গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

তাপসকিরণ রায়


রমাকান্ত নামা--কোন্দল 

রমাকান্তর সময়টা খারাপ চলছে। না আর্থিক দিক থেকে নয়। ওই সাংসারিক খিটিমিটি যাকে বলে । এমন নাকি প্রায় ঘরেই হয়। কিন্তু রমাকান্ত জানেন, এতটা কোথাও হয় না !
“রান্না করার কিছুই নেই, চোখে দেখো না নাকি” ? হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে লক্ষণের শক্তি-শেল এসে বিঁধল যেন রমাকান্তর দেহে । এ সেই শৈলবালার কামান গলা ! “আমার মাথায় জট আছে যে আপনি আপনি সব জানতে পারব” ? রমাকান্ত প্রতিযুদ্ধে যোগ দেবার চেষ্টা করলেন। রান্না ঘরের ভিতর থেকে দু তিনটে ব্যাগ উড়ে এসে পড়ল বাইরে, একেবারে রমাকান্তর সামনে । “মেয়ে মানুষের তাক দেখো, ছোট বেলায় পাড়ার আমগাছে ঢিল মেরে বেড়াত যে” !

রমাকান্তও সিধা লক্ষ্য লাগাবার চেষ্টা করলেন। ছেলে রমেন কমাস আগে চাকরি পেয়ে পুণেতে গেছে। ঘর এখন খালি । তাই বোধহয় সুযোগে খালি ঘরে কোন্দল আরও বেড়ে গেছে । ব্যাগ নিয়ে শাঁ শাঁ  করে বাজারে বেরিয়ে গেলেন রমাকান্ত । মাছ কিনে  পকেটে হাত দিয়েই, “যাঃশালা, পয়সা” ? বলে উঠলেন তিনি ।
“কি হল দাদা” ? মেছুনী দাঁত বের করলো । মুখে পাংশু হাসি নিয়ে রমাকান্ত বললেন, “পয়সা আনতে ভুলে গেছি” । “তাতে কি হয়েছে ? তুমি কি আমায় চেন না ! আমি তোমায় কত বছর থেকে দেখছি”, মাছওয়ালী আবার দাঁত বের করল ।

রমাকান্ত তাকালেন মেছুনীর দিকে, প্রায়ই এর কাছ থেকে মাছ নেন তিনি । মাছ বাজারের চত্বরে ঢুকলেই এই মেছুনী হাতের ইশারায় তাঁকে ডেকে নেয় । আর রমাকান্তও কোন দিকে না তাকিয়ে সুড়সুড় করে একেবারে তার কাছটিতে গিয়ে হাজির হন । তবু বলতে গেলে এত দিন মেছুনীকে তিনি সরাসরি দেখেন নি । এবার দেখলেন, মাঝ বয়সী হবে, পানখাওয়া লাল দুই ঠোঁট, মনে হয় পানের পিক ছড়িয়ে দু গালেও লাল ছোপ ধরেছে । আবার খোঁপা চুলে বেলি ফুলের মালিকা ! চেহারা তামাটের কাছাকাছি। আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে,  রোদ্দুরে পুড়ে অমনটা হয়েছে হবে । হাসলে এখনও ওকে মন্দ লাগে না !

“কি বাবু লিয়ে যাও” । সব কাজ রেখে রমাকান্তর দিকে নজর দিয়েছে মেছুনী, একেবারে এক কিলো মাছ কেটে-বেছে, রমাকান্তর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “লিয়ে যাও” --পয়সা, বলে রমাকান্ত একবার কুঁকিয়ে উঠলেন। “আরে বলছি তো তুমি আপন লোক, তোমার পয়সা না দিলেও চলবে” । মেছুনী আবার রমাকান্তর দিকে রং দেঁতেল হাসি ছড়িয়ে দিল ।
আরও একবার তাকালেন রমাকান্ত। মেছুনী দেখতে খারাপ না, লিপস্টিক দরকার নেই, পান-খয়েরের রসেই তা কেমন চালিয়ে দিয়েছে। এও গিয়ে বলতে গেলে এক ধরনের প্রসাধন ! চলতে চলতে হঠাৎ রমাকান্ত রেগে গেলেন, হারামজাদী ! আমার ঘাড়ে একটা জুটেছে বটে ! ওই মেছোনিটাও মনে হয় আমারটা থেকে ভালো !

“এ কি থলিতে শুধু মাছ, শাক-সবজি কোথায় ?” শৈলর স্বর এখনো সপ্তমে ।
“সব বাজারে”, রমাকান্তও স্বর চড়ালেন । “ধার করে মাছ এনেছি” ।  বৌও সপ্তম স্বরে, তিনি কেন কমাবেন, “কেন, টাকা পয়সা হারিয়ে এলে নাকি ! তবে মাছ আনলে কি ভাবে ?

এবার রমাকান্তর মুখ ফসকে সব বেরিয়ে যাচ্ছিল, মেছুনীর কথা চেপে গিয়ে তিনি বললেন, শৈলর চোখটা কি ভেবে চকচক করে উঠলো, বললেন, ও মাছওয়ালীটা নয় তো ! স্বামীর সঙ্গে দু তিন দিন তিনিও বাজারে সেই মেছুনীকে দেখেছেন । তখন অবশ্য এমনটা মনে হয় নি । রমাকান্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে । শেষে তিনি কি বলতে কি বলে ফেলবেন ! “কি ব্যাপার কিছু বলছ না যে ! ওই মেছুনীটা তোমায় বিনা পয়সায় মাছ দিয়ে দিল তো ?” আরও যেন তেতে গেলেন শৈল । 
“এই--যা ইচ্ছা তাই বলবে না বলে দিচ্ছি” । রমাকান্ত বলে ।

“কেন, কি করবে তুমি আমার শুনি ? শৈলবালা এগিয়ে গেলেন রমাকান্তর দিকে, আরও একবার ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, “বলি করবেটা কি তুমি ?

রাগে তখন অগ্নিশর্মা রমাকান্ত,  বলে ফেললেন, “ওই মেছুনীকে বিয়ে করে ফেলব” । কথাটা বলে তিনি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন যেন, নিজের কানেই যেন কেমন শোনালো । শৈলবালা থতমত খেলেন, রমাকান্তর কথাটা মনে মনে অনুধাবন করে তাঁর দিকে তাকালেন । দুজনেই দুজনের দিকে মুহূর্ত খানেক তাকিয়ে শৈলবালা ফিক করে হেসে দিলেন । রমাকান্ত আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। তখন ধীর শান্ত শৈলবালা বলে উঠলেন, “ঘরের খাটাখাটনির পর আমার মেজাজটা তিরিক্কি হয়ে যায় গো ! তুমি তো তখন শান্ত থাকতে পারো, আমায় বোঝাতে পরো ?


রমাকান্ত আশ্চর্য হলেন, এ যে আগের শৈলবালা উঁকি মারছে ! রমাকান্ত হাসতে চাইলেন না, তবু রাগের ভান করতে গিয়েও তাঁর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো ।