুপ্রিয়া। দুজনের চোখেই তখন
জল।