গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সকাল রায়


কখন সকাল হবে


.

সন্ধ্যেটা সবে আসতে শুরু করেছে; আবছা হচ্ছে আলোটাসূর্য এখন অনেকটা সময় নিয়ে আকাশটাকে মাতিয়ে রাখে; তাই সন্ধ্যেটা আসতে দেরি হয়আর সন্ধ্যেটা পা ফেলতেই ঝুপঝাপ আঁধার নামতে শুরু করেআঁধার নামতে যখন শুরু হয় তখন আবার পাশের নালাটায় ডাক শোনা যায় ঝি ঝি পোকারএকটানা ঝি পোকার শব্দে কান মাতায়সেই সাথে ডোবার ধারে করাত করাত করে ডেকে উঠে ব্যাঙআজ জোনাক গুলোও বড্ড ছন্নছাড়া হয়ে আছে; পাঁচ-দশটি এক জায়গাতে থাকেই না; বড়োজোর দুচারটেকে দেখা যায় এদিক-ওদিক উড়ছেকেন ওরা এমন তা ভাবতে বসে আছে জয়িতাসন্ধ্যের প্রদীপটা এখনো জ্বলেনি সে; আলসেমিটা পেয়ে বসেছে আজ আবার; মা বকুনি নির্ঘাতমেয়েটা যে বড় হয়েছে মায়ের সে খেয়াল থাকেই না; সেই ছোট্টটি কি আর আছে কাল বাদে পরশু যে তার  বিয়ে; তাকে কি বকুনি দেয়া যায়? সন্ধ্যে ছেড়ে কিছুতেই মনটা তার উঠতে চায়না আরেকটু বসে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু সে জো নেই এখুনি সন্ধ্যা ফুরোলো বলে ভাবনার তেপান্তর থেকে মনটাকে টেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় জয়িতাসন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালতে হবে; বাবা চলে এলো বলে; সন্ধ্যে মরে যাচ্ছে কিন্তু প্রদীপ জ্বলেনি দেখলে বাবা রাগ করবে


ধ্রুব গেছে শাড়ী, গয়না, আর টোপর কিনতেকালকের পরদিন সাতাশ তারিখ জয়িতার বিয়েএকটা মাত্র বোনতাকে রাজ রানীর মতো সাজিয়ে বিয়ে দেবেসুখ কষ্ট যাই হোক বাবার ঘরে; কিন্তু স্বামীর ঘরটা যেন দুঃখের না হয় যেন  কষ্টটা ওকে আঁকড়ে ধরতে না পারে কখনোএকটা ভালো পাত্রের সন্ধানে কেটে গেছে তিনশত পয়ষট্টি দিনচাট্টি খানি কথাভালো না হলে চলেসে রাতে ঘরে ফিরে ধ্রুব বলে বাইরের পরিবেশটা বেশ থমথমে; দেখেছিস জয়িতা ? জয়িতা বলে শুধু কি তাই আজ এই রাতেও কাক ডাকছে বিষাদ স্বরে খুব খারাপ লাগছে রে বুঝতে পারছিনা!! না জানি কোন বিপদ আসছে ধেয়ে কে জানেবিষণ্নতায় মনটা ভরে গেলেও মুখে সেটা ফোটাতে পারেনা; ভয় হয় ধ্রুব যদি পাছে জয়িতার মনে জাগে সংশয়না তেমন কিছু না এটা; চাপা হাসিতে বলে ধ্রুবজয়িতা বলে দাদা বিয়েটা শেষ হলেই চল আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাবো ? এখানে শান্তি নেইপাশ বালিশটা টেনে সোফায় বসতে বসতে ধ্র বলে নাহ্ এটা আমার জন্মভূমি আমি ছাড়তে পারবো না সোদা মাটির গন্ধ এই প্রকৃতি আমাকে ছাড়বে না;
তাছাড়া আমি ভালবাসি দেশকে একদিন দেশের এই হাল থাকবে না আমরা সেদিন সাজাবো নতুন করে; ভরে দেব আলোয় আলোয়জানিস এই প্রকৃতি এই হাওয়া আমাকে শক্তি দেয়পথ চলার প্রেরণা পাই মানুষের ভালোবাসা থেকেআমি ছাড়তে পারবো নাজয়িতা বলে তাই বলে এভাবে কি থাকা যায়!! না জানি কবে মারা পড়বোসোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে ধ্রুব বলে যাই হোক আমি আছি থাকবোবিয়ের পর তোর বরের সাথে ঘুড়বোজয়িতা হেসে বলে তাই নাকি; দাদা আমার একটা পুচকো থাকবে যেটা তোকে জ্বালাবে ভীষণজয়িতার মা মেয়েকে বলে তারা তারি তোর বিয়েটা হয়ে গেলেই বাঁচি; দেশে যা শুরু হয়েছে কি যে হয় কে, জানেআজকাল দিনগুলো ভালো যাচ্ছেনা সারাদেশ জুড়ে কিসের যেন পায়তাঁরা চলছে
.

শব্দটা দেয়ালটাকে কাঁপাচ্ছেআধবোজা চোখ মেলে তাকাতেই জয়িতা শব্দের তরঙ্গে কেঁপে উঠে
চারদিকে শুধু শব্দ আর শব্দমনে হচ্ছে সারা শহরে একনাগারে কেউ আতশ ফোটাচ্ছেসেই সাথে মিশেছে আর্ত হাহাকারজয়িতা উঠে বসে জানালার ধারে তাকায় সামনের দিকে শুধু দেখা যায় আগুনের মেলা বসেছে পুরো মহল্লায়সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আগুনের কোন গোলা এসে পড়েছে শহরেধোয়া উঠছে থেকে থেকেকি হচ্ছে এসব কে যেন সারা শহরকে নরক পুরি করে তোলেছে এরই মাঝেদরজা খুলে বাইরে আসেপুরো শহর যেন জ্বলছেযেন আগুন তার রাজত্ব পেয়েছে আজ সব পুরিয়ে করবে ছাড়খারগেটে এসে দাড়ালো জয়িতাধ্রুব দাড়িয়ে আছে    মাকে নিয়েধ্রুব বললো তুই আবার এসেছিস কেন যা ঘরে কিন্তু জয়িতা সেখানেই দাড়িয়ে আছে স্নায়ুবত হয়েপাশের মহল্লায় আগুন পড়েছেবুলেটের আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছেনাবুকের ভেতরে ঢিব ঢিব শব্দটা একটানা হাতুরি পেটাচ্ছেকালকের পরদিন বিয়ে জয়িতারকিন্তু অর্তকিত এই নরপিশাচদের হামলায় কি টিকে থাকা যাবেবিয়েটা বুঝি গেল !! জয়িতা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে দাদা ওরা যদি এদিকে আসে ? না আসবে না অভয় দেয় ধ্রুবদাদা আমার ভয় করছে !! তোকে আমাকে সবাইকে মেরে ফেলবে না' তো ? আবারো অভয় দেয় ধ্রুবনরপিশাচেরা শব্দ শকট হাতে নিয়ে এদিকে আসছে ধীরে ধীরেধ্রুব ভাবে বাড়ি ছেড়ে যে পালাবে সে উপায়টুকু তো নেইযে হারে বৃষ্টির মতো বুলেট ফুটছে; নির্ঘাত কোন বুলেট এসে বিঁধবে বন্ধুর মতোন এই বুকেওদিকে জয়িতার মা বিলাপ শুরু করে দিয়েছেঈশ্বর যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও ? বিপদ না  পড়লে আমাদের ভগবানকে ডাকার তেমন একটা ইচ্ছে মনে জাগে না আজ তাই এই ঘোর বিপদে তাকেই ভীষণ ভাবে প্রয়োজনগেটের পাশটায় জোড়ায় জোড়ায় বুটের আওয়াজ কারা যেন আসছে



টেনে হিচরে নিয়ে যাচ্ছে জয়িতাকে নরপিশাচ গুলোবাধাঁ দেবার কেউ নেইছোপ ছোপ রক্তে আঙ্গিনা রাঙানোএই মহল্লার কেউ মনে বাচঁতে পারবেনা আজ এই রাতে; সে সংকল্পে নেমেছে ওরাদাদা ওরা আমাকে নিয়ে গেলো ওদের ফেরা ? আকুতিটা খুব করুন ভাবে দেয়াল গুলোকেও কাঁপাচ্ছেউপর থেকে কি সুন্দর কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছেন তিনি দেখছেন কিভাবে অসহায় হয়ে পড়ে থাকে তার সৃষ্টিরাজয়িতার চিৎকারটা বাড়ছে ক্রমশই; কিন্তু ধ্রুব সেটা শুনতে পাচ্ছেনা; বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেছে বুলেট সোদা মাটির গন্ধে পাগল ছেলেটা পড়ে আছে; সেঘরের ভেতর লাশ হয়ে পড়ে আছে জয়িতার বাবা আর মা; ওরা বাচঁতে চায় নি; শুধু বলেছিলো আমাদের মেরে ফেলো কিন্তু আমাদের প্রিয় সন্তানদের মেরো নাকিন্তু ওরা শুনবে কেন সে কথা; ওরা আজ নরপিশাচ হয়ে এসেছেযেমন সারি বেধে ওরা এসেছিলো, তেমনি চলে গেল লাশ ডিঙ্গিয়ে সাথে নিয়ে গেল জয়িতাকেজয়িতার লালপেড়ে শাড়ি পরে কপালে সিঁদূর দিয়ে হাতে শাখা ভরে আর বধূ হওয়া হলোনাহলোনা পূরণ স্বামীর সোহাগ কিংবা মা ডাক শোনার অদম্য ইচ্ছেটা রাতে শুধু রক্তে ভরে উঠেছে রাজপথ আর আঙ্গিনানরপিশাচরা সেই রক্তে পা ফেলে প্রান নিধন করেই চলেছে ভয়ঙ্কর রাতটা কিছুতেই ফুরাচ্ছে নারাত যতো বাড়ছে বাতাসে বাড়ছে বারুদের গন্ধ; আর রক্তে রক্তে ঢেকে যাচ্ছে শত শত প্রাণের স্বপ্নরারাতটা যেমন করে শুরু হয়েছিলো তেমন করে শেষ হচ্ছেনাজোনাকিরা নেই এখন আরনালার পাশের ব্যাঙ গুলো আর ডাকছে না থমকে আছে ওরা রাতে কাক আর ডাকবার সুযোগ পায়নি ভয়ে চলে গেছে দুরে কোথাওঘরে পড়ে আছে টোপর আর লাল শাড়ি আর সব তছনছ করে দিয়ে গেছে নরপিশাচেরা কি ভেবে যেন আগুন জ্বালেনি বাড়িতে চারপাশটা কাঁপছে হয়ত সকাল না হলে আরথামবেনারাতটা শেষ হচ্ছেনা সূর্যটা বসে আছে রক্তে আঁকা সকাল দেখবে বলে; কখন সকাল হবে ?