গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী


পাকাদেখা
ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

আমাদের এপার্টমেন্টের থার্ড ফ্লোরে থাকেন এক ভদ্রলোক । নাম প্রতাপ সিংহ রায় । বেশ কিছুদিন আমাদের এপার্টমেন্টে এসেছেন । চেনা সোনা বলতে সোসাইটি মিটিং আর ক্লাবে তাস খেলা । আমার সঙ্গে বাজারে দেখা । দেখেই বলেন ,“অনেকদিন হল একটা কথা মাথায় চাড়া দিচ্ছে। কি করি ভেবে পাচ্ছিনা ! আমার একটাই ছেলে । ইনফোসিস বেঙ্গালুরুতে সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার । বিয়ের বয়েস হয়নি তাও চিন্তা ! বিয়ে দেব কি, যা বিয়ের বাজার !! কি করি বলুন তো !
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে-গেলেন ভদ্রলোক। অপ্রত্যাশিত কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম । আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের সেরকম হৃদ্যতা নেই । হঠাৎ ছেলের বিয়ের ব্যাপারে আমাকে কেন এ সব বলা বুঝলাম না । তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললাম, হ্যাঁ ছেলে মেয়েদের মানুষ করা তারপর যোগ্য পাত্র পাত্রী র সঙ্গে বিয়ে দেওয়া...। 
আমার কথা শেষ না হতেই ঝাঁজিয়ে উঠলেন, “রাখুন ত যোগ্য পাত্রী ! যা দুনিয়ার অবস্থা, পাত্রী ই পাওয়া যায়না তা যোগ্য পাত্রী !! ভাল মেয়ে, ভদ্র ঘরের মেয়ে , দেখতে শুনতে ভালো, ভাল চাকরী করে সেরকম মেয়ে পাচ্ছি কই ? যোগ্য পাত্রী বলতে আর কি বোঝায় বুঝলাম না ! তবুও বলি, দেখুন এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা একটু কম । আপনি বরং বেঙ্গলী মেট্রিমনিতেআপনার ছেলের একটা বায়োডেটা দিয়ে প্রোফাইল খুলুন , ওরাই যোগাড় করে-দেবে পাত্রী । এই বলে পাশ কাটিয়ে যাই । 
পরের সপ্তাহে আবার দেখা । আমি দূর থেকে ভদ্রলোককে দেখে মাছ কেনার ভান করি । ওমা ! ঠিক আমার কাছে এসে হাজির !! মাছ ওয়ালাকে জিগ্যেস করছি ইলিশ কত করে ? মাছওয়ালা বালা বলে বারোশ টাকা কিলো  সে কি, এত দাম ? পদ্মার ইলিশ বাবু । খেলে আবার আসবেন । বাজি রাখছি । সত্যি পদ্মার কিনা জানিনা তবে কানকোর কাছটা লাল আছে । হয়তো তাই !
পাশে দেখি প্রতাপ বাবু হাজির। আমায় দেখে বলেন, “দিয়ে দিয়েছি’ ! কি ? কি দিয়ে দিয়েছেন ? ঐযে আপনি বলেছিলেন, “বেঙ্গলী মেট্রিমনি” ! ওটার সঙ্গে আনন্দবাজারে "পাত্র পাত্রী" কলমের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছি । মনেহয় এবারে আমার চিন্তা গেল। ও তাই ! তা ভাল । 
রবিবার অফিস নেই খোশ মেজাজে কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছি, হটাত কলিং বেল বেজে ওঠে । দরজা খুলে দেখি স্বয়ং প্রতাপ বাবু । গুড মর্নিং । কেমন আছেন দেখতে এলাম । বিরক্ত করছি না তো ? সুপ্রভাত । ওমা সেকি ? আসুন আসুন । আপনার পদ ধূলি আমার দ্বারে পড়লো আমার পরম সৌভাগ্য । আসুন আপনার দৌলতে আরেক কাপ চা খাওয়া যাবে । গিন্নীকে বলি চা বানাতে । চা আসে । দুজনে চা খেতে খেতে প্রতাপ বাবু বলেন, আজকে প্রায় ১০০ টা ফোন কল পেয়েছি । আমার এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলে ভাল মনে হল । তাঁর মেয়ে দিল্লীতে পোষ্টেড । ভালো এক কোম্পানিতে । আপনার মতা মত নিতে এলাম । আমি ! আমি কি মতামত দেব বলুন ? আমি ওসব কিছুই বুঝিনা !! উহু তা বললে চলবে না । আপনার কথার দাম আছে মশাই । শুনুন , মেয়েটি ভাল চাকরী করে , আমার ছেলের চেয়ে তিন বছরের ছোট বাবা ভাল কোম্পানির ডাইরেক্টর, মা শিক্ষয়িত্রী । পাত্রী দেখতে যাব আগামী রবিবার আপনাকে যেতেই হবে আমার সঙ্গে । কথাগুলো গড় গড় করে বলে এক গ্লাস জল খেলেন । আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লাম ! আপনি কেন বুঝছেন না আমি ওসব কিছুই বুঝি না। বিয়ের ব্যাপারে আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে যান আমি যেতে পারবোনা । মাফ করবেন এই জোড়হস্তে বলছি আপনাকে । আমিও আপনাকে জোড় হস্তে অনুরোধ করি আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আপনাকে আমি কিছুতেই না নিয়ে ছাড়বনা । আমি আপনার দাদার মতন । আমার কেউ নেই বলেই আপনাকে অনুরোধ করছি । না বলবেন না প্লিজ । এটা আমার বিনীত অনুরোধ । আমি বলি, পরে ভেবে বলব । আজ কথা দিতে পারছিনা । ক্ষমা করবেন হাত জোড় করে বলি । ভদ্রলোক বলেন , ঠিক আছে যা ভাল বোঝেন । আজ তবে উঠি । বলে দরজার দিকে পা বাড়ান । আমি বুঝি ভদ্রলোক মনক্ষুন্ন হলেন তবে আমার করার কিছুই নেই। আমি বলি , পরে ভেবে বলব । আজ কথা দিতে পারছিনা । ক্ষমা করবেন হাত জোড় করে বলি । ভদ্রলোক বলেন , ঠিক আছে যা ভাল বোঝেন । আজ তবে উঠি । বলে দরজার দিকে পা বাড়ান । আমি বুঝি ভদ্রলোক মন ক্ষুণ্ণ হলেন তবে আমার করার কিছুই নেই।

মাস খানেক পর প্রতাপ বাবু সপত্নীক আমাদের ফ্ল্যাটে আসেন । হাতে একটা সুন্দর বিয়ের কার্ড । হাত জোড় করে বলেন : আপনি আমাদের সঙ্গে গেলে ভালো হত । মনে-হল ওইখানেই আমার ছেলের বিয়ে দিলে ভাল হবে । কোন দাবি দাওয়া রাখিনিরাখবোই বা কেন ! বৌমা ত আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী । পণ চেয়ে ছোট হব কেন বলুন ? "আমার বৌমা তো নিজেই এটিএম মেশিন, পণের কি হবে ?" বলে হ্যা হ্যা করে হাঁসেন । আমি ভদ্রলোকের মুখের পানে হাঁ করে তাকাই আর ভাবি ,"ভাগ্যিস ভদ্রলোকের সঙ্গে যাইনি" ।