ভেজাচোখে
স্বপ্ন
দু’দিন
আগে রহিম ঢাকা এসেছে । রহিমের খবর জানে না
মা। মামার বাড়ি যত্নে থাকবে জানে। তবুও মায়ের মন। আনচান করে । কখনও তো রহিমকে ছাড়া থাকে নি।আসতে দিতে
চায় নি মা। মায়ের প্রাণ। বুক কেঁপেছে থর থর, বাম চোখের নিচের পাতা ফড়কেছে বার বার।
অশুভ লক্ষণ। মা বারণ করেছে। চৈতমাসের গরম বাজান,
এখন গিয়া কি করবি? এই গরমে তো ঘুরতেও পারবি না। তার চাইতে শীতকালে যাইস। নাছোড়বান্দা
রহিম । বলে,মা সামনে বৈশাখ। পয়লা বৈশাখে নাকি খুব বড়ো বড়ো অনুষ্ঠান হয়। মেলা হয়। দিন
জুইড়া নাচগান, কবিতা হয়। আমি দেখুম মা! আহ্লাদ করে রহিম। মা ঈশ্বরের নাম নেয়। দোয়া
দরুদ পড়ে ফুঁ দেয় ছেলের মাথায়। হাত বুলিয়ে দেয় গায়ে। মায়ের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।
চোখকে গালি দেয় মা,পোড়ার চোখ, কাঁদার আর সময় পাইলি না। অলুক্ষুণে লোনাপানি।
মায়ের
চোখের জল সঙ্গে নিয়ে ঢাকা এসেছে রহিম। আগে ঢাকা আসে নি কখনও। সুযোগ হয় নি। বাবা নেই।
মা আর ও। দু’জনের সংসার। একবেলা খেয়ে না খেয়ে লেখাপড়া করে রহিম। মা কাপড় সেলাই করে
যা পায় আর ঢাকা থেকে মামা সামান্য যা কিছু পাঠায়, তাই দিয়েই কোনোমতে চলে যায় ওদের।
ওতেই সংসার চালিয়ে নেয় মা । একমাত্র লক্ষ্য
তার ছেলে বড়ো হবে, মানুষ হবে। দুঃখ ঘুচবে। তখন আজকের এই কষ্টকে আর কষ্ট মনে হবে না।
রহিম
ছাত্র ভালো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে, এবার ক্লাস এইট। এবারেও বৃত্তি দিয়েছে। আশা
আছে এবারও বৃত্তি পাবে। স্কুলে পড়তে কোনো বেতন দিতে হয় না ওকে। ভালো ছেলে। কখনও কোনো
সময় কোনো বায়না করে নি ও। এবারই প্রথম-মা, ঢাকা যাবো। জানো মা, ঢাকা ইয়া বড়ো শহর। ওখানে
সংসদ ভবন আছে। ওই যে টিভিতে দেখোনা প্রধানমন্ত্রীর
সাথে সব মন্ত্রী, সাংসদরা মিলে টেবিল চাপড়ায়া চাপড়ায়া সব কথা কয়। আমি ওইখানে যামু মা।
খুশিতে
টগবগ করে রহিম। বলে, সংসদ ভবন যামু, যামু শিশুপার্ক, যাদুঘর সব দেখুম মা। ওখানে মা
বিরাট শহীদ মিনার আছে। স্মৃতিসৌধ আছে। স্বাধীনতার বধ্যভূমিও আছে মা। স্বাধীনতার কথা
মনে হতেই মলিন হয়ে ওঠে ওর মুখ। কিন্তু পরক্ষণেই আবার উজ্জ্বল হয়। মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে
কণ্ঠে বলে-মা-মাগো, পয়লা বৈশাখে ওখানে মেলা বসে মা। অনেক মানুষ রঙ-বেরঙের মুখোশ পরে
র্যালি করে। আমি র্যালিতেও যামু মা। মেলায়ও। মেলা থেকে কী আনুম মা তোমার জন্য কইয়া
দিও। মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে ওর স্বাপ্নিক চোখ, মুগ্ধ হৃদয়। হাসে মা। পাগল
ছেলে।
মা
চোখ মোছে। রহিমের কথা মনে পড়ে। আজ পয়লা বৈশাখ। সকাল ছয়টা। রহিম মামাতো ভাই এহসানের
সঙ্গে এসেছে রমনার বটমূলে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান।‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-কি সুন্দর গান।
কি সুন্দর সব মেয়েরা। একই রকম শাড়ি পরেছে। সবার মাথায় ফুলের মালা। ছোট ছোট মেয়েরাও
কি সুন্দর গান গায়। রহিম মুগ্ধ হয়। ওর মুগ্ধতায় হাসে এহসান। সেই মুগ্ধতায় আরও একটু
কথার গোলাপ ছিটায় এহসান। এহসান এবার এস.এস.সি দিয়েছে।
এই
রহিম পান্তা খাবি ?
পান্তা
! আরও অবাক হয় রহিম ।
কোথায়
পাবো?
ইলিশমাছ
আর পান্তা। এখানে কিনতে পাওয়া যায় ।
তাই!
বিস্মিত রহিম ।
ওরা
ইলিশ পান্তা খায়।
রমনার
বটমূলে টিভি ক্যামেরা ঘোরে।
এহসান
ভাই, ওইটা কি ?
প্রশ্নের
জবাব দেয় এহসান-ওটা টিভি ক্যামেরা। ছবি দেখা যাবে টিভিতে।
আমারও
?
হ্যাঁ
।
রহিম
লাফিয়ে উঠে হাতের আঙুল দেখায়। এই যে মা আমি।
বোকা
ছেলে ! এহসান ওর কাঁধে হাত রাখে । তোমার কথা কি ফুপ্পি শুনবে ?
শুনবে
না?
নাহ।
রহিমের
মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে। হাত ধরে টানে এহসান। চলো, চলো। এইখানে একটু বসি। গান শুনে তোমাকে
চারুকলার র্যালিতে নিয়ে যাবো। তারপর কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে। কি মজা হবে দেখো। তুমি
এখানে বসো। আমি একটু বাদাম চানাচুর নিয়ে আসি। বাদাম,চানাচুর আনতে যায় এহসান।
কি
সুন্দর গান! আহা ! মঞ্চে গান হচ্ছে। তাল ঠুকছে রহিম। হঠাৎ শব্দ। চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া।
চিৎকার। এহসান চিৎকার দিয়ে চেতনা হারায়। চেতনা হারানোর আগেই একটু শুনতে পায় রহিমের
চিৎকার- মা, মাগো । এদিকে এহসানের চেতনা ফিরে আসে। রহিমকে খোঁজে-রহিম, রহিম। কোথায়
তুমি রহিম ?
এহসানের
বন্ধুরা জমা হয় পাশে, ওরা মিলে রহিমকে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় রহিমকে।
বা-হাত উড়ে গেছে । এখনও
জ্ঞান ফেরে নি। ওরা ধরাধরি করে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার রহিমকে দেখতে
থাকে। এহসান বন্ধুদের ওর কাছে থাকতে বলে বাসায় ফোন করতে যায়। ফোন করে এসে ডাক্তারের
কাছে দাঁড়ায়। ডাক্তার বলে-বড়ো কেউ নেই ? অপারেশন করতে হবে ।
আপনি
শুরু করেন ডাক্তার সাহেব । আমার মা এই এলো বলে । ডাক্তার নার্স সবাই ওকে ওপারেশন থিয়েটারে
নিয়ে যায়। অপারেশন হয়। রহিমকে কয়েকমাস হাসপাতালে থাকতে হয়। রহিমের মা-ও এসেছে। তার
রহিম। তার একমাত্র নয়নের মণি। লেখাপড়া শিখবে, চাকরি করবে, সুখে থাকবে। মাযের চোখে স্বপ্ন,
মনে স্বপ্ন। সব স্বপ্ন রহিমের হাত উড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গেছে। রহিমের মা শুধু কাঁদে। কাঁদে আর কাঁদে। পোড়া
চোখের জল শুধুই ঝরে। কি করবে!
এহসান
বলে-ফুপ্পি চিন্তা করো না। রহিমকে বিদেশ পাঠাতে হবে। বিদেশে হাত লাগিয়ে দেবে। তখন আবার লেখাপড়া করবে। চাকরি
করবে। ফুপ্পি চোখ মোছে। বিদেশ তো পাঠাইবা বাবা, কিন্তু' টাকা? তোমার বাবার তো অতো টাকা নাই। আমারও নাই।
চিন্তা
করো না ফুপ্পি। এহসান বন্ধুদের নিয়ে একটা দল গঠন করে। রহিমের সাহায্যের জন্য টি.এস.সির
মোড়ে, চারুকলার সামনে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকটা বড়ো অফিসেও যায় ওরা।
খবরের
কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। সাহায্য আসতে থাকে। রহিমের তবুও মলিন মুখ। কৃতজ্ঞ চোখে হাসে। বলে,
অনেক করছো এহসান ভাই। তোমার বন্ধুরাও অনেক সাহায্য করছে। তোমরা অনেক অনেক ভালো। চোখ
ভিজে যায় রহিমের।
কেঁদো
না , কেঁদো না রহিম। এ কিছু না। এসব তো করতেই হয়। তুমি আগে ভালো হও, তারপর এতোসব কথা
বলো। এরপর রহিমকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। এহসানের বাবা ওর সঙ্গে যায়। এহসান এখানে থাকে।
যদি আরও টাকার দরকার হয়, টাকার যোগাড় রাখতে হবে।
কিন্তু,
না আর টাকার দরকার হয় নি। রহিম ভালো হয়ে গেছে। তবে আরও
একমাস থাকতে হবে ওখানে। নির্ধারিত একমাস যেন আর কাটতে চায় না। সকলে উৎসুক । রহিম ফিরে
আসে। এহসানকে জড়িয়ে
ধরে রহিম। তুমি না থাকলে এহসান ভাই, আমার কিছুই
হতো না। পঙ্গু হয়ে ভিক্ষে করতে হতো। ছি ছি একথা বলো না রহিম। আমরা মানুষ। আর
মানুষ তো মানুষের জন্যই। সেই গান শোনোনি “মানুষ মানুষের জন্য...”
রহিমের
মায়ের চোখ স্বপ্নে আর জলে চিকচিক করে। স্বপ্ন দেখে রহিম আবার স্কুলে যাবে। লেখাপড়া
করবে। বড় চাকরি করবে। আর কোন দুঃখ থাকবে না ওদের।