চাক্কা জ্যাম
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
তৃতীয় দিনে বেড়িয়েই পড়ল অঙ্কুর, দুদিন শুয়ে বসে ঘুমিয়ে খেয়ে কাটিয়ে চূড়ান্ত
বোর হয়ে গেছে সে। যদিও দাদুর লাইব্রেরির বই সঙ্গী ছিলো এই দুদিন। গোগ্রাসে পড়ছিলো,
কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। অর্থাৎ মাথা সেই
জ্যাম হয়েই রইলো, কোনো নতুন গল্পের প্লট আসছেনা। তাই নিজের ওপর আরোও রেগে
গিয়ে অনন্তদা বারবার মানা করা সত্ত্বেও সাত সকালে এই রাস্তাটাই ধরল অঙ্কুর। যদি
সত্যিই জীনপরী বলে কোনো বস্তু থাকে এবং তার সাথে একবার মোলাকাত হয়ে যায় তবে আর
অঙ্কুরকে পায় কে। পরের গল্পে নিজস্ব বিচিত্র অভিজ্ঞতাকেই লিখবে। তবে হ্যাঁ,
অনন্তদার বক্তব্য অনুযায়ী যদি তেনারা মেরেই
ফেলেন অঙ্কুর কে তবে তো খেল খতম। রাস্তাটার একটাই অসুবিধে টের পায় অঙ্কুর হুড়মুড়
মেঘ নেমে মাঝে মাঝেই ঢেকে দিচ্ছে সব দিক। রাস্তায় অঙ্কুরকে দেখবার মানুষ নেই নাহলে
ঠিক ভাবত কোনো সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে বুঝিবা। বাড়ীর থেকে বেশ অনেকটা পথ হেঁটে এসে প্রায় দুটো পাকদন্ডী ঘুরে রেলিং এর ধারে
দাঁড়ালো অঙ্কুর। খুব কান্না পাচ্ছে তার, জায়গাটা নির্জন দেখে কাঁদতে থাকল অঙ্কুর,
কেউ দেখতে পাবেনা সে কাঁদছে,
কিন্তু ক্রমে কান্নার বেগ সামলাতে নিজের
অজান্তে রাস্তার ওপর বসে পড়ে।
অঙ্কুরের কাকিমা যখন বিয়ে হয়ে আসেন অঙ্কুর তখন মাত্র দশ মাসের। পুতুলের মতো
বাচ্চাটাকে নাওয়ানো খাওয়ানো,তার সাথে খেলা করা, ঘুম পাড়ানো বহু সময়েই করতো পূর্না,
কারন তখন থেকেই চূড়ান্ত অসুস্থ ছিলো অঙ্কুরের
মা। শেষে অঙ্কুরের বছর দেড়েক বয়সে ওর মা মারা গেলে পুরো দায়িত্ব নেয় পূর্না।
কোনোদিন মায়ের অভাব টের পেতেও দেয়নি। নিজে স্কুল টিচার,
ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতো স্কুলে,
আয়ার হাতে সঁপে দেয়নি। অনেকটা বড় হবার পর
অঙ্কুর জেনেছে তার জন্য তার মামনি সন্তান ধারন করেননি। এমনকি এই নিয়ে কাকার সাথে
মনোমালিন্য হওয়ায় অঙ্কুরকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে তার মামনি। তবু আঁচ লাগতে দেয়নি
অঙ্কুরের গায়ে। অদ্ভূত ভাবে অঙ্কুরকে প্রথাগত কোনো লাইনে ঠেলে না দিয়ে পূর্না তার
ভেতরের লেখক সত্ত্বাকে টেনে বের করে সযত্নে লালন করেছে আর তাই এতো অল্প বয়সেই বেশ
কিছু প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ড আর কয়েকটা বেস্ট সেলার অঙ্কুরের সাফল্যের ঝুলিতে।
তাহলে? অঙ্কুর একাই বা
কেন? কাঁদেই বা কেন?
আসল মুস্কিল ওইখানেই;
অঙ্কুর সুদর্শন লেখক,
বিয়ে হয়নি, বা বলা ভালো করেনি বিয়ে,
ফলে বিভিন্ন উদ্বোধনে ডাক পড়ে,
আর সেখানে দুনিয়ার মেয়েরা ছেঁকে ধরে,
চূড়ান্ত অস্বস্ত্বিতে পড়ে অঙ্কুর। পাড়ায়
পাড়ায় দুটো বই এর স্টল আর এক গাদা খাবারের এবং অন্যান্য সামগ্রীর স্টল নিয়ে 'অমুক পাড়া ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত
বিশাল বই মেলা' এই নিয়ে যে কতো উদ্বোধন করতে বাধ্য হয়েছে অঙ্কুর। সাথে সাহিত্য আলোচনার আসর,
যেখানে আলোচনার চেয়ে বোধকরি সমালোচনা
পরস্পরকে আক্রমন অথবা সভার শেষে ভূরিভোজ এগুলোই বেশী ইম্পর্টেন্সী পায়। প্রথম
প্রথম মজা পেলেও আজকাল হতাশ লাগে তার। তারওপর পরপর কয়েকটা বেস্ট সেলার হওয়াতে সেই
স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার চাপ ও বাড়ছে। সামনে বইমেলা এবারের বইটা কেমন হবে সেই
নিয়ে চাপা টেনশন আছেই। এবছর ডিসেম্বর পড়তেই শহর ছেড়েছে অঙ্কুর বলতে গেলে
অজ্ঞাতবাসে এসেছে, তার অতি সম্প্রতি কোনো লেখা আসছেনা। রাইটার্স ব্লক হয়েছে
ভেবে ছটফট করে দেখে মামনিই ঠেলে পাঠিয়েছে তার দাদুর এই বাড়ীটায়। দাদুর বাড়ী মানে
পূর্নার বাবার বাড়ী, অঙ্কুর তাঁকেই দাদু জানে, নিজের মায়ের বাপের বাড়ীর কারো সাথে তেমন
যোগাযোগ নেই তার।
বছরের এই সময়টাতে মামনির বেজায় ব্যস্ততা, স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা,
তার রেজাল্ট, স্পোর্স্টস্, কোনো কোনো বার পিকনিক ও থাকে,
কাজেই একা আসতে বাধ্য অঙ্কুর। এই বয়স অবধি
নারী সঙ্গ বলতে শুধুমাত্র মামনির সাহচর্য্য পেয়েছে। আর তাতেই সে সবচেয়ে স্বস্তিবোধ
করেছে। কলেজ জীবনের একটা ঘটনা তার জেরও যুক্ত হয়েছে হতাশার লিস্টে। পূর্নার দিদিকে
নিজের মাসি মনে করলেও তারা কিন্তু কোনোদিনও অঙ্কুরকে ঠিক সেই চোখে দেখতনা। ছোটো
থাকতে অবহেলা করতো, আর বড় হবার পর চেহারা সুন্দর সাথে কিছু নাম ডাক হতে শুরু
হতেই নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টায় লেগেছিলো ওরা। সেদিন একা ছিলো বাড়ীতে অঙ্কুর
সুযোগ বুঝে পূর্নার দিদির মেয়ে অগ্নিবর্না উপস্থিত। তার উগ্র খোলামেলা সাজপোশাক
প্রথম থেকেই অস্বস্ত্বিতে ফেলেছিলো অঙ্কুরকে। কিছু সময় এটা ওটা গল্প করে হঠাৎই
শরীরি খেলায় মত্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। অঙ্কুর একেবারে অপ্রস্তুত অগ্নির এহেন
আচরনে। সামনে অমন আকর্ষনীয় উন্মুক্ত নারী মূর্তি দেখে প্রলুব্ধ হবার বদলে চূড়ান্ত
অনিচ্ছা বোধ কাজ করে অঙ্কুরের মধ্যে। প্রেমবিহীন শুধু শরীর নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ
না দেখানোতে সপাটে চড় খেয়েছিলো অগ্নিবর্নার হাতে "শালা ইম্পোটেন্ট"
বলে আশাহত
অগ্নি বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। ভেবেছিলো অঙ্কুরের মতো সফল সুদর্শন পুরুষকে বগলদাবা
করতে পারলে এক মুহুর্তে লাইমলাইটে এসে যাবে সে, কিন্তু হোলো না। তবে এই ঘটনা অঙ্কুর না
পেরেছে কারো সাথে শেয়ার করতে, না হজম করতে। স্বাভাবিক ভাবেই অল্প বয়সী মেয়েদের প্রতি একটা
বিতৃষ্ণা তৈরী হয়ে যায় অঙ্কুরের। আর গত মাসে এক লেখক বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে হারিয়ে
যাওয়া একটা বাচ্চাকে বেশ খানিকক্ষন সঙ্গ দিয়ে তার কান্না মুছিয়ে মা বাবাকে খুঁজে
বের করে তাদের কাছে হস্তান্তরিত করে। ঘটনাটায় উপস্থিত অনেকেই ভাবেন অঙ্কুর চূড়ান্ত
মেয়েলি, হয়তবা সমকামী এবং
তাঁদের ভাবনাকে সরাসরি ব্যক্তও করে ফেলেন; এই জন্যই যে অঙ্কুরের বিয়ে হয়নি। ঘটনাটায়
ধাক্কা খেয়েছিলো অঙ্কুর। কেন একজন পুরুষের মধ্যে অপত্য স্নেহ থাকতে নেই?
সমকামীদের প্রতি তার মনোভাব সমর্থনের হলেও সে
নিজে তেমন নয় এটা পুরোপুরি বুঝতে পারে। পূর্না কিছু একটু আন্দাজ করে ঠিকই,
ছেলে যথেষ্ট বড় হয়েছে এবার নিজেরটা নিজে
হ্যান্ডেল করতে শিখুক ভেবে ঘাঁটিয়ে বের করেনি কি হয়েছে তার। শুধু শহর থেকে ঠেলে
পাহাড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলো যাতে নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায় অঙ্কুর।
এই বাড়ীটার পরিবেশ অঙ্কুরের কাছে অচেনা নয়। পুরোনো আমলের কাঠের বাড়ী,
কয়েকটা ঘর দিনের বেলাতেও আধো অন্ধকার। সারা
বাড়ীময় কেমন সোঁদা সোঁদা ধুনো ধুনো গন্ধ। কেয়ারটেকার লীলাবাহাদুর আর রাঁধুনি অনন্ত
বহু দিনের লোক; অঙ্কুরকে ভালোওবাসে দুজনেই। এযাত্রায় অঙ্কুর একা আসায় দুজনেই খুব জোর
গার্জেনগিরি ফলাচ্ছে অঙ্কুরের ওপর। সারাদিন ঘরে থাকে তা ও ঠিক আছে,
কিন্তু কোনোমতেই একা যেন এই রাস্তায় না আসে
বারে বারে সাবধান করেছিলো। অঙ্কুর শোনেনি সে কথা। লুকিয়ে এই রাস্তাতেই এসেছে,
কিন্তু নিজের কষ্ট ধরে রাখতে পারেনি। মামনির
প্রতি কৃতজ্ঞতার বোঝা, নিজের লেখার স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখা,
লেখক হয়ে লেখা বাদে অন্য কাজের জন্য তার
চাহিদা, অগ্নিবর্নার
থাপ্পর, বন্ধুর বিয়ের
দিনের ঘটনা, সব মিলিয়ে যে তার রাইটার্সব্লক সেটা তার কাছে পরিস্কার। কিন্তু তার থেকে বের
হবার উপায় কি দুদিন ধরে লেখাপড়া করেও ধরতে পারলনা। তাই হুহু করে কান্না এলো তার।
ঘরে বসে কান্না করলে তো দুইজনে ধরবে কি হয়েছে জানতে চাইবে। মামনি ছাড়া আর কারো
কাছে মন খুলতে পারেনা অঙ্কুর। সতি্য বলতে কি, মামনির কাছে কিছু বলতেও হয়না,
কেমন করে যেন ঠিক বুঝে যায় পূর্না। আর আজ তার
এমন সঙ্কটের সময়ে মামনি কিনা একা তাকে পাঠিয়ে দিলো? হ্যাঁ এটা ঠিক যে শহরে থাকলে ওই সব উদ্বোধন
ইত্যাদি নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কোনোনা কোনো ক্লাবের কর্মকর্তা মুখ চুন করে,
হাত কচলাতে কচলাতে হাজির হোতো। অঙ্কুরের
অতিষ্ঠ লাগলেও কোনোদিন না করতে পারেনা এদের, সেই উপদ্রবের হাত থেকে বাঁচলেও নিজের
প্রব্লেম থেকে পরিত্রান পায় কি করে? মামনির ওপর অভিমানও জমেছে,
আর কেবল মনে হচ্ছে সে হেরে যাচ্ছে। না হলে
তার লেখার থেকেও সৌন্দর্য্যের চাহিদা বেশী হোলো? এতোদিনেও তার মতো সুন্দর পুরুষের কোনো নারী
সঙ্গী জুটলো না কেন? কেনই বা তার রাইটার্সব্লক হোলো?
দুহাতে মুখ অর্দ্ধেক ঢেকে বসলেও যে কেউ দেখেই
বুঝে যাবে সে কাঁদছে।
"আপনার কি শরীর খারাপ?"
একটা প্রশ্নে আচমকা সব চিন্তা ছিন্ন
অঙ্কুরের। প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকিয়ে দেখে যেন মাটি ফুঁড়ে সে হঠাৎ উপস্থিত।
রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা অঙ্কুর, কোত্থেকে এলো এ আর অঙ্কুরকেই দেখতে পেতে লাগলো?
একবার ভাবলো অনন্তদার বলা সেই জীনপরীই নাকি।
কয়েকটা মুহুর্ত লাগল প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে। ততক্ষনে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন "ডাক্তার লাগবে? শরীর বেশী খারাপ
করছে? কি দরকার ছিলো
এতোটা রাস্তা একা আসবার? জানেন না যতো ওপর দিকে উঠবেন ততো কষ্ট বাড়ে?
খুব অসুবিধা হচ্ছে?
পারবেন ফিরতে?" অঙ্কুর কেমন আবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকে,কে এ? ওর কথা গুলোর কেমন ডুয়াল মিনিং রয়েছে। চশমাটা
খুলে চোখ মোছে
"নাঃ থ্যাঙকস্, আমি ঠিক আছি। আপ্ নি?
মানে এখানেই থাকেন,না __?"মিট্ মিট্ করে হাসে মেয়েটা
"আমার বাড়ী তো আপনার দাদুর বাড়ীর সামনেই,
আমি আপনাকে চিনি।" সম্বিত ফেরে অঙ্কুরের, উঠে দাঁড়ায়
"ওঃ তাই বুঝি? না মানে আমি তো কখনও লক্ষ্য করিনি" হাঁটতে শুরু করে বাড়ীর দিকে ওরা। মেয়েটিকে
এবারে মন দিয়ে দেখে অঙ্কুর, বেশ সাধারন
চেহারা, তবে চোখ দুটো কথা
বলে ওর। সব মিলিয়ে কোথায় যেন আকর্ষন ঠিক বোঝা যায়না। পাশ দিয়ে চলে গেলে হয়ত ঘুরেও
দেখতনা অঙ্কুর কোনোদিনও কিন্তু এখন মেয়েটির সঙ্গ ভারী ভালো লাগছে,
নিজেই অবাক হোলো। মেয়েটি একটু দূর চুপচাপ
হেঁটে হঠাৎ প্রশ্ন করল
"কি হয়েছে? রাইটার্সব্লক?" অঙ্কুর বিষম
খেয়ে, হোঁচট খেয়ে
একাকার, তাতে আবার ফিক্
করে হাসে মেয়েটা।
"তুম্ আপনি কি করে __?"
ভেবে পায়না অঙ্কুর কি করে বুঝল,
না হয় জানে যে সে রাইটার তাই বলে এটা ধরতে
পারল? তার আচরনে কি
বুঝল? নাকি আন্দাজে ঢিল
মারলো? নাকি মন পড়তে
পারে? ইন্টারেস্টিং। "যেটা স্পনটেনিয়াসলি আসে সেটাই বলুন না, ফর্মালিটির কি
আছে? 'তুমি'
বলতে পারেন স্বচ্ছন্দে"
"বেশ তা নাহয় বললাম। কিন্তু তুমি ফস্ করে
রাইটার্স ব্লক বললে কিকরে? না, মানে আমার তো গায়ে নোটিস ঝোলানো নেই। আমার কোনো বড় ধরনের
শোক থাকতে পারে যার দুঃখে আমি ওই ভাবে বসেছিলাম, বা ধরো এমনিই বসে থাকতে থাকতে ইমোশনাল হয়ে
পড়েছিলাম তা ও তো হতে পারে তাই না?"
"আমার অনুমান তার মানে নির্ভুল?
দেখুন আপনার মতো সফল লেখক একজনকে আমি খুউব
কাছের থেকে দেখেছিলাম। তাঁর সাথে মিল পেলাম। আপনার শোক হলে দুনিয়ার চোখকে ফাঁকি
দিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পনে নিজের দুঃখকে নিয়ে বসতেন না। তাছাড়া আপনার মতো ব্যস্ত
মানুষদের শোক করার সময় থাকে? বেশী শোক হলে সেটাও একটা লেখার মাধ্যমে মিটিয়ে নেবেন।
একমাত্র তখনই এ ভাবে কাতর হবেন যখন লেখাটাই আসছেনা" হাঁ করে তাকিয়ে রইল অঙ্কুর। কথা বলতে বলতে, না বলতে বলতে একপাকদন্ডী চলে এলো যেন চট্ করেই। আর এক পাক তারপর কিছুটা গেলেই
তো বাড়ী এসে যাবে, অঙ্কুরের কিছুতেই চলে যেতে দিতে মন চাইলনা নামটা অবধি জানা
হয়নি এখনই যেতে দেয় কি করে? অঙ্কুরই রাস্তার ধারের বড় বড় বোল্ডারের ওপর বসার অফার দিলো।
মেয়েটিও যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলো এক কথায় মেনে নিলো। কেমন সহজ ভাবে চলল অঙ্কুরের
সাথে যেন কতো দিনের পরিচিত। এখান থেকে নদীটা বেশ সুন্দর করে দেখা যায়। মেঘ আটকে
আছে চারিদিকের ঝুলে পড়া গাছের মাথায় মাথায়। মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে,
কিছু সময় নিজের মনে থাকতে দিলো,
ততক্ষন অঙ্কুর তাকিয়ে থাকল। ঝলমলে রঙ্গীন
একটা ভারী পঞ্চ ধরনের উলের পোশাক পরা সাথে জিনস্। মাথায় ওই পোশাকের সাথে মানান সই
টুপি আর নরম লোমোশ ইয়ারমাফ দুটোকে হেডফোনের মতো গলায় টাঙ্গানো। সোজা সোজা চুল গুলো
ছড়িয়ে আছে পিঠে কাঁধে। ও হোঃ নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি সম্বিত ফেরে অঙ্কুরের।
"তোমার নামটা জানতে পারি?"
প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকায় মেয়েটি যেন অন্য কোনো
রাজে্য বিচরন করছিলো
"কল্পিতা" একটু মৃদু স্বরেই জানালো। নামটা মানান সই লাগল অঙ্কুরের এই
মেয়ে যেকোনো লেখক বা কবির কল্পনা হতেই পারে। কল্পনা মানেই যে তাকে
ডানাকাটা পরী বা সুন্দরী অভিনেত্রী মার্কা হতেই হবে তার কি মানে?
সাধারন আটপৌরে চেহারা কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত হতে
পারে না? বসতে আসার পর
থেকে দু'তরফেরই যেন কথা
বলার ইচ্ছে অথচ খুঁজেই পাচ্ছেনা কোথা থেকে শুরু করে, কে আগে শুরু করে। মেয়েটি কি করে,
অঙ্কুরের লেখা পড়েছে কিনা ইত্যাদি জানবার খুব
ইচ্ছে হচ্ছিল তবে অঙ্কুরের প্রশ্ন তার মনেই থেকে গেলো,
প্রশ্ন করল মেয়েটিই "এবারে আপনি একা এসেছেন? আর কেউ আসেননি?"
"আর কেউ বলতে তো শুধু আমার মামনি,
নাঃ আসেননি। ব্যস্ত" একটু ক্ষোভ অভিমান ঠিক ঝরে পড়ল অঙ্কুরের আওয়াজে। কি আশ্চর্য্য
সেটাও মেয়েটার কান এড়ালো না।
"এতে এতো হতাশ হবার মতো কি হোলো?
উনি কি সারাজীবনে এমন কোনোদিনও পাবেননা যখন
নিজের মতো করে থাকতে পারবেন? সারাটা জীবন আপনার শুভ চিন্তা করে আপনাকে সঙ্গ দিয়ে কাটাতে
হবে নাকি?"
"তুমি দেখি সাংঘাতিক। আমার একটা ফিলিংসও চোখ
এড়াচ্ছেনা। তুমি বিবেকের রোলটা খুব ভালো করতে পারবে"
"পুরোনো ডায়ালগ, সত্যজিৎ রায়। তবে উত্তম কুমার আরো সুন্দর
ডেলিভারি করেছিলেন। যাইহোক, দেখুন বিবেক টিবেক নই, স্পষ্ট কথা পরিস্কার ভাবে বলতে ভালোবাসি। এই
যে আপনার কিছু অদ্ভূত আচরন যেগুলো দেখে যে কেউ ধরে ফেলবে আপনার কিছু হয়েছে। কিন্তু
মুখের ওপর বলবে ক'জন? অথচ এগুলো বললে, আলোচনা করলে আপনার উপকারই হবে। এমন দম বন্ধ
ভাবটা আপনার কেটে যাবে, ঠিক একটা ওয়ে আউট হবে এটা আপনিও জানেন। কি ভুল বললাম?"
মাথা নাড়ে অঙ্কুর। মেয়েটা সতি্যই তার উপকারে
লাগবে। এমন করে কথা বলছে অঙ্কুরের খুব স্বস্ত্বি হচ্ছে,
মন খুলে সব কথা বলে হাল্কা হতে ইচ্ছে করছে।
রিল্যাক্স করে বসল, কথা এবারে সে ই বলবে। সমাধান চাইবে তার সমস্যার। ধীর গলায়
বলতে থাকে
"নাঃ, মামনি সারা জীবন কেন আমার জন্য দেবেন?
বরং উনি এতো করেছেন সেই ঋণ কোনোদিন শোধ করতে
পারব কিনা। তবে হ্যাঁ এবারে আমার এমন জটিল মানসিক অবস্থায় উনি পাশে না দাঁড়ানোয়
খুবই কষ্ট পেয়েছি।" কল্পিতা বড় বড় চোখ তুলে তাকায় "উনি আপনার কাকিমা হন, এই তথ্যটা আপনি
ভুলতে পারেননা তাই না? সত্যিকারের মা হলেও কি একই রকম ঋণী লাগত নিজেকে?"
ছ্যাঁকা লাগার মতো চমকায় অঙ্কুর। কথা সরেনা
তার মুখে, দেখে একতরফা
কল্পিতাই বলে চলে। "উনি কিন্তু আপনাকে নিজের সন্তানই ভাবেন। আর তাই একজন মা হয়ে ওঁর করনীয় গুলো
করেছেন। এমনকি এবারে এই যে একা আপনাকে আসতে দিয়েছেন তাতেও ওঁর মহৎ উদ্দেশ্যই দেখা
যাচ্ছে। উনি কি আর চিরটাকাল আপনার সমস্যার সমাধান করবেন? নিজের সমস্যা
নিজেই মেটান, স্বাবলম্বী হোন। ওনার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকতেই পারে কিন্তু সেটার বোঝার তলায়
চাপা পড়ে যাবার মতো কোনো ঘটনা নেই।" দু'মিনিট থেমে আবার
শুরু করল কল্পিতা, "দেখুন আপনার যে রাইটার্স ব্লক ভাবছেন,
এটা কি সত্যিই কোনো সমস্যা?
মানে রাইটার্সব্লক কি এবং কেন বা তার সমাধানের
উপায় এগুলো নিয়েই কিন্তু একটু পড়াশোনা করে দিবি্য লিখে ফেলতে পারেন;
তাই না? আর 'অঙ্কুর' মানেই একটা অসাধারন সাব্জেক্ট নিয়েই লিখতে
হবে এমন কেন? সাধারন দৈনন্দিন জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে লিখুননা। আপনার লেখনিতে সেটাও কিন্তু
অসামান্য রূপ পেতে পারে, এইটুকু কন্ফিডেন্স নেই আপনার? তাহলে তো অপেক্ষাও করতে হয়না কোনো লেখার
সাব্জেক্ট পাচ্ছিনা করে তাইনা? আর জীবনে যদি আরোও কোনো সমস্যা থাকে,
যেটা ধরুন আপনার মামনির সাথেও শেয়ার করতে
পারছেন না, সেগুলোকে আমি সাজেস্ট করবো আরোও একবার ভাবুন। মানে,ভেবে দেখুন যে, সেগুলো আদৌ মাথা ঘামানোর মতো মন খারাপ করার
মতো কোনো ব্যাপার কি? যদি হয় তবে ভরসা করতে পারেন এমন কোনো বন্ধুর কাছে মন খুলে
বলুন। আর যদি তেমন না হয় তাহলে জাস্ট ডিলিট করে দিন। ওই সব জাঙ্ক রেখে ব্রেনের ওপর
প্রেশার দেওয়া কি দরকার?" এতো সহজ সমাধান এটা অঙ্কুরের মাথায় এলোনা?
তবে এটাও ঠিক যে,
অঙ্কুর নিজের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখারই
চেষ্টায় মেতেছিলো। সত্যিই তো সাধারন কোনো বিষয়
কে ও সে অসাধারন বানিয়ে ফেলতে পারতো। আর যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারছিলোনা
সেগুলো কি কল্পিতাকে বলবে? নাকি ওর সাজেশন মতো ডিলিট করে দেবে। কল্পিতা উঠে দাঁড়ায়,
এখনকার মতো বিদায় নিতে চায়। অঙ্কুরকে কিছুটা
সময় নিজের সাথে কাটানোর সাজেশন দেয়।
জলের ঝাপটায় আর অনন্তদার আকুল ডাকে জ্ঞান ফিরল অঙ্কুরের। কিছুই বুঝে উঠতে
পারেনা কি হয়েছে তার।পরে অনন্তদার কথায় শুনল রাস্তার ধারে যেখান থেকে নদী ভালো করে
দেখা যায় সেখানে বোল্ডারের ওপর অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে ছিলো অঙ্কুর। ভাগ্য ভালো যে
বেশী দেরী হয়নি তাকে খুঁজে পেতে। অনন্তদা আর লীলাবাহাদুরের কেমন সন্দেহ হয়েছিলো যে
অঙ্কুর ওই পথেই গেছে। তাই সক্কাল সক্কাল ঘরে না পেয়ে খুঁজতে যায় তাকে। শুধু চশমাটা
ভেঙ্গে গেছে আর মাথায় একটু কেটেছে ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে চোট তেমন নয়। তবে একেবারে
অক্ষত অবস্থায় পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যপার,কারন,ওই রাস্তাতেই গত দুবছরে অনেকের অ্যাক্সিডেন্ট
হয়েছে; কেউ কেউ মারা ও
গেছেন আর সেই জন্যই অঙ্কুরকে মানা করছিলো ওরা। আচ্ছা, কল্পিতা চলে যাবার পর তার মানে কিছু ঘটেছে,
কারন ওই অবধি স্পষ্ট মনে আছে অঙ্কুরের তার
পরের কিছু তো মনে করতে পারছেনা, সব গোলমাল লাগছে তার। যাক, আপাততঃ ঘুমিয়ে নিয়ে সুস্থ হতে হবে। দুপুরের
খাওয়া দাওয়ার সময় দাদুর বাড়ীর সামনের বাড়ীতে কারা থাকে জানতে চাইল ওদের কাছে। শুনল
এক বৃদ্ধ তার পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে থাকেন। বছরের এই সময়ে ওনার পুরো পরিবার আসে
এখানে। বছর দুয়েক আগে ওই রাস্তাতেই ভদ্রলোকের এক ছেলে আর নাতনি মারা যায়। ভদ্রলোক
কি করতেন এখন চলে কিকরে এসব খবর কেউ জানেনা কারন ওঁরা বড্ড একাচোরা,
মেশেনা কারোর সাথে,
বিশেষ করে ওই ঘটনার পর থেকে আরোই মেশেনা।
বিকেলে অঙ্কুর অস্থির হয়ে উঠল খুব ইচ্ছে করছে কল্পিতার সাথে কথা বলতে,
সব কিছু ওর সাথেই শেয়ার করতে। তার এই রকম
অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার কথাটাও জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে। টুকটুক করে চলেই গেলো
ওদের বাড়ী। ও বাড়ীটাও বেশ পুরোনো বনেদীয়ানার ছাপ ওয়ালা কাঠের বড় বাড়ী। দরজা খুলল
অবশ্য সম্পূর্ন অচেনা মুখ, ঘরে গিয়ে পরিবারের মুখোমুখি হোলো;
বৃদ্ধ বৃদ্ধা তাঁদের এক ছেলে আর্মিতে,
তিনি তাঁর স্ত্রী ও উপস্থিত। নিজের পরিচয়
দিলো অঙ্কুর; শুনল যে ছেলে মারা গেছেন তিনিও লেখক ছিলেন, তার স্ত্রী একজন ডাক্তার তিনিও আপাততঃ রয়েছেন এদের
সাথে। সবাইকে দেখছে শুধু যাকে দেখতে চায় তাকেই দেখতে পাচ্ছেনা বলে জানালো যে সে
সকালে কল্পিতার সাথে পরিচিত হয়েছে এখন আরেকটু তার সাথে কথা বলতে চাইলে বাড়ীর
মানুষদের আপত্তি হবে কিনা। অবাক চোখে তাকায় সবাই তার দিকে। পরিবারের এ হেন আচরনে
বেশ পাজলড্ অঙ্কুর। যিনি ডাক্তার পুত্রবধূ জানতে পারল উনি কল্পিতার মা হন,
হাতের ইশারায় পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে
দেওয়ালে টাঙ্গানো বড় একটা ছবির সামনে দাঁড় করালো। ছবিতে বোল্ডারের ওপর বসা,
ঝলমলে রঙ্গীন ভারী পঞ্চ মতো উলের পোশাক,
সাথে জিনস্, মাথায় ওই পোশাকের সাথে মানান সই টুপি আর নরম লোমশ ইয়ার মাফ দুটো হেডফোনের মতো
গলায় টাঙ্গানো, সোজা সোজা চুল গুলো ছড়িয়ে আছে কাঁধে, কল্পিতার চোখ দুটো হাসছে। রাইটার বাবাকে
বাঁচাতে গিয়ে ওই রাস্তায় হড়কে পড়ে মারা যায় এই রকম সময়েই,
বছর দুয়েক আগে। কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে যায়
অঙ্কুর কল্পিতাদের বাড়ী থেকে।
"মামনি, এবার বইমেলার পর,
পুজোর আগে, সামারেই আরোও একটা বই বের করতে পারব,
দেখো ওটা ও বেস্টসেলার হবে।" ছেলের কান্না ভেজা আওয়াজ ঠিকই কিন্তু পূর্না
টের পায় পুরোনো আত্মবিশ্বাস এবং লেখার প্রচুর সাব্জেক্ট এখন অঙ্কুরের কাছে।