আত্মগ্লানি
মনোজিৎ কুমার দাস
ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম আমরা দুটিতে। আমরা একই পাড়ায় মানুষ,
একই পাড়ার স্কুলে লেখাপড়া । পুরনো ঢাকার এক
সময়ের বনেদী পরিবারে আমাদের দু’জনেরই জন্ম। যদিও প্রাইমারী স্কুলের পড়াশোনা কালের প্রথম
দিকে আমরা একে অপরকে চিনতাম না। ও পড়তো ওদের বাসার কাছের সরকারী মডেল প্রাইমারিী
স্কুলে , আর আমি পড়তাম
আমাদের বাসার কাছের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। আমাদের পাড়ার নবারুণ সঙ্ঘের
সঙ্গীতানুষ্ঠানে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমরা তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি।
পুরনো ঢাকার চক বাজারে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ওর বাবা । আমার বাবা মতিঝিলের
বড়সড় ফার্মের বড় চাকুরে ।
ক্লাস সিক্স থেকে একই স্কুলে পড়তে পড়তে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা । আমাদের
পাড়াটা বেশ বড়সড় । তাই এতদিন আমরা পরস্পরকে চিনতাম না। গার্ল্স স্কুলটা আমাদেরই
পাড়ায়। স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজলে আমরা একই সঙ্গে স্কুল থেকে বের হয়ে আমি আগে
আমাদের বাড়িতে পৌঁছাতাম । আর আমাদের বাড়ি পেরিয়ে কলেজটাকে পাশে রেখে ও কালীবাড়ির
সামনের ওদের বাড়িতে যেত । স্কুলে যাবার সময় ও আমাদের গেটের বাইরে থেকে আমার নাম
ধরে ডাক দিত। ডাক শুনে আমি বুঝতে পারতাম পামেলা ছাড়া অন্য আর কেউ নয়। সেই ক্লাস
থেকেই পামেলার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ।
যেদিন সাড়ে নয়টা বেজে পনে দশটায় ঘড়ির কাটা ছুঁইছুঁই করতো সেদিন আমি বুঝতাম
পামেলা আজ স্কুল কামাই করছে। সে সময় তো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না,
তবে আমাদের বাসায় বাবা চাকুরীর সূত্রে একটা
ল্যান্ড ফোন ছিল। আমি ভাবতাম, ওর এত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও ওদের বাসায় একটা
ফোন নেই কেন। ও না এলে কেন যেন শূন্য শূন্য মনে হতো। অপেক্ষা করে করে এক সময় আমি
স্কুলের দিকে পা বাড়াতাম। একদিন দেরি করে স্কুলে পৌঁছায় ন্যাশনাল এন্থেমে উপস্থিত
না হতে পারায় বড় আপার বকুনি খেয়েও আমি কিন্তু পামেলার অপেক্ষায় না থেকে পারতাম না।
শরীর স্বাস্থ্যে পামেলাকে আমার চেয়ে বড়সড় দেখাতো । ও বেশই সুন্দরী,
চোখদুটো টানাটানা,
ডাগর নয়না বললে ভুল বলা হয় না। নাকটা টিকালো,
কথা কলার সময় ওর গোলাপী গালে টোল পড়ে,
ঠোঁট দুটো প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। নজর কাড়ার
মতো সুন্দরী যাকে বলে। আমিও কিন্তু কম সুন্দরী ছিলাম না। তবে আমরা পাশাপাশি
দাঁড়ালে ওর মুখের প্রতি নজর পড়তো প্রথমে ।
দু’ক্লাস পাশ দিয়ে
আমরা ক্লাস এইটে উঠলাম। ক্লাস সেভেনে উঠার মাঝামাঝি থেকেই আমাদের শরীর স্বাস্থ্যে
বদল ঘটতে থাকে, আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। ক্লাস এইটের মাঝামাঝি সময়ে পামেলা আমার চেয়ে শরীর
স্বাস্থ্য চেহারায় আরো সুন্দরী হয়ে উঠলো। সেই থেকেই ওকে দেখে আমি মুগ্ধ হতে থাকি।
আমি নিজেই যেন আমার প্রিয় বান্ধবীটির প্রেমে পড়ে যাই । এক সময় আমি বুঝতে পারলাম,
একদিন ওকে না দেখলে আমার মনটা যেন শূন্য
শূন্য লাগে। গাহর্স্থ্য বিজ্ঞানের টিচার তানিয়া আপা তার ক্লাসে বয়:সন্ধিক্ষণের চ্যাপটার বুঝাতে গিয়ে বয়:সন্ধিক্ষণের তের চৌদ্দ বছরের মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্য ও মন বদলে যাওয়ার কথা
সুন্দরভাবে ব্যাখা করার পর আমার জ্ঞানচক্ষু যেন খুলে গেল। তিনি
বললেন- ছেলেমেয়েরা এ বয়স থেকেই সুন্দরের আরাধনা শুরু করে । আমি মনে মনে ভাবলাম, পামেলা সুন্দরী তাই আমি ওকে এত ভালবাসি, ও আমারই মতো একটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ।
আমি বড় হয়ে উঠলে আমার মা ও দিদিমা আমাকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করলেন তা আমি
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। ক্লাস নাইনে উঠার পর আমরা নতুন বই হাতে পেলাম। দিদিমা
একদিন বললেন- দিদিভাই ,
তোদের বাংলা সিলেকসন বইটা আনতো দেখি,
কী কী গদ্য পদ্য আছে ?
আমি বইটা তার হাতে দিলে তিনি সূচিপত্র দেখে
বললেন- এইতো রবীন্দ্রনাথের ’ছুটি’ গল্প, ফটিক নামের ছেলেটার চরিত্র সুন্দরভোবে এঁকে
তোদের বয়সী তের চৌদ্দ বছরের বয়সীদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন । এ গল্পটা
পড়লে বুঝতে পারবি কেন আমরা এখন তোকে নিয়ে এতটা ভাবি । ছুটি গল্পটা তখন পড়লাম ,
কিন্তু গল্পটা আমার মনে তেমনভাবে রেখাপাত
করলো না ।
দুটো বছর গড়িয়ে গেল। আমরা ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টেনে উঠলাম। পামেলা আমার চেয়ে
ভাল রেজাল্ট করলো। আমার রেজাল্ট পামেলার চেয়ে খারাপ হওয়া সত্বেও আমি মোটেই অখুশি
নই। ওকে ঈর্ষা করা আমারে ধাতে সয় না কেন না ,আমি খুব ভালবাসি।
জানুয়ারির
দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পুরোদমে আমাদের ক্লাস শুরু হলো। গীতাঞ্জলী ম্যাডাম আমাদের
বাংলা সাহিত্য পড়ান। তিনি ছুটিতে থাকায় বড় আপা তার ক্লাস নিতে লাগলেন।তিনি সাধারণত
ক্লাস টেনে দু’একটা ক্লাস নেন । তিনি যে এত সুন্দর পড়ান তা আমাদের জানাই ছিল না। তিনি
রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি ‘ গল্পটা খুবই সুন্দর করে বুঝাতে চেষ্ট করলেন। তিনি বুঝালেন- রবীন্দ্রনাথ ফটিক চরিত্রের মাধ্যমে
বয়সন্ধিক্ষণের অর্থাৎ থার্টিন টু
নাইনটিন টিন এজার ছেলেমেয়েদের মনের টালমাটাল অবস্থার কথা সুন্দর ভাবে তুলে
ধরেছেন। পৃথিবীর তাবত তাবত মনবিজ্ঞানীরা এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে যা বলেছেন
রবীন্দ্রনাথ সে কথাগুলোই এ গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। আর তোমরা হচ্ছো ওই বয়সী
মেয়ে। আজ এই পর্যন্ত, আগামী ক্লাসে আরো বিস্তারিত বুঝাবো।
বড় আপার পড়া আমার মনে প্রথম দিকে তেমন রেখাপাত না করলেও পামেলার মনে যে তা
বিশেষভাবে রেখাপাত করছে সেদিন ছুটির পর স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে পামেলার কথা
শুনে বুঝতে পারলাম। পামেলার মনটাতে খুশি আমেজ আমি কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছিলাম ।
আমাদের পাড়ার বারোয়ারি কালীপুজোর রাতে ওর সাজগোজ দেখে আমি তো অবাক। আমাদের স্কুলে
মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে ক্লাসের ইউনিফর্মের ছাড়া পোশাক পরে আসার নিয়ম চালু ছিল ।
এক বৃহস্পতিবারে পামেলার পরনের পোশাক দেখে গীতাঞ্জলী ম্যাডাম তো পামেলার উপর রেগে
আগুন হয়ে বললেন—পামেলা , ইউনিফর্ম্ ছাড়া অন্য পোশাক পরার অর্থ্ শালীনতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া নয় কি?
খবরদার এমন পোশাক আর কোন দিন স্কুলে আসবে না,
পামেলা।
বড় আপা আবার ক্লাস নিতে এলেন । তিনি আমাদের স্কুলে এক নাগাড়ে পনরো বছর
হেডমিস্ট্রেস আছেন , সামনের বছরের মে মাসে তিনি অবসরে যাবেন। তিনি আমাদের
অনেকেরই দিদিমা, ঠাকুমার বয়সী। এ কথাটা তিনি গত সালের স্কুল ফাইনালের এসএসসি পরীক্ষার্থিণীদের
বিদায় অনুষ্ঠানের ভাষণে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি ’গল্পের শেষাংশের উপর ক্লাস নিতে এসে বড় আপা
বললেন- আজ আমি একটু খোলামেলা ভাবেই তোমাদের সাথে আলোচনা করবো। এই বয়সের অনেক
ছেলেমেয়ের মনে রঙ লাগে,বাস্তবতাকে ভুলে রঙিন চোখে জগতটাকে দেখতে
শুরু করে । কোনটা ভাল , আর কোনটা মন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।প্রিয়জনের প্রকৃত
ভালবাসা না পেয়ে অনেক ছেলেমেয়ে বিপথে চালিত হয়। অনেক মেয়ে হয়তো ক্ষণিকের মোহে
প্রেমিককে জানপ্রাণ দিয়ে ভালবাসেতে শুরু করে, আবার অনেক ছেলে কোন মেয়েকে ভালবেসে দেওয়ানা
হয়ে সংসার বিবাগী হতেও দ্বিধা করে না। এমনকি একজন মেয়ে পাগলের মতো আর একজন মেয়েকেও
ভালবাসতে পারে, ঠিক সেই ভাবে একজন ছেলে আর একজন ছেলেকেও জানপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পারে। এ বয়সের
ছেলেমেয়েরা মা বাবা স্নেহ ভালবাসা না পেলে ছুটি গল্পের ফটিকের মতো পরিণতি ঘটতেও
পারে। তিনি একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন - সহিংসতার শিকার যাতে না হয় তার জন্যে টিন
এজারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে এ বিষয়ের
উপর আসছে কাল সকাল নয়টা থেকে বারটা তিন ঘন্টার একটা সেমিনার হবে, আমিও সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করবো। তোমরা কেউ সেমিনারে যোগদান
করতে চাইলে নয়টার আগে ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করো।
ওই দিন স্কুল থেকে ফিরবার পথে আমি পামেলাকে জিজ্ঞেস করলাম-
এই বয়সটার জন্যেই কি আমি তোকে এমন ভাবে
ভালবাসি? আমার কথা
শুনে ও বললো – হবে হয়তো ।
– তুই কিন্তু আমাকে তেমনটা ভালবাসিস না বলে আমার মনে হয়। পামেলা আমার কথার জবাব
না দিয়ে বাড়ির দিকে হন হন করে চলতে লাগলো। আমাদের বাড়ির কাছে পৌঁছে পামেলা বললো- কাল তো সাপ্তাহিক ছুটি ,
চল কাল শাহবাগে জাদুঘরে সেমিনারে অ্যাটেন্ড
করি। বড় আপার সঙ্গে নয়টার আগে দেখা করলেই হবে।
তার প্রস্তাবে সাড়া দেবার আগেই ও বললো- বাড়ির পারমিশনের কথা ভাবস না , চল এখনই তোর
দিদিমার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে রাখি। পামেলা জানতো আমি কোনদিনই পামেলার কথা
প্রতিবাদ করিনি। তাই বল- চল্ তাই যাই। দিদিমার
পারমিশন পেলে আমাদের বাসার কেউ আপত্তি করবে না। মেয়ের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি শুনলে
পামেলার মাও আপত্তি করবে না তা আমরা দু’জনেই জানি।
পুরনো ঢাকা থেকে শাহবাগের দূরত্ব কম নয়। আমরা সকাল আটটার দিকে কবি নজরুল ইসলাম
কলেজের মোড় থেকে ডবল ডেকার বাসের উপরতলায় বসে পড়লাম। সকালবেলা পুরনো ঢাকা থেকে ডবল
ডেকারটা ছেড়ে আসছে তাই উপরতলা তখনো আমরা দু’জন ছাড়া অন্য কোন যাত্রী নেই। ও বসেছে বা’দিকে জানলার পাশের সিটে ,
আর তার পাশে। পামেলা এক সময় আমার কানের কাছে
মুখ নিয়ে কোন রকম ভনিতা না করেই বললো- আমি একটা ছেলের প্রেমে পড়েছি, তুই আমাকে
সাহায্য না করলে আমার জীবনটা মাটি হয়ে যাবে।
পামেলার কথা শুনে আমার পিলে যেন চমকে উঠলো। বলে কী! আমার মনের মধ্যে কৌতূহল মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আমি একটু ভেবে
নিয়ে ওকে বললাম –
তোর জন্যে আমি সব কিছুই করতে পারি এ
বিশ্বাসটা তোর নেই দেখছি!
পামেলা হাসি হাসি মুখে বললো- আমি জানি তুই আমাকে----
আমি তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম- অবশ্যই তোর সুখের জন্যে যা যা করার তাই করবো।
তবে ছেলেটি কে ?
- ছেলেটিকে তুই চিনিস না । তবে আমি তার সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব। -
আমি আগ্রহ সহকারে বললাম- ঠিক আছে।
পামেলা ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল।
ছেলেটির নাম সুশোভন , আসলেই দেখতে অপূর্ব্। আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তের
লক্ষ্মীবাজারের কাছাকাছি ওদের বাসা একটা বিদেশী ফার্মের আইটি সেক্টরে ছেলেটি কাজ
করে। আমাদের বাসার কাছাকাছি ওর বাসা হওয়ায় আমি আমি আমার বান্ধবী পামেলা ও তার
প্রেমিকের মধ্যে প্রেমপত্রের ডাক পিয়ন হলাম।
সুশোভন নামের ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা ঘন ঘনই হতে লাগলো। ছেলেটি ভাল গিটার বাজায়,
খেলাধুলো করতে ভালবাসে। আমিও গিটার বাজাতে
ভালবাসতাম , স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গিটার বাজিয়ে আমি দু’বার পুরস্কারও পেয়েছি। আমার বড়মামা কানাডা
থেকে আসবার সময় আমাকে একটা কম্পিউটার এনে দেন। তখন আমাদের এখানে কম্পিউটার
হাতেগোণা কয়েকজনেরই ছিল। লক্ষ্মীবাজারের ছুটির দিনে আমি একাই বাসা থেকে
কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিতে যেতাম। সুশোভনের সাথে সপ্তাহে একদিন মিলিত হয়ে পামেলার
ও তার চিঠি আদান প্রদান করতে লাগলাম। আমাদের কমন ইন্টারেস্ট গিটার বাজনা ,
তাই ওই বিষয় নিয়ে আলাপ করি। এভাবেই ছেলেটির
সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা বাড়ছে তা তখনো আমি ভালভাবে বুঝতে পারিনি। পামেলা ও আমি স্কুল
ফাইনাল এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছি। আমার ক্লাস না থাকায়
আমি এর মধ্যেই সাধারণ প্রোগ্রাম শেষ করে এক্সেল প্রোগ্রাম শিখছিলাম সপ্তাহে দু’দিন। ফলে পামেলার প্রেমিক সুশোভনের সঙ্গে
আমার যোগাযোগ আগের চেয়ে আরো বেশি হতে থাকলো।
আমাদের রেজাল্ট বের হলো । আমরা দু’জনেই ভাল রেজাল্ট করলাম। আমরা একই কলেজে
ভর্তি হলাম। এর মাঝে আমার বাবার সিলেটে বদলীর অর্ডার এলো। ঢাকা ছাড়ার আগে টের
পেলাম অজান্তেই ছেলেটিকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। ঢাকা ছাড়ার দিন এগিয়ে এলো। আমি
ভাবলাম, ভালই হলো ।
বান্ধবীর প্রেমিককে নিজের করে পাবার জন্যে রেশারেশি করা অর্থ্ হয় না,
পামেলা ছেলেটির সঙ্গে চোখের সামনে প্রেম করবে
সেটা ভাবতেও কষ্ট লাগতো ঢাকায় থাকলে।
বিধাতার মনে কী ছিল কে জানে! বছর খানেক পরে একদিন পামেলা টেলিফোন বুথ থেকে আমাদের ফোনে
জানালো য়ে সুশোভন এক বছরের ট্রেনিং এ সিলেটে গেছে। আমি আমার
বান্ধবীর ফোন পেয়ে মনের অজান্তেই আনন্দিত হলাম। সে আমাকে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বললো- তুই ওকে হেল্প করিস কিন্তু। ও তো ওখানকার কোন কিছু চেনে
না।ছেলেটি আমাদের ঠিকানা খুঁজে আমার সঙ্গে দেখা করলো। ছেলেটির সঙ্গে মাঝেমধ্যেই
আমার দেখা সাক্ষাৎ ঘটতে লাগলো ।
একদিন সুশোভন আমাকে বললো যে ট্রেনিংটা শেষ হলে সে একটা প্রোমোশন পাবে,
আর তখন সে পামেলাকে বিয়ে করতে পারবে। ওর কথা
শুনে আমার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। আমি মনস্থ করলাম যে করেই হোক পামেলার সঙ্গে
তার বিয়েটা ভেঙে দিকে হবে। আমি যে ওকে ভালোবাসি তা ও তখনো জানতে পারেনি। আমি
ভাবলাম, ওকে না পেলে আমি
মরে যাব ! আমি মনে মনে প্লান কষতে শুরু করলাম। সুশোভনের মনটা আমার দিকে যে করেই হোক
ফেরাতে হবে। আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবী পামেলা আমাকে চিঠি লিখে জানালো সে সুশোভনের পথ
চেয়ে বসে আছে,
অন্যদিকে বাড়ি থেকে তার বিয়ের জন্য চেষ্টা
করা হচ্ছে। ট্রেনিং সেন্টারে ঠিকানায় চিঠি দিলে তা ওর হাতে নাও পড়তে পারে। আমার
ঠিকানায় মুখবন্ধ খামে ও তার প্রেমিক সুশোভনকে চিঠি পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করলো ,
আমি যেন চিঠিটা ওকে দিয়ে দেই।
তারপর থেকে একই ভাবে আমার ঠিকানায় মুখবন্ধ খামে সুশোভনকে চিঠি পাঠাতে লাগলো ।
আমি ওর চিঠি প্রথম প্রথম সুশোভনের দিতে ভুল করতাম না। যখন আমি জানতে পারলাম ওর বাবা মা পামেলার বিয়ে অন্যত্র দেবার জন্যে উঠে পড়ে
লেগেছেন, সে কোন রকমে
বিয়েটা ঠেকিয়ে রেখেছে। তখন থেকে আমি সুশোভনকে পামেলার পাঠানো চিঠি বন্ধ করে
দিলাম।সুশোভন একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তার বান্ধবী কেন চিঠি দিচ্ছে না?
পামেলার বাড়িতে টেলিফোন থাকেলে সে টেলিফোন
করে দেখার চেষ্টা করতো। ছেলেটির দু:চিন্তার কথা শুনে আমি তাকে বললাম- আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমিও তো সেটাই ভাবছি। সুশোভন মাঝে মধ্যে আমার
সঙ্গে দেখা করে ওর মনকষ্টের কথা জানাতে থাকলো। আমি ভাবলাম,
এটাই সময় ওকে আমার দিকে কাছে টানার ।
সুশোভন মনকষ্ট দিন দিন বেড়ে যেতে থাকলো। আমি ভাবলাম,
ইচ্ছে করলে ও ঢাকায় গিয়ে পামেলার খোঁজ নিয়ে
আসতে পারে, কিন্তু ও পামেলাদের বাড়িতে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারলো না। পামেলা ওর খোঁজ
নেওয়ার জন্যে আগে কয়েকবার টেলিফোন বুথ থেকে আমাকে ফোন করেছিল। কিছুদিন পরে পামেলার
ফোন এলো, ও জিজ্ঞেস করলো- কী রে!
কী ব্যাপার
সুশোভন তো আমাকে অনেকদিন চিঠি দেয় না। ও কেন আমাকে চিঠি দিচ্ছে না বুঝছি না। আমি
ফোনের এপ্রান্ত থেকে অম্লানবদনে বলে দিলাম-
কী জানি ! ও তো আমার সঙ্গেও বেশদিন দেখা করে না। তবে শুনেছি এখানে নাকি
ও একজন বান্ধবী জুটিয়ে নিয়েছে।
আমার কথা শুনে পামেলা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো- এখন তা হলে আমি এখন কী করবো? বাড়ি থেকে বের
হতে পারলে আমি তোদের ওখানে ছুটে যেতাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। আমি
পামেলার কথা শুনে মনে স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম , এখন দেখবো তুই কিভাবে ওকে পাস্।
আমার মাথায় জেদ চেপে গেল। আমি ভাবলাম এবার দেখি সুশোভন আমার না হয়ে যায় কোথায়?
সুশোভনের সঙ্গে পামেলার যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে
গেলে পামেলা ফোন করে আমাকে জানালো- ওর বিয়ে পাকাপকি ভাবে ঠিক হয়ে গেছে।
সুশোভন যেন অবিলম্বে ঢাকায় এসে তার সঙ্গে দেখা করে।
আমি সুশোভনকে এ থবরটি জানালাম না।সুশোভন ঢাকায় যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলে
আমি তাকে বললাম- পামেলা হয়তো বাড়িতে কড়াকড়ির মধ্যে আছে। এখন ওর সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়াই
উচিত। কয়েকদিন পরেই যাওয়াই ভাল। দিশেহারা অবস্থায় সুশোভন আমার কথা
মেনে নিল।
সুশোভন ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়ায় পামেলা খুবই মর্মাহত হলো। সুশোভন
প্রতি প্রচন্ড অভিমানে ও বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করতে রাজি হলো।
ছেলেটি কানাডা প্রবাসী। বিয়ের পর পরই তাকে কানাডায় নিয়ে যাবে। পামেলা ওই ছেলের
সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দেবার পর থেকে পামেলার কানাডা যাওয়ার পাসপোর্ট্ ভিসার
প্রক্রিয়া শুরু তার হবু বর।
ফোন করে পামেলা আমাকে সব কিছুই জানালো। আমি কিন্তু এ খবর সুশোভনকে জানালাম না।
বিয়ের পর পামেলা আমাকে ফোন করে জানালো তার পাসপোর্ট্ ভিসা রেড়ি হতে মাস খানেক
লাগবে। আমি পামেলার ফোন পেয়ে আশ্বস্ত হলাম সুশোভনের ঢাকা যাওয়া মাস খানেক ঠেকিয়ে
রাখতে পারলে আমার লুকোচুরির কথা সুশোভন জানতে পারবে না। যে কোন ভাবেই হোক
পামেলাকে কানাডা যাওয়ার আগে কোনক্রমেই ঢাকায় যেতে দেওয়া যাবে না। পামেলা ঢাকা ছেড়ে
চলে যাওয়ার পর সুশোভন ঢাকায় গেলে সে পামেলাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে ও আমার কাছেই ফিরে আসবে।
বাস্তবে কিন্তু তা হলো না। মাস দেড়েক পরে সুশোভন ঢাকায় গিয়ে আর ফিরে এলো না।
পরে আমি জানতে পারলাম, সুশোভন ঢাকায় গিয়ে চাকরি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।
আমার সঙ্গে তার আর কোন যোগাযোগ হয়নি। আমার বান্ধবী পামেলা ও সুশোভন কেউ আসল সত্যটা আজও জানে না। এখন আমি মরমে মরে যাই। আমারই
বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে পামেলা ও সুশোভন একে অপরকে পেল না। এখন আমার আত্মগ্লানি আমার
বুকে পাথরের মতো চেপে বসে আছে।#