গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

ডঃ সুজাতা ঘোষ


গভীরে নীল সমুদ্র

সকাল থেকেই আকাশটার গা ম্যাজম্যাজ ভাব। এখনো সূর্যের নাম গন্ধও নেই, সকাল প্রায় ন টা বাজতে চলেছে। আজ রবিবার তাই একটু গাছাড়া ভাব আমার মনের ভিতরেও। সবেমাত্র চা সুখ উপভোগ করে সোফাটার নরম গদির ভিতর যতটা সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে অপেক্ষা করে আছি; হঠাৎ কোন পরিবর্তন হবে ... সেটা ঠিক কি? কি চাই আমি? ওফ আর একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হত। কিছু ভাবতে ভালো লাগে না। শুধু ঘুম পায়। এই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাবটা কেমন যেন একটা নেশা ধরায় সমস্ত শরীরে। নরম কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে আর একটু চোখ দুটো বন্ধ করতে পারলে বেশ হত। না থাক, উঠেই যখন পড়েছি, আর দরকার নেই। অন্যদিন তো এইসময় ক্লাসে ঢুকে লেকচার দিতেও শুরু করে দেই। আজ নেহাত ছুটি, তাই।

সোহম আজ বেশ ভোর ভোর উঠেই অফিসে চলে গেছে। ওকে চা করে দেওয়ার জন্য উঠতে হয়েছে সেই ভোরে, না হলে আর একটু গড়াতাম। সোহম আর আমি, আমি মানে শ্রুতি, বিয়ের পনের বছর পরেও কোন অভিযোগ, রাগ, দুঃখ ছাড়াই বেশ ভালো আছি। কেমন যেন একটা সরকারি চাকরির মত ... ছাড়তে ইচ্ছা করে না, নিশ্চিন্ত আশ্রয় একে অপরকে ঘিরে। ঠিক বলতে পারব না যে, কে কাকে কতটা ভালোবাসি; তবে টান অনুভব করি, ভালো চাই, ভরসা পাই।

একটা আস্তরনের পিছনে অন্য একটা নেশার জগত, অন্য মানুষ, অন্য রঙ, অন্য ইচ্ছা ...কেন? চোখ বন্ধ করলেই অনিশ। কেন এমন হয়? মনের, মাথায়, শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেন ওর অবয়ব ঘুরে বেড়ায়? কেন ছুঁতে চাই ওকে? আস্তে আস্তে গভীর, আরও গভীর হতে থাকে যন্ত্রণা। আমার শরীরের চারিপাশে ঘুরে বেড়ায় সুগন্ধির মত হাল্কা ভালোলাগা ছড়িয়ে।

অনেকগুলো সময় কেটে গেছে, কাজের চাপ বেড়েছে, নতুন জায়গায় বদলি হয়ে এসেছি, একটু একটু করে সংসারটাকে গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। জায়গাটা বেশ অন্যরকম। আমাদের কোলকাতার মতন না, এখানে প্রায় সময়ই ঠাণ্ডা থাকে। আমার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না এখানে আসার, সোহমের বদলির জন্য আমার নিজের সরকারি স্কুলের চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ন অন্য পরিবেশে আসব কেন? সেটার উত্তর পাওয়ার আগেই লাগেজ গুছাতে হয়েছিল আমাকে। অনেক কিছুরই উত্তর পাই না; প্রায় স্ব প্রশ্নগুলোই গোল গোল করে ঘুরে একই সমাধানে এসে থেমে যায় – সোহম যেখানে, শ্রুতি সেখানে এটাই ভবিতব্য। কারন আমরা স্বামী – স্ত্রী।

একটা দীর্ঘশ্বাস ঘুরে ঘুরে পাক খায়, কিন্তু বের হতে পারে না, আবার ভিতরে মিলিয়ে যায়। কেমন যেন একটা একঘেয়ে ভাব আমার গাঢ় লিপস্টিক আর আইশ্যাডোর ভিতর ধোঁয়াশা ছড়ায়।
আমার বেশ ভালো লাগে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে কলেজে নিয়ে যেতে, একটা ভালো লাগা হলুদ প্রজাপতির মত উড়ে উড়ে বেড়ায়, আমি শ্বাস নেই প্রান খুলে।  অনিশ বোধহয়  ব্যস্ত আছে।
সামনেই সেকেন্ড সেমিস্টার, এম. বি. এর ঝাঁ চকচকে আকর্ষনীয় ছাত্র। চারপাশে প্রচুর সুন্দরীরা প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়ায়। তবুও আমি বেশ টের পাই ফাস্ট বেঞ্চে বসে থাকা গম্ভীর সুদৃঢ় মনের দীর্ঘকায় সুপুরুষ চেহারার মধ্যে প্রাণোচ্ছল গভীর চোখদুটি আমাকেই খুঁজে বেড়ায়।

একি শাস্তি, যতই চেষ্টা করি এড়িয়ে চলার ততই কষ্টটা বাড়তে থাকে যাতে একটু একটু করে অস্থির হতে থাকে আমার মস্তিস্ককোষ। ভয় হয়, সোহম কষ্ট পাবে নাতো, ভুল বুঝবে নাতো!

কেপটাউনে আসার পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমার এই কলেজে চাকরিটা জুটে যায় নিজের চেষ্টা, অভিজ্ঞতা আর ডিগ্রির দৌলতে। না হলে কপালে বেশ দুঃখ ছিল যদি সারাদিন বিদেশে এসে রান্না করে কাটাতে হত। সারা দিনরাত পরিশ্রম করে প্রচুর টাকা আয় করা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা আপাতত সোহমের মাথায় নেই। রাতেও বেশ ব্যস্ত থাকে অফিস নিয়ে। আর আমি সারাদিনে কয়েকটা লেকচার, বাড়ি ফিরে রান্না, গান শোনা, আজকাল আবার আর একটা কাজ নতুন যোগ হয়েছে – রুপচর্চা। যা আগে প্রায় ছিল না বললেই চলে। আজকাল নিজেকে কম বয়সী ছাত্রীদের মত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে খুব ভালো লাগে। সোহম মাঝে মধ্যে সময় পেলে অবশ্যই বলে ভালো লাগছে, আমার মনে হয় জীবনটা ধন্য হয়ে গেল। মন আর শরীর এই দুটোই যে ওকে না পেয়ে পেয়ে প্রায় অচেনা ভাবতে শুরু করেছে, তা কি ও বোঝে? আমার ইচ্ছাগুলোর কোথাও যদি অনীশের হাল্কা চাহুনির ছোঁয়া লাগে, তাকি সত্যিই অপরাধ? আমি তো অনেক চেষ্টা করেছিলাম সোহমকে বোঝাতে ...পরিষ্কার ভাসাতেও কখনো বুঝিয়ে বলেছি ...আর এর চেয়ে বেশী কি করতে পারি ?
                
গতকাল গণেশ পূজা ছিল। কলকাতায় থাকলে হয়তো ভাবতেও পারতাম না যে, কেপটাউনে বসে কোন বিদেশিনী গণেশ পূজা করতে পারে। বেশ ভালোভাবেই পূজা হয়েছে, বেশ কিছু ভারতীয় এবং অর্ধেক ভারতীয় পরিবারে। আমরাও উপস্থিত ছিলাম সোহমের বন্ধু জয়ের অ্যাপার্টমেন্টে । ওর স্ত্রী  ফ্লোরা দারুন খিচুড়ি ভোগ দিয়েছিল গণেশজিকে। সন্ধ্যেটা একসাথে ভালোই কেটেছে। রাতে বাড়ি ফেরার পর থেকে মনটা কেমন যেন উসখুস করছে। এপাশ ওপাশ করে ঘুমটা আনার চেষ্টা করছি অথচ চিন্তাগুলো কিছুতেই মুক্তি দিচ্ছে না মনটাকে। পাশে সোহম ভগবান নারায়নের মত সোজা হয়ে বাদিক ঘুরে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। বাধ্য হয়ে উঠে একবার টয়লেটে গেলাম। আলো জ্বলতেই প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে ভাবলাম, আমি এত সুন্দর! এটা মনে আসতেই মনে হল, বোকার মত প্রশ্ন করছি কেন? চোখে মুখে জল দিলাম, ঠাণ্ডা জলের ফোটা গরম গালের তাপে উত্তপ্ত হয়ে গলা থেকে বুক হয়ে হাঁটুতে নেমে গেল। তাকিয়ে রইলাম আমি পায়ের নখের দিকে, সোনালী নেলপলিসটা রাতের আলোতে ভীষণ চোখে লাগছে। সোহম কি এখনো ঘুমচ্ছে? কি করে ঘুমায় একটা মানুষ এত নিশ্চিন্ত হয়ে? ওর কি কখনো ইচ্ছা করে না, আমার মনে উকি দিয়ে দেখতে? কখনো কি মনে হয় না, ওর এত ব্যস্ততার মধ্যে অন্য কোন পুরুষ ঢুকে যেতে পারে চোরাপথে আমার মনে? নাকি কিছু এসে যায় না? এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছে, যাবে।

অনিশ কি করছে? রাতে নিশ্চয়ই ঘুমচ্ছে? একবার ফোন করব? এখন এখানে রাত প্রায় সারে তিনটে, না থাক কি ভাববে, যদি ঘুম ভেঙে বিরক্ত হয় বা ব্যস্ত থাকে পড়ায় কিংবা যদি বুঝতে পেরে যায় ... না না দরকার নেই। আবার মুখে জলের ছিটে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাণ্ডা হাওয়া ভেসে ভেসে এসে আমার সমস্ত নরম গোলাপের পাপড়ির মত শরীরটাতে দাঁতের কামড় বসাচ্ছে ধীরে, বহু ধীরে। ঘুম পাচ্ছে, দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম বিছানায়। সোহম এখনো ঘুমাচ্ছে। অনিশ, তুমি কি ঘুমাচ্ছ? আমার চোখে ঘুম নেই কেন ?
                
প্রতিটা মুহুর্ত সুন্দর হতে হতে স্বপ্নের মধ্যেও অনিশের আবির্ভাব অব্যর্থ। আমি অনুভব করি তাকে আমার সমস্ত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। সোহমের আমার প্রতি উদাসীনতা এখন আর কষ্ট দেয় না আমাকে বরং কোন গুরুত্ব পায় না ওর উপস্থিতি আমার জীবনে। ক্রমশ আরও অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম আমি আর অনিশ। মঝেমধ্যে লাইব্রেরিতে দরকারি আলোচনা, আবার কখনো ক্লাসের শেষে করিডোরে আলতো ছুঁয়ে চলে যাওয়া, কিংবা আমার বাড়িতে সোহমের অনুপস্থিতিতে কিছুটা সময় একসাথে সুন্দরভাবে কাটানো, ভালোই লাগছিল সবকিছু কিন্তু হঠাৎই কেমনযেন সব ওলট পালট হয়ে যায়। অনিশের সাথে নন্দিনীর দূরত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। যা আমার সহ্যের ক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়। নন্দিনী ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। যথেষ্ট সুন্দরী ও মেধাবী। ওদের দুজনের একসাথে পা ফেলার ছন্দ সারা কলেজে ছড়িয়ে পড়েছে হাস্নুহানার গন্ধের মত। আর সেই গন্ধ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতি মুহুর্তে।

সোহম কাজপাগল মানুষ, আমার একাকীত্বের মানে বোঝার ক্ষমতা ওর নেই। নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে নিজেকে মনে হয়, এত তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে গেলাম? চুল সাদা হতে শুরু করেছে, গালে শুকনো খসখসে চামড়ায় অসংখ্য দাগ। হাত ভত্তি ক্রিম ঘষলেও নন্দিনীর মত চকচকে টানটান কিছুতেই হয় না। কি করি? শরীরের ঢেউয়ের খাঁজে খাঁজে মেদ জমতে শুরু করেছে। আজকাল রাতে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি বললেই চলে। তাতে মুশকিল হল, ক্লাসে ঢুকে মাঝে মধ্যে মাথা ঘুড়িয়ে যায়। ঠিক কি যে করব বুঝতে পারি না।

প্রতিদিন নিয়ম করে যোগাসন, ফল, জল ইত্যাদির মধ্যেই আছি। তবুও দিন দিন বেশ বুঝতে পারি যে, অনিশ নন্দিনীর কাছেই এগিয়ে চলেছে, আমাকে পিছনে ফেলে। পুরুষকে বিশ্বাস করা আর বৈশাখে আকাশকে ভরসা করা একই রকম ভুল।
আজকাল আর সাজতে ইচ্ছা হয় না, তবুও হাল্কা একটু মেকাপ দিয়ে নেই, যাতে বয়সটা কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে। নিজের একাকীত্বের সাথে লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করি আর ভাবি আমি সত্যিই সুন্দরী, সোহম এত বছরেও সময় করে উঠতে পারল না আমাকে ভালো করে দেখার। এই যে আমার গোলাপি পাপড়ির মত ঠোঁটের উপর খয়েরি ছোট্ট তিল আছে, ও কি জানে?  কিংবা বুকের বাদিকে বেশ গাড় তিলটা অথবা নাভির উপর কালো তিলটা যেটা আমাকে আরও আকর্ষনীয় করে তুলেছে, জেটার দিকে তাকিয়ে থাকলে গা শিরশির করে ওঠে আমার নিজেরি; অথচ সোহম আজ পর্যন্ত সময়ই করে উঠতে পারে নি। আমার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল হাওয়ায় হাওয়ায়। গোধূলির লালচে সোনা আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। খয়েরি চুলে আঙুল টেনে তুলে নিলাম মাথার উপর, কোনাকুনি দুটি সুডল হাত আর তার নীচে আমার শরীরের উন্মত্ততা লুটোপুটি খাচ্ছে নেশায়। সময় এভাবেই পার হয়ে গেছে আমার জীবনে। তবুও আমি আছি।
                        
তিন বছর হল কোলকাতায় ফিরেছি। এখানে সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই আত্মীয় স্বজন, বন্ধু প্রতিবেশীর আগমন শুরু হয়ে যায়। এখানে রোজই স্যটনাইট। আনন্দে আত্মহারা। এই তো সেদিন পলাশ আর মপিয়া এসেছিল। আমার কলেজমেট দুজনেই। এখন দুই ছেলেমেয়ের বাবা – মা, ভাবা যায়! হাসির মধ্যেও একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। হারিয়ে গেলাম বহু বছর আগে। একসময় পলাশই আমার প্রেমে পাগল ছিল। তখন আমি যাকে তাকে খুব একটা পাত্তা দিতাম না। বাধ্য হয়ে মপিয়াকে রাজি করিয়েছিল ওর সাথে হাত ধরে লেকের ঘাসে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটার জন্য। আজও একইভাবে হেঁটে চলেছে ওরা। আমার পাটাই শুধু থমকে গেছে কবে যেন, টেরও পাইনি।

এখানে আসার পর আর কলেজে যাই না, একটা বাচ্চাদের স্কুলে আঁকা শেখাই কিছুটা সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। মাঝেমধ্যে বাড়ি ফেরার পথে এখানে সেখানে ঢু মেরে আসি। কখনো মেলাতে, কখনো সেলে আবার কখনো শপিং মলে। আজ যেমন হঠাৎই দক্ষিণাপণে দেখা হয়ে গিয়েছিল পলাশের সাথে। কেনাকাটা বন্ধ করে ধোসা খেতে খেতে কত পুরনো গল্প করলাম। এখনো একই রকম আছে, শুধু কি আমিই পাল্টে গেছি? ওঃ, ফোন নাম্বারটা যেন কোথায় রেখেছি? ব্যাগের কোন পকেটে, দেখি তো হাতড়ে, হ্যাঁ, এই তো কার্ডটা পেয়েছি। একবার ফোন করব? কি আর হবে, করিই না ফোন করার জন্যই তো নম্বর দিয়েছে, ...এই তো রিং হচ্ছে, - হ্যালো।
হ্যায়, আমার গোলাপি পরী স্রুতি! বিশ্বাসই করতে পারছি না যে।
শোন না, ব্যস্ত নেই তো? মানে বিরক্ত ...
ন্যাকামটা এখনো ছাড়তে পারলি না? তোর কোনকিছুতেই কখনো বিরক্ত হয়েছি? তোর হাতেই শুধু সময় ছিলনা আমার জন্য। তা, কি করতে পারি আমি আপনার জন্য, হুকুম করা হোক।
কথা বলতে ইচ্ছা করছিল .. তাই ... মানে...
সোহমদা কোথায়?
অফিসে।
হুম, চা - টা কিছু খাওয়া হয়েছে নাকি? যে পরিমাণ জলে ভিজেছিস, কতবার বললাম একটু দাঁড়িয়ে যেতে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছিল যে, কি করব?
বাঃ, এখনো কলেজের ছাত্রীই আছিস দেখছি।
মৌপিয়া কি করছে?
ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে।
সিগারেট খাচ্ছিস? কতবার বারন করেছি।
কি করে বুঝলি? ফোনে গন্ধও পাওয়া যায় নাকি?
বুঝতে পারি।
এই বোঝাটা যদি কুড়ি বছর আগে বুঝতি, তা হলে আমাদের জীবনটা আজকে হয়তো বোঝা হয়ে উঠত না।
তখনও  বুঝতাম।
বাঃ, শুনে খুশি হলাম। মানে, আমাকে শোয়া অবস্থায় লাথি মেরে নীচে ফেললি।
চুপ কর, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কি হবে।
ঠিক, এখনো হাতে সময় আছে, তাই তো?
মানে?
না হলে রাত দশটায় ফোন করলি কেন, নিজের বরকে ফোন না করে?
বাজে কথা কম বল, আমি রাখছি।
পস্তাবি।
মোটেও না।
ঠিক তো? নিজের মনকে একবার জিজ্ঞাসা কর তো।
জানি না রাখছি।
সোহমদা এসেছে?
কি করে জানলি?
গাড়ির শব্দ এল কানে।
ওফ বাবা, তোর কান ... হ্যাঁ এসেছে, ছাড়ছি, পরে কথা বলব।
গুড নাইট।
গুড নাইট।
এই দাঁড়া দাঁড়া, ফোনটা ঠোঁটে চেপে ধর একবার।
কেন?
ধর না।
হাল্কা একটা শব্দ হল। আমি ছিটকে গেলাম ফোন থেকে দূরে।  
       
                
প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে আই. সি. ইউ র সামনে বসে আছি। পলাশও এসেছে খবরটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে। মৌপিয়া আমার উল্টোদিকের চেয়ারে। মুখের দিকে তাকানোর মত সাহস আজ আর আমার নেই। তবুও দু – একবার যতটা দেখেছি আড়চোখে, তাতে ঠিক বুঝতে পারছি না যে, ও কি ভাবছে। একটা কথাও বলেনি এখনো, রাগ- দুঃখ কিছু বোঝার উপায়ই নেই। ও কি সোহমকে দেখতে এসেছে? নাকি পলাশ এসেছে বলেই ............... আমার সামনে আর একা ছাড়তে সাহস পাচ্ছে না? এদিকে পলাশ কখনো পায়চারি করছে, কখনো সিগারেট খেতে বাইরে চলে যাচ্ছে, আবার কখনো একা কোন চেয়ারে বসছে, যেটা আমার বা মৌপিয়া কাররই কাছে নয়। তাহলে কি ও অপরাধ বোধে ভুগছে?

আলোটা কখন নিভবে? তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। সোহমকে বিপদমুক্ত দেখতে মনটা ছটফট করছে। তাহলে কি ওকে কখনো ভালোবেসে ফেলেছিলাম একঘেয়ে অভ্যস্থ জীবনের মধ্যেই কোন এক মুহুর্তে? মনে হয় না, এটা আসলে একটা অনুভূতি।  একসাথে অনেকদিন থাকলে টান নামক একটি ক্রিয়া কাজ করে মনের ভিতর। আমার চোখের সামনে সবকিছু ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এল। আজকে সোহম ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃত্যুর দেশে চিরঘুমে আবদ্ধ হতে চেয়েছিল, এরজন্য দায়ী আমি। কাজ পাগল একটা মানুষ আর যাই হোক, অন্য কোন মহিলার প্রেমে পড়ে আমাকে অন্তত সরষেফুল তো দেখায় নি। হয়তো আমারও উচিৎ ছিল জোর করে তাকে আমার কাছে টেনে আনা, সব মানুষ তো আর একরকম হয় না।

দিনের পর দিন একাএকা থাকতে থাকতে প্রায় কোমায় চলে গেছিলাম আমি। পলাশ এসে ওই কঠিন বাহু দিয়ে আমায় আঁকড়ে না ধরলে কি আর আজ আমিও শ্বাস নিতে পারতাম? ওর মনের গভীরতা, শরীরের উত্তাপ সিঞ্চন করেই তো শ্বাস নিচ্ছে আমার যৌবনের মাদকতায় পরিপূর্ন শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র। পরশু সকালেও আমি জানতাম না যে, আজ এইভাবে আমাদের মুখোমুখি বসতে হবে উত্তর দিতে। সেদিন রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য পলাশ বাড়ি ফিরতে পারে নি। ভোরেই চলে যাবে ভেবেছিল, বিন্তু প্রকৃতি আর শরীরের প্রকৃতি কেউই আমাদের নিয়েন্ত্রনে থাকে না। হঠাৎই ভীষণ দুরন্ত হয়েছিল ও আমাকে পাওয়ার জন্য। এ নতুন কিছু নয়, তবে সেদিন ভাগ্য আমাদের সাথে ছিল না। যখন দুজনে চরম সুখের শেষ মুহুর্তের তৃপ্তি লেহন করছি, ঠিক তখনই সোহম সোজা চলে এসেছিল ছাদের বাগান ঘরে। ওর সেদিন রিও থেকে ইন্ডিয়া ফেরার কথা। হয়তো আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলেই শোবার ঘরে না পেয়ে সোজা ছাদের বাগান ঘরে চলে এসেছিল সাতসকালে। ও জানে অনেক সময় ওই ঘরে ছবি আঁকতে আঁকতে ভোরের দিকে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ি। হাতে কয়েকটা অর্কিডের স্টিক ছিল আমার জন্য। এমন সকাল খুব একটা আসেনি আমার জীবনে এর আগে। সোহম কি তাহলে আমার জন্য কিছু অনুভব করতে শুরু করেছিল? নাহলে ফুল হাতে ... ভাবাই যায় না।

পুরো একটা দিন আমরা কেউ কাউকে কোন প্রশ্ন না করেই এক ছাদের নীচে ছিলাম। আজ ভোরে সোহমের ঘর থেকে আসা একটা শব্দ আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। দৌড়ে গিয়ে দেখি টেবিল ল্যাম্পটা নীচে পড়ে কাঁচের টুকরোগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। তখনো হাল্কা জ্ঞান ছিল, মুখ থেকে গ্যাঁজা বের হতে শুরু করেছিল সবেমাত্র। সঙ্গে সঙ্গে আমি পলাশকে ফোন করি। তাছাড়া আর কিছু আসেনি আমার মাথায়। নিজের বলতে তো এই দুটি মানুষই।

মৌপিয়া হয়তো এতক্ষণে সব  আন্দাজ করতে পেরেছে। শুধু সোহম নয়, ওর কাছেও তো আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে। ওরা কি ক্ষমা করবে আমাকে? নাকি আমার নিজের জীবন শেষ করেই প্রায়চিত্ত করতে হবে? মাথাটা কাজ করছে না একদমই। সোহমের মুখোমুখি দাঁড়াব কোন মুখে? এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওর বাড়ির লোকও খবরটা পেয়ে গেছে। কি জবাব দেব তাদের? এতো কোন দুর্ঘটনা নয়, এতো আত্মহত্যা। পলাশই পুলিশের সাথে কথা বলেছে, পলাশই হয়তো ওর বাড়ির লোককে বোঝাবে। কিন্তু আমি? আমি নিজেকে কি বোঝাব? আমার কোন অধিকারই নেই আর এক মুহুর্ত সোহমের জীবনে থাকার। সোহমের বাড়ির লোক, মৌপিয়া, পলাশ সবার দিকে তাকিয়ে শেষ বারের মত ক্ষমা চেয়ে নিলাম মনে মনে, তারপর সোজা দৌড়ে চলে গেলাম সবার অলক্ষ্যে লিফটের দরজার দিকে। আমি উপরে উঠছি, অনেক উপরে, একটা একটা করে লাল নম্বর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।
ছাঁদে কেউ নেই, চারপাশ ফাঁকা। এটা মনে হয় ন তলা। একেবারে ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। নীচে গাড়িগুলো খুব ছোট ছোট, একেবারে আমার ছেলেবেলার খেলনা গাড়ির মত। সবাই ব্যস্ত, মানুষ – গাড়ি সব দৌড়চ্ছে। শুধু আমারই কোন ব্যস্ততা নেই আজ, আমি সমস্ত বন্ধন মুক্ত। দুহাত মেলে দিয়ে শ্বাস নিলাম জোরে, সমস্ত বুক ভরে। উপরে নীল আকাশ, বিশাল শূন্যতা সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। আমার শরীর ওজনশূন্য হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ার সাথে আস্তে আস্তে। আমি ডুবে যাচ্ছি গভীর নীল সমুদ্রে।  শান্তি, শান্তি আর শান্তি। সমুদ্রের ঢেউ তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমায় আরও গভীরে, যেখানে শুধু নীল আর নীল জড়িয়ে আছে একে অপরের সাথে।।