রমাকান্ত
নামা--কোন্দল
রমাকান্তর
সময়টা খারাপ চলছে। না আর্থিক দিক থেকে নয়। ওই সাংসারিক খিটিমিটি যাকে বলে । এমন
নাকি প্রায় ঘরেই হয়। কিন্তু রমাকান্ত জানেন,
এতটা কোথাও হয় না !
“রান্না করার
কিছুই নেই, চোখে
দেখো না নাকি” ? হঠাৎ
ঘরের ভিতর থেকে লক্ষণের শক্তি-শেল এসে বিঁধল যেন রমাকান্তর দেহে । এ সেই শৈলবালার
কামান গলা ! “আমার মাথায় জট আছে যে আপনি আপনি সব জানতে পারব” ? রমাকান্ত প্রতিযুদ্ধে যোগ দেবার চেষ্টা
করলেন। রান্না
ঘরের ভিতর থেকে দু তিনটে ব্যাগ উড়ে এসে পড়ল বাইরে,
একেবারে রমাকান্তর সামনে । “মেয়ে মানুষের তাক দেখো, ছোট বেলায় পাড়ার আমগাছে ঢিল মেরে বেড়াত
যে” !
রমাকান্তও
সিধা লক্ষ্য লাগাবার চেষ্টা করলেন। ছেলে রমেন ক’মাস আগে চাকরি পেয়ে পুণেতে গেছে। ঘর এখন খালি । তাই বোধহয় সুযোগে
খালি ঘরে কোন্দল আরও বেড়ে গেছে । ব্যাগ নিয়ে শাঁ শাঁ করে বাজারে বেরিয়ে গেলেন রমাকান্ত । মাছ কিনে পকেটে হাত দিয়েই,
“যাঃশালা, পয়সা” ? বলে উঠলেন তিনি ।
“কি হল দাদা” ? মেছুনী দাঁত বের করলো । মুখে পাংশু হাসি নিয়ে রমাকান্ত
বললেন, “পয়সা
আনতে ভুলে গেছি” । “তাতে কি হয়েছে ? তুমি কি আমায় চেন না ! আমি তোমায় কত বছর থেকে দেখছি”, মাছওয়ালী আবার দাঁত বের করল ।
রমাকান্ত
তাকালেন মেছুনীর দিকে, প্রায়ই
এর কাছ থেকে মাছ নেন তিনি । মাছ বাজারের চত্বরে ঢুকলেই এই মেছুনী হাতের ইশারায় তাঁকে ডেকে নেয় । আর রমাকান্তও
কোন দিকে না তাকিয়ে সুড়সুড় করে একেবারে তার কাছটিতে গিয়ে হাজির হন । তবু বলতে গেলে
এত দিন মেছুনীকে তিনি সরাসরি দেখেন নি । এবার দেখলেন,
মাঝ বয়সী হবে, পানখাওয়া লাল দুই ঠোঁট, মনে হয় পানের পিক ছড়িয়ে দু গালেও লাল ছোপ ধরেছে । আবার খোঁপা চুলে
বেলি ফুলের মালিকা ! চেহারা তামাটের কাছাকাছি। আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে, রোদ্দুরে
পুড়ে অমনটা হয়েছে হবে । হাসলে এখনও ওকে মন্দ লাগে না !
“কি বাবু লিয়ে
যাও” । সব কাজ রেখে রমাকান্তর দিকে নজর দিয়েছে মেছুনী,
একেবারে এক কিলো মাছ কেটে-বেছে,
রমাকান্তর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “লিয়ে যাও” --পয়সা, বলে
রমাকান্ত একবার কুঁকিয়ে উঠলেন। “আরে বলছি তো তুমি আপন লোক,
তোমার পয়সা না দিলেও চলবে” । মেছুনী আবার রমাকান্তর দিকে রং দেঁতেল
হাসি ছড়িয়ে দিল ।
আরও একবার
তাকালেন রমাকান্ত। মেছুনী দেখতে খারাপ না,
লিপস্টিক দরকার নেই, পান-খয়েরের রসেই তা কেমন চালিয়ে দিয়েছে। এও গিয়ে বলতে গেলে এক
ধরনের প্রসাধন ! চলতে চলতে হঠাৎ রমাকান্ত রেগে গেলেন,
হারামজাদী ! আমার ঘাড়ে একটা জুটেছে বটে ! ওই মেছোনিটাও মনে হয়
আমারটা থেকে ভালো !
“এ কি থলিতে শুধু
মাছ, শাক-সবজি কোথায় ?” শৈলর স্বর এখনো সপ্তমে ।
“সব বাজারে”, রমাকান্তও স্বর চড়ালেন । “ধার করে মাছ
এনেছি” । বৌও
সপ্তম স্বরে, তিনি
কেন কমাবেন, “কেন,
টাকা পয়সা হারিয়ে এলে নাকি ! তবে মাছ আনলে কি ভাবে ?”
এবার
রমাকান্তর মুখ ফসকে সব বেরিয়ে যাচ্ছিল, মেছুনীর কথা চেপে গিয়ে তিনি বললেন,
শৈলর চোখটা কি ভেবে চকচক করে উঠলো,
বললেন, ও
মাছওয়ালীটা নয় তো ! স্বামীর সঙ্গে দু তিন দিন তিনিও বাজারে সেই মেছুনীকে দেখেছেন ।
তখন অবশ্য এমনটা মনে হয় নি । রমাকান্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে । শেষে তিনি কি বলতে কি বলে
ফেলবেন ! “কি ব্যাপার কিছু বলছ না যে ! ওই মেছুনীটা তোমায় বিনা পয়সায় মাছ দিয়ে দিল
তো ?” আরও যেন তেতে গেলেন
শৈল ।
“এই--যা ইচ্ছা
তাই বলবে না বলে দিচ্ছি” । রমাকান্ত বলে ।
“কেন, কি করবে তুমি আমার শুনি ?” শৈলবালা এগিয়ে গেলেন রমাকান্তর
দিকে, আরও
একবার ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, “বলি করবেটা কি তুমি ?”
রাগে তখন
অগ্নিশর্মা রমাকান্ত, বলে ফেললেন,
“ওই মেছুনীকে বিয়ে করে ফেলব” । কথাটা বলে তিনি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে
গেলেন যেন, নিজের
কানেই যেন কেমন শোনালো । শৈলবালা থতমত খেলেন,
রমাকান্তর কথাটা মনে মনে অনুধাবন করে তাঁর দিকে তাকালেন । দুজনেই
দুজনের দিকে মুহূর্ত খানেক তাকিয়ে শৈলবালা ফিক করে হেসে দিলেন । রমাকান্ত আরও
গম্ভীর হয়ে গেলেন। তখন ধীর শান্ত শৈলবালা বলে উঠলেন,
“ঘরের খাটাখাটনির পর আমার মেজাজটা তিরিক্কি হয়ে যায় গো ! তুমি তো তখন শান্ত থাকতে পারো,
আমায় বোঝাতে পরো ?”
রমাকান্ত
আশ্চর্য হলেন, এ
যে আগের শৈলবালা উঁকি মারছে ! রমাকান্ত হাসতে চাইলেন না,
তবু রাগের ভান করতে গিয়েও তাঁর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো ।