মেঘের দুপুরে নিজের ছায়াকে সনাক্ত
করা যতটা কঠিন তার চেয়েও জটিল অনীকদাকে চেনা ।কখন যে কি করে বসে তা আন্দাজ করা
মুশকিল । শুধু মুশকিল নয় বিশ্বাস করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে অনেক সময় । প্রথম পরিচয় কখন
কিভাবে হয়েছিল মনে নেই তবে প্রতিদিনই তাকে রহস্যময় মনে হত । মানুষটাকে কি আমি আজও
চিনি ? নিজেই তো জানিনা । চেনা অঙ্কের মত মনে হলেও শেষ লাইনে এসে থমকে গেছে
উত্তর । ধরতে গিয়েও চ্যাং মাছের মত পিছলে গেছে বারবার । এখন যে মানুষটি আমার সামনে
দাঁড়িয়ে সে কি সত্যিই অনীকদা ? নিজেকেই প্রশ্ন করি ।জিজ্ঞাসার
বৃত্তে ঘুরে যায় স্নায়ু । বহিরঙ্গে অনীকদার কোন ছাপ নেই । লাল টুপি যা তার অবয়বের
সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবেই, আজ নেই । দাড়ি গোঁফ
সুন্দর ভাবে কামানো । অথচ অনীকদা মানেই এলোমেলো বিন্যাস বর্জিত ফিদেল কাস্ত্রো
দাড়ি । ছন্নছাড়া আধ ময়লা হাফ সার্ট । উদভ্রান্তের মত এক দীর্ঘশ্বাস । আজ সেসব
কিছুই নেই । বেশ স্মার্ট , রিলাক্সড ও সুন্দর লাগছে তাকে
। ডাকলাম – কি ব্যাপার অনীকদা , তোমাকে
বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে , ফ্রেশ । তুমি তো এমন ছিলেনা ।
প্রেমে পড়লে না কি ? - খেপেছিস ? - দেখে তো তাই মনে হচ্ছে । কি ব্যাপার দাদা ? - পরে
শুনিস। সে অনেক গল্প ।কেমন আছিস ? - ভাল নেই । - -কেন ? কি হল ? - অনেকদিন
তোমাকে দেখিনি প্রান ভরে। - তাই ? ফুসফুস ভরা এক অলৌকিক হাসি হাসল অনীকদা - এবার
রোজ দেখা হবে । প্রাণ ভরে যতখুশি দেখিস । ডেলি দেখলে ভাল লাগবেনা, আকর্ষণ কমে যাবে বৈচিত্র্য মুগ্ধতাও । - বাড়তেও
তো পারে ।
- চান্স নেই। গালাগালি ছাড়া আমার আর কোনো
পুরস্কার নেই। আসি রে, অনেক কাজ । পরে কথা বলব । -
হ্যাঁ , দাদা । তোমার অফিসের দেরি হয়ে
যাচ্ছে । - অফিস ? সে তো চারদিন
হল ছেড়ে দিয়েছি । তোরা জানিস না ? অনীকদা ফিরে তাকাল আমার
দিকে । - ফালতু ইয়ার্কি করছ কেন বস । ঠিক এভাবেই বেরিয়ে
এল কথাগুলো । - অন গড বলছি । তবু বিশ্বাস হয়না । এরকম কথা
অনীকদা বহুবার বলেছে । বারবার শুনতে শুনতে কবেই তো গুরুত্ব কমে গেছে সেসব কথার ।
-বিশ্বাস কর দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে গিয়ে অনেক ভুগেছি। না নাটক না
চাকরি কিছুই তো সামলাতে পারিনি । চা না কফি এই দ্বন্দ্বেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর
। ভুল রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কবেই তো হারিয়ে গেছে আসল রাস্তা । আমি অনীকদার দিকে
তাকাই , তার চোখের লিপি পড়তে থাকি , এ কি কোনও নাটকের সংলাপ ? -শেষ পর্যন্ত আমি
পেরেছি । অনেক দিন পর ... অনীকদা কে থামিয়ে দিই মাঝপথে । তুমি কি পাগল হয়ে গেছ
দাদা ? -আজ নয় অনেকদিন আগেই । পাগল ছাড়া কেউ নাটক করেনা,
কবিতা লেখেনা । জানে এতে পয়সা নেই , যশ ভালোবাসা
, খ্যাতি নেই... শুধু গালি। তালি দেওয়ার কেউ নেই । আজ চলি
। বলে ঝড়ের গতিতে চলে গেল অনীকদা । ব্যাপারটাকে আমি সত্যি মনে করিনি সেদিন ।
প্রলাপ নাট্য সংস্থার সাথে আমার যোগাযোগ অনেকদিনের । শিশুশিল্পী হিসেবে দু একবার
অভিনয়ও করেছি ছোটবেলায় । প্রলাপ – অনীকদার নিজের হাতে
তৈরি । তার ঘর উঠোন । তার জীয়ন কাঠি । ততটা সংসারী নয় অনীকদা । বউ ছেলে মেয়ে সবই
আছে অথচ সম্পর্কহীন নিরাসক্ত । একে একে সবাই ছেড়ে গেছে তাকে । ছাড়তে পারেনি তার মা
। রোজগার পাতি মন্দ নয়। বেসরকারি চাকরি । চাকরি ভাল লাগেনা বলে মাঝে মাঝে
without pay . নাটকের দল নিয়ে দূর দূরান্তে যেতে হয় , অফিস কামাই । নাটকের প্রস্তুতি ,অফিস কামাই ।
প্রচুর মাইনে কাটা যায় । চাকরিটা যাব যাব করেও যায়নি । এসব নিয়ে সংসারে নানা
অশান্তি ।ঝুট ঝামেলা দাম্পত্য কলহ । সুমিতা বৌদি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই অনীকদাকে
ছেড়ে চলে যায় । ছেলে মেয়ে দুটো তখন ছোট । এসবকথাও নিঃসংকোচে অনীকদা বলেছে আমার
কাছে – সবার কি আর সংসার ভাল লাগে ? - এখনও সময় আছে , তুমি বৌদিকে বোঝাও । - বুঝিয়ে হয়ত আবার নিয়ে এলাম । কিন্তু আমার জীবন তো বদলাতে পারব না ।
- নিজেকে অন্তত একটু বদলাও , সামান্য ।
- পারবোনা , বিশ্বাস কর আমি পারবো না । এসব
কথা বলার সময় তার গলার কম্পাঙ্ক আমি অনুভব করেছি । চোখে অশ্রুভাস কিম্বা মুখে
দুর্ভাগ্যের কোন অভিব্যক্তি লক্ষ করিনি সেদিন । পরে অনেক পরে একদিন কথায় কথায়
বলেছিল – সুমিতাও ভুল বুঝল , দুজন
মানুষের বাঁচার সংজ্ঞা যখন পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায় তখন হাত ছেড়ে দেওয়াই উচিত ।
...। এই প্রথম আমি অনীকদা কে মঞ্চের বাইরে কাঁদতে দেখেছিলাম । আরও অনেককথা ছিল
হৃদয়স্পর্শী আত্মা নিংড়ানো । আজকের অনীকদাকে কিন্তু ততখানি সিরিয়াস মনে হল না আমার
।
২ ঐ দেখ স্বর্ণ মৃগ দূরে...। মায়ার
ছলনে ভুলি
কি যেন হারায়ে খুঁজি আজ । কই সীতা ? আনন্দ উৎসব সুখ
চুরি করে নিয়ে গেছ তুমি তো রাবণ ।
মাইল মাইল দীর্ঘ বনভূমি ...। - কি বকছ অনীকদা
? - প্রলাপ । রামের ডায়লগ বলছি । আমার নতুন নাটক ।
- ডায়লগ শুনতে আসিনি দাদা । - তবে
- তুমি কি সত্যিই চাকরিটা ছেড়ে দিলে ? - কেন ? তোর বিশ্বাস হচ্ছেনা ? তবে দেখ বলে পকেট থেকে রেজিগনেশন লেটার বার করে আনে অনীকদা । এখনও
অ্যাকসেপ্ট করেনি , দু এক দিনের মধ্যেই করবে । দুষ্টু
গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালই ভাল , তা ওরা ভাল করেই জানে।
- আরও ভাবা উচিৎ ছিল তোমার - অসম্ভব ।
অনেক ভেবেছি , বারবার পিছিয়ে এসেছি । আর নয় । - খাবে কি ? তোমার তো জমানো টাকাও নেই ।
- চলে যাবে । যাদের চাকরি নেই তাদের যেভাবে চলে । আমি চুপ করে
থাকি । বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি । কোথায় দাঁড়িয়ে আছি । - চিন্তা
নেই । ৩/৪ টে সিরিয়াল আমার হাতে । যা পাব , আমি আর মা
দুটো তো প্রানি ঠিক চলে যাবে । বুঝতে পারি ফালতু বকছে অনীকদা । কোথাও কিছু নেই ।
বিরক্ত হয়ে উঠি – থামো তো , কি
মনে কর তুমি জীবনটাকে ? নাটক ? থিয়েটার
? রঙ্গমঞ্চ ? - একদম তাই । জীবন
তো এক প্রলম্বিত নাটক । তার বেশি কিছু নয় । অনীকদার হাতেপায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম
। শোনেনি আমার কথা । এরপর আর কোন যোগাযোগ ছিলনা । অভিমান হয়েছিল ভীষণ ।পরে সুমিতা
বউদির সাথে একদিন দেখা হয়েছিল অশোক বস্ত্রালয়ে । সঙ্গে ঋদ্ধি ও ছিল , অনীকদার মেয়ে , এখন কলেজে পড়ে । সব খুলে
বলেছিলাম । - তাহলেই ভাবো এইসব পাগল ছাগল নিয়ে সংসার করা
কত জটিল । - কেমন আছ বৌদি ? - আছি
একরকম । জীবনের চলার পথ অনেকসময় পা ও ঠিকমত খুঁজে নিতে পারেনা । আসি ভাই ।
মানুষটাকে দ্যাখো , খুব চিন্তা হয় ...। এরপর অনেক
ধুলোবালি জমেছে স্নায়ুর পর্দায় । আমাকেও পেটের দায়ে চলে আসতে হয়েছে অনেক দূরে । ৩ অনীকদার
মায়ের মৃত্যুর সময় ওর পাশে থাকতে পারিনি । অফিসের কাজে হায়দ্রাবাদে ব্যস্ত ছিলাম
তখন । ফিরে এসে শুনি সরমামাসি আর নেই । আফসোস হয়েছিল খুব । অনীকদার চোখমুখ তখন
পাগলের মত । অনর্গল বকে চলেছে অসংলগ্ন কথা । অর্থহীন প্রলাপ । দেখতেও ঠিক স্বাভাবিক
লাগছে না । চোখে জল এল । মানুষের গতিপথে কত বাঁক । বিচিত্র রঙের খেলা ছবিঘরের
দেওয়ালে । মাসীমার কথা স্মরনে এল । কত যন্ত্রনা আর কষ্ট নিয়ে বেঁচেছিল একটু সুখ
দেখবে বলে । দেখতে পেল কি ? অনীকদার মুখোমুখি দাঁড়ালাম
এবার । আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল অনীকদা । চোখের জলের
ধারাস্নানে ভিজে যেতে লাগলাম আমরা দুজনে ।
৪ কখনও কখনো খুব দাম্ভিক মনে হত
তাকে । যখন বলত – আমার ঐ সংলাপটা শুনেছিস তোদের শম্ভু মিত্র সাতজন্মেও পারত ওরকম ডায়লগ
ছাড়তে ? রক্তকরবী , চাঁদ বনিকের
পালা যদি আমার হাতে পড়ত কাকে অভিনয় বলে দেখিয়ে দিতাম । শম্ভু মিত্র একদম বোগাস । শুনে
যেতাম সেসব কথা । লোকটা বলে কি – আকাশের চাঁদ আর চাঁদু
পরামানিকের তুলনা । অদ্ভুত মায়া হত । জানতাম বুকের ভেতর কোথাও তরল কষ্ট আছে । শুধু
শিশির ভাদুড়ির প্রসঙ্গ এলে চুপ করে যেত। হাত দুটো মাথার উপর তুলে প্রনাম করে বলত –
গুরুদেব । যেমন শিক্ষিত মানুষ সেরকম ই প্রতিভাবান । নানা ধরনের
নাটক শোনাত । বিদেশি নাটক নিয়েও অদ্ভুত সব কথা বলত , সব
বুঝতাম না । - একটা নতুন নাটক নামাচ্ছি । একদম টাটকা । থিয়েট্রন কনসেপ্টে লেখা ।
সুন্দর এক্সপেরিমেন্ট বলে শুনিয়ে যেত পাতার পর পাতা । শ্রদ্ধায় প্রনত হয়ে উঠতাম ।
নির্ভার মমতায় গিলে খেতাম তার অভিব্যক্তি । যদিও সংলাপ তেমন গতিশীল নয় । আর্থিক
অসঙ্গতি মঞ্চস্থ হতে দেয়নি সেই নাট্যরূপ । সরমামাসিমনির মৃত্যুর পর আরও অভাব নেমে
এসেছিল ঘরে । অগোছালো ছন্নছাড়া ভাব । অনীকদাকে বলতাম – ঘরের
দিকে মন দাও । বউদিকে নিয়ে এসো , আর কেন অভিমান অট্টহাসিতে
আকাশ কাপিয়ে হেসে উঠত অনীকদা – দুদিনের এই মোহ একে তুমি
ঘর বল । যে ঘরের স্বপ্ন দেখে এতদূর হেঁটেছি অক্লেশে ... আর বেশি দূরে নেই...।
-তুমি কি সংলাপ বলছ দাদা ? -না তো ।
স্টেজের বাইরের আলোকিত সত্য । - তোমার আজকের জীবন এ তো
শুধু নাটকের জন্য । সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এভাবে বেঁচে থাকতে ভাল লাগে ? - পছন্দ না হলেও রোলটা খুব চ্যালেঞ্জিং । কাউকে কাউকে তো এ ধরনের চরিত্রে
অভিনয় করতেই হবে । ভারি হয়ে যেত বুকের বাতাস । জমাট বাঁধা কষ্টের পাহাড় ঠেলে
বেরিয়ে আসত দীর্ঘশ্বাস । ৫ অনীকদাকে সম্বর্ধনা জানানোর আয়োজন করেছিলাম আমরা । তার
সমস্ত জীবন তো নাটকের জন্য উৎসর্গীকৃত । ফুল মালা মানপত্র আর কিছু সাম্মানিক ।
সবাই ঝাপিয়ে পড়েছিল কাজটিকে সফল সুন্দর করার জন্য । অনীকদার জীবন ও কাজ নিয়ে একটা
বইও করা হয়েছিল । মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই বার্তা । হাজার হাজার মানুষ এসে
যুক্ত হয়েছিল আমাদের কাজে । কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন তাকে আর খুঁজে পাইনি আমরা ।
মঞ্চ আর আলোর পৃথিবী থেকে সে তখন দূরে অনেকদূরে । তার পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে রাখি ।
অগোছালো অর্ধসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে হবে এখন । পাতার পর পাতা উল্টে যাই । সাজাই ।
কিছু কাজ তো বাকি থাকেই মানুষের জীবনে । আবার কেউ আসবে মঞ্চে ঠিক তার ই মত ...।
স্টেজ অন্ধকার করে দিওনা কেউ আসছে
...।