গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

ঝর্না চট্টোপাধ্যায়


আমি তিতাস...

 অনীশ

এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে, প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। কাল কি এইসময় ফোনটা এসেছিল,  নাকি আরো পরে, নাকি আরো আগেই! এক একটা সময় আসে, যখন চিন্তা-ভাবনা সব শেষ হয়ে যায়। কাল ফোনটা পাবার পর আমারও ঠিক সেই রকমই মনে হয়েছিল...আমার সব শেষ হয়ে গেল, কোথাও আর কিছু বাকি রইল না। কাল সারাটা রাত, আজ সারা দিন, দুপুর, বিকেল গড়িয়ে এখন বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় আমার নীলার কথা মনে  হল। এতক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কি করল এটা নীলা! কেন এমন করল,  আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। গত পরশু দিনই এসেছিল আমার কাছে, এইখানে, এইঘরেই। একটু ছটপট করছিল। কিছু যেন একটা হয়েছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল  না। বললাম--
কি হয়েছে, একটু চুপ করে বোস না, তুমি তো এমন কর না! উত্তর দিল--
-কথা বলতে ইচ্ছে না করলে বোল না, দিব্যি তো দিইনি।
ঝাঁঝিয়ে উঠল, যা নীলার কাছে আশা করাই যায় না। একেবারে শান্ত, ঠান্ডা একটা মেয়ে, কোন অস্থিরতায় এমন করে বলছিল, আমি বুঝিনি। নীলা সত্যিই একেবারে শান্ত, নিরুত্তাপ মেয়ে। মিহির, আমার বন্ধু, নীলাকে প্রথম দেখে বলেছিল---একেবারে ন্যাতানো মেয়ে, এই মেয়ে কি করে তোর বন্ধু হল, বলিহারি!
কে জানত নীলা এমন করবে?

 মিহির

এখন বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা, সন্ধ্যেই বলা যায়। গতকাল ঠিক এইসময়েই নীলার খবরটা পাই। তাঁর আগে সকালেই নীলা আমাকে ফোন করেছিল, বিকেল চারটের সময় হাওড়া ষ্টেশনে বড় ঘড়ির নিচে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু কাল আমার তখন আপিসের বড়ো কর্তার ঘরে ফাইল নিয়ে মিটিং-এ বসার কথা। বললাম, আরো কিছুটা পরে যেতে পারি। রাগ করে উত্তর দিল---
তাহলে আর আসার দরকার নেই।
কিছু বলতে যাব তার আগেই ফোনটা কেটে দিল। নিজের নয়, অন্য কোন জায়গা থেকে ফোন করেছিল নীলা। তারপরে যখন ফোনে খবরটা পাই, আমি তখনও মিটিং-এ, নীলাকে যাব বলেও যেতে পারিনি।
কেন এমন করল নীলা, তাঁর কি হয়েছিল!

 শর্বরী

এখন বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা। আমাদের এই জায়গাটা একটু অন্ধকার মতো, তাই সন্ধ্যে নেমে এসেছে মনে হচ্ছে। কাল কি এই সময়েই নীলার খবরটা পেয়েছিলাম, নাকি আরো পরে? ঠিক মনে নেই, কাল থেকে কিভাবে যে আমার সময় কেটেছে, আমিই শুধু জানি । সেই কোন ছোটবেলা থেকে ওর সঙ্গে পরিচয়...নীলা যে এমন করবে, কে জানত!
সকালেই আমাকে বলেছিল বিকেলে চারটের সময় গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়াতে, একসঙ্গে শাড়ীর দোকানে যাবে । আমার স্কুল থেকে ফিরতে আরো কিছুটা দেরি হয়, তাই বলেছিলাম, সাড়ে চারটে হলে অসুবিধে নেই। একটু চুপ করে আরো ঠান্ডা গলায় বলেছিল---আর কোন দিন আসার দরকার নেই ।
বোঝাতে যাব, লাইনটা কেটে দিল। আবার ফোন করতে গিয়ে দেখি অন্য কোন জায়গা থেকে ফোন করেছে, হয়ত কোন বুথ থেকে। মনটা খারাপ হয়েই রইল। বিকেলে বাড়িতে ফিরে চা-খাবার খাওয়ার পর মা সন্ধ্যে দিতে যাবেন বলে উঠেছেন, ফোনটা এল...কেন এমন করল নীলা...এখনও বুঝিনি !   

 তিতাস

আমি তিতাস । কাল ঠিক এইসময়ে আমিই খবরটা সকলকে দিয়েছিলাম। তখন বেলা চারটে । আমি কোচিং ক্লাস থেকে ক্লাস নিয়ে ফিরছি। কাল অন্যদিনের চেয়ে তাড়াতাড়িই ফিরছিলাম। এইসময় মেয়েটাকে দেখেছিলাম । কি সুন্দর যে দেখতে! আমি এত সুন্দর মেয়ে আগে কোনদিন দেখিনি । আমাদের এদিকে এত সুন্দর মেয়ে দেখা যায় না, এই মেয়ে নিশ্চয়ই খাস কলকাতার বনেদী পাড়ার মেয়ে । ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াতেই পলকের মধ্যে মেয়েটা ঝাঁপ দিল অতগুলো লোকের সামনে লাইনে ।   
চীৎকার, চ্যাঁচামেচি, গোলমাল...। সকলের সঙ্গে আমিও গেলাম লাইনের নীচে কাটা যাওয়া মেয়েটাকে দেখতে। মেয়েটা তখন লালে লাল...। কাছে গিয়ে আমার মনে হল মেয়েটার হাতে কি যেন একটা আছে মুঠো করা। সেদিকে তখন কারো হুঁশ নেই, সবাই টানাটানি করে তুলছে, যদি বাঁচানো যায় ! কিন্তু মেয়েটা বেঁচে ছিল মনে হয়নি । এক ফাঁকে হাতের টুকরোটা টেনে নিয়ে আমি প্রথমে আসতে আসতে বাইরে এলাম, তারপর ছুট লাগালাম প্ল্যাটফর্ম থেকে। ছুট...ছুট...একেবারে অনেক দূরে এসে থেমেছি। বাইরে এসে দেখি তিনটে ফোন নম্বর লেখা, আর কিছু নেই, কারো নাম নেই। আমি ঠিক করলাম জানিয়ে দেব, ফোন করব । কিন্তু মেয়েটার নাম জানি না । মন কিন্তু বলেছিল পুলিশ কেস হবে, সাবধান! তাই আবার ষ্টেশন, আবার কলকাতা, তিন জায়গার তিনটে ফোন বুথ থেকে তিনটে নম্বরে ফোন করে একই কথা বলেছি--মেয়েটা শেষ হয়ে গেল, রেলে কাটা পড়ল...ছিঃ ।
বাড়ি ফিরেছি, রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। মা দরজা খুলল দুঃখী, ভীতু ভীতু মুখে, যেন আমি আর বাড়ি ফিরব না , কিছু হয়েছে আমার...ধরেই নিয়েছিল। ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল মা--
এত রাত হল, কোথায় ছিলি ?’
--ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। মায়ের মুখে স্পষ্ট অবিশ্বাস ।  ভেবেছে বুঝি আমি টুবলুদের ঠেকে মজে গিয়েছিলাম। আমি মায়ের মুখের কাছে হাঁ নিয়ে গিয়ে বললাম...দ্যাখ, মুখে গন্ধ আছে কি না! মা ঠেলে সরিয়ে দিলেন---কি যে করিস !
বিছানায় গেছি রাত্রি প্রায় একটা । সেই থেকেই ভেবেই চলেছি। মনের মধ্যে একটাই ছবি...সেই মেয়েটা । যাওয়ার আগে আমায় দেখা দিয়ে কি লাভ হল ! কি ছিল ওর দুঃখ, কেন যেতে হল ওকে? ওরা ওকে যেতে দিল কেন...!