অনিশ্চিত তিনটি রাত
১
আজ অনেক দিন,
প্রায় চৌত্রিশ বছর পরে হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর সুন্দর রাতের কথা আবার মনে পড়ে গেল। অনিশ্চিত,
বিপৎসংকুল
সেই রাতের ছবি মাঝেমাঝেই
স্মৃতির
পটে দেখা দেয়,
বিশেষ করে যখন কারো কাছে কোন রাতের অভিজ্ঞতার গল্প শুনি। আর তখনই স্মৃতিপটে আরও,
আরও অনেক রাতের সুখ,
দুঃখ,
আনন্দ,
বেদনা,
অভিমান,
ভয়, সবাই স্মৃতির
আগল খোলা পেয়ে একে একে গেট-টুগেদারে
অংশ গ্রহণ করতে হাজির হয়ে যায়। ভয়ঙ্কর
রাত্রিও
যে কত সুন্দর
হতে পারে,
জানিনা
আমার মতো আর কেউ উপলব্ধি
করেছেন
কী না। আজ সেইসব স্মৃতি
থেকে তিনটি রাতের কথা বলবো।
সালটা ১৯৮০, মাসটা আগষ্ট, আমি, দিলীপ ও অমল হিমাচল প্রদেশের চাম্বায় এসে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য, মণিমহেশ দর্শন। অন্যান্য বারের মতোই সঙ্গে তাঁবু বা অন্য কোন সরঞ্জাম বিহীন যাত্রা। চাম্বায় অবস্থিত হিমাচল টুরিজম আমাদের পরিস্কার জানিয়ে দিল, মণিমহেশের পথে কোন থাকার জায়গা বা টেন্ট পাওয়া যাবে না। মণিমহেশ যাত্রীরা পথে রাতে কোথায় আশ্রয় নেয় জানতে চাওয়ায় উত্তর পেলাম—“এপথে সাধারণ কোন টুরিষ্ট যায় না। জন্মাষ্টমী থেকে রাধাষ্টমী, এই সময়টার মধ্যে সারা দেশ থেকে অসংখ্য পূণ্যার্থী এই পথে যায়, মণিমহেশে মানত করে ত্রিশুল পুঁতে দিয়ে আসার জন্য। তারা রাতে রাস্তাতেই থাকে, ভেড়ার মাংস পুড়িয়ে খায়। আমরাও নির্দিষ্ট সময়েই এসেছি, তাই আমাদের এই পথে যাবার জন্য সাহায্য করার অনুরোধে আমাদের জানানো হ’ল, তাদের পক্ষে আমাদের কোনরকম সাহায্য করা সম্ভব নয়, এমন কী তাঁবুর পরিবর্ত হিসাবে পলিথিন শীট পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব নয়। আমার দুই সঙ্গী এই উপাদেও সংবাদটি পেয়ে একটু মুষড়ে পড়লেও আমি কাউন্টারের ভদ্রলোকটিকে জানালাম, “আমরা মণিমহেশ যাব বলে যখন এতটা পথ এসেছি, তখন আমরা যাবই। আপনি সাহায্য করলে তো যাবই, না করলেও যাব”। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ঐ পথে হিমালয়ান বিয়ারের ভীষণ উৎপাত। রাস্তায় ভাল্লুক দেখলে আড়ালে চলে যাবেন। পাথর ছুড়ে বা অন্য কোনভাবে তাড়াতে যাবেন না। এইপথে অনেকে ভাল্লুকের আক্রমনে চোখ নাক হারিয়েছে, রাস্তায় হয়তো দেখা হলেও হতে পারে”। আমরা আর কথা না বাড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে এগিয়ে গেলাম। পিছন থেকে ভদ্রলোকের সাবধান বাণী শুনলাম—“সাবধানে যাবেন, তবে এইভাবে না গেলেই ভাল করতেন”। পরদিন আমরা বিকালের শেষে, প্রায় সন্ধ্যার মুখে, ভারমোড় এসে উপস্থিত হলাম। রাতে কৃষাণ নামে একজন কুলি কাম গাইডের সাথে ভোরে রওনা হওয়ার ব্যবস্থা পাকা করা হ’ল।
সকালে আমরা চারজন মণিমহেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সূর্যালোকহীন এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় অনেক দুরে একটা কালো রঙের হৃষ্টপুষ্ট প্রাণীকে গদাই-লস্করী চালে এগিয়ে আসতে দেখে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনেকটা কাছে আসতে বুঝতে পারলাম, সেটা আসলে একটা কুকুর। কুকুরটা আমাদের প্যান্ট, জুতো একটু শুঁকে দাঁড়িয়ে রইলো। আমরা এগিয়ে চললাম। কুকুরটাও কখনও আমাদের সামনে সামনে, কখনও আমাদের পিছন পিছন, আমাদের সাথে এগিয়ে চললো। একসময় অনেকটা দুরে দু’টো তাঁবু চোখে পড়লো। কৃষাণ জানালো আমরা ধানচৌ এসে গেছি। আরও কাছে আসতে লক্ষ্য করলাম একটা খুব ছোট তাঁবু, তার পাশেই অপেক্ষাকৃত একটু বড় আর একটা তাঁবু খাটানো আছে। বড় তাঁবুটার সামনে এক বৃদ্ধ বসে হুঁকো টানছেন। কৃষাণ জিজ্ঞাসা করলো একটা তাঁবুতে আমাদের থাকতে দেবার জন্য বৃদ্ধকে অনুরোধ করবে কী না। আমি বারণ করলাম। কারণ একবার না বললে তাঁকে রাজী করানো মুশকিল হতে পারে। এইভাবে বিকালবেলা আমরা আমাদের কুলি কৃষাণ, ও গাইড কুকুরটার সাথে ধানচৌ এসে পৌঁছলাম। এখানেই আমাদের রাতে থাকতে হবে। এখনও জানিনা বিস্তীর্ণ এই উপত্তকায় রাতে কোথায় থাকবো।
বৃদ্ধের সাথে কোন কথা না বলে, তাঁর বিনা অনুমতিতে ছোট তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করে, মালপত্র একপাশে রেখে তাঁবুর বাইরে এসে, “নমস্তে লালাজী” বলে হাতজোড় করে তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে গল্প জুড়ে দিতে, তিনি খুব খুশী হলেন। ভদ্রলোক জানালেন এবার সারা দেশ থেকে পূণ্যার্থীর আগমন হবে, তাই রাস্তা মেরামত, মাইলস্টোনে রঙ করা ইত্যাদি কাজ হচ্ছে। তিনি সম্ভবত সুপারভাইজার, যদিও কাছেপিঠে আর কাউকে দেখলাম না। ছোট তাঁবুটার একটু ওপরে ছোট্ট একটা অস্থায়ী দোকান। আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, কোনরকম অনুরোধ ছাড়াই আগের মতো আবার ছোট তাঁবুতে এসে ঢুকলাম। তাঁবুর একপাশে কিছু বস্তায় সম্ভবত চাল রাখা আছে। আমরা তাঁবুর ভিতরটা ভালভাবে পরিস্কার করে, কৃষাণকে পাইন গাছের পাতা নিয়ে আসতে বললাম। কৃষাণ পাইন গাছের ডাল সমেত অনেক পাতা এনে হাজির করলো। তাকে ডাল থেকে ছিঁড়ে শুধু পাতা এক জায়গায় জড়ো করতে বললাম। এবার তাঁবুর চারপাশে নালার মতো করে কেটে, ঢালুর দিকে অনেকটা দুর পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। ব্যাস, অনেকটা শিবলিঙ্গ আকৃতির এই নালায়, বৃষ্টির জল আর তাঁবুতে ঢোকার কোন সম্ভাবনাই রইলো না। এবার আমরা পাইন পাতা তাঁবুর মেঝেতে বেশ মোটা করে পেতে, তার ওপরে পলিথিন শীট পেতে, তার ওপর কম্বল পেতে, খাসা বিছানা করে নিলাম। ভদ্রলোক চুপ করে বসে আমাদের কার্জকলাপ লক্ষ্য করলেও মুখে কিছু বললেন না। কুকুরটাও তাঁবুর বাইরে বসে রইলো।
আমরা সব কাজ সেরে তাঁবুর বাইরে আসলে ভদ্রলোক শুধু বললেন যে, এখানে বিচ্ছু অর্থাৎ পাহাড়ি কাঁকড়া বিছার খুব উপদ্রব, আমরা যেন তাঁবুর ভিতরটা ভালভাবে দেখে তবে বিছানায় শুই। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে, আমরা জায়গাটা এক চক্করে ঘুরে দেখতে গেলাম। আমাদের পিছন দিকটায় উঁচু পর্বতশৃঙ্গ, লম্বা পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঐ দিকে উঁচুনীচু মাঠের মতো অনেকটা জায়গায় ইতস্তত ছোট বড় পাথর পড়ে আছে। তারই এক ধারে, ছোট্ট দোকানটা। আমরা ঐ দিকে বেশ খানিকটা দুর পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালাম, বড় পাথরের ওপর চড়ে বসলাম, ফটো তুললাম। কিছুক্ষণ সময় ঐভাবে কাটিয়ে দোকানটায় ঢুকলাম। রাতে রুটি তরকারী পাওয়া যাবে শুনে আশ্বস্ত হলাম। দোকানটায় আর কিছু পাওয়া যাক বা না যাক, ডিম সাজানো আছে দেখলাম, আর দেখলাম লাল, নীল, সবুজ রঙের নানা আকৃতির সুদৃশ্য পেয়ালায় তরল পানীয়। হয়তো স্থানীয় কোথাও তৈরী, কিন্তু পানপাত্রে কেন ঢেলে রাখা হয়েছে, তা বোঝা গেল না। এখানে ঐ এক বৃদ্ধ লালাজী ছাড়া এতটা পথে দ্বিতীয় কোন মানুষের দেখা পাই নি। লালাজী এই রসে আসক্ত কী না জানিনা, তবে তিনি খেলেও আর কত খাবেন? তার জন্য অতগুলো পাত্রে তরল পানীয় ঢেলেই বা রাখার প্রয়োজন কী, বোঝা গেল না।
আমাদের সামনে অনেকটা নীচে সম্ভবত কোন পাহাড়ী নদী ছোট বড় পাথড়ের ওপর দিয়ে কুল কুল করে নিজের আনন্দে বয়ে যাচ্ছে। জল প্রায় নেই বললেই চলে। নদীর ওপাড়ে পর্বতশ্রেণী রক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ডানপাশে মণিমহেশ যাবার পথ, বাঁপাশটা দিয়ে কিছুক্ষণ আগে আমরা এসেছি। চারিদিকে পাইন বা ঐ জাতীয় আকাশচুম্বি গাছের সারি। ক্রমে অন্ধকার নেমে আসলো। আমরা দোকানটায় গিয়ে ডিমের অমলেটের অর্ডার দিলাম। সুদৃশ্য পান পেয়ালায় কী আছে প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল “দারু”। সঙ্গে ব্র্যান্ডির বোতল আছে, তবু মনে হ’ল জিনিসটা চেখে দেখলে কেমন হয়? অমল বললো বিষ হতে পারে, না খাওয়াই ভালো। আমি বললাম, “পাত্রে যখন সাজিয়ে রেখেছে, তখন খদ্দেরও নিশ্চই আছে। তারা যদি খেয়ে বেঁচে থাকে, আমরাই বা মরবো কেন”? শেষে ঠিক হ’ল কৃষাণ এইসব এলাকার লোক, ওকেই প্রথমে খাওয়ানো যাক। ওর কিছু না হলে, আমরা একপাত্র করে চেখে দেখবো। দারু খাবে কী না জিজ্ঞাসা করায়, কৃষাণ খুব খুশী হয়ে মাথাটা কাত করে প্রায় পেটের কাছে এনে সম্মতি জানালো। পর পর দু’পাত্র গলায় ঢেলে সে ডিমের অমলেটে কামড় দিল। নতুন কোন রোগের ওষুধ আবিষ্কারের পর গিনিপিগের ওপর প্রয়োগ করে চিকিৎসক যেমন অধীর আগ্রহে গিনিপিগটিকে পর্যবেক্ষণ করেন, আমরাও সেইরকম কৃষাণের ওপর লক্ষ্য রাখতে শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে যখন আরও একপাত্র খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলো, তখন নিশ্চিত হওয়া গেল, যে জিনিসটা ক্ষতিকারক কী না তার পরীক্ষার খরচ একটু বেশী হলেও, বিপদের কোন সম্ভাবনা নেই। তখন আমরাও ডিমের অমলেট সহযোগে দু’এক পাত্র করে পান করে তাঁবুতে ফিরে এলাম। আরও কিছু পরে দোকানে রাতের খাবার, রুটি তরকারী খেতে গেলাম। রুটির চারপাশটা গোল করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে আমরা দু’তিনটে করে রুটি খেলাম। কৃষাণ অনেকগুলো রুটি খেয়ে নিল। এখন আবার আমাদের সঙ্গে আমাদের অতিথি, গাইডটিও ল্যাজ নাড়তে নাড়তে রাতের খাবার খেতে এসেছেন।
তাঁবুর পাশে বসে অনেকক্ষণ গুলতানি করলাম। লালাজী বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। চারিদিক হালকা জ্যোৎস্নালোকে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। পয়সা খরচ করে দোকানে দু’এক পাত্র খেয়ে কোন নেশা না হলেও, এই পরিবেশ আমাদের নেশাগ্রস্থ করে ফেললো। নির্জন এই উপত্যকায় বেওয়ারিস্ তাঁবুর পাশে বসে হালকা চাঁদের আলোয় চতুর্দিক গাছপালা ঢাকা এক উপত্যকায় আমরা তিন বন্ধু। সঙ্গে কৃষাণ ও ভাল্লুক সাদৃশ্য এক সারমেয়। বহু নীচে জল বয়ে যাওয়ার হালকা দরবারীর সুর, তীব্র ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গতে, ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। গলা ছেড়ে কিছুক্ষণ “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে….” গাইলাম।
আমরা তাঁবুতে ঢুকে তাঁবুর দড়ি ভাল করে বেঁধে শুয়ে পড়লাম। অনেক রাত, ক’টা বাজে বলতে পারবো না, কিসের একটা খস্ খস্ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চুপ করে শুয়ে শুয়ে ভাবছি বিচ্ছু নয় তো? হিমালয়ান বিয়ারের পরিবর্তে অতি ভদ্র ও মিশুকে এক কুকুরের দেখা মিললেও, বিচ্ছুর পরিবর্তে যে তিন বাউন্ডুলে ব্যাচেলারের কাছে শুভবার্তা নিয়ে প্রজাপতি আসবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? আরও কিছু পরে উঠে বসলাম। অমল ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করলো “কিসের আওয়াজ বলতো”? বুঝলাম তার ঘুমও ভেঙ্গে গেছে। দু’জনে টর্চ জ্বেলে কোন বিচ্ছুর সন্ধান না পেলেও, একটা বেশ বড় মাকড়সা দেখতে পেলাম। ঐ রাতে তাঁবুর ভিতরে মোমবাতি জ্বেলে হিন্দুমতে তার সৎকার করা হ’ল। ইতিমধ্যে দিলীপেরও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কৃষাণের নাসিকা গর্জনকে উপেক্ষা করে তিনজনে তাঁবুর দড়ি খুলে বাইরে রাস্তার পাশে খাদের ধারে টর্চ জ্বেলে এলাম জলবিয়োগ করতে। চাঁদের আলো বোধহয় একটু জোর হয়েছে। নদীর ওপারে বহুদুর পর্যন্ত পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ মনে হ’ল মুখ ঘোরালেই যদি ভাল্লুকের দেখা পাই, তাই পাশের দুই বন্ধুকে বললাম, টর্চ নিভিয়ে ওয়ান টু থ্রী বললেই, ছুটে গিয়ে তাঁবুতে ঢুকবো। যেন টর্চ নিভিয়ে দিলে ভাল্লুক আর আমাদের দেখতে পারবে না। কথামতো আলো নিভিয়ে ছুটে তাঁবুতে ঢুকতে গিয়ে দেখি, দোকানের বহু উপরে সেই পাহাড়ের চুড়ায় আগুন জ্বলছে। ভালুকের ভয় ভুলে, কিসের আগুন ভাবতে বসলাম। শেষে আবার তাঁবুতে ঢুকে দড়ি বেঁধে শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে লালাজীর কাছেই মালপত্র রেখে, মণিমহেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ফেরার সময় শুনেছিলাম কোন মেষপালকের ভেড়া হারিয়ে যাওয়ায়, সে তার ভেড়ার খোঁজে ওখানে গিয়ে রাতে ফিরতে না পারায় আগুন জ্বেলেছিল।
(দ্বিতীয়অংশ পরের সংখ্যায় )