রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট অথবা রামছাগলের আনন্দ
বাজারে একটু ঘোরাঘুরি করেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল ক্ষিতীশ বাবুর। তিন দিনের মধ্যেই আনাজপাতি সব কাটা ঘুড়ির মতো নাগালের মধ্যে গোঁত্তা খাচ্ছে। বেগুন বারো টাকা। তিনদিন আগে কিনেছেন তিরিশ টাকা। মাসখানেক আগে তো আশি টাকা দরে তাকে আড়াইশ’ বেগুন কিনতে হয়েছে। ভাবা যায়! কী আর করা, একেই তিনি নিরামিষাশী, তায় ডায়াবেটিক। আনাজপাতি খেতেই হয় বেশি করে। গিন্নির সেদিকে মস্ত সুবিধে। এক টুকরো মাছ হলেই সাঁটিয়ে দেবেন এক থালা। তাঁর হাঁটু-কোমরের ক্যাচক্যাচানি ছাড়া অন্য কোনও বালাই নেই। যত ঝামেলা পাকাল ওই সুগার। নইলে ক্ষিতীশবাবুও বরাবর ডাল-পোস্ত দিয়ে থালা সাঁটিয়েছেন --
আনাজের পরোয়া আর কবেই বা করেছেন। এখন তো এক কাপ ভাত মাত্র বরাদ্দ। বাধ্য হয়ে শাকসবজি দিয়েই পেট ভরাতে হয়। তা, সেখানে যদি এক টাকার জিনিস পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতে হয় চামড়া চিড়বিড় করবে না? ক্ষিতীশ বাবু অবশ্যই গরিব লোক নন। সরকারের উঁচু পদে ছিলেন, বছর খানেক হল অবসর নিয়েছেন। মোটা পেনশন পান। নিজস্ব সঞ্চয় বিশেষ না থাকলেও অবসরকালীন যেসব থোক টাকা পেয়েছেন সেটা কম কিছু না। সেসব টাকা বেশিরভাগই ব্যাঙ্কে ফিক্সড্ ডিপোজিট করা আছে। তার সুদ পেনসনের সঙ্গে যোগ করলে তাঁর রোজগার মাইনের থেকে খুব একটা কম হচ্ছে না। তবুও আগে যেমন খরচ করে সুখ পেতেন, এখন আর তেমনটি পান না। তখনও ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বেতন চালু হয়নি। মাসান্তে নগদ পাঁচশ’ টাকার বাণ্ডিল ছাড়াও একশ, পঞ্চাশ, কুড়ি, দশ – কোনও কোনও মাসে এমনকি পাঁচ টাকার বান্ডিলও মিলত। তাঁর মাইনের টাকা আসত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে। সব ঝকঝকে নতুন নোট। ফেলে ছড়িয়ে খরচ করেও অর্ধেকটা শেষ হত না। ব্যাঙ্কে জমা দিতেও বুকটা ফেটে যেত। দোকান-বাজারে তখন তাঁর খাতিরই আলাদা। বড় নোট ভাঙালে খুচরো যেসব ময়লা নোট ফেরত পাওয়া যেত সেগুলো ছুঁতেও গা ঘিনঘিন করত। তাই তিনি দশ-পাঁচের বাণ্ডিল নিয়ে বাজারে বেরতেন। সব্জি-ওয়ালাকে হয়ত একটা পাঁচ টাকার নোট দিলেন। অমনি তার মোলায়েম হাসি, - আর গোটা ছয়েক দিন না কাকাবাবু, পাঁচের নোট তো আর চোখেই দেখি না।
ক্ষিতীশবাবু হয়ত ইতস্তত করছেন। তখন তার সুর আরও অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে, - আপনি তো কাকু সব খরচই করবেন। আমি যত্ন করে রেখে দেব। নাতি পুতিরা একদিন দেখবে। তখন হয়ত পাঁচ হাজার টাকার নোট বেরবে, লোকে একশ টাকার নোট ভিখিরির দিকে ছুঁড়ে দেবে।
ঠিকই তো। ক্ষিতীশ বাবু দিয়ে দিতেন। দিয়ে আনন্দও পেতেন। ভাবতেন, লোকটাকে অন্তত একটু আনন্দ দেওয়া গেল। আনন্দ পেতে তো লোক ভুলেই যাচ্ছে। ক্ষিতীশ বাবু নিজেও যেমন আনন্দে থাকতে ভালবাসেন, অন্যদেরও তেমনি যতটা সম্ভব আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আজকাল মানুষজনের মনটাই কেমন যেন খ্যাচড়া মতন হয়ে গেছে। নইলে চাইলে আনন্দের উপকরণের কোনও অভাব আছে নাকি মানুষের? তবে সেটা পেতে জানতে হয়। টাকা-পয়সা নয়, তার জন্যে দরকার মন। এই যেমন আজ তাঁর বেগুনের দামটা শুনেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। বেগুনকে কিছু লোক দুচ্ছাই করে বটে, কিন্তু তারা নেহাতই মূর্খ। বেগুন একটা অল-ইম্পর্ট্যান্ট সব্জি। আপনি পালং শাক খান, সুক্তো খান, থোড়-মোচা-কচু খান - বেগুন বিনে সবই কানা। এমনকি হালি তেতো যে নিমপাতা, তাতে বেগুন মিশিয়ে দিন তো সে অমৃত। গরম গরম বেগুনভাজার কথাটা বাদই দিন, শীতকালে বেগুনপোড়া যে খায়নি, তুরীয়ানন্দ কাকে বলে সে জানল না জীবনে! গরম গরম বেগুনির কথাটা না তোলাই ভালো – মুড়ি বা খিচুড়ি কোনটাই তাঁর গিন্নির পছন্দ নয়।
মনের সুখে দু-ব্যাগ ভর্তি বাজার করে ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরলেন ক্ষিতীশবাবু। গিন্নিকে সুখবরটা দেবেন বলে যেই না মুখ খুলতে গেছেন, অমনি এক ঝাপটায় তাঁর মুখটা বন্ধ হয়ে গেল।
থামো তো! কাজের লোকগুলোকে সব লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ, আর তারা সুযোগ পেয়ে আমার হাড়ে দুব্বো লাগাতে বসেছে!
ক্ষিতীশবাবু মনে মনে বললেন, -- হাড়ে দুব্বো গজায়, লাগানো যায় না। কিন্তু মুখে কথাটি না বলে চুপটি করে অপেক্ষায় থাকলেন ‘দুঃখবর’টি শোনার জন্যে। শব্দের অপচয় ও অপপ্রয়োগে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর অসামান্য প্রতিভা। কিন্তু ক্ষিতীশবাবু মনে মনে শপথ করলেন, আজ কোনোমতেই ধৈর্য হারাবেন না এবং অঘটনটি যাই হোক, মেজাজটিকে আনন্দচ্যুত করবেন না।
ক্ষিতীশবাবুর তৈরি এ বাড়িটির মতো সর্ববিধ অসুবিধাযুক্ত বাড়ি যে ভূভারতে একটিও মিলবে না – বিস্তর ক্ষোভের সঙ্গে এই মহামূল্যবান অভিমতটি ঘোষণা করে গিন্নি অবশেষে জানালেন, ঊর্মিলা আজ কাজে আসেনি এবং এ বাড়ি এমনই ‘বিন্দাস’ যে কোন ঝি-ই বেশিদিন টিকবে না এখানে।
ফুঃ! এই কথা। ঊর্মিলা কি ইংল্যান্ডেশ্বরী যে তিনি দর্শন না দিলে লাটসাহেবের ঘর অন্ধকার যাবে?
তোমার ওই ঢং-এর কথাগুলো রাখো দিকি! এক পাঁজা এঁটো বাসন পড়ে রয়েছে কাল রাত থেকে। সেগুলো তোমার কোন ঈশ্বরী এসে মেজে দিয়ে যাবে? দিনরাত সংসারের জোয়াল ঠেলতে ঠেলতে হাতে পায়ে হাজা হয়ে গেল। এত বেলায় এখন আবার বাসন মাজতে বসি!
অন্য সময় হলে ক্ষিতীশবাবু বলতেন, জোয়াল টানলে হাজা হয় না, কাঁধে কড়া পড়ে। বলদ-মোষ তো দেখলেই না চোখ মেলে। বদলির চাকরিতে সারা রাজ্যি সাথে সাথে ঘুরেও সেই তোমার ছোটবেলার হাতিবাগান-শ্যামবাজার ছাড়িয়ে আর কোন কিছুই চেনার চেষ্টা করলে না! সেবার মনে নেই, মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দশ হাত দূরে একটা গরু দেখলে। সে বেচারা মাথা নাড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছিল; অমনি তুমি গুঁতোতে আসছে ভেবে ছুটে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পায়ের হাড়ে চিড় ধরালে। আর তোমার কাজের ব্যাখ্যান? সংসারে তো দু’টি মাত্র প্রাণী। তার জন্যে চার-চারটে কাজের লোক! রাঁধুনি, বাসন-মাজুনি কাম ঘর-মোছানি, কাপড়-কাচুনি এবং শেষজনটি তোমার খাস বেয়ারিণী। ঝুল ঝাড়া, ঘর গোছানো, তোমার হাতে পায়ে তেল মাখানো, যাবতীয় ফাই-ফরমাশ খাটা – সবই তার দায়িত্ব। তাহলে কাজের আর বাকি রইল কী?
বাকি অবশ্যি আরও অনেক কিছুই রইল, ক্ষিতীশবাবু ভাবলেন। ঠাকুরঘরে গিন্নির তেত্রিশ কোটি দেবতারা সকলেই উপস্থিত। দু’বেলা তাঁদের পূজা গিন্নিকেই করতে হয়। কেননা, সেখানে তাঁর নিয়ম -কানুনের এমনই কড়াকড়ি যে পুরুত ঠাকুরেরাও বেইজ্জত হওয়ার ভয়ে তাঁর বাড়িতে পুজো করতে আসেন না। এ ছাড়া, চারটে কাজের লোকের পেছনে – এটা ছুঁলে কেন? ওটা বাঁ হাতে কেন, সেটা ডান হাতে কেন? – এই সব ফইজতে এবং রান্নাঘরের ন্যাতা দিয়ে খাবারের টেবিল মোছার মতো অনাচার আটকাতে তাঁর পরিশ্রম কম হয় না। আর সেই পরিশ্রমের ধকল সামলাতে ক্ষিতীশবাবুকে কাজের মেয়েদের সঙ্গে কিছু গোপন আঁতাত করতে হয়। ফলে তাদের কাছে তাঁর একটা আলাদা কদর আছে। তবে সেটা জনান্তিকে যে ভাষায় প্রকাশিত হয়, তা একদিন আলটপকা শুনে ফেলায় ক্ষিতীশবাবু যারপরনাই মর্মাহত হয়েছিলেন। বাজার করেই ফিরছিলেন সেদিন হাঁটতে হাঁটতে। তাঁর আগে আগে যাচ্ছিল তাঁর মাজুনি মেয়েটি তার এক সখীর সঙ্গে গল্প করতে করতে। তিনি শুনলেন মেয়েটি বলছে, - বড় বাড়ির বুড়োটা, বুজলি কুসু, হেব্বি হাঁদা! একটু মনে হয় মাতার দোষও আচে। এক তো মাইনা – বুড়ির সাতে যা ঠিক হবে, হবে। তার ওপর একশ-দেড়শ বুড়ো লুকিয়ে হাতে গুঁজে দেবে। আবার হটাৎ হটাৎ টাকার দরকার পড়লে – বুজলি কুসু – হি হি হি – বুড়োর পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দুক্কের কতা ফেঁদে কিচু আগাম চা – পাঁচশ – সাতশ – বুড়ো ঠিক বুড়িকে লুকিয়ে চুপচাপ হাতে গুঁজে দেবে। মাইনা থেকে কাটতে গেলে একটু কাঁদুনি গা – ব্যস্ - বুড়ো ফিসফিস করে শুধু বলবে – তাইলে পরের মাসে। চ্যাঁচাতে তো আর পারবে না – বুড়ি শুনে ফেললে যা হবে না! হি হি হি। আর বুড়োর টাকাগুলো যা না – বিন্দাস মাইরি – সব কড়কড়ে, যেন ছাপার কল থেকে এইমাত্তর বেরিয়ে এল। নাইলে বুড়িটা যা দজ্জাল, আর অষ্টপহর খিটখিট করে – কে করত ও বাড়িতে কাজ!
তো সেই মেয়েটাকে অবশ্যি গিন্নি জবাব দিয়েছেন বেশ কিছুদিন আগে। কে জানে তিনিও হয়তো শুনে ফেলেছিলেন তার ওইরকমই কিছু রসালো কথা। ক্ষিতীশবাবুর কাছে দরবার করতে এসেও কিছু ফল হয়নি বেচারার। নিজের কেস নিজেই গুবলেট করলে তিনি আর কী করবেন! সেই মেয়েটির পর তার জায়গায় বহাল হয় ঊর্মিলা। ঊর্মিলা তার আসল নাম নয়। রাঁধুনির সুপারিশে বহাল হয়ে প্রথম দিনে কাজে আসতেই ক্ষিতীশবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, -- নামটি কী গো মা কালী?
এমন সম্বোধনে একটু হকচকিয়ে গেলেও মোটাসোটা, গোলগাল, আলকাতরা রঙের মেয়েটি দেখা গেল বেশ সপ্রতিভ। মুহূর্তেই ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটি সামলে নিয়ে ঝকঝকে বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে দিয়ে বলল, -- আমার নাম সুপ্পোনখা গো মামা।
অ্যাঁ! সুপ্পোনখা? মানে শূর্পণখা! ছ্যাঃ ছ্যাঃ – মেয়ের এই নাম কেউ দ্যায়! শূর্পণখা কী করেছিল আর তার কী হয়েছিল জানিস?
অতসব জানব কী করে মামা! আমাদের ঘর কি এখেনে? সেই কোন ছাপরা জেলায় দেশ, পেটের ধান্দায় এখেনে বাস।
ক্ষিতীশবাবু বললেন, -- বটেই তো, বটেই তো!
ঊর্মিলা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, -- কী হয়েছিল মামা সুপ্পোনখার?
সেসব শুনে আর কাজ নেই তোর। বালাই ষাট্,
শূর্পণখা কোন দুঃখে হতে যাবি? তার চেয়ে ঢের ভালো ঊর্মিলা হওয়া। আমরা তোকে ঊর্মিলা বলেই ডাকব।
শুধু তোমরা কেন মামা, সব্বাইকেই বলে দেব আমাকে যেন উরমিলা বলে ডাকে। আনার সাট্টিফিটও নাই, ভোটার লিস্টিও নাই, তুমি যা নাম দিলে মামা সেটাই আমার আসল নাম।
তোর বরের নাম কি লক্ষ্মণ?
একটু থমকে গিয়েই ঊর্মিলা ওরফে শূর্পণখার কালো মুখে আলো ঝলকাল, -- হ্যাঁ গো মামা, তুমি জানলে কি করে? তুমি তো ভগমান গো মামা, গড় করি তোমাকে।
বলেই ঊর্মিলা তাঁর দু’পায়ের ওপর কেতরে পড়ল। গিন্নি এই সময় ফোড়ন কাটলেন, -- বাবাঃ, দেখিস আবার ভক্তির ঠ্যালায় মুচ্ছো যাসনে যেন!
অমনি ঊর্মিলা মুখ তুলে গিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, -- কী রূপ গো তোমার মামি, দুগ্গা পিতিমেও হার মেনে যাবে!
লাজে লাল হয়ে গেলেন গিন্নি।
ঊর্মিলা কাজে লাগল। বয়স বছর পঁচিশেক। ছাপরা জেলায় নাকি বাড়ি, কিন্তু বাংলা উচ্চারণে তার কোন ছাপ নেই। তার বর রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে। খালধারের বস্তিতে খাপরার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। চার বাড়িতে কাজ করে। সঙ্গে নিয়ে আসে তার চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েকে। মেয়েটা আপন মনে সিঁড়ির তলায় বসে ইঁট-কাঠের টুকরো নিয়ে একা একা খেলা করে। ঊর্মিলা দাপিয়ে ঘর মোছে, সশব্দে বাসন মাজে। মাঝে মাঝেই মামা-মামি যে স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেব-দেবী – পা ছড়িয়ে বসে জলখাবার খেতে খেতে সেই সমাচার ব্যক্ত করতে থাকে। ক্ষিতীশবাবু লক্ষ্য করেন, অন্য মেয়েদের কাজে গিন্নি যেমন অহরহ ‘নোংরামো’ বা ‘ফাঁকিবাজি’ আবিষ্কার করেন, ঊর্মিলার কাজে তেমন গুরুতর কিছু দোষ খুঁজে পান না। সামান্য কিছু পেলেও এমন মিষ্টি করে তাকে দাবড়ানি দেন যে ক্ষিতীশবাবু নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারেন না।
মাস তিনেক কাটার পর এক সকালে ক্ষিতীশবাবু গল্পের বই-এ ডুবে ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর তার কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা, অ্যাডভেঞ্চার আর হাসির গল্পের খুব নেশা হয়েছে। চাকুরি জীবনে ভারী ভারী আইনের বই পড়তে পড়তে মাথার ভেতরটা কেমন জট পাকিয়ে গিয়েছিল। এখন এই সব বই পড়তে পড়তে সেসব জট আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। তাঁর মনে হচ্ছে, সত্যই ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...’। এমন সময় ঊর্মিলা এসে তাঁর পায়ের কাছে বসল। বলল, -- আমার একটা ছাগল আছে, জানো মামা।
ক্ষিতীশবাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, -- অ।
‘অ’ কি গো মামা? আমি বলছি ছাগলের কথা। তুমি মোটে শুনছই না। বইটা একটু বন্ধ কর না মামা।
সামান্য বিরক্ত হয়েই ক্ষিতীশবাবু বই রেখে বললেন, -- ছাগল? ছাগলের দুধ খুব উপকারী, গান্ধিজি খেতেন। তুই মেয়েকে খাওয়াবি।
ঊর্মিলা হেসেই অস্থির। -- এমন কথা বল না মামা তুমি! আমারটা কি মাদি ছাগল যে দুধ দেবে? খাসি করা মদ্দা ছাগল, ছ’মাস মাত্তর বয়েস। তিন মাস বয়েসে কিনেছিলাম। এমনই বাড় যে এখনই তিরিশ কিলো মাংস হয়ে যাবে।
ক্ষিতীশবাবুর সংশয় ও রাগ – দুটো একসঙ্গেই হল। বললেন, -- ছ’মাসের বাচ্চার ওজন তিরিশ কিলো! আমাকে কি তুই শহুরে ভূত পেয়েছিস যে যা বলবি তাই বিশ্বাস করব! তাছাড়া, তুই মাংস খাওয়ার জন্যে ছাগল পুষেছিস? ছিঃ ছিঃ –
ও মামা! আগে শুনবে তো সবটা! আগে আগেই রেগে যাচ্ছো! দিশি ছাগল নয় মামা, রামছাগল। বড় হলে সত্তর-আশি কিলো ওজন হবে। আর খাওয়ার জন্যে পুষিনি মামা। তোমার মত মানুষের সামনে মিথ্যা বললে আমার জিভ খসে যাবে। কসাই-এর কাছে বিক্রি করলে অনেক টাকা লাভ হবে, সেজন্যেই পুষেছিলাম মামা।
ক্ষিতীশবাবু দেখলেন, ঊর্মিলার চোখ ছলছলে হয়ে আসছে। সে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল, -- আর কি বিক্রি করতে পারব মামা! ওটা যে কী ভালবাসে আমাকে তুমি বিশ্বাস যাবে না! আমি খেতে না দিলে খাবেই না। মেয়ের বাবা যদি খেতে দিতে যায়, এমন ঢুঁ মারবে না মামা, কী আর বলব! রাত্তির বেলায় যতক্ষণ না আমি চট পেতে দেব মেঝেতে, শোবেই না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। সব থেকে মজার কথা কী জানো মামা – বলেই ঊর্মিলা খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। ক্ষিতীশবাবু সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকলেন মজার কথাটা শোনার জন্যে। একটু পরে হাসি সামলে ঊর্মিলা বলল, -- আমার মেয়েটাকে একটুও দেখতে পারে না ছাগলটা। সামনে পেলে এমন ঢুঁ মারে না মামা – সেদিন তো ঢুঁ মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল, কপালটা এতখানি কেটে গেছে। খুব সাবধানে রাখতে হয় মেয়েটাকে।
শুনে ক্ষিতীশবাবু চমৎকৃত। বললেন, -- ছাগলটা তোকে মা মনে করে, বুঝলি ঊর্মিলা। সেজন্যেই মেয়েটাকে হিংসে করে।
(দ্বিতীয় অংশ পরের সংখ্যায়)