(দ্বিতীয় অংশ)
সালটা ১৯৭২, মাসটা ডিসেম্বর,
আমি একা বেনারস
হয়ে ওবরার পথে পাড়ি দিলাম।
বাড়ির সবাই তাল তুললো দাদার বিয়ের বেনারসী,
বেনারস
থেকে কেনা হবে। আমার এক নিকট আত্মীয়র
ভাই ওবরায় চাকরী করতেন।
শুনলাম
বেনারস
থেকে ওবরার এরিয়াল
ডিসটেন্স
একশ’
কিলোমিটার।
ঐ ভদ্রলোক
আমার সঙ্গে বেনারস
এসে,
আমায় বেনারসী
কেনায় সাহায্য
করবেন।
আমার বেনারস
ও বেনারসী,
উভয় ব্যাপারেই
বিন্দুমাত্র
ধারণা নেই। যতদুর বোঝা গেল ঐ ব্যক্তিটির
এই ব্যাপারে
পান্ডিত্য,
আমার মতোই। তখন মোবাইল
ছিল না। টেলিফোন
ব্যবহারকারির
সংখ্যাও
হাতে গোনা যেত। যোগাযোগের
সহজ ও একমাত্র
বিশ্বাসযোগ্য
ব্যবস্থা
ছিল,
টেলিগ্রাম।
আমার আত্মীয়টি
জানালেন,
যে তিনি তাঁর ভাইকে এক্সপ্রেস
টেলিগ্রাম
করে দিয়েছেন
নির্দিষ্ট
দিনে বেনারস
রেলওয়ে
স্টেশনে
উপস্থিত
থাকার জন্য। আমি তাঁর সাথে ওবরায় তাঁর কোয়ার্টার্সে
গিয়ে দিন কয়েক কাটিয়ে,
তাঁর সাথে আবার বেনারস
এসে বেনারসী
কিনে বাড়ি ফিরবো।
আমার আত্মীয়টি
যদিও কখনও ওবরায় তাঁর ভাইয়ের
কাছে যান নি, তবু তিনি জানালেন
যে, বেনারস
স্টেশনের
পাশ থেকেই ওবরা যাওয়ার
বাস ছাড়ে। এর আগে দু’একবার দীঘা বা পুরলিয়ায়
দাদার কাছে যাওয়া ছাড়া,
একা কোথাও বেড়াতে
যাওয়ার
অভিজ্ঞতাও
আমার নেই। এত ভালো ব্যবস্থার
পর, আমার একা ঐ অচেনা জায়গায়
যাওয়ার
মধ্যে আর কোন অসুবিধা
বা বিপদের
সম্ভাবনা
না থাকায়,
নির্দিষ্ট
দিনে দুন এক্সপ্রেসে
চেপে বেনারস
স্টেশনে
এসে নামলাম।
দীর্ঘক্ষণ
ধরে বেনারস
যাত্রীদের
ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে
নামা ও নতুন যাত্রীদের
প্ল্যাটফর্ম
থেকে ট্রেনে
ওঠার পর্ব শেষ হয়ে ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্ম
ছেড়ে চলে গেল,
তখন গুটিকতক
লোককে প্ল্যাটফর্মে
দেখা গেলেও,
তাদের মধ্যে আমার পরিচিত
ব্যক্তিটিকে
কিন্তু
কোথাও দেখলাম
না। আরও কিছুক্ষণ
প্ল্যাটফর্মের
এ্র প্রান্ত
থেকে ও প্রান্ত
পায়চারি
করে,
ওবরার বাসের খোঁজে প্ল্যাটফর্মের
বাইরে আসলাম।
কথামতো
স্টেশনের
বাইরে কোন বাসস্ট্যান্ড
বা বাসের দেখা না পেয়ে,
এক ব্যক্তিকে
ওবরা যাবার বাস কোথা থেকে ছাড়ে জিজ্ঞাসা
করায়,
হিন্দীতে
উত্তর পেলাম—
“ আপনি
এক কাজ করুণ,
আপনি মুখার্জীর
হোটেলে
থেকে যান। খুব সস্তা ও ভালো হোটেল”। বুঝতে পারলাম
এই ব্যক্তি
ঐ হোটেলের
দালাল,
কিন্তু
কারো কাছে ওবরা যাওয়ার
বাসের সঠিক সন্ধান
না পেয়ে শেষে স্টেশনের
একটা কাউন্টার
থেকে জানা গেল,
গোধুলিয়া
থেকে ওবরা যাবার বাস ছাড়ে। তাঁর কথার ওপর ভরসা করে রিক্সা
করে,
এই এলাকায়
নতুন হওয়ার অপরাধে
বেশী ভাড়া গুণে,
গধুলিয়ায়
এক বিশাল বাসস্ট্যান্ডে
এসে হাজির হলাম। অনেক বাস,
অনেক কাউন্টার,
অনেক প্যাসেঞ্জার।
খোঁজ করে করে নির্দিষ্ট
কাউন্টারে
এসে ওবরার টিকিট চাওয়ায়
হিন্দীতে
পরামর্শ
পেলাম—
“এখন
ওবরা যাওয়ার
কোন বাস নেই,
আপনি চোপান চলে যান,
ওখান থেকে ওবরা যাবার অনেক বাস পেয়ে যাবেন”। বাধ্য হয়ে শেষে চোপানের
একটা টিকিট কেটে,
নির্দিষ্ট
বাসের খোঁজে অগ্রসর
হয়ে আর এক অসুবিধার
সম্মুখীন
হলাম। বাসের টিকিটের
ওপর ইংরাজী
অক্ষরে
বাস নাম্বার
লেখা থাকলেও
বাসস্ট্যান্ডের
সমস্ত বাসের নাম্বার
প্লেট হিন্দীতে
লেখা,
যেটার সম্বন্ধে
আমার সম্যক্
ধারণার
যথষ্ট অভাব ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির
পরে নিজের বিদ্যা
বুদ্ধির
ওপর আস্থা হারিয়ে,
অন্যের
সাহায্য
নিয়ে নির্দিষ্ট
বাসের চেয়ার সিটটার
জানালার
ধারে জায়গা দখল করে বসলাম।
পকেটে বেনারসী
কেনার জন্য কয়েকটা
একশ’
টাকার নোট,
খুচরো টাকা প্রায় শেষ। বাস থেকে নেমে পুরি আর কালো রঙের বেগুনের
তরকারী
খেয়ে বাসে ফিরে এলাম। আস্তে আস্তে বাসটায়
ভিড় বাড়তে লাগলেও
বাস ছাড়ার কোন লক্ষণ কিন্তু
চোখে পড়লো না।
আমাদের বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। চোপান কতদুর, কখন পৌঁছবে, সেখান থেকে ওবরা-ই বা কত দুর কিছুই জানা নেই। দুপুর শেষে, প্রায় বিকেলের দিকে একজন, আমার পিছনের কারো উদ্দেশ্যে হিন্দীতে প্রশ্ন করলেন, “কোথায় যাবে খুকী”? পিছন থেকে উত্তর আসলো “চোপান”। চোপান শুনে আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি, পিছনের লম্বা সীটটায় বসা একটা বছর বার-তের বয়সী মেয়ে উত্তরটা দিল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম এই ভেবে যে, এই মেয়েটি যেখানে নামবে, আমিও সেখানেই নামবো, কাজেই কোথায় নামতে হবে এই চিন্তা আর থাকলো না। মাঝেমাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মেয়েটি তার সীটে আছে কী না। এইভাবে সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, মেয়েটি বাস থেকে রাস্তায় নামছে। আমিও কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই বাসের সকলকে বিষ্মিত করে হঠাৎ ধরমর করে সীট ত্যাগ করে রাস্তায় নামলাম।
অন্ধকার আকাশে ভীষণ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছ। খুব হালকা দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আজই পৃথিবীর শেষ দিন। রাস্তার পাশে পরপর দু’টো দোকান। একটা হোটেল কাম মিষ্টির দোকান, অপরটা পান, বিড়ি, সিগারেট কাম স্টেশনারী কাম মুদিখানা দোকান। রাস্তার অপর পারে দরজা জানালাহীন একটা বিশাল বিল্ডিং, বোধহয় কোন গুদামঘর। কোল্ড-স্টোরেজ হলেও হতে পারে। অ্যাসবেসটসের ঢালু ছাদ, বিল্ডিং এর দেওয়াল ছাড়িয়ে এক ইঞ্চিও এক্সট্রা রাখা হয় নি। ফলে তার নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির জলের হাত থেকে বাঁচা তো যায়ই না, উল্টে ছাদ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, অনেক বেশী ভিজতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পরিবেশটা কিরকম থমথমে আকার ধারণ করে অল্প হলেও বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হ’ল, সঙ্গে মারাত্বক বিদ্যুৎ চমকানো ও বজ্রপাত।
গাড়ি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, হোটেল কাম মিষ্টির দোকান থেকে বা পাশের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আবার হুস করে চলে যাচ্ছে। একটা বাসকেও এখনও পর্যন্ত আসতে দেখলাম না। দোকানের লোকেরা কোন প্রশ্ন না করলেও, তাদের দৃষ্টি আমার ওপর ঘোরাফেরা করছে। আমার পোষাক, আমার অস্থিরতা, আমার চালচলনে তারা বুঝে ফেলেছে, যে আমি এই অঞ্চলে নতুন। আকাশের অবস্থা ভাল না হলেও বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে। ক্রমে রাত বাড়ছে। ফাঁকা মোটরগাড়ি কিছু যেতে দেখলেও এখন পর্যন্ত বাস কিন্তু বেপাত্তা। এবার শুরু হ’ল দোকান বন্ধের তোড়জোড়। কীআমি কী করা উচিৎ ভেবে না পেয়ে হোটেলটার ভিতর একটু ঢুকে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝেমাঝে এক-আধটা মোটর করবো ভেবে পাচ্ছি না। এই দোকানটায় রাজী হলে বন্ধ দোকানের ভিতর মাটিতে বসেও রাত কাটানো যেতে পারে। পাশের দোকানটায় সেই সুযোগও নেই। দোকান দু’টো বন্ধ হয়ে গেলে, অন্ধকার দুর্যোগপূর্ণ ভীষণ শীতের রাতে রাস্তায় একা রাত কাটানো ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা থাকবে না। যা করার এখনই করতে হবে। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবছি দোকানের লোকগুলোকে আমার বিপদের কথা বলে দোকানে রাতটা থাকতে দেবার অনুরোধ করবো কী না। যদিও জানি তাদের রাজী হবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। খিদেও যথেষ্ট পেয়েছে। সেই সকাল থেকে খানকতক পুরি পেটে পড়েছে। খুচরো টাকাও বিশেষ পকেটে নেই।
“বাঙালী বলে মনে হচ্ছে, কোথায় যাবেন”? পিছনে প্রায় ঘাড়ের কাছে কথাগুলো শুনে চমকে উঠে পিছনে তাকালাম। বছর সাতাশ-আঠাশ বয়সের একজন দাঁড়িয়ে আছেন। বাঙলা ভাষা যে এত মিষ্টি, এত আপন, এত মনোবল বর্ধক, আগে কোনদিন বুঝবার সুযোগ হয় নি। ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম অনিমেষ মজুমদার, রেলে চাকরী করি। সারাদিন অফিসের কাজে বাইরে বাইরে ঘুরে এখন বাসায় ফিরছি। আপনাকে দেখে মনে হ’ল বাঙালী, তাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কোথায় যাবেন”?
তাঁকে সকাল থেকে সমস্ত ঘটনা বলে বললাম, “এখন পর্যন্ত একটা বাসও চোখে পড়লো না। দু’চারটে মোটর গাড়ি দেখলেও দাঁড় করাবার চেষ্টা করে অবশ্য দেখি নি”। ভদ্রলোক বললেন মোটরে ওঠেন নি বেঁচে গেছেন। একটু পথ গিয়ে রাস্তাটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জায়গাটা খুব খারাপ। সবকিছু কেড়ে নিয়ে ওখানে আপনাকে নামিয়ে দিত, এ ঘটনা এখানে আখছার হয়। ওবরা যাবার বাস আসবে। আমি আপনাক বাসে তুলে দিয়েও যেতে পারি। কিন্তু এত রাতে আপনি ওখানে আপনার আত্মীয়র বাড়ি খুঁজে বার করে নিতে পারবেন তো”?
“হ্যাঁ পারবো”, এই দেড়খানা শব্দ কিন্তু জোর গলায় বলতে পারলাম না। অনেক যদি, কিন্তু, সামনে এসে ভিড় করলো। ওবরায় শুনেছি এশিয়ার বৃহত্তম থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট অবস্থিত। সামান্য ব্যান্ডেল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টে গিয়ে দেখেছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কত কোয়ার্টার্স, তাহলে এত রাতে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় নির্দিষ্ট কোয়ার্টার্স খুঁজে বার করা, বিশেষ করে এই দুর্যোগপূর্ণ ঠান্ডা রাতে, সম্ভব হবে তো? সমস্ত বাড়িতেই তো হিন্দীতে বাড়ির নাম্বার বা ঠিকানা লেখা থাকবে? ওবরা কত বড় জায়গা তাও জানা নেই, গোধুলিয়া থেকে ছাড়া বাস আর স্টেশনের কাছ থেকে ছাড়া বাস যদি শহরের দুই প্রান্তে এসে যাত্রা শেষ করে, তাহলে তো বাড়ি খোঁজা আরও সমস্যার হবে।
ভদ্রলোক বোধহয় আমার মনের কথা পাঠ করে ফেলেছেন। তিনি বললেন, “আপনার হাতে এখন দু’টো অপশন আছে। এক, আমি আপনাকে বাসে তুলে দিয়ে যাচ্ছি আপনি ওবরা চলে যান। আর দুই, আজ রাতটা আমার কাছে থেকে গিয়ে, কাল সকালে দিনের আলোয় ওবরা চলে যাওয়া। এখন ভেবে দেখুন কী করবেন, তবে যা ঠিক করার, একটু তাড়াতাড়ি করুণ। কারণ সারাদিন ঘুরে ঘুরে আমি খুব ক্লান্ত, এবার নিজের কোয়ার্টার্সে ফিরে একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন”। আমি এরকম পান্ডব বর্জিত এলাকায় রেললাইন-ই বা কোথায়, আর কোয়ার্টার্সই বা কোথায়, ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে রেললাইন আছে? আপনার কোয়ার্টার্সটা কত দুরে”? ভদ্রলোক বললেন, “এখানে রেল ইয়ার্ড আছে। আমার কোয়ার্টার্স সামনেই। আপনি কী ভয় পাচ্ছেন? তাহলে স্বচ্ছন্দে ওবরা চলে যেতে পারেন”।
আমি মনে মনে দ্রুত অঙ্ক কষে নিলাম। এই ভদ্রলোককে আমি চিনি না। আমার কাছে সামান্যই টাকা আছে। উনি জোর করে এই টাকা কেড়ে নিতে পারেন, কিন্তু এর জন্য খুনখারাপির কোন সম্ভাবনা নেই। কিছু হলে আজ রাতেই বা কাল সকালে চিৎকার করে লোক জড় করে ওঁর বাসস্থানটা অন্তত চিহ্নিত করতে পারবো। কিন্তু এই রাতে ওবরায় কিছু হলে, আমি কিছুই করতে পারবো না। অতএব এর কাছে থেকে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ও নিরাপদ হবে।
ভদ্রলোক আবার বললেন, “ভয় পাচ্ছেন? যা করার তাড়াতাড়ি করুণ, আমি খুব ক্লান্ত”। ব্যাপারটা “এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন, আদর ক’রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন” গোছের ভয়াবহ হলেও ঝুঁকি না নিয়ে আমার উপায় নেই। তাই বললাম, “ভয় পাব কেন? আপনার এখানেই থেকে যাব, কিন্তু কিছু খাওয়া দরকার, সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি”। ভদ্রলোক বললেন, “এই হোটেলেই খেয়ে নিন, দেখুন কী পাওয়া যায়”। আমি জানালাম যে আমার কাছে খুচরো টাকা বিশেষ নেই, একটা একশ’ টাকার নোট আছে। ভদ্রলোক বললেন, “আপনি খেয়ে নিন, আমি এখন দাম দিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালে বড় নোট ভাঙ্গিয়ে দেওয়া যাবে”।
দোকানে ঢুকে কী পাওয়া যাবে খোঁজ করে জানা গেল— ভাত, ডাল, সবজী, আর পিঁয়াজ পাওয়া যাবে। খুব ভাল চালের ভাত, অল্প ডাল, সামান্য ঝোলের মধ্যে গোটা গোটা, ছোট ছোট দু’টো আলু, আর মস্ত এক কাঁচা পেঁয়াজ। ভাতে ডাল মেখে চামচ দিয়ে একটা আলু কাটতে গেলে ছিটকে উড়ে গিয়ে মাটিতে আশ্রয় নিল। অগত্যা একটা ছোট্ট আলু আর সাধের মস্ত এক পেঁয়াজ দিয়ে ভাত খেয়ে, নিজের পকেট থেকেই দাম মিটিয়ে রাস্তায় এলাম। খুব ইচ্ছা করছিল পাশের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরাই, কিন্তু কিরকম একটা সঙ্কোচ বোধে কিনতে পারলাম না। ভদ্রলোকের সাথে এ গলি ও গলি ঘুরে তাঁর কোয়ার্টার্সে এসে উপস্থিত হলাম।
ছোট্ট কোয়ার্টার্স। দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে ছোট বাথরূম। তারপাশে রান্নাঘর। ডানপাশে একটা মাঝারি ঘর। ঘরে ঢুকেই ভদ্রলোক বললেন, “নিন্ ফ্রেস হয়ে নিন্। আমার কাছে একটা লেপ আর একটা কম্বল আছে, আপনি কোনটা নেবেন”? আমি বললাম, “আমার কোন ফ্যাশিনেশন নেই, যেটা হোক একটা হলেই চলবে। না হলেও কোন অসুবিধা নেই”। ভদ্রলোক বললেন, “এখানে ভীষণ ঠান্ডা। আমি রোজ দুটোই নি, আপনি বরং লেপটা নিন ঠান্ডা কম লাগবে। আমি ব্যাগ থেকে পায়জামা, গামছা নিয়ে বাথরূমে ঢুকলাম। আমার কাছে বেনরসী কেনার জন্য কয়েকটা একশ’ টাকার নোট ছিল। আমি ইচ্ছা করে একটা একশ’ টাকার নোট আছে বলেছিলাম। না বলে উপায়ও ছিল না। কেড়ে নিলে একটা নোটই কেড়ে নিক। এবার পায়জামার দড়ি পরানোর গর্তে অন্য নোটগুলো সরু করে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রেখে, পকেটে একটা মাত্র একশ’ টাকার নোট রেখে, হাত মুখ ধুয়ে, জামা প্যান্ট হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে, বিছানায় এসে লেপের তলায় ঢুকলাম। একটু পরেই আমার পাশে ভদ্রলোকের মৃদু নাসিকা গর্জন শুরু হলেও আমার চোখে ঘুম নেই। সত্যিই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন না আমায় বোকা বানাবার চেষ্টা করছেন, রাতে টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়ার জন্য আক্রমন করলে আত্মরক্ষার্থে আমার কী করা উচিৎ, ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
ঘুম ভাঙ্গলো চোখে সূর্যালোক পড়ায় ও গানের আওয়াজে। দেখি ভদ্রলোক কম্বল চাপা দিয়ে বসে ট্রানজিষ্টারে রেডিও সিলোন শুনছেন। আমার ঘুম ভাঙ্গা দেখে তিনি বললেন, “ঘুম ভাঙ্গলো? বাপরে কী ঘুম আপনার, নিন্ তৈরী হয়ে নিন্”। আমি লেপের তলা থেকেই পায়জামার দড়ির গর্তে চাপ দিয়ে দেখলাম, টাকাগুলো নির্দিষ্ট জায়গাতে ঠিক আছে।
বাথরূমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে, জামা প্যান্ট পরে তৈরী হয়ে তাঁর সাথে গতকালের দোকানটায় এসে পেট ভরে কচুরী আর জিলিপি খেয়ে, পকেট থেকে একশ’ টাকার নোটটা দিয়ে ভাঙ্গিয়ে দিতে বললাম। ভদ্রলোক দোকান থেকে নোটটা ভাঙ্গিয়ে দশটা দশ টাকার নোট দিয়ে বললেন, “আপনি আমার গেষ্ট হয়ে জলখাবারের দাম আপনি দেবেন? ছি ছি, আমায় আপনি কী ভাবছেন বলুন তো”? প্রতিটা দশ টাকার নোট ছেঁড়া ও খবরের কাগজের টুকরো দিয়ে জোড়া। উনি জানালেন, এখানে সব এই জাতীয় নোটই পাবেন। চিন্তা করবেন না, সব নোট চলে যাবে। ফেরার আগে খরচা করে ফেলবেন। দেখতে দেখতে বাস এসে গেল। তিনি আমায় বাসে তুলে দিয়ে হাত নাড়লেন। আমিও হাত নাড়লাম।
দাদার বিয়েতে তাঁকে নিমন্ত্রণ করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাঁর ঠিকানা জেনে না আসায় সম্ভব হয় নি। আজ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পরে তাঁর কথা লিখে তাঁকে আমার কৃতজ্ঞতা জানালাম।
(৩য় ও শেষ অংশ আগামী সংখ্যায় )