যাহ্ বাবা কোথায় ভেবেছিলাম আজ
একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাব সেটাও হলোনা । ধুস ! জানলার পর্দাটা টেনে রাখতে ভুলে গেছি
কাল। যাকগে ! উঠেই পড়ি। নাহ উঠবো না। আজ কোন কাজ নেই, অফিসও নেই।
কাজের মেয়েটার আসার সময় পেরিয়ে গেলো,নিশ্চয়ই ব্যাটা ডুব
দিয়েছে। উফ ,বাঁচা গেল। নিজের মনে কথাগুলো বলে পাশ ফিরলো
স্বর্ণকমল।আচ্ছা কাল রাত্রে গ্যাসটা অফ করেছিলাম?ভাবতে
ভাবতে তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে রান্না ঘরে দৌড়ল। নাহ , আর শোব না। আজ বরং একটা ছবি আঁকব। অনেকদিন আঁকাই হচ্ছেনা কাজের চাপে। সাইকেলটা
রেখে হাঁটতে লাগলো। লাল আঁকাবাঁকা পথটা দিয়ে হাটতে খুব ভাল লাগে ওর।কোথায় কোলকাতা
শহর আর কোথায় এই ছোট্ট জায়গাটা ! এখানে চাকরিটা সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে আঁকার
সরঞ্জাম নিয়ে স্বর্ণকমল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে।ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশনের
কাছে একটা চা দোকানে পেয়ে ভালোই হয়েছে।ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল সে। যেখানে রাস্তাটা
হঠাৎ উঁচু হয়ে গেল সেখানটা টপকে ডান দিকে ঘুরেই একটা তিন রাস্তার মোড় পড়লো।এই
জায়গাটার নাম কলেজ মোড় । স্টেশন থেকে হেঁটে এলে দশ মিনিট লাগে।এই মোড় থেকে একটা
রাস্তা আরা-র দিকে গেছে। সেই রাস্তা ধরে দশ মিনিট হেটে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে ,স্বর্ণকমল শুনেছে,সেই গ্রামটা নাকি ছবির মত
সুন্দর।গ্রামের বাইরে একটা প্রকান্ড দিঘি আছে ।দিঘির জলে বড় বড় গাছের ছায়া পড়ে,পুকুরে সারি সারি হাঁস সাঁতার কাটে,ছেলে-মেয়ের
দল জলের মধ্যে লাফায় ঝাঁপায়। গ্রামটাতে পৌঁছে একটা প্রকান্ড বট গাছের নিচে বসে পড়ল
স্বর্ণকমল। ঝোলা থেকে একে একে সব বার করে আঁকা শুরু করল। কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে
ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলো ,”বাবু কি আঁকছো?”স্বর্ণকমল বলল ওইযে প্রকাণ্ড বটগাছটা দেখছো,ওটা
আঁকছি। ওর দুঃখ-সুখ আঁকছি ,ওর প্রেম আঁকছি।বলতে বলতে মনে
হয় কিছুতা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিলাম।। মেয়েটি বলল,” বাবু
তুমি কি বলছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা”।আমি বললাম,ঐতো, ঐতো,
সামনের বটগাছটা দেখছো ওটাই আঁকছি।মেয়েটি বলল,” বাবু,বটের ঝুরি গুলো গাছের ডাল থেকে মাটিতে
কেন নামে ?”আমি বললাম,এটাই বট
গাছের বিশেষত্ব। মেয়েটি কি বুঝলো জানিনা,আমার কথা শুনল
কিনা তাও জানিনা।মেয়েটি বলল ,”বাবু আমার ও বটের ঝুরির মত
লম্বা—চুল আছে ,এই দেখো ।বলে
মস্ত খোঁপাটা আলগা করে দিল।”আমার মনে হোল আমার সামনে একটা
নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর কালো গভীর জলে ঢেউ খেলতে লাগলো,হাওয়া
লেগে।আমার হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো হয়ে গেলো।আমি বললাম তোমার নাম কী নদী? মেয়েটি বলল,আমার নাম বুলান।মেয়েটি আবার প্রশ্ন
করল,”বাবু গাছের পাতা গুলো দেখে তোমার কী মনে হয়?”আমি বললাম তোমার কী মনে হয়?মেয়েটি বলল,”কচি কচি গোলাপি পাতা গুলো আমাকে বলে,জীবন খুব
সুন্দর।জীবনকে খুব যত্নে রাখতে হয়।আগলে রাখতে হয়।নরম নরম হাল্কা সবুজ পাতা গুলো
বলে,জীবনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয় আর গাঢ় সবুজ পাতাগুলো
বলে,জীবনে অনেক ঝড়,ঝাপ্টা সয়ে
বেঁচে থাকতে হয়।যন্ত্রনায় কষ্টে নীল হয়ে গেলেও জীবনটাকে বাচিয়ে রাখতে হয়।বলে
মেয়েটি একটি হাত সামনে বাড়িয়ে বলল,বাবু ঠিক বলেছি কী?”মনে হোল যেন বটের একটি সরু ডাল গায়ে এসে ঠেকলো। আমি বললাম-হুম। মেয়েটি
বলল,”বাবু বট গাছের লাল ফল গুলোর কথা তোমার বইয়ে কী লেখা
আছে?”আমি বললাম,এটাই লেখা আছে যে,ফল থেকে নতুন চারা জন্মায়।মেয়েটি বলল ,”হুম”।“সবুজ পাতার ভিতর লাল লাল ফল গুলোর জন্যই
পাখি আসে,ঠুকরে ঠুকরে খায়, ফল
গুলো লাল সুন্দর বলেই তো গাছটার যত জ্বালা।নাহলে কেউ ঠুকরাতো না ।না গো বাবু?”কথা ফুরোতে না ফুরোতে মেয়েটি ধূমকেতুর মতো উধাও হয়ে গেল। আমি এদিক –সেদিক খুঁজতে লাগলাম। একটি মাঝবয়সি লোক উল্টো দিক থেকে আসছিলেন।গ্রামের
মধ্যে অচেনা লোক দেখেই বোধ হয় জিজ্ঞেস করলেন,”বাবু এ গাঁয়ে
? কাদের বাড়ি এসেছেন ?আমি বললাম
নানা কারো বাড়ি না ? কাউকে খুঁজছেন মনে হোল তাই জানতে
চাইলাম।আমি পাশাপাশি তিন গাঁয়ের লোককে চিনি!”আমি বললাম না
মানে--- বু-লা-ন—। লোকটি হো হো করে হেসে বললেন,” আর বলতে হবেনা ,এবার বুঝেছি। পাগলিটা খুব
জ্বালিয়েছে তো! ওর কথায় কিছু মনে করবেন না বাবু।ছোটবেলায় বাপ-মা মরা মেয়ে মাথার
ঠিক নেই। মেয়েটার জন্যে গাঁয়ের মাথা হেঁট হয়ে যায়।মেয়েটা মরলে গাঁয়ের হাড় জুড়োয়।কি
পাজি মেয়ে জানেন ? যখন তখন গাছে উঠে বসে থাকে।আচ্ছা বলুন
দিকি পড়লে কি কান্ড হবে ? মেয়েটার মাথাটা এক্কেবারে খারাপ
,বুঝলেন।যাকগে ওর কথায় আপনি যেন কিছু মনে করবেন না”।বলে লোকটি চলে গেল। এবার আমি আঁকায় মন দিলাম।আমার ক্যানভাস আস্তে
আস্তে ভরে উঠছে।দেখলাম ক্যানভাসে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠলো, চুল এলানো একটি মেয়ে।মেয়েটি সরু হাতদুটো দিয়ে ঢেকে রেখেছে তার দীঘল
চোখের লাল বটফলের মত মণিদুটো।দশটা আঙুলে গোলাপী হালকা সবুজ ,আর গাঢ় সবুজ রং।ছবিটা হঠাৎ বলে উঠলো “বাবু,তুমি আমাকে এঁকেছো ? তুমি যে বলেছিলে বট গাছ
আকবে? আমি বললাম তাইতো এঁকেছি।মেয়েটি বললো এ বটের নাম কি?
আমি বললাম বুলান –বট।