গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী


        

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট অথবা রামছাগলের আনন্দ

(দ্বিতীয় অংশ)

শহরতলিতে বাস করলেও ক্ষিতীশবাবুর দেশ মেদিনীপুরের এক অজ পাড়াগাঁয়ে। ছোটবেলায় দেখেছেন বাড়িতে অনেক গরু-বাছুর। তাঁর মা খুব যত্ন করতেন তাদের। তাঁর মনে পড়ে গেল, একটা মা-হারা বাছুর এমনই ন্যাওটা ছিল মায়ের যে শীতকালে সে তাঁর খাটের পাশে মেঝেতে শুত। মা যতক্ষণ না তাকে চটের বিছানাটি পেতে দিতেন, সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। স্মৃতিমেদুর ক্ষিতীশবাবু অন্য রকম চোখে ঊর্মিলার দিকে তাকালেন। ঊর্মিলা তাঁর পায়ের কাছে আর একটু সরে এসে গলার স্বর নিচু করে বলল, -- দিনদিন ছাগলটা খুব বদমাশ হয়ে যাচ্ছে মামা। যাকে তাকে যখন তখন ঢুঁ মারছেআমাকে অষ্টপহর কথা শুনতে হচ্ছে। আসলে কী জানো মামা, একা একা থাকে তো। একটা সঙ্গী পেলে দুজনে মিলেমিশে থাকতে পারে। ঢুঁ-মারামারি, খেলাধুলাসব নিজেদের মধ্যে করবে। তাই বলছিলাম কি মামা, পাইকারের কাছে একটা তিন মাসের বাচ্চা আছে, বিক্রি করবে। তিন হাজার চাইছে। আমরা গরিব মানুষ, অত টাকা কোথা পাই বলো! আমার বর বলছিল, মামার কাছে চাও নাঅতবড় ভালোমানুষ, সব শুনলে ঠিকই দেবে। মাসে মাসে পাঁচশো করে মাইনে থেকে কেটে নেবে। দেবে মামা?
ক্ষিতীশবাবু দেখলেন, ঊর্মিলার মুখ প্রত্যাশায় উজ্জ্বল। আহা রে! ছাগলটাকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসে বেচারা। সেটার কথাও ভাবা দরকার। একটা সঙ্গী পেলে ঢুসোঢুসি করে আনন্দে থাকবে। দু-দুটো প্রাণীদুটো কেন, ঊর্মিলাকে ধরলে তিন-তিনটে প্রাণীকে এতখানি আনন্দ দেওয়া যাবে মাত্র তিন হাজার টাকায়! কিচ্ছু নাক্ষিতীশবাবু ভাবলেন, কী আছে টাকায়? আনন্দের কাছে সবই তুচ্ছ! আর অন্যকে আনন্দ দিয়ে যা মেলে সে তো তুরীয়ানন্দ! তাছাড়া, টাকাটা তো শোধই দেবে বলছে। যদি না- দিতে পারে তাতেই বা কী?
ক্ষিতীশবাবু চুপিচুপি বললেন, -- তোর মামি কোথায়?
দুতলায়ঠাকুরঘরে।
ক্ষিতীশবাবু চুপচাপ উঠে গিয়ে টা কড়কড়ে পাঁচশটাকার নোট ঊর্মিলার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, - সাবধান, মামি যেন টের না পায়।
        টাকা নিয়ে যাওয়ার পর মাসখানেক সবে কেটেছে। ক্ষিতীশবাবু লক্ষ্য করেছেন, গতমাসে ঊর্মিলার কামাই-এর বহর বেড়েছে। মাসের মধ্যিখানে তো পাঁচদিনের জন্যে স্রেফ গায়েব হয়ে গেল। তিনি যখন ভাবছেন তাঁর টাকাটা মারই গেল, তখন দিনের মাথায় ঊর্মিলা মুখ শুকনো করে হাজির। তাকে আর তার বরকে নাকি ভাসুর আর দেওর মিলে এমন পিটিয়েছে যে বরকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। কালকে ছাড়া পেয়েছে বটে, তবে নাকি তার পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। ডাক্তার বলেছে বুকে বেল্ট বাঁধতে হবে। তার পাঁচশো টাকা দাম। কতদিন এখন কাজে যেতে পারবে না কে জানে।
কী হবে মামা আমার?
ক্ষিতীশবাবু বললেন, -- তা পেটাল কেন? কী করেছিলি?
কিচ্ছু না মামা। আমার ভাসুর আর দেওরটা যে কী শয়তান মামা, বললে বিশ্বাস যাবে না। শুধু হিংসে! আমার ছাগল দেখে হিংসেয় জ্বলছে। ওদের রান্নাঘরে ঢুকে নাকি রুটি খেয়ে নিয়েছে। সব
গিন্নি এইসময় বেরিয়ে এসে ঊর্মিলার গলায় রাশ টানলেন, -- পাঁচদিন পর কাজে এসে আর ঢং মারিস না তো। তোর গপ্পো শোনার সময় কারুর নেই। কাজ করতে হলে কর, নইলে বিদেয় দিন ওইটুকু কাজের জন্যে এর ওর পায়ে তেল দিতে দিতে আমার হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেল।
ঊর্মিলা মুখ ভার করে বাসন মাজতে চলে গেল। ক্ষিতীশবাবুও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন গিন্নি অবশেষে প্রবাদটিকে লাগসই করতে পেরেছেন দেখে। ঊর্মিলা সেদিন কাজ সেরে যাওয়ার সময় চুপিচুপি বলে গেল, -- মাসটায় আর টাকাটা কেটোনি মামা। বরের বেল্টটা না কিনলে কাজেই যেতে পারবে না।
        অগত্যা ক্ষিতীশবাবু গেল মাসে পুরো মাইনেটাই দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও মাসে আবার কামাই শুরু করল ঊর্মিলা! নাঃ, এরা দেখছি কাউকে আনন্দে থাকতে দেবে না। তবে অল্পে হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক ক্ষিতীশবাবু নন। তিনি বুক ঠুকে গিন্নিকে বললেন, -- তুমি বাসন মাজতে যাবে কোন দুঃখে! একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসো দিকি। টুসকি দিতে না দিতেই আমি সব মেজে ঝকঝকে করে দিচ্ছি। ভারী তো টা বাসন!
        ক্ষিতীশবাবু লিকুইড সাবান আর স্কচ ব্রাইট নিয়ে কলতলায় টুল পেতে জুত করে বসে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন গিন্নি। তার সাথে আনাজ কোটা ফেলে রেখে রান্নার মেয়ে করুণা। করুণা বলল, -- উঠুন কাকাবাবু, আপনি আবার বাসন মাজবেন কিআমি মেজে দিচ্ছি।
গিন্নি বললেন, -- তোমার কি ভীমরতি হল নাকি! ব্যাটাছেলে বাসন মাজবেছিঃ!
বলেই তিনি পিছন দিকের বাড়ির জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সে বাড়ির কর্ত্রী মজা-পাওয়া মুখে এদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন।
--দেখে ফেলল, যাঃবলেই একহাত জিভ বের করে গিন্নি ঘরে ঢুকে গেলেন। ক্ষিতীশবাবু সেটা টের পেয়ে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললেন, -- করুণা, তোমার নিজের কাজ করগে যাও। রান্নাটা যেন ভালো হয়। কাজের কোন ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে নেই, ছোট বড় নেই, কাজ হচ্ছে কাজ। তোমার কাকিমাকে বল, তিনি বরং কথাবার্তাগুলো ঠিকঠাক বলতে শিখুন। একষট্টি বছরের মানুষকে কেউ ব্যাটাছেলে বলে!
গিন্নি চুপ। করুণাও রান্নাঘরে চলে গেল। ক্ষিতীশবাবু প্রবল বিক্রমে বাসনে সাবান মাখাতে লাগলেন। এমন সময় ঘরের ভেতর ক্ষিতীশবাবুর মোবাইল বেজে উঠল। তিনি হাঁক দিলেন, -- কে দেখো তো।
গিন্নি মোবাইল হাতে দরজার কাছে এসে বললেন, -- নুর।
নুর মহম্মদ ক্ষিতীশবাবুর বন্ধু, একই সার্ভিসের লোক। দু-এক মাসের মধ্যে সে- রিটায়ার করবে। একটু পাগলাটে হলেও ভালো মানুষ। ক্ষিতীশবাবুর দু-হাত জোড়া। গিন্নিকে বললেন, -- কানে লাগাও।
গিন্নি বিনা বাক্যে আদেশ পালন করলেন। আলাপ শুরু হল দুই বন্ধুর
নুরঃ এত সময় লাগে কেন ফোন ধরতে?
ক্ষিতীশঃ কাজ করছি তো।  
নুরঃ রিটায়ার করেছ, এখন আবার কিসের কাজ?
ক্ষিতীশঃ (গলা ফুল ভল্যুমে চড়িয়ে যাতে প্রতিবেশীদের শুনতে অসুবিধে না হয়) বাসন মাজছি।
নুরঃ কী মারছ?
ক্ষিতীশঃ মারা নয়, মারা নয়মা-জা, বা-- মা--ছি।
নুরঃ বাঃ বাঃ! খাসা কাজ! হাঃ হাঃ হাঃ
ক্ষিতীশঃ হাসছ যে! মেজেছ কোনোদিন?
নুরঃ আকছার, আকছার। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি, মাস্টারমশাই রচনা লিখতে দিলেন, বড় হয়ে কী করতে চাও। লিখেছিলুম, মিষ্টির দোকানে বাসন মাজতে চাই। সেটা পড়ে মাস্টারমশাই কান মলে দিলেন। আমিও প্রতিজ্ঞা করলুম, এর শোধ একদিন তুলবই। তারপর বুজলে, একদিন মাস্টারমশাই আমাদের চড়ুইভাতি করতে নিয়ে গেছেন
ক্ষিতীশবাবু প্রমাদ গনলেন। পাগলটা গল্প করার সুযোগ পেলে জগৎসংসার ভুলে যায়। শুরু যখন করেছে শেষ কখন করবে বলা মুশকিল। গিন্নি এদিকে ধনুকটি হয়ে তাঁর কানে মোবাইল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর হাঁটু-কোমরের ক্যাচক্যাচানি মুখ দিয়ে বেরোল বলে! তিনি গিন্নিকে ইশারায় বললেন মোবাইলের সুইচ অফ করে দিতে। পরে এক সময় টাওয়ারের দোষ দিয়ে দিলেই হবে। যেমন বলা, অমনি কাজ। গিন্নি মোবাইল নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
        এদিকে ক্ষিতীশবাবু ক্রমশ টের পাচ্ছেন, বাসন মাজাটা যতটা সোজা কাজ ভেবেছিলেন ততটা নয়। দুটো থাক দেখে বসেছিলেন, কিন্তু সেগুলোর পেটে পেটে যে এত বুঝতে পারেননি। গামলার পেটে হাঁড়ি, হাঁড়ির পেটে বাটি, বাটির পেটে কাপ, কাপের পেটে চামচশেষই আর হয় না! পিঠ আর কোমরে টনটনানি শুরু হয়ে গেল। একটা কাচের গ্লাস সাবান-পিছল আঙুল থেকে সড়াৎ করে হড়কে গিয়ে দুহাত দূরে পড়ে খানখান হয়ে গেল। প্রতিবেশিনী মুচকি হেসে জানালা থেকে সরে গেলেন। গিন্নির দন্তঘর্ষণের আওয়াজ ক্ষিতীশবাবু পরিষ্কার শুনতে পেলেন। করুণা অবশ্যি ছুটে এল।  ভাঙা কাচের টুকরো ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে অভিমানী গলায় বলল, -- কাকাবাবুকে কত করে বললাম
ক্ষিতীশবাবু অবশ্যি তাতে কান দিলেন না। তিনি জেদি লোক, আরব্ধ কাজের শেষ না দেখে ছাড়েন না। তাতে মেজাজ বিগড়ক সে ভি আচ্ছা!
        অবশেষে ঘণ্টা দুয়েক পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে যখন কোমর-বাঁকানো অবস্থায় ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন, তখন বহু চেষ্টা করেও মনের ভেতরে সকালবেলার আনন্দটির ছিটেফোঁটাও খুঁজে পেলেন না। উলটে তাঁর রাগ হতে লাগল ঊর্মিলার ওপর। নেহাৎ তিনি খুবই রুচিবান মানুষ, মনে মনেও খুব একটা খারাপ কথা বলতে পারেন না। তবুবেইমানি কোথাকারমনে মনে উচ্চারণ করেও আবার থমকে গেলেন। ব্যাকরণে ভুল হয়ে গেল।বেইমানিতো বিশেষ্য। সুতরাং ঊর্মিলার বিশেষণ হিসেবে সেটা খাবে না।বেইমানশব্দের স্ত্রীলিঙ্গ কিবেইমানিহবে? না কিবেইমানিনী’? এমন শব্দ কি অভিধানে আছে? ক্ষিতীশবাবু সংশয়ে পড়ে গেলেন।হারামজাদিটা মনে মনে উচ্চারণ করতেই কেমন অশ্লীল অশ্লীল লাগল।
        হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, মুখে নয়, হাতে-কলমে ঊর্মিলাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। আজ বিকেলেই তার বাড়ি খুঁজে বের করবেন আর হিড়হিড় করে নতুন কেনা রামছাগলটাকে টানতে টানতে এনে কসাই-এর কাছে বিক্রি করে দেবেন। দাম যা দেয় দেবে, না- যদি দেয়সে ভি আচ্ছা!
        বিকেলে রাগ অনেকটা পড়ে গেলেও ক্ষিতীশবাবু তাঁর প্রতিজ্ঞা থেকে সরে এলেন না। তিনি তাঁর উচ্চপদসুলভ গাম্ভীর্যটি মুখে ঝুলিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ঊর্মিলা কোন বস্তিতে থাকে জানতেন। খুব বেশি দূরেও নয়। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল, ঊর্মিলা তো ওর আসল নাম নয়। শূর্পণখা বলেছিল প্রথম দিন। সেটাও আসল কিনা কে জানে! তিনি দ্বিধায় পড়লেন। তাতেই তার গাম্ভীর্য অনেকটা খসে পড়ল। তবু তিনি হাল না ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে বস্তিতে পৌঁছে গেলেন। ঢোকার মুখেই একটা বুড়োকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, -- শূর্পণখার বাড়ি কোনটা জানেন?
বুড়োটা কপাল কুঁচকে খানিক চিন্তা করল। তারপর বলল, -- নামে তো কেউ এখেনে থাকে না।
ক্ষিতীশবাবু বললেন, -- ঠিক করে মনে করুন তো দেখি, দিন আগে ওদের বাড়িতে ভায়ে ভায়ে জোর মারপিট হয়েছিল।
এবার লোকটি বেশ সংশয়ের দৃষ্টিতে ক্ষিতীশবাবুর দিকে তাকাল। তারপর বলল, -- কোথা থেকে আসছেন বলুন তো বাবু? কী দরকারে? এই বস্তির সক্কলকে আমি চিনি। এখেনে কোন বাড়িতেই ভায়ে ভায়ে মারপিট হয়নি।
ক্ষিতীশবাবু ভীষণ দমে গেলেন। লোকটির শেষ বাক্যের সুরটিও তাঁর বিশেষ ভালো ঠেকল না। সর্বত্র আজকাল পলিটিক্যাল পার্টির কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। শেষটায় তাঁকেই না ফ্যাসাদে ফেলে দেয়। তিনি প্রতিজ্ঞা ভুলে ফিরে যাবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় রামছাগলই তাঁকে বাঁচাল। তিনি খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে বললেন, -- দুটো রামছাগল আছে ওর বাড়িতে।
বুড়োর মুখ এবার একটু সরল হল। বলল, -- সুপির কথা বলছেন কি? এখেনে ওরই একমাত্র রামছাগল আছে। কিন্তু দুটো নয়, একটা।
হাতে স্বর্গ পেলেন ক্ষিতীশবাবু। ভাবলেন, দ্বিতীয়টা তো মাত্রই দিন আগে কিনেছে। লোকটা সেটার কথা তাই জানে না। বললেন, -- হ্যাঁ হ্যাঁ, সুপিই হবে। শূর্পণখা থেকেই তো সুপি হয়।
        ক্ষিতীশবাবুকে আচমকা নিজের দুয়ারে দেখেই প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল ঊর্মিলা। তারপর একগাল হেসে কলকলিয়ে উঠল, -- মামা তুমি! আমাদের সাতপুরুষ আজ উদ্ধার হয়ে গেল মামা তোমার পায়ের ধুলায়
ছিটেবেড়ার ওপর মাটি লেপা, খাপরার চালের এক কামরা ঘর, সামনে এক চিলতে বারান্দা আর খানিকটা উঠোন বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ঊর্মিলা সাত তাড়াতাড়ি একটা নড়বড়ে স্টিলের চেয়ার ঘর থেকে বের করে এনে সেটা ঝেড়েঝুড়ে উঠোনে পেতে দিয়ে বলল, -- ঘরের যা অবস্থা আমাদের, এখেনেই বসো মামা।
ক্ষিতীশবাবু না বসে গম্ভীর স্বরে বললেন, -- আজ কাজে যাসনি যে বড়? তোর বর কোথায়? তার না বুকের হাড় ভেঙেছে! তোর ভাসুর-দেওরতারা সব কোথায়?
বলছি মামা, সবই বলছি। আগে একটু বসো দিকি শান্ত হয়ে। এতখানি হেঁটে এসে ঘেমে গেছ মামা। আমাদের তো ইলেকটিরি নাই। একটু হাওয়া করি তোমাকে।
বলেই সে ঘরের ভেতর থেকে একটা তালপাতার হাতপাখা নিয়ে এসে তাঁকে হাওয়া করতে শুরু করে দিল। কী আর করেন ক্ষিতীশবাবু, বসলেন চেয়ারে। ঊর্মিলা তার ডান আর বাঁ দিকের একই রকম দুটো ঘর দেখিয়ে বলল, -- এইটা দেওরের বাড়ি আর ওইটা ভাসুরের। সব ধান্দায় বেরিয়েছে। ফিরতে ফিরতে রাত। আমার বর আজকেই পরথম বেল্ট পড়ে কাজে গেছে মামা। মাস্টার বলেছে হালকা কাজ দেবে।
মাস্টারটা আবার কে?
তা- জানো না মামা! হেড মিস্তিরি গো, যে কন্টাক নেয়।
তা বেশ। -- ক্ষিতীশবাবু গলায় গাম্ভীর্য বজায় রাখলেন। -- তা আজ কাজে যাসনি কেন?
আর বলোনি মামা! সকালে উঠেই পেটের যন্তন্নায় কাটা ছাগলের মত ছটফট করেছি। ওষুদ খেয়ে তবে দুপুরের দিকে একটু কমল। ওরকম যন্তন্না আমার সময়ে সময়ে হয়। তোমাকে কেমন করে বলি মামা, মামি জানে।
ক্ষিতীশবাবুর কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। ঢোকার সময় ভেবেছিলেন কামাই করার মিথ্যে অজুহাত সব ধরা পড়ে গেছে ঊর্মিলার। ক্রমে মনে হচ্ছে, মিথ্যে না- হতে পারে। এই সময়েই ছুটতে ছুটতে ঊর্মিলার মেয়েটা ঢুকল উঠোনে, আর তার পেছন পেছন তাকে তাড়া করে এক রামছাগল। ঊর্মিলা ঝটিতি পাখা ফেলে দিয়ে ছাগলটাকে ধরতে ধরতে বলল, -- দেখেছ মামা! কী বলেছিলাম তোমাকে, কেমন শয়তান হয়েছে ছাগলটা! মেয়েটাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। সুযোগ পেলেই তাড়া করে এসে ঢুঁ মারবে।
ক্ষিতীশবাবু দেখলেন, সত্যিই তো, বিশাল ছাগল। প্রায় তাঁর কোমর সমান উঁচু হবে তিনি বললেন, -- তোর দুনম্বরটা কোথায়? আমার কাছে টাকা নিয়ে যেটা কিনলি?
ঊর্মিলা বলল, -- সে এক কাণ্ড মামা! কী আর বলব। তোমাকে লজ্জায় বলতে পারিনি। কী যে বেহায়া আমার এই ছাগলটা! যেদিন তুমি টাকাটা দিলেআহা, কড়কড়ে নতুন সেই টা নোট! আমি বাড়ি ফিরে বারান্দায় বসে আঁচলের খুঁট খুলে বের করে যেই না হাতে নিয়েছি মামা, অমনি উঠোন থেকে ছুটে এসে খপ করে মুখে নিয়েই চিবোতে শুরু করে দিয়েছে শয়তানটা। সে কি দৃশ্য মামা! নতুন নোটের সোয়াদটা মনে হয় বিন্দাস, বুজলে মামা, শয়তানটা চোখ বুজে চিবোচ্ছে আর কষ বেয়ে ফেনা গড়াচ্ছে। আমি কেড়ে নেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়েই থেমে গেলাম। নোটগুলো তো গেছেই, বেচারা এমন মহানন্দে খাচ্ছেআনন্দই তো জীবনের আসল জিনিস, ঠিক না মামা? ঠিক করিনি?
        ঊর্মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষিতীশবাবুর মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগল। কথাগুলো কে বলছে? ঊর্মিলা, না তিনি নিজেই?